ঢাকা ০৮:৪৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে চার কারণে ‘এনআর’কে ভোট দেয় ফরাসিরা

ফ্রান্সে রোববার অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনের প্রথম দফায় ৩৩ শতাংশ ভোট নিয়ে এগিয়ে আছে ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালি (এনআর)।

২৮ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফ্রান্সের বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ)। এদিকে ২১ শতাংশের কাছাকাছি ভোট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দল। এখন সংসদের নিয়ন্ত্রণ যাতে ডানপন্থীদের হাতে চলে না যায়, তাই ফ্রান্সের মধ্যপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।

কিন্তু ফরাসিদের মেরিন লে পেন ও জর্ডান বারডেলা’র নেতৃত্বাধীন দল ‘এনআর’কে নির্বাচনের প্রথম দফায় জিতিয়ে দেয়ার মতো এত ভোট দেয়ার কারণ কী? ফ্রান্সের প্রবীণ ভাষ্যকার অ্যালাইন ডুহামেল বলেছেন, এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

অভ্যন্তরীণ কারণ ও অর্থনৈতিক অবস্থা
ভোট দেয়ার আগে যেসব বিষয় ভোটাররা বিবেচনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত সঙ্কট, যা তাদের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন ফরাসিরা, যেটিকে তারা ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বলে উল্লেখ করছে।

যদিও সামগ্রিকভাবে ফ্রান্সের অর্থনীতি ভালো। কিন্তু প্রধান শহর থেকে দূরে বসবাস করা মানুষ বিবিসিকে বলেন, তারা উপেক্ষিত অনুভব করেছেন। কারণ সকল তহবিল ও মনোযোগ শুধুমাত্র শহরগুলোকে ঘিরে।

ফ্রান্সের কোনো কোনো জায়গায় বেকারত্বের হার অনেক বেশি। এটি ২৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশটির অনেকের জন্য আবাসন ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বরাদ্দ সঙ্কুচিত করার কারণে কোনো কোনো এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং স্থানীয় স্বাস্থসেবা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বিরক্ত।

অধ্যাপক থমাস পিকেটি বলেন, উপেক্ষিতরাই ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকছে।

সর্বাধিক বিক্রীত ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক পিকেটি চিহ্নিত করেছেন, ‘ছোট শহরগুলোর শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পরিষেবা পেতে জনসাধারণকে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে; ট্রেন লাইনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরগুলো থেকে দূরে থাকলে আপনার শিশুদের শিক্ষিত করা কঠিন।’

৩৭ বছর বয়সী পরিচ্ছন্নকর্মী অরেলি দুই সন্তানের মা, যিনি উত্তর ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে থাকেন। তিনি বলেন, এনআর-এর নীতি’র সাথে তিনি একমত ‘নিরাপত্তার’ কারণে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য বের হই। এক সময় আমি অ্যামিয়েন্সের রাস্তায় সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে পারতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন আমাকে গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। কারণ এসব রাস্তাজুড়ে সবসময় যুবকরা ঘোরাফেরা করে এবং আমি এই বিষয়টি নিয়ে ভয় পাই।’

প্যারিসের পূর্ব দিকের শহর পন্টাল্ট-কম্বল্ট শহরের প্যাট্রিক এনআর-কে ভোট দিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘মানুষ এখন পরিবর্তন চায়, সেজন্য তারা ভোট দিতে আগ্রহী। তারা যখন রাস্তাঘাটে অনিরাপদ বোধ করে, তখন তারা খুশি হয় না। এছাড়া পেনশন নিয়ে ভোটাররা চিন্তিত। কারণ গতবছর ম্যাক্রোঁ আইন পাশ করে পেনশনের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত করেন। ম্যাক্রোঁ সরকারের অজনপ্রিয় সংস্কারগুলোর মাঝে এটি ছিল অন্যতম। কিন্তু ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন যে পেনশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ঠেকাতে এই সংস্কার অপরিহার্য ছিল।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও ঘর গরম করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসও ভোটারদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা বলেন, তারা জ্বালানি ও ১০০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট কর্তনের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। শুধু তাই নয়, তারা কয়েক মাসের মাঝে পেনশন ব্যবস্থাও সংস্কার করবেন।

বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ
ভোটাররা প্রায়ই বলছেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ কারছে না। তারা মনে করছেন, এনআর সরকারে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়নি। বিশ্রাম নেয়ার মতো সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসাটাও ভালো মনে করছেন তারা।

এনআর সমর্থক ৬৪ বছর বয়সী জেন-ক্লড গ্যালেট বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট। কারণ আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন।’

আরেক এনআর সমর্থক ৮০ বছর বয়সী মার্গারিট বলেন, ‘তারা (ন্যাশনাল র‍্যালি) উঠে আসতে পেরেছে। কারণ জনগণ বিরক্ত। তাই জনগণ এখন বলছে যে ‘উই ডোন্ট কেয়ার। আসুন ভোট দেই। দেখি কী হয়। তবে আমি যা নিয়ে ভয়ে আছি, তা হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এখানে বাধা সৃষ্টি করবে। আমরা ভোট দিয়েছি। এই হলো তার ফলাফল। আমাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে এবং দেখতে হবে যে কী ঘটে।’

কিন্তু ওয়েনিজ শহরের ইয়ামিনা আদ্দোউ বলেন, তিনি এনআর-এর সাফল্যে হতবাক। তিনি বলেন যে ডানপন্থীদের সমর্থন করার জন্য ভোটারদেরকে প্রভাবিত করা হয়েছে এবং তাদের এই সিদ্ধান্ত ফরাসি সমাজকে গুরুতর ও বিপজ্জনক বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্যই এটি আমায় ধাক্কা দিয়েছে। এটি খুব দুঃখজনক বলে আমি মনে করি। কী ঘটছে, মানুষ তা বুঝতে পারছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তারা শুধুমাত্র ক্রয় ক্ষমতা এবং স্বল্পমেয়াদী ও দৃশ্যমান অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে। কিন্তু এর পেছনে অনেক ভাবনা ও কৌশল আছে, যা আমাদেরকে একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধের দিকে পরিচালনা করবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে এই যুদ্ধ হবে আরো অনেক বেশি সূক্ষ্ম। মানুষ বুঝতে পারছে না যে আমরা একটি গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলব। আমি এমনটাই ভাবি। এতে আমাদের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’

অনেকেই বলেন যে ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও চলমান সঙ্কটের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ দায়ী।

ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্যারিস ব্যুরো চিফ সোফি পেডার বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদেরকে একত্রিত করার জন্য একটি সম্মতিমূলক আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। সংসদ ও দু’পক্ষের মাঝে চলমান বিরামহীন কলহ থামাতে এটি কাজও করেছিল। কিন্তু ফলাফল হলো, কেবল বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা ম্যাক্রোঁর দলে যোগ দিয়েছে। শুধু যোগ দেয়নি কট্টরপন্থীরা।’

অভিবাসী ও ভয়
বহু বছর ধরে ন্যাশনাল র‍্যালি’র নেতা মেরিন লে পেন তার দলকে মূলধারায় আনতে ও ভোটারদের কাছে দলকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কাজ করছেন।

শুরুর দিকে এই দলের নাম ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার পিতা জ্যোঁ-ম্যারি লে পেন। তার বাবা ও দলের বাকি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ইহুদিবিরোধী এবং চরমপন্থী অবস্থানকে মুছে দিতে তিনি কাজ করেছেন। এমনকি তিনি দলের ওই নামও পরিবর্তন করেছিলেন। বর্তমানে সেটিই হলো ন্যাশনাল র‍্যালি।

যাইহোক, এটি এখনো অভিবাসনবিরোধী দল হিসেবেই রয়ে গেছে। দলের বর্তমান নেতা জর্ডান বারডেলা বলেছেন, তিনি ফরাসি দ্বৈত নাগরিকদেরকে কৌশলগত সংবেদনশীল পদ থেকে নিষিদ্ধ করতে চান। তিনি তাদেরকে ‘হাফ-ন্যাশনালস’ হিসেবে অভিহিত করেন।

তিনি অভিবাসীদের জন্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধাও সীমিত করতে চান। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করা বিদেশী নাগরিকদের সন্তানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরাসি নাগরিকত্ব প্রাপ্তির যে অধিকার, এটিও বন্ধ করতে চান তিনি। কিন্তু জনসমক্ষে মাথায় স্কার্ফ পরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা পরিকল্পনা, সেটি আপাতত অগ্রাধিকারের মাঝে নেই। অভিবাসীরা, বিশেষ করে মুসলমানরা ফরাসি সমাজের একীভূত হবে না এমন শঙ্কাকে কাজে লাগিয়ে থাকে দলটি।

যেমন ইভাঙ্কা দিমিত্রোভা নামক একজন প্রার্থী বিবিসিকে বলেন, যেসব অভিবাসী ধর্মীয় আইনকে ফরাসি আইনের উপরে রাখতে চায়, দল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

একজন বিশ্লেষক বলেন, গত এক দশকে ফরাসি জনমত অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে।

তবে অভিভাসীদের বিষয়ে মূলধারার বিশ্বাস যে এমনই, এরকম কোনো প্রমাণ নেই। দলও এ বিষয়টি খোলাসা করেনি যে বর্তমান আইনের বাইরে আর কী ধরনের ‘ব্যবস্থা’ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্যারিসের ব্যুরো চিফ লেইলা আবৌদ বলেন, ‘গত এক দশকে অভিবাসনের বিরুদ্ধে ফরাসি জনমত বেশ কঠোর হয়েছে। ২০১৫ সালের সিরিয়া যুদ্ধের সময় থেকে শরণার্থী সঙ্কটের কথা ধরতে পারেন আপনি। চারপাশের এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিবিদরাও পরিবর্তিত হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রসঙ্গে এনআর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ইউরোপীয় আইনের প্রাধান্যের অবসান ঘটাবে, যা ইইউ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কিন্তু এনআর তাদের ন্যাটো-বিরোধী এবং ইইউ-বিরোধী নীতিগুলো শিথিল করেছে। রাশিয়ার সাথে এনআর-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাদ দেয়া হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে তাদের এজেন্ডায় ইইউ ছাড়ার বিষয়টি আর নেই।

ডানপন্থীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার
এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়, বিশেষ করে টিকটকে।

এনআর খুব সাধারণ স্লোগান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে সফলভাবে তাদের প্রচারণা চালিয়েছে। জনগণের মাঝে ফরাসি পরিচয় হারানোর ভয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির যে চলমান সঙ্কট, এই দুই বিষয়কে কাজে লাগিয়েছে এনআর।

তারা ভোটারদের কাছে নিজেদেরকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব কার্যকরভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে।

উনিভার্সিটি ডি ফ্রাঞ্চ-কমটি’র ভিনসেন্ট লেব্রু বিবিসির নিউজনাইট প্রোগ্রামে বলেন, ‘ফ্রান্সে আমরা জর্ডান বারডেলাকে টিকটক রাজনীতিক বলি। কারণ, তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এটি এমন কিছু, যা তার প্রোফাইলে বেশ অবদান রেখেছে। তিনি ঠিক কী প্রস্তাব করছেন, সেটি না জানলেও তার অনেক কিছুই আপনি দেখতে পাচ্ছেন।’

এনআর-এর বিরোধী বামপন্থী দল এনপিএফ প্রার্থী চার্লস কুলিওলি বলেছেন, ‘অনেক মানুষই বর্ণবাদী নয়। তারা কেবল সিস্টেমে বিরক্ত। তারা ম্যাক্রোঁর নীতিতে বিরক্ত। তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া সকল জিনিস নিয়ে বিরক্ত।’

সূত্র : বিবিসি

আরো পড়ুন : ভারতে চালু হওয়া নতুন তিন আইন নিয়ে যত বিতর্ক

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

যে চার কারণে ‘এনআর’কে ভোট দেয় ফরাসিরা

আপডেট সময় ০৬:২৯:২৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ জুলাই ২০২৪

ফ্রান্সে রোববার অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনের প্রথম দফায় ৩৩ শতাংশ ভোট নিয়ে এগিয়ে আছে ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‍্যালি (এনআর)।

২৮ শতাংশ ভোট নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ফ্রান্সের বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ)। এদিকে ২১ শতাংশের কাছাকাছি ভোট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দল। এখন সংসদের নিয়ন্ত্রণ যাতে ডানপন্থীদের হাতে চলে না যায়, তাই ফ্রান্সের মধ্যপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।

কিন্তু ফরাসিদের মেরিন লে পেন ও জর্ডান বারডেলা’র নেতৃত্বাধীন দল ‘এনআর’কে নির্বাচনের প্রথম দফায় জিতিয়ে দেয়ার মতো এত ভোট দেয়ার কারণ কী? ফ্রান্সের প্রবীণ ভাষ্যকার অ্যালাইন ডুহামেল বলেছেন, এ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

অভ্যন্তরীণ কারণ ও অর্থনৈতিক অবস্থা
ভোট দেয়ার আগে যেসব বিষয় ভোটাররা বিবেচনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত সঙ্কট, যা তাদের ক্রয় ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসুবিধা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন ফরাসিরা, যেটিকে তারা ‘নিরাপত্তাহীনতা’ বলে উল্লেখ করছে।

যদিও সামগ্রিকভাবে ফ্রান্সের অর্থনীতি ভালো। কিন্তু প্রধান শহর থেকে দূরে বসবাস করা মানুষ বিবিসিকে বলেন, তারা উপেক্ষিত অনুভব করেছেন। কারণ সকল তহবিল ও মনোযোগ শুধুমাত্র শহরগুলোকে ঘিরে।

ফ্রান্সের কোনো কোনো জায়গায় বেকারত্বের হার অনেক বেশি। এটি ২৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

দেশটির অনেকের জন্য আবাসন ব্যবস্থা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। বরাদ্দ সঙ্কুচিত করার কারণে কোনো কোনো এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এবং স্থানীয় স্বাস্থসেবা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বিরক্ত।

অধ্যাপক থমাস পিকেটি বলেন, উপেক্ষিতরাই ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকছে।

সর্বাধিক বিক্রীত ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের লেখক পিকেটি চিহ্নিত করেছেন, ‘ছোট শহরগুলোর শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পরিষেবা পেতে জনসাধারণকে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে; ট্রেন লাইনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বড় শহরগুলো থেকে দূরে থাকলে আপনার শিশুদের শিক্ষিত করা কঠিন।’

৩৭ বছর বয়সী পরিচ্ছন্নকর্মী অরেলি দুই সন্তানের মা, যিনি উত্তর ফ্রান্সের অ্যামিয়েন্স শহরে থাকেন। তিনি বলেন, এনআর-এর নীতি’র সাথে তিনি একমত ‘নিরাপত্তার’ কারণে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে উঠে কাজের জন্য বের হই। এক সময় আমি অ্যামিয়েন্সের রাস্তায় সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে পারতাম। কিন্তু এখন আর পারি না। এখন আমাকে গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। কারণ এসব রাস্তাজুড়ে সবসময় যুবকরা ঘোরাফেরা করে এবং আমি এই বিষয়টি নিয়ে ভয় পাই।’

প্যারিসের পূর্ব দিকের শহর পন্টাল্ট-কম্বল্ট শহরের প্যাট্রিক এনআর-কে ভোট দিয়েছেন। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘মানুষ এখন পরিবর্তন চায়, সেজন্য তারা ভোট দিতে আগ্রহী। তারা যখন রাস্তাঘাটে অনিরাপদ বোধ করে, তখন তারা খুশি হয় না। এছাড়া পেনশন নিয়ে ভোটাররা চিন্তিত। কারণ গতবছর ম্যাক্রোঁ আইন পাশ করে পেনশনের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৪ বছরে উন্নীত করেন। ম্যাক্রোঁ সরকারের অজনপ্রিয় সংস্কারগুলোর মাঝে এটি ছিল অন্যতম। কিন্তু ম্যাক্রোঁ বলেছিলেন যে পেনশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়া ঠেকাতে এই সংস্কার অপরিহার্য ছিল।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও ঘর গরম করার জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাসও ভোটারদের কাছে উদ্বেগের বিষয়। এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা বলেন, তারা জ্বালানি ও ১০০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট কর্তনের বিষয়ে মনোনিবেশ করবেন। শুধু তাই নয়, তারা কয়েক মাসের মাঝে পেনশন ব্যবস্থাও সংস্কার করবেন।

বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষ
ভোটাররা প্রায়ই বলছেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ কারছে না। তারা মনে করছেন, এনআর সরকারে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়নি। বিশ্রাম নেয়ার মতো সরকার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসাটাও ভালো মনে করছেন তারা।

এনআর সমর্থক ৬৪ বছর বয়সী জেন-ক্লড গ্যালেট বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি সন্তুষ্ট। কারণ আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন।’

আরেক এনআর সমর্থক ৮০ বছর বয়সী মার্গারিট বলেন, ‘তারা (ন্যাশনাল র‍্যালি) উঠে আসতে পেরেছে। কারণ জনগণ বিরক্ত। তাই জনগণ এখন বলছে যে ‘উই ডোন্ট কেয়ার। আসুন ভোট দেই। দেখি কী হয়। তবে আমি যা নিয়ে ভয়ে আছি, তা হলো, অন্যান্য রাজনৈতিক দল এখানে বাধা সৃষ্টি করবে। আমরা ভোট দিয়েছি। এই হলো তার ফলাফল। আমাদেরকে এটা মেনে নিতে হবে এবং দেখতে হবে যে কী ঘটে।’

কিন্তু ওয়েনিজ শহরের ইয়ামিনা আদ্দোউ বলেন, তিনি এনআর-এর সাফল্যে হতবাক। তিনি বলেন যে ডানপন্থীদের সমর্থন করার জন্য ভোটারদেরকে প্রভাবিত করা হয়েছে এবং তাদের এই সিদ্ধান্ত ফরাসি সমাজকে গুরুতর ও বিপজ্জনক বিভাজনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্যই এটি আমায় ধাক্কা দিয়েছে। এটি খুব দুঃখজনক বলে আমি মনে করি। কী ঘটছে, মানুষ তা বুঝতে পারছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তারা শুধুমাত্র ক্রয় ক্ষমতা এবং স্বল্পমেয়াদী ও দৃশ্যমান অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনা করে। কিন্তু এর পেছনে অনেক ভাবনা ও কৌশল আছে, যা আমাদেরকে একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধের দিকে পরিচালনা করবে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে এই যুদ্ধ হবে আরো অনেক বেশি সূক্ষ্ম। মানুষ বুঝতে পারছে না যে আমরা একটি গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলব। আমি এমনটাই ভাবি। এতে আমাদের মতো মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।’

অনেকেই বলেন যে ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও চলমান সঙ্কটের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ দায়ী।

ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্যারিস ব্যুরো চিফ সোফি পেডার বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষদেরকে একত্রিত করার জন্য একটি সম্মতিমূলক আন্দোলন তৈরি করেছিলেন। সংসদ ও দু’পক্ষের মাঝে চলমান বিরামহীন কলহ থামাতে এটি কাজও করেছিল। কিন্তু ফলাফল হলো, কেবল বামপন্থী ও মধ্যপন্থীরা ম্যাক্রোঁর দলে যোগ দিয়েছে। শুধু যোগ দেয়নি কট্টরপন্থীরা।’

অভিবাসী ও ভয়
বহু বছর ধরে ন্যাশনাল র‍্যালি’র নেতা মেরিন লে পেন তার দলকে মূলধারায় আনতে ও ভোটারদের কাছে দলকে আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য কাজ করছেন।

শুরুর দিকে এই দলের নাম ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্ট, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার পিতা জ্যোঁ-ম্যারি লে পেন। তার বাবা ও দলের বাকি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের ইহুদিবিরোধী এবং চরমপন্থী অবস্থানকে মুছে দিতে তিনি কাজ করেছেন। এমনকি তিনি দলের ওই নামও পরিবর্তন করেছিলেন। বর্তমানে সেটিই হলো ন্যাশনাল র‍্যালি।

যাইহোক, এটি এখনো অভিবাসনবিরোধী দল হিসেবেই রয়ে গেছে। দলের বর্তমান নেতা জর্ডান বারডেলা বলেছেন, তিনি ফরাসি দ্বৈত নাগরিকদেরকে কৌশলগত সংবেদনশীল পদ থেকে নিষিদ্ধ করতে চান। তিনি তাদেরকে ‘হাফ-ন্যাশনালস’ হিসেবে অভিহিত করেন।

তিনি অভিবাসীদের জন্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধাও সীমিত করতে চান। ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করা বিদেশী নাগরিকদের সন্তানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরাসি নাগরিকত্ব প্রাপ্তির যে অধিকার, এটিও বন্ধ করতে চান তিনি। কিন্তু জনসমক্ষে মাথায় স্কার্ফ পরার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা পরিকল্পনা, সেটি আপাতত অগ্রাধিকারের মাঝে নেই। অভিবাসীরা, বিশেষ করে মুসলমানরা ফরাসি সমাজের একীভূত হবে না এমন শঙ্কাকে কাজে লাগিয়ে থাকে দলটি।

যেমন ইভাঙ্কা দিমিত্রোভা নামক একজন প্রার্থী বিবিসিকে বলেন, যেসব অভিবাসী ধর্মীয় আইনকে ফরাসি আইনের উপরে রাখতে চায়, দল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

একজন বিশ্লেষক বলেন, গত এক দশকে ফরাসি জনমত অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে।

তবে অভিভাসীদের বিষয়ে মূলধারার বিশ্বাস যে এমনই, এরকম কোনো প্রমাণ নেই। দলও এ বিষয়টি খোলাসা করেনি যে বর্তমান আইনের বাইরে আর কী ধরনের ‘ব্যবস্থা’ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্যারিসের ব্যুরো চিফ লেইলা আবৌদ বলেন, ‘গত এক দশকে অভিবাসনের বিরুদ্ধে ফরাসি জনমত বেশ কঠোর হয়েছে। ২০১৫ সালের সিরিয়া যুদ্ধের সময় থেকে শরণার্থী সঙ্কটের কথা ধরতে পারেন আপনি। চারপাশের এই পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিবিদরাও পরিবর্তিত হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রসঙ্গে এনআর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ইউরোপীয় আইনের প্রাধান্যের অবসান ঘটাবে, যা ইইউ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। কিন্তু এনআর তাদের ন্যাটো-বিরোধী এবং ইইউ-বিরোধী নীতিগুলো শিথিল করেছে। রাশিয়ার সাথে এনআর-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাদ দেয়া হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে তাদের এজেন্ডায় ইইউ ছাড়ার বিষয়টি আর নেই।

ডানপন্থীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার
এনআর নেতা জর্ডান বারডেলা সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয়, বিশেষ করে টিকটকে।

এনআর খুব সাধারণ স্লোগান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে সফলভাবে তাদের প্রচারণা চালিয়েছে। জনগণের মাঝে ফরাসি পরিচয় হারানোর ভয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির যে চলমান সঙ্কট, এই দুই বিষয়কে কাজে লাগিয়েছে এনআর।

তারা ভোটারদের কাছে নিজেদেরকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খুব কার্যকরভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে।

উনিভার্সিটি ডি ফ্রাঞ্চ-কমটি’র ভিনসেন্ট লেব্রু বিবিসির নিউজনাইট প্রোগ্রামে বলেন, ‘ফ্রান্সে আমরা জর্ডান বারডেলাকে টিকটক রাজনীতিক বলি। কারণ, তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এটি এমন কিছু, যা তার প্রোফাইলে বেশ অবদান রেখেছে। তিনি ঠিক কী প্রস্তাব করছেন, সেটি না জানলেও তার অনেক কিছুই আপনি দেখতে পাচ্ছেন।’

এনআর-এর বিরোধী বামপন্থী দল এনপিএফ প্রার্থী চার্লস কুলিওলি বলেছেন, ‘অনেক মানুষই বর্ণবাদী নয়। তারা কেবল সিস্টেমে বিরক্ত। তারা ম্যাক্রোঁর নীতিতে বিরক্ত। তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া সকল জিনিস নিয়ে বিরক্ত।’

সূত্র : বিবিসি

আরো পড়ুন : ভারতে চালু হওয়া নতুন তিন আইন নিয়ে যত বিতর্ক