ঢাকা ০৩:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রাইসির ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন কেমন ছিল 

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ এক ধর্মীয় নেতা, যিনি ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাসান রুহানির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন তিনি।

৬৩ বছরের এই সাবেক বিচার বিভাগীয় প্রধান ব্যাপকভাবে জয়ী হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

রাইসি এমন একটা সময় প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করেন যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনাসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।

রাইসি দায়িত্বভার গ্রহণের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরান, যার মধ্যে ২০২২ সালে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, গাজায় ইসরাইল ও ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়েই কিন্তু ইরান এবং ইসরাইলের ছায়া যুদ্ধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

তার কর্মজীবন বেশ ঘটনাবহুল। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। খুব অল্প বয়সে সাফল্য পান তিনি।

এবার এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক তার জীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ।

ব্যক্তিগত জীবন
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। রাইসির বাবাও একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী মহানবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদরাসায় যোগ দেন রাইসি।

আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন।

সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ শাসনের পতন ঘটে।

ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন খামেনি।

ইব্রাহিম রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং তাদের দুটি সন্তান আছে।

তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুম্মার নামাজ পরিচালনা করেন।

৪০ বছরের বিচার বিভাগীয় অভিজ্ঞতা
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। বিপ্লবের পর সবগুলো বছরই তিনি বিচারিক পদে কাজ করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যখন জেনারেল প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে তিন বছর আগে আস্তান কুদস রাজাভির দায়িত্ব নেন, সেই সময়েও তিনি বিশেষ করণিক আদালতের কৌঁসুলি ছিলেন।

তার নির্বাচনী বিতর্ক এবং প্রচারাভিযানের সময় বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিজের কর্মকাণ্ডকে ‘সফল’ হিসেবে দাবি করলেও অনেকেই মনে করেন তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন বিচার ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন ইব্রাহিম রাইসি। ১৯৮৮ সালে এক গোপন ট্রাইব্যুনাল বসেছিল, ওই ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারপতির মধ্যে একজন ছিলেন রাইসি। তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি পদে থাকাকালীনই ওই ট্রাইব্যুনালের অংশ ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যে জেলে সাজা ভোগ করছেন এমন হাজার হাজার বন্দীর ‘পুনর্বিচার’ করার জন্য বসানো হয়েছিল ওই ট্রাইব্যুনাল। এই সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন বামপন্থী বিরোধী দল মুজাহেদিন-ই খালকের (এমইকে) সদস্য, যা পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন অব ইরান (পিএমওআই) নামেও পরিচিত।

আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভির দায়িত্ব
রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি। ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলির (প্রসিকিউটার জেনারেল) দায়িত্ব পান।

দুই বছর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে।

এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাশহাদে অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার দরগাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে।

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের দাতব্য এবং অন্যান্য সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হাতে।

মার্কিন তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণকাজ, কৃষি, বিদ্যুৎ জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক ব্যবস্থাসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব এই সংস্থার হাতে রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন রাইসি। ওই নির্বাচনে অবশ্য তিনি জেতেননি। জিতেছিলেন ধর্মীয় নেতা হাসান রুহানি যিনি প্রথম দফায় ৫৭% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরা ইব্রাহিম রাইসি ৩৮% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পান ওই নির্বাচনে।

তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুহানির কাছে পরাজয় তার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারেনি। ২০১৯ সালে আয়াতুল্লা খামেনি তাকে দেশের বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে অধিষ্ঠিত করেন।

এরপরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস বা বিশেষজ্ঞমণ্ডলির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দেশটির পরবর্তী সবোর্চ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে ৮৮ ধর্মীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ।

বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে তার সময়কালে বিচার ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার হয়েছে। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা কমেছে এবং অবৈধ মাদক সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যাও কমেছে বলে দাবি করা হয়।

২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করার সময় তিনি ‘দেশের নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপমান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্বতন্ত্র মঞ্চে এসেছেন’ বলে দাবি করেন।

প্রথম দফায় ৬২% ভোট পেয়ে তিনি জয় নিশ্চিত করতে পারেন। তবে ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৯ শতাংশের কিছু কম, যা ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে রেকর্ড সর্বনিম্ন।

ওই বছরের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের মেয়াদ শুরু করার সময় দেশের সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যেকোনো কূটনৈতিক পরিকল্পনা সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

তার ইঙ্গিত ছিল ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে ২০১৫ সালের চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনার দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তি নিয়ে কোনো ইতিবাচক উত্তর পায়নি ইরান। এরপর থেকে ইরান ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে পাল্টা জবাব দিয়েছে।

রাইসি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার পাশাপাশি তাদের আঞ্চলিক তৎপরতা রক্ষার অঙ্গীকার করেন এবং নিজেদের ‘স্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী শক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।

আলোচনায় রাইসির কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও ২০২২ সালের আগস্টে পরমাণু সমঝোতা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল বলে জানা গেছে। যদিও তৎকালীন সময়ে ইরানের পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

আঞ্চলিক উত্তেজনা
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সাত বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে রাইসি সরকার ইরানের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক সুন্নি শক্তি সৌদি আরবের সাথে আকস্মিক সমঝোতা করতে রাজি হয়ে যায়।

কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায়।

একই সময়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হাউছি এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন মিলিশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ইরানের নেটওয়ার্ক ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রদর্শনের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।

এই উত্তেজনা বৃদ্ধি একটি অঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে এমন আশঙ্কা এপ্রিলে আরো জোরদার হয় যখন ইরান প্রথমবার সরাসরি সামরিক হামলা চালায় ইসরাইলে।

সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলে ৩০০’রও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন রাইসি। তবে সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্রই ভূপতিত করতে সক্ষম হয়েছিল ইসরাইল, পশ্চিমা মিত্র ও আরব মিত্ররা। ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিমানঘাঁটিতে অবশ্য সে সময় সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইসরাইল এর জবাবে ইরানের একটি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সেই আক্রমণ অবশ্য তার সরকারকে বিচলিত করতে পারেনি বলেই দাবি করেন রাইসি।

রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঁধ উদ্বোধনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়ে রাইসি বলেন, ‘ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম ইস্যু’।

সূত্র : বিবিসি

আরো পড়ুন : ইরানের প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

রাইসির ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন কেমন ছিল 

আপডেট সময় ০৫:৫৮:১৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ মে ২০২৪

ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ এক ধর্মীয় নেতা, যিনি ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাসান রুহানির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন তিনি।

৬৩ বছরের এই সাবেক বিচার বিভাগীয় প্রধান ব্যাপকভাবে জয়ী হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।

রাইসি এমন একটা সময় প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করেন যখন ইরান তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যা, ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক উত্তেজনা এবং বিশ্বশক্তিগুলোর সাথে পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার আলোচনাসহ একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল।

রাইসি দায়িত্বভার গ্রহণের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ইরান, যার মধ্যে ২০২২ সালে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, গাজায় ইসরাইল ও ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ। গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়েই কিন্তু ইরান এবং ইসরাইলের ছায়া যুদ্ধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

তার কর্মজীবন বেশ ঘটনাবহুল। বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্রে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। খুব অল্প বয়সে সাফল্য পান তিনি।

এবার এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক তার জীবনের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ।

ব্যক্তিগত জীবন
ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। রাইসির বাবাও একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

শিয়া ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী মহানবীর বংশধরদের মতো কালো পাগড়ি পরতে দেখা যেত তাকে। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৫ বছর বয়সে কুম শহরে এক শিয়া মাদরাসায় যোগ দেন রাইসি।

আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। শহীদ মোতাহারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেসরকারি আইনে বিশেষীকরণসহ আইনশাস্ত্র এবং আইনের মৌলিক বিষয়ে পিএইচডি লাভ করেন।

সেখানে শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পশ্চিমা সমর্থিত শাহ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ শাসনের পতন ঘটে।

ছাত্র অবস্থা থেকেই তাকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেতে থাকে। পশ্চিমা সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে বিক্ষোভেও যুক্ত ছিলেন তিনি।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর বিচার বিভাগে যোগ দেন তিনি। আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছে প্রশিক্ষণের সময় বেশ কয়েকটি শহরে প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন খামেনি।

ইব্রাহিম রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলে তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং তাদের দুটি সন্তান আছে।

তার শ্বশুর আয়াতুল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। তিনিও একজন ধর্মীয় নেতা এবং মাশহাদ শহরে জুম্মার নামাজ পরিচালনা করেন।

৪০ বছরের বিচার বিভাগীয় অভিজ্ঞতা
বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল ইব্রাহিম রাইসির। বিপ্লবের পর সবগুলো বছরই তিনি বিচারিক পদে কাজ করে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যখন জেনারেল প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে তিন বছর আগে আস্তান কুদস রাজাভির দায়িত্ব নেন, সেই সময়েও তিনি বিশেষ করণিক আদালতের কৌঁসুলি ছিলেন।

তার নির্বাচনী বিতর্ক এবং প্রচারাভিযানের সময় বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিজের কর্মকাণ্ডকে ‘সফল’ হিসেবে দাবি করলেও অনেকেই মনে করেন তিনি দায়িত্বে থাকাকালীন বিচার ব্যবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।

বিচার বিভাগীয় ক্ষেত্রে খুব অল্প বয়সেই সাফল্য অর্জন করেছিলেন তিনি। ডেপুটি কৌঁসুলি নিযুক্ত হন ইব্রাহিম রাইসি। ১৯৮৮ সালে এক গোপন ট্রাইব্যুনাল বসেছিল, ওই ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারপতির মধ্যে একজন ছিলেন রাইসি। তেহরানের ডেপুটি কৌঁসুলি পদে থাকাকালীনই ওই ট্রাইব্যুনালের অংশ ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যে জেলে সাজা ভোগ করছেন এমন হাজার হাজার বন্দীর ‘পুনর্বিচার’ করার জন্য বসানো হয়েছিল ওই ট্রাইব্যুনাল। এই সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন বামপন্থী বিরোধী দল মুজাহেদিন-ই খালকের (এমইকে) সদস্য, যা পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন অব ইরান (পিএমওআই) নামেও পরিচিত।

আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভির দায়িত্ব
রাষ্ট্রীয় পরিদর্শক সংস্থার প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি। ইরানের বিচার বিভাগের প্রথম উপ-প্রধান পদে নিযুক্ত হন এবং ২০১৪ সালে ইরানের মহাকৌঁসুলির (প্রসিকিউটার জেনারেল) দায়িত্ব পান।

দুই বছর পর আয়াতুল্লাহ খামেনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে।

এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাশহাদে অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার দরগাটির রক্ষণাবেক্ষণ করে।

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের দাতব্য এবং অন্যান্য সংস্থা পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের হাতে।

মার্কিন তথ্য অনুযায়ী, নির্মাণকাজ, কৃষি, বিদ্যুৎ জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক ব্যবস্থাসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্ব এই সংস্থার হাতে রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্যবেক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন রাইসি। ওই নির্বাচনে অবশ্য তিনি জেতেননি। জিতেছিলেন ধর্মীয় নেতা হাসান রুহানি যিনি প্রথম দফায় ৫৭% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। নিজেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরা ইব্রাহিম রাইসি ৩৮% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পান ওই নির্বাচনে।

তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুহানির কাছে পরাজয় তার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারেনি। ২০১৯ সালে আয়াতুল্লা খামেনি তাকে দেশের বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে অধিষ্ঠিত করেন।

এরপরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস বা বিশেষজ্ঞমণ্ডলির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। দেশটির পরবর্তী সবোর্চ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে ৮৮ ধর্মীয় নেতার সমন্বয়ে গঠিত এই পরিষদ।

বিচার বিভাগীয় প্রধান হিসেবে তার সময়কালে বিচার ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার হয়েছে। এর ফলে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা কমেছে এবং অবৈধ মাদক সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যাও কমেছে বলে দাবি করা হয়।

২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করার সময় তিনি ‘দেশের নির্বাহী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে এবং দারিদ্র্য, দুর্নীতি, অপমান ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে স্বতন্ত্র মঞ্চে এসেছেন’ বলে দাবি করেন।

প্রথম দফায় ৬২% ভোট পেয়ে তিনি জয় নিশ্চিত করতে পারেন। তবে ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৯ শতাংশের কিছু কম, যা ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে রেকর্ড সর্বনিম্ন।

ওই বছরের আগস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের মেয়াদ শুরু করার সময় দেশের সমস্যা সমাধানে অর্থনৈতিক উন্নতি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের যেকোনো কূটনৈতিক পরিকল্পনা সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

তার ইঙ্গিত ছিল ইরানের পরমাণু কার্যক্রম সীমিত করতে ২০১৫ সালের চুক্তি নিয়ে আলাপ আলোচনার দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই এই চুক্তি নিয়ে কোনো ইতিবাচক উত্তর পায়নি ইরান। এরপর থেকে ইরান ক্রমবর্ধমান বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে পাল্টা জবাব দিয়েছে।

রাইসি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার পাশাপাশি তাদের আঞ্চলিক তৎপরতা রক্ষার অঙ্গীকার করেন এবং নিজেদের ‘স্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী শক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।

আলোচনায় রাইসির কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও ২০২২ সালের আগস্টে পরমাণু সমঝোতা পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল বলে জানা গেছে। যদিও তৎকালীন সময়ে ইরানের পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

আঞ্চলিক উত্তেজনা
কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সাত বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে রাইসি সরকার ইরানের তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক সুন্নি শক্তি সৌদি আরবের সাথে আকস্মিক সমঝোতা করতে রাজি হয়ে যায়।

কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে ইসরাইল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করলে আঞ্চলিক উত্তেজনা বেড়ে যায়।

একই সময়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হাউছি এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন মিলিশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সক্রিয় মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো ইরানের নেটওয়ার্ক ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রদর্শনের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।

এই উত্তেজনা বৃদ্ধি একটি অঞ্চলিক যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে এমন আশঙ্কা এপ্রিলে আরো জোরদার হয় যখন ইরান প্রথমবার সরাসরি সামরিক হামলা চালায় ইসরাইলে।

সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে প্রাণঘাতী হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরাইলে ৩০০’রও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন রাইসি। তবে সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্রই ভূপতিত করতে সক্ষম হয়েছিল ইসরাইল, পশ্চিমা মিত্র ও আরব মিত্ররা। ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিমানঘাঁটিতে অবশ্য সে সময় সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইসরাইল এর জবাবে ইরানের একটি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সেই আক্রমণ অবশ্য তার সরকারকে বিচলিত করতে পারেনি বলেই দাবি করেন রাইসি।

রোববার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বাঁধ উদ্বোধনের সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইরানের সমর্থনের ওপর জোর দিয়ে রাইসি বলেন, ‘ফিলিস্তিন মুসলিম বিশ্বের প্রথম ইস্যু’।

সূত্র : বিবিসি

আরো পড়ুন : ইরানের প্রেসিডেন্ট এব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত