ঢাকা ০৪:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবের ছয় দফার নামে স্বাধীনতা ঘোষণা

মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন
১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?” শেখ মুজিব উত্তরে আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।” ঘুরিয়ে বলা এই এক দফা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ স্বাধীনতা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলনের দাবী উঠেছে কিন্তু ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে এটি একক এজেন্ডায় পরিণত হয়।

ছয় দফার পটভূমি
ছয় দফা কোন রাতারাতি কর্মসূচি ছিল না। এর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের। উনিশ’শ চল্লিশ সালের লাহোর প্রস্তাব, ‘৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন – এসবই ছয় দফার ভিত তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন।”

ছয় দফার জন্মের পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য।
জন্মের পর থেকে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বেশিরভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের ‘সোনালী ফসল পাট’ বিদেশে রপ্তানি করে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো সেটাও চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ১৯৭০ সালের রিপোর্টে দেখা যায় উন্নয়ন ও রাজস্ব খাতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমের মাথা পিছু আয়ও বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তার সাথে ছিল রাজনৈতিক বৈষম্য। প্রশাসনে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। নেওয়া হতো না সেনাবাহিনীতেও। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্যও মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।

কী ছিল ছয় দফায়?
পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে সাথে নিয়ে ওই সম্মেলনে যান শেখ মুজিবুর রহমান এবং আগের দিন সম্মেলনের বিষয় নির্ধারণী কমিটির সভায় ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফার ছিল তিনটি স্বতন্ত্র দিক- রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো।
ছয় দফার দাবিগুলো ছিল এরকম:
* পাকিস্তান একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হবে
* ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র। অন্যান্য বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে থাকবে।
* প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক তবে অবাধে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। যদি একক মুদ্রা হয় তাহলে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।
* রাজস্ব থাকবে প্রদেশের হাতে।
* প্রতিটি প্রদেশের মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
* আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি প্রদেশকে মিলিশিয়া রাখার অনুমতি দিতে হবে।
ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন: “আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?”

ছয় দফার প্রতিক্রিয়া
শেখ মুজিব বিরোধী দলগুলোর যে সম্মেলনে এসব দফা তুলে ধরেছিলেন সেখানেই তার বিরোধিতা করা হয়। সবার আপত্তির কারণে এই প্রস্তাব সম্মেলনের এজেন্ডায় স্থান পায়নি। ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ মুজিব সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। রাজনীতিবিদরা বলেন, এসব দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান থাকবে না, ভেঙে যাবে। পাকিস্তানের খবরের কাগজে তাকে চিহ্নিত করা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে।

এ সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রয়োজনে তিনি অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফার জবাব দেওয়ার হুমকি দেন। ১৯৬৬ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন দেশের অখণ্ডতা-বিরোধী কোন প্রচেষ্টা সরকার সহ্য করবে না।

এর পর শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তখনই শোনা গেল ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ এই স্লোগান।।

অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে উঠেন শেখ মুজিব
লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে পরের মাসেই এসে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। ছয় দফা কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফর করতে শুরু করেন। এই কর্মসূচিকে তারা ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলকে চাঙ্গা করা এবং দলের প্রধান হয়ে ওঠার জন্যেও শেখ মুজিবের এরকম একটি কর্মসূচির প্রয়োজন ছিল। এর পরই তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন এবং এই কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে মহকুমায় মহকুমায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন। তখন তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসময় শেখ মুজিবের সফরসঙ্গী ছিলে তাজউদ্দীন আহমদ।

এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গণজাগরণের সৃষ্টি হলো। দৈনিক ইত্তেফাক এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকা হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এসময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও শেখ মুজিব সারা দেশে ঘুরে ঘুরে লোকজনকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তান কেড়ে নিচ্ছে। তাদের সুদিন আসবে যদি তারা তাদের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

ছয় দফা ঘোষণা করে শেখ মুজিব চলে এলেন একেবারে সম্মুখভাগে। তিনি তখন সবকিছু নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন তিনি। একজন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ৭০ এই চার বছরে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে। ছয় দফা আন্দোলন তাকে সাহায্য করলো বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন প্রতীক হয়ে উঠতে।

ছয় দফা ঘোষণার মাত্র পাঁচ বছর পর জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।

আরো পড়ুন : স্বীয় জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবের ছয় দফার নামে স্বাধীনতা ঘোষণা

আপডেট সময় ০৭:৩৭:৫৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪

মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন
১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?” শেখ মুজিব উত্তরে আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, “আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।” ঘুরিয়ে বলা এই এক দফা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ স্বাধীনতা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলের স্বাধিকার আন্দোলনের দাবী উঠেছে কিন্তু ছয় দফার দাবির মধ্য দিয়ে এটি একক এজেন্ডায় পরিণত হয়।

ছয় দফার পটভূমি
ছয় দফা কোন রাতারাতি কর্মসূচি ছিল না। এর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের। উনিশ’শ চল্লিশ সালের লাহোর প্রস্তাব, ‘৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন – এসবই ছয় দফার ভিত তৈরি করেছে।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন।”

ছয় দফার জন্মের পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য।
জন্মের পর থেকে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বেশিরভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের ‘সোনালী ফসল পাট’ বিদেশে রপ্তানি করে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো সেটাও চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৬০ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কিন্তু প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে।
পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ১৯৭০ সালের রিপোর্টে দেখা যায় উন্নয়ন ও রাজস্ব খাতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমের মাথা পিছু আয়ও বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তার সাথে ছিল রাজনৈতিক বৈষম্য। প্রশাসনে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। নেওয়া হতো না সেনাবাহিনীতেও। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্যও মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।

কী ছিল ছয় দফায়?
পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে সাথে নিয়ে ওই সম্মেলনে যান শেখ মুজিবুর রহমান এবং আগের দিন সম্মেলনের বিষয় নির্ধারণী কমিটির সভায় ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফার ছিল তিনটি স্বতন্ত্র দিক- রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো।
ছয় দফার দাবিগুলো ছিল এরকম:
* পাকিস্তান একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হবে
* ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র। অন্যান্য বিষয় প্রদেশগুলোর হাতে থাকবে।
* প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক তবে অবাধে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। যদি একক মুদ্রা হয় তাহলে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।
* রাজস্ব থাকবে প্রদেশের হাতে।
* প্রতিটি প্রদেশের মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
* আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি প্রদেশকে মিলিশিয়া রাখার অনুমতি দিতে হবে।
ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন: “আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?”

ছয় দফার প্রতিক্রিয়া
শেখ মুজিব বিরোধী দলগুলোর যে সম্মেলনে এসব দফা তুলে ধরেছিলেন সেখানেই তার বিরোধিতা করা হয়। সবার আপত্তির কারণে এই প্রস্তাব সম্মেলনের এজেন্ডায় স্থান পায়নি। ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ মুজিব সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। রাজনীতিবিদরা বলেন, এসব দফা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তান থাকবে না, ভেঙে যাবে। পাকিস্তানের খবরের কাগজে তাকে চিহ্নিত করা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে।

এ সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রয়োজনে তিনি অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফার জবাব দেওয়ার হুমকি দেন। ১৯৬৬ সালে কনভেনশন মুসলিম লীগের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন দেশের অখণ্ডতা-বিরোধী কোন প্রচেষ্টা সরকার সহ্য করবে না।

এর পর শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তখনই শোনা গেল ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ এই স্লোগান।।

অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হয়ে উঠেন শেখ মুজিব
লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে পরের মাসেই এসে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। ছয় দফা কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান সফর করতে শুরু করেন। এই কর্মসূচিকে তারা ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলকে চাঙ্গা করা এবং দলের প্রধান হয়ে ওঠার জন্যেও শেখ মুজিবের এরকম একটি কর্মসূচির প্রয়োজন ছিল। এর পরই তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন এবং এই কর্মসূচি নিয়ে সারা দেশে মহকুমায় মহকুমায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন। তখন তিনি যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এসময় শেখ মুজিবের সফরসঙ্গী ছিলে তাজউদ্দীন আহমদ।

এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গণজাগরণের সৃষ্টি হলো। দৈনিক ইত্তেফাক এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকা হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়। এসময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও শেখ মুজিব সারা দেশে ঘুরে ঘুরে লোকজনকে বোঝাতে পেরেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তান কেড়ে নিচ্ছে। তাদের সুদিন আসবে যদি তারা তাদের সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।

ছয় দফা ঘোষণা করে শেখ মুজিব চলে এলেন একেবারে সম্মুখভাগে। তিনি তখন সবকিছু নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন তিনি। একজন অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ৭০ এই চার বছরে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে। ছয় দফা আন্দোলন তাকে সাহায্য করলো বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন প্রতীক হয়ে উঠতে।

ছয় দফা ঘোষণার মাত্র পাঁচ বছর পর জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।

আরো পড়ুন : স্বীয় জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ