ঢাকা ০৩:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজিমুল্লাহ খানের তৈরি করা স্লোগান ‘ভারত মাতা কি জয়’

নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘ভারত মাতা কি জয়’ এই স্লোগান ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ আর নেতা-কর্মীদের মুখে নিয়মিতই শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন এই স্লোগান প্রথম দিয়েছিলেন এক মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে, ১৮৫৭ সালে।

তবে সম্প্রতি ভারতে এমন অনেক ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে মুসলমান ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা হয় যে তারা কেন ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে রাজি হন না!

বিগত কয়েক বছরে মুসলমানদের ‘গণপিটুনি’র যে সব ঘটনা হয়েছে, তার বেশ কয়েকটিতে শোনা গেছে হিন্দুত্ববাদীরা জোর করে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলানোর চেষ্টা করেছে গণপিটুনির শিকার হওয়া মুসলমান ব্যক্তিটিকে।

স্লোগানটি যে একজন মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামীর তৈরি করা, এই বিষয়টি ইতিহাসবিদদের একাংশ স্বীকার করলেও তা সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের একটি ভাষণের সূত্রে।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই বিজয়নের দেওয়া সোমবারের ওই ভাষণ উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেখানে বিজয়ন বলেছেন, “সংঘ পরিবারের নেতারা এখানে এসে সামনে বসে থাকা মানুষদের ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে বলেন। তারা কি জানেন এই স্লোগানটা কে তৈরি করেছিলেন? আমি জানি না সংঘ পরিবার জানে কি না যে তার নাম আজিমুল্লাহ খান।“

ইতিহাস বলছে ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, যাকে অনেকে সিপাহি বিদ্রোহ বলেও উল্লেখ করেন, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন আজিমুল্লাহ খান।

ইতিহাসবিদ ও লেখক সৈয়দ উবায়েদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আজিমুল্লাহ খানই যে ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান’ জিন্দাবাদ স্লোগানটি দিয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

ইতিহাসবিদরা বলছেন, আজিমুল্লাহ খানের দেওয়া ওই স্লোগানটিরই অনুবাদ হল ‘ভারত মাতা কি জয়’।

তবে ইসলামি ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলছিলেন, ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ শব্দ-বন্ধের সঠিক অনুবাদ হল মাতৃভূমি ভারতবর্ষ জিন্দাবাদ।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন আরও বলেছেন যে কূটনীতিবিদ আবিদ হাসান সাফরানি যেমন ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটির প্রবর্তক, তেমনই মুহম্মদ ইকবাল লিখেছিলেন বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’।

কে ছিলেন আজিমুল্লাহ খান?
সৈয়দ উবায়েদুর রহমানের সংকলিত গ্রন্থ ‘বায়োগ্রাফিকাল এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়ান মুসলিম ফ্রিডম ফাইটার্স’-এ আজিমুল্লাহ খানকে নিয়ে একটি আলাদা পরিচ্ছেদই রয়েছে।

সেখানে লেখা হয়েছে, “আজিমুল্লাহ খান ১৮৫৭-র বিদ্রোহের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। ইংরেজি ও ফরাসি-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন, যে জ্ঞান অন্য অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর ছিল না।”

“শীর্ষ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাতেন তিনি। ভারতের অনেকে যখন মনে করতেন যে ব্রিটিশ বাহিনী অপরাজেয়, তখন তিনি তুরস্ক আর ক্রিমিয়ায় গিয়ে, ইউরোপ ভ্রমণ করে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সেখানে পরাজিত হচ্ছে।”

“প্রয়াত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক নেওয়া পুত্র নানা সাহেবের দেওয়ান ছিলেন তিনি, পরে তার প্রধানমন্ত্রী হন”, লিখেছেন সৈয়দ উবায়েদুর রহমান।

আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক বলে যাকে মনে করা হয়, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকর তার বই ‘দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ ১৮৫৭’- এ আজিমুল্লাহ খান সম্বন্ধে লিখেছেন, “১৮৫৭-র বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলির মধ্যে সব থেকে স্মরণীয় ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন আজিমুল্লাহ খান। স্বাধীনতা যুদ্ধর ভাবনাটা যাদের মাথায় প্রথম এসেছিল তাদের মধ্যে আজিমুল্লাহকে বিশেষ জায়গা দিতেই হবে।”

নানা সাহেব যেহেতু পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক পুত্র ছিলেন, এই যুক্তিতে বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পরে নানা সাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

সাভারকর ছাড়াও অনেক ইতিহাসবিদই লিখেছেন যে উত্তরাধিকারের বিষয়গুলি মীমাংসা করতে নানাসাহেব ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন আজিমুল্লাহ খানকে।

প্রায় বছর দুয়েক তিনি যুক্তরাজ্যে ছিলেন, যদিও পেনশন পুনরায় চালু করাতে পারেননি তিনি। দেশে ফিরে আসেনে ১৮৫৫ সালে।

ইংরেজি, ফরাসি-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠলেও আজিমুল্লাহ খানের শিশু বয়সটা কেটেছিল চরম দারিদ্রের মধ্যে।

ইতিহাসবিদরা লিখছেন, ১৮৩৭-৩৮ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে তাকে এবং তার মাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের ঠাঁই হয় কানপুরের একটি খ্রিস্টান মিশনে।

একটা সময়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বাড়িতে কখনও ওয়েটার হিসাবে, কখনও বাবুর্চি হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। সেখান থেকে তার ইংরেজি, ফরাসি শেখা বলে জানাচ্ছেন ইতিহাসবিদরা।

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ সফর সেরে ফেরার পথেই আজিমুল্লাহ খান তুরস্ক ও ক্রিমিয়াতে যান এবং দেশে ফিরে এসে নানাসাহেবকে পরামর্শ দেন বিদ্রোহ শুরু করার।

পত্রিকার মাধ্যমে স্বাধীনতার আহ্বান
ইউরোপ থেকে ফিরে এসে ‘পায়াম-এ আজাদি’ নামে একটি পত্রিকা চালু করেন আজিমুল্লাহ খান। উর্দু, মারাঠি আর হিন্দিতে ছাপা হত পত্রিকাটি।

তিনি ইউরোপ থেকে একটা ছাপার যন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন, সেই যন্ত্রেই ছাপা হত তার পত্রিকাটি।

উর্দু সাংবাদিকতার ইতিহাস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গবেষক আসাদ ফয়সাল ফারুকি বলছিলেন যে ওই পত্রিকার মধ্যে দিয়েই বিদ্রোহের কথা, স্বাধীনতার কথা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন আজিমুল্লাহ খান।

“তিনি স্বাধীনতার জন্য একই সঙ্গে মুসলমান, হিন্দু, শিখ- সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই বার বার তার পত্রিকার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। যে গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতির কথা বলা হয়, তার লেখায় সেটাই বেরিয়ে এসেছে সব সময়ে”, বলছিলেন ফয়সাল ফারুকি।
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহী বিদ্রোহের যে মার্চিং সং, সেটিও তারই লেখা।

ফারুকি পড়ে শোনাচ্ছিলেন সেই গানটি, যার শেষ দুটি লাইনে বোঝা যায় সব ধর্মের মানুষকে কীভাবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন : “হিন্দু মুসলমান শিখ হামারা, ভাই ভাই প্যেয়ারা, ইয়েহ আজাদি কা ঝাণ্ডা, ইসে সালাম হামারা” … অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান শিখ সবাই ভাই-ভাই, এই স্বাধীনতার পতাকাকে আমাদের সালাম।”

সেই পর্যায়েই তার পত্রিকায় তিনি ‘মাদর-এ-ওয়াতন’ স্লোগানটি লেখেন, এমনটাই বলছিলেন ইতিহাসবিদ ও লেখক সৈয়দ উবায়েদুর রহমান।

“এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে এই স্লোগান তারই লেখা। তবে এই স্লোগানটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হবে না। তার পত্রিকায় নিয়মিতই স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানাতেন, এ ধরনের নানা স্লোগান লিখতেন তিনি”, বলছিলেন উবায়েদুর রহমান।

তবে আজিমুল্লাহ খানই যে ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, এরকম প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি বলেও কেউ কেউ বলছেন।

আজিমুল্লাহ খান ১৮৫৭-র মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ছিলেন বলেও মন্তব্য উবায়েদুর রহমানের।

বিদ্রোহ দমিত হওয়ার পরে আর বেশি দিন বাঁচেননি আজিমুল্লাহ খান। ১৮৫৯ সালে তার মৃত্যু হয় নেপালের তরাই অঞ্চলে।
ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন পালিয়ে বেড়ানোর কারণেই সম্ভবত তার চিকিৎসা ঠিক মতো হয় নি। সূত্র : বিবিসি।

আরো পড়ুন : অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবের ছয় দফার নামে স্বাধীনতা ঘোষণা

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

আজিমুল্লাহ খানের তৈরি করা স্লোগান ‘ভারত মাতা কি জয়’

আপডেট সময় ০৯:০৮:৩৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘ভারত মাতা কি জয়’ এই স্লোগান ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদ আর নেতা-কর্মীদের মুখে নিয়মিতই শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন এই স্লোগান প্রথম দিয়েছিলেন এক মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামী, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে, ১৮৫৭ সালে।

তবে সম্প্রতি ভারতে এমন অনেক ঘটনা সামনে এসেছে, যেখানে মুসলমান ব্যক্তিদের প্রশ্ন করা হয় যে তারা কেন ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে রাজি হন না!

বিগত কয়েক বছরে মুসলমানদের ‘গণপিটুনি’র যে সব ঘটনা হয়েছে, তার বেশ কয়েকটিতে শোনা গেছে হিন্দুত্ববাদীরা জোর করে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলানোর চেষ্টা করেছে গণপিটুনির শিকার হওয়া মুসলমান ব্যক্তিটিকে।

স্লোগানটি যে একজন মুসলমান স্বাধীনতা সংগ্রামীর তৈরি করা, এই বিষয়টি ইতিহাসবিদদের একাংশ স্বীকার করলেও তা সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের একটি ভাষণের সূত্রে।

সংবাদ সংস্থা পিটিআই বিজয়নের দেওয়া সোমবারের ওই ভাষণ উদ্ধৃত করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সেখানে বিজয়ন বলেছেন, “সংঘ পরিবারের নেতারা এখানে এসে সামনে বসে থাকা মানুষদের ‘ভারত মাতা কি জয়’ স্লোগান দিতে বলেন। তারা কি জানেন এই স্লোগানটা কে তৈরি করেছিলেন? আমি জানি না সংঘ পরিবার জানে কি না যে তার নাম আজিমুল্লাহ খান।“

ইতিহাস বলছে ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, যাকে অনেকে সিপাহি বিদ্রোহ বলেও উল্লেখ করেন, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন আজিমুল্লাহ খান।

ইতিহাসবিদ ও লেখক সৈয়দ উবায়েদুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আজিমুল্লাহ খানই যে ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান’ জিন্দাবাদ স্লোগানটি দিয়েছিলেন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

ইতিহাসবিদরা বলছেন, আজিমুল্লাহ খানের দেওয়া ওই স্লোগানটিরই অনুবাদ হল ‘ভারত মাতা কি জয়’।

তবে ইসলামি ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলছিলেন, ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ শব্দ-বন্ধের সঠিক অনুবাদ হল মাতৃভূমি ভারতবর্ষ জিন্দাবাদ।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন আরও বলেছেন যে কূটনীতিবিদ আবিদ হাসান সাফরানি যেমন ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটির প্রবর্তক, তেমনই মুহম্মদ ইকবাল লিখেছিলেন বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’।

কে ছিলেন আজিমুল্লাহ খান?
সৈয়দ উবায়েদুর রহমানের সংকলিত গ্রন্থ ‘বায়োগ্রাফিকাল এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইন্ডিয়ান মুসলিম ফ্রিডম ফাইটার্স’-এ আজিমুল্লাহ খানকে নিয়ে একটি আলাদা পরিচ্ছেদই রয়েছে।

সেখানে লেখা হয়েছে, “আজিমুল্লাহ খান ১৮৫৭-র বিদ্রোহের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। ইংরেজি ও ফরাসি-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন, যে জ্ঞান অন্য অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর ছিল না।”

“শীর্ষ ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাতেন তিনি। ভারতের অনেকে যখন মনে করতেন যে ব্রিটিশ বাহিনী অপরাজেয়, তখন তিনি তুরস্ক আর ক্রিমিয়ায় গিয়ে, ইউরোপ ভ্রমণ করে দেখেছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সেখানে পরাজিত হচ্ছে।”

“প্রয়াত পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক নেওয়া পুত্র নানা সাহেবের দেওয়ান ছিলেন তিনি, পরে তার প্রধানমন্ত্রী হন”, লিখেছেন সৈয়দ উবায়েদুর রহমান।

আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের জনক বলে যাকে মনে করা হয়, সেই বিনায়ক দামোদর সাভারকর তার বই ‘দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স অফ ১৮৫৭’- এ আজিমুল্লাহ খান সম্বন্ধে লিখেছেন, “১৮৫৭-র বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলির মধ্যে সব থেকে স্মরণীয় ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন আজিমুল্লাহ খান। স্বাধীনতা যুদ্ধর ভাবনাটা যাদের মাথায় প্রথম এসেছিল তাদের মধ্যে আজিমুল্লাহকে বিশেষ জায়গা দিতেই হবে।”

নানা সাহেব যেহেতু পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক পুত্র ছিলেন, এই যুক্তিতে বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পরে নানা সাহেবের পেনশন বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

সাভারকর ছাড়াও অনেক ইতিহাসবিদই লিখেছেন যে উত্তরাধিকারের বিষয়গুলি মীমাংসা করতে নানাসাহেব ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন আজিমুল্লাহ খানকে।

প্রায় বছর দুয়েক তিনি যুক্তরাজ্যে ছিলেন, যদিও পেনশন পুনরায় চালু করাতে পারেননি তিনি। দেশে ফিরে আসেনে ১৮৫৫ সালে।

ইংরেজি, ফরাসি-সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠলেও আজিমুল্লাহ খানের শিশু বয়সটা কেটেছিল চরম দারিদ্রের মধ্যে।

ইতিহাসবিদরা লিখছেন, ১৮৩৭-৩৮ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ে তাকে এবং তার মাকে উদ্ধার করা হয়। তাদের ঠাঁই হয় কানপুরের একটি খ্রিস্টান মিশনে।

একটা সময়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বাড়িতে কখনও ওয়েটার হিসাবে, কখনও বাবুর্চি হিসাবে কাজ করেছেন তিনি। সেখান থেকে তার ইংরেজি, ফরাসি শেখা বলে জানাচ্ছেন ইতিহাসবিদরা।

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপ সফর সেরে ফেরার পথেই আজিমুল্লাহ খান তুরস্ক ও ক্রিমিয়াতে যান এবং দেশে ফিরে এসে নানাসাহেবকে পরামর্শ দেন বিদ্রোহ শুরু করার।

পত্রিকার মাধ্যমে স্বাধীনতার আহ্বান
ইউরোপ থেকে ফিরে এসে ‘পায়াম-এ আজাদি’ নামে একটি পত্রিকা চালু করেন আজিমুল্লাহ খান। উর্দু, মারাঠি আর হিন্দিতে ছাপা হত পত্রিকাটি।

তিনি ইউরোপ থেকে একটা ছাপার যন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন, সেই যন্ত্রেই ছাপা হত তার পত্রিকাটি।

উর্দু সাংবাদিকতার ইতিহাস এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গবেষক আসাদ ফয়সাল ফারুকি বলছিলেন যে ওই পত্রিকার মধ্যে দিয়েই বিদ্রোহের কথা, স্বাধীনতার কথা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন আজিমুল্লাহ খান।

“তিনি স্বাধীনতার জন্য একই সঙ্গে মুসলমান, হিন্দু, শিখ- সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই বার বার তার পত্রিকার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। যে গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতির কথা বলা হয়, তার লেখায় সেটাই বেরিয়ে এসেছে সব সময়ে”, বলছিলেন ফয়সাল ফারুকি।
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বা সিপাহী বিদ্রোহের যে মার্চিং সং, সেটিও তারই লেখা।

ফারুকি পড়ে শোনাচ্ছিলেন সেই গানটি, যার শেষ দুটি লাইনে বোঝা যায় সব ধর্মের মানুষকে কীভাবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন : “হিন্দু মুসলমান শিখ হামারা, ভাই ভাই প্যেয়ারা, ইয়েহ আজাদি কা ঝাণ্ডা, ইসে সালাম হামারা” … অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান শিখ সবাই ভাই-ভাই, এই স্বাধীনতার পতাকাকে আমাদের সালাম।”

সেই পর্যায়েই তার পত্রিকায় তিনি ‘মাদর-এ-ওয়াতন’ স্লোগানটি লেখেন, এমনটাই বলছিলেন ইতিহাসবিদ ও লেখক সৈয়দ উবায়েদুর রহমান।

“এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে এই স্লোগান তারই লেখা। তবে এই স্লোগানটাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে হবে না। তার পত্রিকায় নিয়মিতই স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানাতেন, এ ধরনের নানা স্লোগান লিখতেন তিনি”, বলছিলেন উবায়েদুর রহমান।

তবে আজিমুল্লাহ খানই যে ‘মাদর-এ-ওয়াতন হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন, এরকম প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায়নি বলেও কেউ কেউ বলছেন।

আজিমুল্লাহ খান ১৮৫৭-র মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম ছিলেন বলেও মন্তব্য উবায়েদুর রহমানের।

বিদ্রোহ দমিত হওয়ার পরে আর বেশি দিন বাঁচেননি আজিমুল্লাহ খান। ১৮৫৯ সালে তার মৃত্যু হয় নেপালের তরাই অঞ্চলে।
ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন পালিয়ে বেড়ানোর কারণেই সম্ভবত তার চিকিৎসা ঠিক মতো হয় নি। সূত্র : বিবিসি।

আরো পড়ুন : অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবের ছয় দফার নামে স্বাধীনতা ঘোষণা