ঢাকা ১২:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পোশাকশিল্পের সমস্যা ও সমাধান

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের শিল্পায়ন শুরু হয় আশির দশকের শুরু দিকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানিমুখী পাটকলগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এবং বিদেশি উদ্যোক্তারা এ সময় অন্যান্য শিল্পখাতে বিনিয়োগের প্রয়াস পান। ১৯৮৩ সালে গড়ে উঠে দেশের প্রথম চট্টগ্রাম ইপিজেড। ১৯৭৬ সালে ১৭৬ জন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে ৪টি পোশাক কারখানা। ১৯৮০ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ এবং শ্রমিকসংখ্যা ৪০০০ হাজার। শুরুতে পোশাক কারখানা অর্থনীতির জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এখন সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা পোশাক খাতটিই বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য। বর্তমানে পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ যার ৮০% নারী।

বিশ্বের ১১৫ রকমের পোশাকের চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে ৩৬ প্রকারের পোশাক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। গ্যাপ, কেলভিন ক্লেইন, টমি হিলকিগার, এইচ এন্ড এম, প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড বাংলাদেশের প্রধান ক্রেতা। এছাড়া টার্গেট ও ওলমার্টের মত (খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ঢাকায় নিজস্ব অফিস। সম্প্রতি রপ্তানি তালিকায় যোগ হয়েছে জাপানের নাম।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৪৫৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকেরা। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। বর্তমানে নানা প্রতিকুলতার মাঝে গার্মেন্টস ব্যবসাটি ক্রমেই বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।

অথচ ২০০৫ সালে কোটা ঊঠে যাওয়ার পর এই শিল্প বন্ধ হওয়ার আশংকা করেছিলেন। কিন্তু কোটা উঠে যাওয়ার পর এই শিল্প টিকে আছে এবং ২০০৮-০৯ সালে উন্নত বিশ্বে মন্দার সময়ও রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা গত এক দশকে সবচাইতে বেশি।

প্রায় সাড়ে তিন দশক পূর্বে শুরু করে দূর্বল অবকাঠামো, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা যা কম বেশি আজও বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও গার্মেন্টস টিকে আছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার পরেও কি এই শিল্প শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাব কঠিন। তবে যখন দেখি শুরুতে যেভাবে বিদেশী ক্রেতারা এই শিল্পের প্রতিটি বিষয়ে নাক গলাতেন এবং ডিকটেট করতেন এখনও তেমনিই করছেন। তার অর্থ এখনও নির্ভরশীলতা কাটেনি। তবে একেবারেই যে কাটেনি, তা নয় । কয়েক বছর পূর্বে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিবৃন্দ পোশাক শিল্পের মালিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- বাংলাদেশ যেহেতু তুলা উৎপাদন করে না তাই পশ্চাৎ সংযোগ (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) শিল্পের প্রয়োজন নেই। এমন উদ্ভট যুক্তি শোনা মাত্রই আমাদের শিল্পপতিরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বলেছিলেন- যে সমস্ত দেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশই তুলা উৎপাদন করে না। এমনকি যেখানে পোশাক শিল্প দিয়েই শিল্প বিপ্লব হয়েছে কিংবা দেশকে শিল্পায়িত করেছে তারা কেউ তুলা উৎপাদনকারী দেশ নয়। পরে অবশ্য উপদেশকারীরা তাদের বক্তব্য তুলে নিয়েছিলেন।

দেশের অর্থনীতির প্রধানতম চালিকাশক্তি এ খাতে বর্তমানে তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। যার প্রধান কারণ হলো নিম্ন মজুরি, বেতন বৈষম্য, সময়মত বেতন প্রদান না করা, চাকরি হারানোর ভয়, শ্রমিক ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব। এছাড়াও আছে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ঘর-বাড়ি ভাড়া ঘন ঘন বৃদ্ধি, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা হয়রানি, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি প্রভৃতি। শ্রমিক অসন্তোষের জন্য গার্মেন্ট বন্ধের গুজব ও স্বার্থান্বেষী এনজিওদের ভূমিকাও শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।

শ্রমিক অসন্তোষকে শুধুমাত্র বেতন বৃদ্ধির দাবি থেকেই আসেনি। এর পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। পোশাক শিল্প খাতের অস্থিরতার কারণ যাই হোক না কেন এর জন্য দরকার সুষ্ঠু সমাধান। ইতিমধ্যে সরকার মালিক-শ্রমিককে আলোচনার টেবিলে এনেছে, সামান্য হলেও মজুরি বাড়িয়েছে, শিল্প পুলিশ গঠন করেছে। তথাপিও বলতে হয় সম্ভবত আনুকূল্যের পাল্লা মালিকদের দিকেই বেশি। শ্রমিকদেও কথা আন্তরিকভাবে ভাবার সময় এসেছে। যৌক্তিকভাবে বেতন বৃদ্ধিসহ ঈদেও আগে সময়মত বোনাস প্রদান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি, আবাসন ও মেডিক্যাল ভাতা ইত্যাদিও ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে। এছাড়া দেশি-বিদেশী চক্রান্তকারীরা যাতে আমাদের এ শিল্পকে ধ্বংস করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আরো পড়ুন : ইউনূস-বাইডেন বৈঠক; যে বার্তা পেল বাংলাদেশ

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

পোশাকশিল্পের সমস্যা ও সমাধান

আপডেট সময় ১২:৫৪:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের শিল্পায়ন শুরু হয় আশির দশকের শুরু দিকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানিমুখী পাটকলগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা এবং বিদেশি উদ্যোক্তারা এ সময় অন্যান্য শিল্পখাতে বিনিয়োগের প্রয়াস পান। ১৯৮৩ সালে গড়ে উঠে দেশের প্রথম চট্টগ্রাম ইপিজেড। ১৯৭৬ সালে ১৭৬ জন শ্রমিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে ৪টি পোশাক কারখানা। ১৯৮০ সালে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ এবং শ্রমিকসংখ্যা ৪০০০ হাজার। শুরুতে পোশাক কারখানা অর্থনীতির জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এখন সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা পোশাক খাতটিই বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য। বর্তমানে পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ যার ৮০% নারী।

বিশ্বের ১১৫ রকমের পোশাকের চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ রপ্তানি করছে ৩৬ প্রকারের পোশাক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। গ্যাপ, কেলভিন ক্লেইন, টমি হিলকিগার, এইচ এন্ড এম, প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড বাংলাদেশের প্রধান ক্রেতা। এছাড়া টার্গেট ও ওলমার্টের মত (খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান) প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ঢাকায় নিজস্ব অফিস। সম্প্রতি রপ্তানি তালিকায় যোগ হয়েছে জাপানের নাম।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৪৫৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকেরা। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। বর্তমানে নানা প্রতিকুলতার মাঝে গার্মেন্টস ব্যবসাটি ক্রমেই বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।

অথচ ২০০৫ সালে কোটা ঊঠে যাওয়ার পর এই শিল্প বন্ধ হওয়ার আশংকা করেছিলেন। কিন্তু কোটা উঠে যাওয়ার পর এই শিল্প টিকে আছে এবং ২০০৮-০৯ সালে উন্নত বিশ্বে মন্দার সময়ও রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা গত এক দশকে সবচাইতে বেশি।

প্রায় সাড়ে তিন দশক পূর্বে শুরু করে দূর্বল অবকাঠামো, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা যা কম বেশি আজও বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও গার্মেন্টস টিকে আছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতার পরেও কি এই শিল্প শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পেরেছে? এই প্রশ্নের জবাব কঠিন। তবে যখন দেখি শুরুতে যেভাবে বিদেশী ক্রেতারা এই শিল্পের প্রতিটি বিষয়ে নাক গলাতেন এবং ডিকটেট করতেন এখনও তেমনিই করছেন। তার অর্থ এখনও নির্ভরশীলতা কাটেনি। তবে একেবারেই যে কাটেনি, তা নয় । কয়েক বছর পূর্বে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিবৃন্দ পোশাক শিল্পের মালিকদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন- বাংলাদেশ যেহেতু তুলা উৎপাদন করে না তাই পশ্চাৎ সংযোগ (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) শিল্পের প্রয়োজন নেই। এমন উদ্ভট যুক্তি শোনা মাত্রই আমাদের শিল্পপতিরা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং বলেছিলেন- যে সমস্ত দেশে পোশাক শিল্প গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশই তুলা উৎপাদন করে না। এমনকি যেখানে পোশাক শিল্প দিয়েই শিল্প বিপ্লব হয়েছে কিংবা দেশকে শিল্পায়িত করেছে তারা কেউ তুলা উৎপাদনকারী দেশ নয়। পরে অবশ্য উপদেশকারীরা তাদের বক্তব্য তুলে নিয়েছিলেন।

দেশের অর্থনীতির প্রধানতম চালিকাশক্তি এ খাতে বর্তমানে তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। যার প্রধান কারণ হলো নিম্ন মজুরি, বেতন বৈষম্য, সময়মত বেতন প্রদান না করা, চাকরি হারানোর ভয়, শ্রমিক ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব। এছাড়াও আছে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ঘর-বাড়ি ভাড়া ঘন ঘন বৃদ্ধি, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা হয়রানি, নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি প্রভৃতি। শ্রমিক অসন্তোষের জন্য গার্মেন্ট বন্ধের গুজব ও স্বার্থান্বেষী এনজিওদের ভূমিকাও শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।

শ্রমিক অসন্তোষকে শুধুমাত্র বেতন বৃদ্ধির দাবি থেকেই আসেনি। এর পেছনে রয়েছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। পোশাক শিল্প খাতের অস্থিরতার কারণ যাই হোক না কেন এর জন্য দরকার সুষ্ঠু সমাধান। ইতিমধ্যে সরকার মালিক-শ্রমিককে আলোচনার টেবিলে এনেছে, সামান্য হলেও মজুরি বাড়িয়েছে, শিল্প পুলিশ গঠন করেছে। তথাপিও বলতে হয় সম্ভবত আনুকূল্যের পাল্লা মালিকদের দিকেই বেশি। শ্রমিকদেও কথা আন্তরিকভাবে ভাবার সময় এসেছে। যৌক্তিকভাবে বেতন বৃদ্ধিসহ ঈদেও আগে সময়মত বোনাস প্রদান, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি, আবাসন ও মেডিক্যাল ভাতা ইত্যাদিও ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে। এছাড়া দেশি-বিদেশী চক্রান্তকারীরা যাতে আমাদের এ শিল্পকে ধ্বংস করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আরো পড়ুন : ইউনূস-বাইডেন বৈঠক; যে বার্তা পেল বাংলাদেশ