ঢাকা ০২:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ছাত্র সমাজের প্রতি বল প্রয়োগ নয়, সহানুভূতি দেখান

সম্পাদকীয়
দেশে চলমান বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, স্থবির হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন হবে কষ্টসাধ্য, রফতানি খাতেও পড়েছে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনে মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট যোগাযোগসহ সব ধরনের লেনদেন বন্ধ থাকায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় শুধু চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসের প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। বিজিএমইএর সভাপতি এই ক’দিনের স্থবিরতায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হওয়ার কথা বলেছেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার ঘটনায় অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, অগ্নিসংযোগে বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানে হাজার কোটি টাকা ক্ষতির কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। এ কথা সত্যি যে, দেশের অর্থনীতি আগে থেকে সঙ্কটে ছিল, এখন পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। বর্হিবিশে^ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি এ আন্দোলনে দেশের দুই শতাধিক ছাত্র-শ্রমিক-মজুর-পথচারী এমনকি ঘরের মধ্যে থেকে নিষ্পাপ শিশুও মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থনীতি মানে আমদানি-রফতানি, মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়। কিন্তু এই বিপুল প্রাণহানি ঘটলো, তাদের জীবনের যেন কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই? দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা, জীবনমান, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার যেন কোনো মূল্য নেই। কেন ছাত্রদের প্রতি সমর্থন দিয়ে সাড়া দেশের লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, কেনইবা গুলির সামনে উদীয়মান তরুণরা বুক পেতে দিলেন সে প্রসঙ্গে যাদের ভাববার কথা তারাই যেন শুধু অর্থনীতি ক্ষতির বিষয়েই রয়েছেন বেশি সোচ্চার।

কেন কোটার মতো ছোট্ট একটি ইস্যুতে দেশব্যাপী এত বড় আন্দোলন হলো, এত মানুষকে জীবন দিতে হলো, কেনইবা এত সম্পদের ক্ষতি হলো দেশের, কেনইবা বিশ্ব মানচিত্রে বাংলদেশের মান দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে, কেন অর্থনীতির সব সূচকে দেশটি বিশ্বের র‌্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে?

ছাত্রদের সর্বশেষ কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোটা আন্দোলনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অনেক বঞ্চনার চাপা দীর্ঘশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শহরে আশ্রয়হীন ছাত্ররা বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পান না। মানসম্মত খাওয়া নেই, লাইব্রেরিতে পড়ার জায়গা নেই, বই নেই, গণরুম নামক বন্ধিশালায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের শর্তে জায়গা পাওয়া, বড় ভাইদের সম্মান করার পদ্ধতি শিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে থেরাপির শিকার হওয়া ইত্যাদি তো রয়েছে। পদে পদে বঞ্চনা ও বৈষম্যের স্বীকার আছে। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন তারা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এত কিছু মেনে নিয়েও তারা এগোচ্ছিলেন। আশায় বুক বাঁধেন চাকরি নামক সোনার হরিণের জন্য। কোটার নামে সে আশায় যখন গুড়েবালি হওয়ার আশঙ্ক দেখা দেয় তখন তারা বসে থাকতে পারেননি। তার উপরে স্বজনপ্রীতি, প্রশ্ন ফাঁস ইত্যাদি তো রয়েছেই। সরকারকে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে।

কোটা সংস্কারের মতো নির্দোষ, নির্দলীয়, রাজনীতির গন্ধহীন একটা নির্দিষ্ট দাবি ঘিরে এত বড় একটা ঘটনাও মূলত সরকারের জনগণের মনোভাব বুঝতে না পারার ফল। এছাড়া আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার মনোভাব হিতে বিপরীত হয়েছে।
দেশে গত কয়েক দশকের ইতিহাসে মাত্র অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এত মানুষের মৃত্যু কখনো ঘটেনি। স্বাধীনতা-পূর্ব ঊনসত্তরের তিন মাসের গণ-আন্দোলনেও এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়নি। এর কারণ হয়তো এবারের আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। অথচ নিশ্চয়ই বল প্রয়োগের বিকল্প ছিল।

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে দেশের সম্পদ বিনষ্টের পাশাপাশি প্রাণহানির যে ক্ষতি হলো, ঝরে গেল অসংখ্য মেধাবী প্রাণ, তাদের ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে? সরকারকে আরো উপলব্ধি করতে হবে, কেন দেশের আগামীর ভবিষ্যত ছাত্র সমাজ বুলেটের সামনে নির্ভয়ে বুক পেতে দিয়েছেন? ছাত্র সমাজের প্রতি বল প্রয়োগ নয়, সহানুভূতি দেখান, তা না হলে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে আমার প্রিয় মাতৃভূমি।

আরো পড়ুন : প্রশ্ন ফাঁসে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

ছাত্র সমাজের প্রতি বল প্রয়োগ নয়, সহানুভূতি দেখান

আপডেট সময় ১১:২১:২৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৪

সম্পাদকীয়
দেশে চলমান বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনে অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, স্থবির হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন হবে কষ্টসাধ্য, রফতানি খাতেও পড়েছে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনে মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট যোগাযোগসহ সব ধরনের লেনদেন বন্ধ থাকায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় শুধু চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসের প্রায় ১ হাজার ১০৮ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে। বিজিএমইএর সভাপতি এই ক’দিনের স্থবিরতায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হওয়ার কথা বলেছেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার ঘটনায় অনেক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, অগ্নিসংযোগে বিদ্যুৎ খাতের প্রতিষ্ঠানে হাজার কোটি টাকা ক্ষতির কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী। এ কথা সত্যি যে, দেশের অর্থনীতি আগে থেকে সঙ্কটে ছিল, এখন পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। বর্হিবিশে^ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি এ আন্দোলনে দেশের দুই শতাধিক ছাত্র-শ্রমিক-মজুর-পথচারী এমনকি ঘরের মধ্যে থেকে নিষ্পাপ শিশুও মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থনীতি মানে আমদানি-রফতানি, মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়। কিন্তু এই বিপুল প্রাণহানি ঘটলো, তাদের জীবনের যেন কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই? দেশের মানুষের বাক-স্বাধীনতা, জীবনমান, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার যেন কোনো মূল্য নেই। কেন ছাত্রদের প্রতি সমর্থন দিয়ে সাড়া দেশের লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, কেনইবা গুলির সামনে উদীয়মান তরুণরা বুক পেতে দিলেন সে প্রসঙ্গে যাদের ভাববার কথা তারাই যেন শুধু অর্থনীতি ক্ষতির বিষয়েই রয়েছেন বেশি সোচ্চার।

কেন কোটার মতো ছোট্ট একটি ইস্যুতে দেশব্যাপী এত বড় আন্দোলন হলো, এত মানুষকে জীবন দিতে হলো, কেনইবা এত সম্পদের ক্ষতি হলো দেশের, কেনইবা বিশ্ব মানচিত্রে বাংলদেশের মান দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে, কেন অর্থনীতির সব সূচকে দেশটি বিশ্বের র‌্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পৌঁছে যাচ্ছে?

ছাত্রদের সর্বশেষ কোটা আন্দোলন যে শুধু চাকরির জন্য, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কোটা আন্দোলনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অনেক বঞ্চনার চাপা দীর্ঘশ্বাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শহরে আশ্রয়হীন ছাত্ররা বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পান না। মানসম্মত খাওয়া নেই, লাইব্রেরিতে পড়ার জায়গা নেই, বই নেই, গণরুম নামক বন্ধিশালায় দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের শর্তে জায়গা পাওয়া, বড় ভাইদের সম্মান করার পদ্ধতি শিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে থেরাপির শিকার হওয়া ইত্যাদি তো রয়েছে। পদে পদে বঞ্চনা ও বৈষম্যের স্বীকার আছে। নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন তারা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। এত কিছু মেনে নিয়েও তারা এগোচ্ছিলেন। আশায় বুক বাঁধেন চাকরি নামক সোনার হরিণের জন্য। কোটার নামে সে আশায় যখন গুড়েবালি হওয়ার আশঙ্ক দেখা দেয় তখন তারা বসে থাকতে পারেননি। তার উপরে স্বজনপ্রীতি, প্রশ্ন ফাঁস ইত্যাদি তো রয়েছেই। সরকারকে বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে।

কোটা সংস্কারের মতো নির্দোষ, নির্দলীয়, রাজনীতির গন্ধহীন একটা নির্দিষ্ট দাবি ঘিরে এত বড় একটা ঘটনাও মূলত সরকারের জনগণের মনোভাব বুঝতে না পারার ফল। এছাড়া আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করার মনোভাব হিতে বিপরীত হয়েছে।
দেশে গত কয়েক দশকের ইতিহাসে মাত্র অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে এত মানুষের মৃত্যু কখনো ঘটেনি। স্বাধীনতা-পূর্ব ঊনসত্তরের তিন মাসের গণ-আন্দোলনেও এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়নি। এর কারণ হয়তো এবারের আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। অথচ নিশ্চয়ই বল প্রয়োগের বিকল্প ছিল।

রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে দেশের সম্পদ বিনষ্টের পাশাপাশি প্রাণহানির যে ক্ষতি হলো, ঝরে গেল অসংখ্য মেধাবী প্রাণ, তাদের ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে? সরকারকে আরো উপলব্ধি করতে হবে, কেন দেশের আগামীর ভবিষ্যত ছাত্র সমাজ বুলেটের সামনে নির্ভয়ে বুক পেতে দিয়েছেন? ছাত্র সমাজের প্রতি বল প্রয়োগ নয়, সহানুভূতি দেখান, তা না হলে ভবিষ্যতে হয়তো এর চেয়েও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে আমার প্রিয় মাতৃভূমি।

আরো পড়ুন : প্রশ্ন ফাঁসে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক