ঢাকা ০৭:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সৎ-নীতিবান অফিসাররাই উচ্চতর পদোন্নতির দাবিদার : প্রধান উপদেষ্টা পূজামণ্ডপে ব্যাগ-থলে-পোটলা প্রবেশে বিরত থাকতে বলেছে পুলিশ শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, দুই ভাইয়ের লাশ উদ্ধার তারেক রহমানের মামলার ভবিষ্যত :বিএনপির আইন সম্পাদক ইরানে পাল্টা হামলা চালাবে ইসরায়েল : নেতানিয়াহু ঝুলে আছে বেসরকারি খাতে ১০ গ্রিড সংযুক্ত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে দরপত্র আহ্বান দাম্পত্য ভাঙনের পথে,ঐশ্বরিয়ার ডায়েরির পাতায় কী লেখা সেখানে? সংসদের মেয়াদ চার বছর ও দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট করার প্রস্তাব গণঅধিকার পরিষদের  গ্রেপ্তার আতঙ্ক আ.লীগ নেতা-কর্মীদের পাকিস্তানে সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষ, নিহত ১২

বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
(১০ জুলাই ১৮৮৫-১৩ জুলাই ১৯৬৯)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
জন্ম :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বাঙালি বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন।

শিক্ষাজীবন :
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান সহ বি.এ এবং ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সর্বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা :
ফুরফুরা শরীফের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক শিক্ষক মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকির নিকট আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং খেলাফত লাভ করেন।

কর্মজীবন :
এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বেদ পঠনের অনুমতি দেননি পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। স্যার আশুতোষের চেষ্টায় ও কলিকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি বেদপাঠের সুযোগ পান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩-১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রায় ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। এর মধ্যে ১৮টি ভাষার ওপর তার উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্য ছিল। উল্লেখযোগ্য ভাষাসমূহ হলো- বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি, ইংরেজি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি।

উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।

সাহিত্য :
শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ভাষা ও সাহিত্য, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, দীওয়ানে হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নবী করিম মুহাম্মাদ, ইসলাম প্রসঙ্গ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ,মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন।
ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা :

বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচ্যে অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র স্মরণীয় উক্তি ছিল, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী”।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যে ক’জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়।

আরবি হরফে বাংলার ব্যাপারে বিরোধিতা :
মূল নিবন্ধ: আরবি হরফে বাংলা লিখন
১৯৪৭ দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে ফজলুর রহমান ভাষার ইসলামিকরণের স্বার্থে বাংলাকে আরবি লিপিতে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বাংলাকে অপরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব বাংলা রাষ্ট্রভাষা তথা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব :
মূল নিবন্ধ: আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব
মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন যে, বাঙালিরা ইংরেজি শেখার সাথে সাথে উর্দু শিখতে পারে, তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে: “যেদিন আরবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি ন্যায়সঙ্গত হবে।” তাই ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি এ লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আরবি ভাষা সংঘের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান গণ পরিষদে পেশ করার জন্য একটি খসড়া স্মারকলিপি অনুমোদন করেন। তাতে আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন এবং জেলায় জেলায় “দরসে কুরআন” এর মাধ্যমে আরবি শেখানোর প্রস্তাব করেন।

পুরস্কার :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক (১৯৫৮)’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। তিনি ‘চলন্ত শব্দ কল্পদ্রুম’ বলেও পরিচিত।

মৃত্যু :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।

আরো পড়ুন : আহমদ ছফা; সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সৎ-নীতিবান অফিসাররাই উচ্চতর পদোন্নতির দাবিদার : প্রধান উপদেষ্টা

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

আপডেট সময় ১০:১৮:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ জুলাই ২০২৪

বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
(১০ জুলাই ১৮৮৫-১৩ জুলাই ১৯৬৯)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
জন্ম :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বাঙালি বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ছিলেন।

শিক্ষাজীবন :
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান সহ বি.এ এবং ১৯১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়াও ১৯২৮ সালে তিনি প্যারিসের সর্বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি ১৯১০ সালে যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

আধ্যাত্মিক শিক্ষা :
ফুরফুরা শরীফের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক শিক্ষক মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকির নিকট আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং খেলাফত লাভ করেন।

কর্মজীবন :
এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যশোর জেলা স্কুলের শিক্ষক (১৯০৮-০৯) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে কিছুদিন প্রধান শিক্ষকের (১৯১৪-১৯১৫) দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১০ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে বেদ পঠনের অনুমতি দেননি পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী। স্যার আশুতোষের চেষ্টায় ও কলিকাতা উচ্চ আদালতের নির্দেশে তিনি বেদপাঠের সুযোগ পান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩-১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রায় ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। এর মধ্যে ১৮টি ভাষার ওপর তার উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্য ছিল। উল্লেখযোগ্য ভাষাসমূহ হলো- বাংলা, উর্দু, ফারসি, আরবি, ইংরেজি, অসমীয়া, ওড়িয়া, মৈথিলী, হিন্দি, পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠি, কাশ্মীরি, নেপালি, সিংহলি, তিব্বতি, সিন্ধি, সংস্কৃত, পালি ইত্যাদি।

উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।

সাহিত্য :
শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ভাষা ও সাহিত্য, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, দীওয়ানে হাফিজ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, নবী করিম মুহাম্মাদ, ইসলাম প্রসঙ্গ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, ,মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন।
ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা :

বহু ভাষাবিদ, পণ্ডিত ও প্রাচ্যে অন্যতম সেরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জাতিসত্তা সম্পর্কে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র স্মরণীয় উক্তি ছিল, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী”।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যে ক’জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়।

আরবি হরফে বাংলার ব্যাপারে বিরোধিতা :
মূল নিবন্ধ: আরবি হরফে বাংলা লিখন
১৯৪৭ দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৪৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলনে ফজলুর রহমান ভাষার ইসলামিকরণের স্বার্থে বাংলাকে আরবি লিপিতে লেখার প্রস্তাব করেছিলেন এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জটিলতা বৃদ্ধির আশঙ্কা করে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বাংলাকে অপরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব বাংলা রাষ্ট্রভাষা তথা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।

আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব :
মূল নিবন্ধ: আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব
মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন যে, বাঙালিরা ইংরেজি শেখার সাথে সাথে উর্দু শিখতে পারে, তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে: “যেদিন আরবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি ন্যায়সঙ্গত হবে।” তাই ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি এ লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আরবি ভাষা সংঘের সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তান গণ পরিষদে পেশ করার জন্য একটি খসড়া স্মারকলিপি অনুমোদন করেন। তাতে আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন এবং জেলায় জেলায় “দরসে কুরআন” এর মাধ্যমে আরবি শেখানোর প্রস্তাব করেন।

পুরস্কার :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক (১৯৫৮)’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। তিনি ‘চলন্ত শব্দ কল্পদ্রুম’ বলেও পরিচিত।

মৃত্যু :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তার নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।

আরো পড়ুন : আহমদ ছফা; সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ