ঢাকা ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শহীদ কাদরী; নিজস্ব স্বকীয়তার এক অনন্য কবি

শহীদ কাদরী
নিজস্ব স্বকীয়তার এক অনন্য কবি
(১৪ আগস্ট ১৯৪২-২৮ আগস্ট ২০১৬)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

শহীদ কাদরী। ছিলেন কবি ও লেখক। তিনি ১৯৪৭ পরবর্তীকালের বাঙালি কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ এবং প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি তার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যেকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কাব্যে। তার কবিতায় অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সুক্ষèতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় সুস্পষ্ট।

প্রাথমিক জীবন:
শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে ভারত) রাজধানী কলিকাতা শহরের পার্ক সার্কাসে জন্ম নেন। কলিকাতা শহরে তার শৈশব কাটান। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের দিকে দশ বছর বয়সে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। এরপর প্রায় তিন দশক তিনি ঢাকা শহরে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৮ সাল থেকে প্রবাসজীবন শুরু করেন। তিনি বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিউইয়র্কে বসবাস করেছেন। তাঁর দাম্পত্যসঙ্গী ছিলেন নাজমুন নেসা পিয়ারি।

সাহিত্য জীবন:
এগারো বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তিনি ‘পরিক্রমা’ শিরোনােম তার প্রথম কবিতা রচনা করেন যা মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’ কাগজে ছাপা হয়েছিল। এরপর ‘জলকন্যার জন্য’ শিরোনামে কবিতা লিখেন, এবং একই কাগজে ছাপতে দেন। এভাবে নিয়মিত অনিয়মিতভাবে তার কবিতা লেখা চলতে থাকে। এরপর শহীদ কাদরী লিখেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখেছেন খুবই অল্প। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। এই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। আবার গ্রন্থ চারটির প্রকাশকাল দেখেও আমরা বিস্মিত হই। প্রথমটি অর্থাৎ উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে যখন কবির বয়স ২৫ বছর । দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’ নামক গ্রন্থ। এর প্রায় ৩০ বছর পরে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ গ্রন্থটি।

তাঁর কবিতার সংখ্যা, গ্রন্থের সংখ্যা আর এক গ্রন্থ থেকে অন্য গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় কবির প্রতি, সেইসঙ্গে আফসোসও হয়, কবি আরো কেন ভরিয়ে দিলেন না তাঁর সৃজনের উঠোন-বারান্দা। অবশ্য একজন কবির সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তাঁর কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল।

পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। যেমন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। আর একজন বিখ্যাত কবি জঁ আর্তুর র্যাঁবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের ধারায় এক সংযোজন বলতে পারি শহীদ কাদরীকে।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে সংখ্যার একটা প্রচলিত ব্যাপার থাকলেও শহীদ কাদরী তাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন লেখকের প্রধান কথাগুলো বলে ফেলবার জন্যে ৫০-৬০টি গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ একথা সত্য যে, শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পুনরাবৃত্তি পাই না। এক গ্রন্থ থেকে আরেক গ্রন্থে থেকেছে চিমত্মার নতুনত্ব। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিশেষ বাঁকবদল। এই অল্পকটি কবিতায় কবি আমাদের যা দিয়েছেন, তা অসামান্য আর অতুলনীয়।

পুরস্কার :
শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন।

মৃত্যু :
শহীদ কাদরী ২০১৬ সালে ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন।

শহীদ কাদরীর কবিতাগুচ্ছ

আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও

হে নবীনা, এই মধ্য-ম্যানহাটানে বাতাসের ঝাপটায়
তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল
আমার বুকের ‘পর আছড়ে পড়লো
চিরকালের বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতন।

তোমার জবার মতো চোখে রাঙা শ্রাবণের জল
পালতোলা নৌকার মতন বাঁকাচোরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে কম্পমান
তোমার বিপদগ্রস্ত স্তন।
আমি ভাবতে পারি নি কোনোদিন এতো অসাধারণ আগুন
প্রলয় এবং ধ্বংস রয়েছে তোমার চুম্বনগুলিতে।

হে নবীনা,
আমার তামাটে তিক্ত ওষ্ঠের ও অবয়বের জন্যে
যেসব চুম্বন জমে উঠবে সংগোপনে,
তাদের ওপর থেকে আমার স্বত্বাধিকার আমি ফিরিয়ে নিলাম
আমাকে শীতের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দাও,
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু
শুধু তুমি,
আমার সংরক্ট চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।

হন্তারকদের প্রতি
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।

 

সঙ্গতি
(অমিয় চক্রবর্তী, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু’জন একঘরে পাবে ঠাঁই
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…

 

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।
ভয় নেই-আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

আরো পড়ুন : প্রমথ চৌধুরী; গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

শহীদ কাদরী; নিজস্ব স্বকীয়তার এক অনন্য কবি

আপডেট সময় ০১:০২:৫৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ অগাস্ট ২০২৪

শহীদ কাদরী
নিজস্ব স্বকীয়তার এক অনন্য কবি
(১৪ আগস্ট ১৯৪২-২৮ আগস্ট ২০১৬)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

শহীদ কাদরী। ছিলেন কবি ও লেখক। তিনি ১৯৪৭ পরবর্তীকালের বাঙালি কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যিনি নাগরিক-জীবন-সম্পর্কিত শব্দ চয়নের মাধ্যমে বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন। তিনি আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক অভিব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ববোধ এবং প্রকৃতি ও নগর জীবনের অভিব্যক্তি তার কবিতার ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যেকে বৈশিষ্ট্যায়িত করেছে। শহর এবং তার সভ্যতার বিকারকে তিনি ব্যবহার করেছেন তার কাব্যে। তার কবিতায় অনুভূতির গভীরতা, চিন্তার সুক্ষèতা ও রূপগত পরিচর্যার পরিচয় সুস্পষ্ট।

প্রাথমিক জীবন:
শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমানে ভারত) রাজধানী কলিকাতা শহরের পার্ক সার্কাসে জন্ম নেন। কলিকাতা শহরে তার শৈশব কাটান। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের দিকে দশ বছর বয়সে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। এরপর প্রায় তিন দশক তিনি ঢাকা শহরে অবস্থান করেন এবং ১৯৭৮ সাল থেকে প্রবাসজীবন শুরু করেন। তিনি বার্লিন, লন্ডন, বোস্টন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নিউইয়র্কে বসবাস করেছেন। তাঁর দাম্পত্যসঙ্গী ছিলেন নাজমুন নেসা পিয়ারি।

সাহিত্য জীবন:
এগারো বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তিনি ‘পরিক্রমা’ শিরোনােম তার প্রথম কবিতা রচনা করেন যা মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’ কাগজে ছাপা হয়েছিল। এরপর ‘জলকন্যার জন্য’ শিরোনামে কবিতা লিখেন, এবং একই কাগজে ছাপতে দেন। এভাবে নিয়মিত অনিয়মিতভাবে তার কবিতা লেখা চলতে থাকে। এরপর শহীদ কাদরী লিখেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু লিখেছেন খুবই অল্প। তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা চার। এই চারটি গ্রন্থে কবিতা রয়েছে ১৫০টির মতো। আবার গ্রন্থ চারটির প্রকাশকাল দেখেও আমরা বিস্মিত হই। প্রথমটি অর্থাৎ উত্তরাধিকার প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে যখন কবির বয়স ২৫ বছর । দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। এরপর ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’ নামক গ্রন্থ। এর প্রায় ৩০ বছর পরে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ গ্রন্থটি।

তাঁর কবিতার সংখ্যা, গ্রন্থের সংখ্যা আর এক গ্রন্থ থেকে অন্য গ্রন্থের মধ্যে ব্যবধান আমাদের শ্রদ্ধা জাগায় কবির প্রতি, সেইসঙ্গে আফসোসও হয়, কবি আরো কেন ভরিয়ে দিলেন না তাঁর সৃজনের উঠোন-বারান্দা। অবশ্য একজন কবির সৃষ্টি-সংখ্যা দিয়ে তাঁর কৃতিত্ব বিচার্য নয়, তাঁর সৃষ্টিটাই আসল।

পৃথিবী বিখ্যাত অনেক কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের গ্রন্থসংখ্যা খুবই অল্প। যেমন জগদ্বিখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ারের বইয়ের সংখ্যা একটাই (লে ফ্লর দ্যু মাল)। কবিতার সংখ্যা ১৮০টি। আর একজন বিখ্যাত কবি জঁ আর্তুর র্যাঁবো। তাঁর বই মাত্র দুটি। এই বিরলপ্রজ কবিদের ধারায় এক সংযোজন বলতে পারি শহীদ কাদরীকে।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে সংখ্যার একটা প্রচলিত ব্যাপার থাকলেও শহীদ কাদরী তাতে বিশ্বাস করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন লেখকের প্রধান কথাগুলো বলে ফেলবার জন্যে ৫০-৬০টি গ্রন্থের প্রয়োজন হয় না। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সাধারণত দেখা যায় কি, লেখকেরা তাদের প্রধান লেখাগুলোর পর সব পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।’ একথা সত্য যে, শহীদ কাদরীর কবিতায় আমরা পুনরাবৃত্তি পাই না। এক গ্রন্থ থেকে আরেক গ্রন্থে থেকেছে চিমত্মার নতুনত্ব। প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিশেষ বাঁকবদল। এই অল্পকটি কবিতায় কবি আমাদের যা দিয়েছেন, তা অসামান্য আর অতুলনীয়।

পুরস্কার :
শহীদ কাদরী ১৯৭৩ সালে বাংলা কবিতায় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১১ সালে ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক লাভ করেন।

মৃত্যু :
শহীদ কাদরী ২০১৬ সালে ২৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুবরণ করেন।

শহীদ কাদরীর কবিতাগুচ্ছ

আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও

হে নবীনা, এই মধ্য-ম্যানহাটানে বাতাসের ঝাপটায়
তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল
আমার বুকের ‘পর আছড়ে পড়লো
চিরকালের বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতন।

তোমার জবার মতো চোখে রাঙা শ্রাবণের জল
পালতোলা নৌকার মতন বাঁকাচোরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে কম্পমান
তোমার বিপদগ্রস্ত স্তন।
আমি ভাবতে পারি নি কোনোদিন এতো অসাধারণ আগুন
প্রলয় এবং ধ্বংস রয়েছে তোমার চুম্বনগুলিতে।

হে নবীনা,
আমার তামাটে তিক্ত ওষ্ঠের ও অবয়বের জন্যে
যেসব চুম্বন জমে উঠবে সংগোপনে,
তাদের ওপর থেকে আমার স্বত্বাধিকার আমি ফিরিয়ে নিলাম
আমাকে শীতের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দাও,
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু
শুধু তুমি,
আমার সংরক্ট চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।

হন্তারকদের প্রতি
বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়,
বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়
না, কোনো উপমায় তদের গ্রেপ্তার করা যাবে না
তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম
বুট, সৈনিকের টুপি,
বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের কথাও হয়েছিলো,
তারা ব্যবহার করেছিল
এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো
বাংলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো
দেখতে, এবং ওরা মানুষই
ওরা বাংলা মানুষ
এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন।

 

সঙ্গতি
(অমিয় চক্রবর্তী, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…
ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু’জন একঘরে পাবে ঠাঁই
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না…

 

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।
ভয় নেই-আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!
সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

আরো পড়ুন : প্রমথ চৌধুরী; গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক