ঢাকা ০৪:৩১ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহররমের শিক্ষা; মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা

মহররমের শিক্ষা
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন
মহররম। ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিস্টর্ধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার অধিকারী। কেননা এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি।

মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিনে মিলিত হন। হজরত ইদ্রিসকে (আ.) এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘদিন পর এই দিন পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হজরত মুসা (আ.) এই দিনে তুর পর্বতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। মিসরের জালিম শাসক ফেরাউনের সদলবলে সলিল সমাধি ঘটে এই দিনে। আর হজরত মুসার (আ.) সঙ্গে বনি ইসরায়েল ফেরাউনের কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে।

এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবছর আশুরার দিনটি। এমনকি কিয়ামতও এই দিনেই সংঘটিত হবে বলে মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা এই দিনের অন্য সব স্মৃতিকে মøান করে দিয়েছে। সর্বশেষ বাণীবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদরের নাতি, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও জান্নাতে রমণীকুলের নেত্রী হজরত ফাতেমার (রা.) নয়নমণি হজরত হোসনে (রা.) কারবালা প্রান্তরে এই দিনে এজিদের নির্দেশে সীমারের হাসে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। এজিদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পদ্ধতি হজরত হোসেন (রা.) সমর্থন করেননি। কুফার বাসিন্দারা তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই কুফাকে কেন্দ্র করে ইসলামি খেলাফতের অকৃত্রিম ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা থেকে রওনা হয়ে কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হলে বাধার মুখে পড়েন উবায়দুল্লাহ বাহিনীর সামনে। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর যে মোকাবিলা হয়, তাতে এক দিকে ছিল প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় হোসেন (রা.) বাহিনী। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। অন্য পক্ষে ছিল বিশাল সশস্ত্র যুদ্ধবাহিনী। নিতান্ত অসম যুদ্ধে নবী পরিবারের প্রায় সবাই শহিদ হন। সবচেয়ে নির্মমতার শিকার হন স্বয়ং হজরত হোসেন (রা.)। উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে তিনি পান করেন শাহাদতের অমিয় সুধা। কিন্তু তিনি রেখে যান মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুপম আদর্শ। হজরত হোসেনের (রা.) শাহাদাত ছিল প্রকৃতপক্ষে এজিদের মৃত্যু। কারবালার বিযোগান্তক ঘটনার পর ইসলাম নতুনভাবে সজীব হয়।

এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। এমনকি কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, মহাকাব্য ও উপন্যাস। কিন্তু আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) সহ কয়েকজন সাহাবি বর্ণনা করেছেন, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ ছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করে এসে দেখতে পান ইহুদিরা এ দিনটিতে রোজা রাখে। তিনি জানতে পারেন, এদিনেই হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরায়েলকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করে ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) প্রতি বছর এ দিনে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা হিসেবে রোজা রাখতেন। মহানবী (সা.) তখন ইরশাদ করেন, হজরত মুসার (আ.) প্রতি আমাদের কর্তব্য আরো বেশি। এই বলে তিনি রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এখন এ দিনের রোজা ফরজ নেই। অবশ্য অত্যন্ত ফজিলতের নফল রোজা হিসেবে বহাল আছে।

সুতরাং আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। হজরত হোসেনের (রা.) আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন। এখন মুসলিম বিশ্বে কারবালার ময়দান একটা নয়, অনেক। একাধিক স্থানে প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কারবালার মতোই মর্মন্তুদ ঘটনা। ফিলিস্তিন, মিয়ানমার সহ বিশ্বের অনেক দেশে, অনেক স্থানে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। অন্তঃকলহ ও বিভক্তির মাঝে পড়ে মুসলিম উম্মাহ শোচনীয় দুর্দশায় নিমজ্জিত। সে ধর্মীয় বন্ধন তাদের পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের মাধ্যম, তার প্রতি ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা এখন অনেকটাই দুর্বল। সুতরাং মর্সিয়া আর ক্রন্দন নয়, এখন চাই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণ সাধনের প্রতিজ্ঞা।

আরো পড়ুন : অবৈধ আয়! কি বলে ইসলাম?

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

তারেক রহমানের মামলার ভবিষ্যত :বিএনপির আইন সম্পাদক

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

মহররমের শিক্ষা; মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা

আপডেট সময় ০৪:৪০:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১২ জুলাই ২০২৪

মহররমের শিক্ষা
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন
মহররম। ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। এ মাসের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিস্টর্ধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার অধিকারী। কেননা এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি।

মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিনে মিলিত হন। হজরত ইদ্রিসকে (আ.) এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘদিন পর এই দিন পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হজরত মুসা (আ.) এই দিনে তুর পর্বতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। মিসরের জালিম শাসক ফেরাউনের সদলবলে সলিল সমাধি ঘটে এই দিনে। আর হজরত মুসার (আ.) সঙ্গে বনি ইসরায়েল ফেরাউনের কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে।

এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতিবছর আশুরার দিনটি। এমনকি কিয়ামতও এই দিনেই সংঘটিত হবে বলে মহানবী (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা এই দিনের অন্য সব স্মৃতিকে মøান করে দিয়েছে। সর্বশেষ বাণীবাহক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদরের নাতি, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও জান্নাতে রমণীকুলের নেত্রী হজরত ফাতেমার (রা.) নয়নমণি হজরত হোসনে (রা.) কারবালা প্রান্তরে এই দিনে এজিদের নির্দেশে সীমারের হাসে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। এজিদের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পদ্ধতি হজরত হোসেন (রা.) সমর্থন করেননি। কুফার বাসিন্দারা তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তাই কুফাকে কেন্দ্র করে ইসলামি খেলাফতের অকৃত্রিম ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে তিনি মক্কা থেকে রওনা হয়ে কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত হলে বাধার মুখে পড়েন উবায়দুল্লাহ বাহিনীর সামনে। সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর যে মোকাবিলা হয়, তাতে এক দিকে ছিল প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় হোসেন (রা.) বাহিনী। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। অন্য পক্ষে ছিল বিশাল সশস্ত্র যুদ্ধবাহিনী। নিতান্ত অসম যুদ্ধে নবী পরিবারের প্রায় সবাই শহিদ হন। সবচেয়ে নির্মমতার শিকার হন স্বয়ং হজরত হোসেন (রা.)। উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে তিনি পান করেন শাহাদতের অমিয় সুধা। কিন্তু তিনি রেখে যান মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুপম আদর্শ। হজরত হোসেনের (রা.) শাহাদাত ছিল প্রকৃতপক্ষে এজিদের মৃত্যু। কারবালার বিযোগান্তক ঘটনার পর ইসলাম নতুনভাবে সজীব হয়।

এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। এমনকি কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, মহাকাব্য ও উপন্যাস। কিন্তু আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) সহ কয়েকজন সাহাবি বর্ণনা করেছেন, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা মুসলমানদের জন্য ফরজ ছিল। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় হিজরত করে এসে দেখতে পান ইহুদিরা এ দিনটিতে রোজা রাখে। তিনি জানতে পারেন, এদিনেই হজরত মুসা (আ.) বনি ইসরায়েলকে ফেরাউনের কবল থেকে উদ্ধার করে ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) প্রতি বছর এ দিনে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা হিসেবে রোজা রাখতেন। মহানবী (সা.) তখন ইরশাদ করেন, হজরত মুসার (আ.) প্রতি আমাদের কর্তব্য আরো বেশি। এই বলে তিনি রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদের রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর এখন এ দিনের রোজা ফরজ নেই। অবশ্য অত্যন্ত ফজিলতের নফল রোজা হিসেবে বহাল আছে।

সুতরাং আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। হজরত হোসেনের (রা.) আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন। এখন মুসলিম বিশ্বে কারবালার ময়দান একটা নয়, অনেক। একাধিক স্থানে প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কারবালার মতোই মর্মন্তুদ ঘটনা। ফিলিস্তিন, মিয়ানমার সহ বিশ্বের অনেক দেশে, অনেক স্থানে মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। অন্তঃকলহ ও বিভক্তির মাঝে পড়ে মুসলিম উম্মাহ শোচনীয় দুর্দশায় নিমজ্জিত। সে ধর্মীয় বন্ধন তাদের পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের মাধ্যম, তার প্রতি ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা এখন অনেকটাই দুর্বল। সুতরাং মর্সিয়া আর ক্রন্দন নয়, এখন চাই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণ সাধনের প্রতিজ্ঞা।

আরো পড়ুন : অবৈধ আয়! কি বলে ইসলাম?