মানবাধিকার শব্দটিকে ভাঙলে দুটি শব্দ পাওয়া যাবে- ‘মানব’ এবং ‘অধিকার’। অর্থাৎ, মানুষের অধিকার। সাধারণত মানবাধিকার বলতে মানুষের সেসব অধিকারকে বোঝায়, যা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করে, যা তাকে বিশিষ্টতা দান করে। এসব বিষয় হরণ করলে সে আর মানুষ থাকে না। অর্থাৎ, মানুষের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যে অধিকারগুলো দরকার, তা-ই মানবাধিকার। এই অধিকারগুলো সহজ, স্বাভাবিক ও সহজাত। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং সামাজিক জীব হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মানবাধিকার অপরিহার্য। মানবাধিকার প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদাকে সম্মান প্রদর্শনের মধ্যেই নিহিত।
শুধু তাই নয়, একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন গতিশীলতায় মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি অপরিহার্য। এটি এখন আধুনিক সভ্য মানুষের মূলমন্ত্র ও আদর্শ এবং তার পরিচিতি ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন নীতিনির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ধরনের পরিভাষা, যেমন- মৌলিক স্বাধীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং মানবীয় আচার-আচরণ, এমনকি নারী অধিকার ইত্যাদির ব্যাপক প্রভাব ও কার্যকারিতা রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান বিশ্বে প্রকৃত মানবাধিকার সংরক্ষিত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে? আজ বিশ্বে মানবাধিকার বলে যা কিছু করা হচ্ছে বা বলা হচ্ছে, আসলে তা প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মানবাধিকার নয়; বরং তা হচ্ছে খণ্ডিত। প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ শুধু তখনই সম্ভব হবে, যখন তা ‘মানুষ’-সংক্রান্ত প্রকৃত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন থেকে উৎসারিত হবে। সাধারণভাবে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে এ কথা সত্য। আয়ে বৈষম্য বৃদ্ধির মধ্যেই দারিদ্র্য হ্রাসের ধারাও অব্যাহত আছে। তার পরও ছিন্নমূল মানুষ, বস্তিবাসীর দৈনন্দিন জীবনে তার ছোঁয়া কমই লেগেছে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ও অবহেলিত প্রসঙ্গটি সম্ভবত মানবাধিকার। একদিকে যখন মানবাধিকার উন্নয়নে ব্যস্ত পুরো পৃথিবী, অন্যদিকে ঠিক তেমনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনাও ঘটে চলেছে চারপাশে। পশ্চিমা বিশ্ব আজ মানবাধিকারের ধুয়া তুলে নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন, লেবানন, ইরান তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। ইসরায়েলে বর্বরতা প্রতিনিয়ত গাজা ও লেবাননে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। তারপর আমেরিকা সহ উন্নত বিশ্ব হিসেবে খ্যাত রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের পক্ষে সাফাই গাইছে। পাশ্চাত্যের এই দ্বিমুখী নীতি বিশ্ববিবেকের কাছে মোটেও বিস্ময়কর ঠেকছে না।
বিশ্বের উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা মানবাধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নয়। ১৯৯৭ সালে ‘হিউম্যান রাইটস ইউএসএ’ নামের একটি সংগঠন পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, মাত্র ৮ শতাংশ বয়স্ক মানুষ এবং ৪ শতাংশ তরুণ সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা সম্বন্ধে অবহিত। ওই জরিপে আরো দেখা যায়, ৮৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করে, মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে সংগতি রেখে আমেরিকার অনেক কিছু করার আছে। ওই জরিপের তথ্য মতে, ৮৩ শতাংশ মনে করে, দরিদ্র মানুষ বৈষম্যের শিকার। ৬১ শতাংশ প্রতিবন্ধী, ৫৪ শতাংশ প্রবীণ এবং ৪১ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান অনুরূপ মত পোষণ করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছে। আর যারা মাটি কামড়ে পড়ে আছে, তারা ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এখনো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। মিয়ানমারে বছরের পর বছর রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। রোহিঙ্গারা আজ তাদের আদি নিবাসে বহিরাগত।
প্রতিটি দেশের নাগরিকদের বৈষম্য দূর করে সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব হয়ে উঠতে পারে প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি। আর বিশ্বে টেকসই নিরাপদ আবাসভূমি গড়তে হলে প্রয়োজন মানবাধিকার সুরক্ষা।
আরো পড়ুন : আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কী? বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব?