ঢাকা ০১:৫৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে কারণে বিজ্ঞানী আবদুস সালাম হারিয়ে যাচ্ছেন

১৯৭৯ সালে পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, যেটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা এখনও পদার্থবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হচ্ছে। বস্তুত এটিই ২০১২ সালের ‘হিগস বোসন’ কণা আবিষ্কারের ভিত্তি রচনা করেছিলো।

মি. সালাম ছিলেন প্রথম পাকিস্তানি, যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। সে হিসেবে এই অর্জনটি পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং এই কৃতিত্বের জন্য মি. সালামকে মনে রাখা উচিত ছিল।

কিন্তু মনে রাখার বদলে মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে নিজ জন্মভূমিই মি. সালামকে ভুলে গেছে। আর এভাবে ভুলে যাওয়ার কারণ তার ধর্ম বিশ্বাস।

কয়েক বছর আগে তার উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে মি. সালামকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷

“সালামই প্রথম মুসলিম যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন,” চলচ্চিত্রটির অন্যতম প্রযোজক জাকির থাভার বিবিসি কালচারকে বলেন।

“তিনি তার শিকড়ের প্রতি এবং দেশের মানুষের দুর্দশার উন্নতির জন্য এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, স্টকহোমে সুইডেনের রাজার কাছ থেকে (নোবেল) পুরস্কার নেওয়ার সময়ও তিনি পাগড়ি পরেছিলেন।”

এমনকি নোবেল ভোজসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়ও মি. সালাম কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

চলচ্চিত্রটিতে তিনটি বিষয়ের প্রতি মি. সালামের অধ্যাবসায় ও আত্মত্যাগ তুলে ধরা হয়েছে।সেগুলো হচ্ছে: পদার্থবিজ্ঞান, তার বিশ্বাস এবং জাতীয়তা।

সালাম ১৯২৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ঝাং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষক পিতার বিশ্বাস ছিল যে তার সন্তানের জন্ম স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া একটি স্বপ্নের ফল, যেটি তিনি শুক্রবারে জুমার প্রার্থনার সময় পেয়েছিলেন।ফলে ছোটবেলা থেকে পরিবারের সদস্যরা তাকে আলাদা নজরে দেখতেন এবং আদর যত্ন করতেন।

নিয়মিত পারিবারিক কাজ, যেমন: গরুর দুধ সংগ্রহ বা গোবর পরিষ্কার করা ইত্যাদি থেকে তাকে বিরত রাখা হয়েছিলো। ফলে মি. সালাম গণিতে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

তবে খুব বেশি বিলাসী শৈশব তিনি পাননি। সরকারি কলেজে পড়ার জন্য নিজ শহর ছেড়ে যখন মি. সালাম লাহোরে গিয়েছিলেন সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক বাতি দেখেছিলেন।

কলেজে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা তাকে অন্যান্য সহপাঠীদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।

পরে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পান। এছাড়া দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে তখন যে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী সেন্ট জোনস কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, মি. সালাম তাদেরই একজন।

কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি টান ছিল প্রবল। ফলে ডক্টরেট ডিগ্রি শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং লাহোরে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়
জীবনভর সালাম ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম। লন্ডনে নিজের অফিসে বসেও তিনি কোরান শুনতেন। বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে ধর্ম কখনোই তার জীবনে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে এ দু’টির একটি অপরটির সহায়ক বলেই মনে করছেন মি. সালাম।

সহকর্মীদের কাছে তিনি এমন দাবিও করেছিলেন যে, বিজ্ঞান গবেষণায় তার অনেক আইডিয়া বা ধারণাই এসেছে সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে।

তিনি মূলত এমন একটি তত্ত্ব আবিষ্কারের প্রয়াস চালাচ্ছিলেন, যেটি সমগ্র পার্টিকেল ফিজিক্স বা কণা পদার্থবিদ্যাকে ব্যাখ্যা করবে। এটি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

“আমরা (তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা) কিছু মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে জড় পদার্থের সমস্ত জটিলতাকে যতটা সম্ভব বুঝতে চাই,” একবার বলেছিলেন সালাম। যদিও বিগ ব্যাং তত্ত্বের মতো বিজ্ঞানের কিছু বিষয় তার ধর্ম বিশ্বাসের সাথে যায় না বলেও মেনে নিয়েছিলেন তিনি।

নিজের ধর্ম বিশ্বাস সালামের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও ধর্ম বিশ্বাসের কারণ তাকে অনেক নিপীড়ন ও বৈষম্য সহ্য করতে হয়েছে।

বিশেষ করে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে তখন পাকিস্তানে যেভাবে দেখা হতো, সেটির কারণেই ওইসব যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। মুসলামানদের এই সম্প্রদায়টির সাথে অন্যদের বিশ্বাসগত কিছু পার্থক্য আছে।

তবে আহমদিয়ারা আইন মান্যকারী চমৎকার সম্প্রদায় বলে মনে করেন আদিল শাহ, যিনি লন্ডনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন ইমাম।

“যদিও পাকিস্তানে বারবার তারা নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে।” পাকিস্তানে আহমদিয়াদের সমস্যা শুরু হয় মূলত ১৯৫৩ সালে। তখন লাহোরে বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে।

পাঞ্জাব সরকার তখন মাত্র ২০ জন মারা যাওয়ার কথা বললেও সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশি। পরে ১৯৭৪ সালে আইন করে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। কিছু অধিকার থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১০ সালেও দু’টি আহমদিয়া মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে ৯৪ জন নিহত হন।

জাকির থাভার বলছেন, নোবেল জয়ী প্রথম মুসলিম বিজ্ঞানী আবদুস সালামের সমাধিফলক থেকে মুসলিম শব্দটা মুছে ফেলা হয়েছে।

“এমনকি কোনো আহমদিয়া মুসলিম ইসলামি কায়দায় সালাম দিলেও তার জেল জরিমানা হতে পারে। তাদের মসজিদ, কবরখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র এসব বিষয়ে বরাবরই নিরব এবং দেখেও না দেখার ভান করছে,” বলেন মি. থাভার।

১৯৫৩ সালের দাঙ্গার পর পাকিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। তিনি ক্যামব্রিজে ফিরে যান এবং পরে লন্ডনে ইমপেরিয়াল কলেজে যোগ দেন।

নিজ দেশে প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি পাকিস্তানকে ছেড়ে দেননি। বরং দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক বড় বড় সকল প্রকল্পে সংযুক্ত থেকে সাহায্য করেছেন।

১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান স্পেস প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিতেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সেদেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আইন পাশ করলে তাকে ওইসব প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়।

পাকিস্তানে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার পাঁচ বছর পর সালাম নোবেল পুরস্কার জেতেন। বিশ্বের কাছে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম, যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। অথচ তার দেশের মানুষের কাছেই অপরিচিত রয়ে গেলেন।

মৃত্যুর পর মি. সালামের কবরের স্মৃতিফলকে লেখা হয় যে, তিনি প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সেই ফলক থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা মুছে দিয়েছে।

একজন কিংবদন্তীকে আবিষ্কার
থাভার বলেছেন যে তিনি এবং তার সহপ্রযোজক ওমর ভানদাল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানেই তারা প্রথমবারের মতো তাদের দেশের বিজ্ঞানী আবদুস সালাম সম্পর্কে জানতে পারেন। “আমরা নিউইয়র্ক টাইমসে সালামকে নিয়ে একটি শোক সংবাদ পড়ি। দেশে তার জীবন কাহিনীকে রীতিমত সমাধিস্থ করা হয়েছে।”

বিষয়টি নিয়ে আরও খোঁজ-খবর করার পর এই দুই যুবক আবিষ্কার করেন যে, ধর্ম বিশ্বাসের কারণেই মি. সালামের জীবন কাহিনী কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।

“সালামের এই অসাধারণ জীবন কাহিনী জানার পর আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, এটি অন্যদেরকেও বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করবে এবং তার সম্পর্কে জানার পর অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন,” বলছিলেন থাভার।

পদার্থবিজ্ঞানে মি. সালাম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। মৌলিক কণার মধ্যে দুর্বল ও তড়িৎ চৌম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া বিষয়ক তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

ধর্মের কারণে নিজ দেশে অনেক নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

তাকে ব্রিটেন ও ইটালির নাগরিকত্বের প্রস্তাব দেয়া হলেও মি. সালাম সেটি গ্রহণ করেননি। আমৃত্যু তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক।

ইমাম আদেল বলছিলেন, এটাকেই বলা হয় আহমদিয়া চিন্তাধারা। মি. আদেল নিজেও পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে পরে তিনি যুক্তরাজ্যে লন্ডনে চলে আসেন।

“আমার মতো আহমদিয়া মুসলিমদের বাকি সবাই এখনও তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসা পোষণ করে। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যখনই ডাক আসবে, তখনই সবার আগে তারা গিয়ে হাজির হবে,” বলেন তিনি।

দেশের জন্য কাজ করার পাশাপাশি মি. সালাম উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার প্রচার ঘটানোর ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন।

এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৬৪ সালে ইতালির ত্রিয়েস্তে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসিটিপি) প্রতিষ্ঠা করেন।

এই প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাবিদদের যোগাযোগ স্থাপন করার দারুণ এক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।

বিজ্ঞানী আবদুস সালামের জীবনের টুকরো টুকরো সব ঘটনা একত্রিত করে চলচ্চিত্র বানাতে থাভার ও ভানদালের প্রায় ১৪ বছর সময় লেগে গিয়েছে।

থাবার বলেন, “তখন আমরা ছিলাম অপরিচিত তরুণ ও বোকা ধরনের উচ্চাভিলাষী, নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতা। আমরা তাৎপর্যপূর্ণ এমন একটি কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, ইতিহাস যেটাকে বিশেষভাবে মনে রাখবে।”

চলচ্চিত্রটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্কাইভ ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষত মি. সালামের। তার এমন কিছু ছবি এখানে দেখা যাবে, যা আগে কখনো কেউ দেখায়নি।

“এসব ফুটেজ সংরক্ষণাগার থেকে পুনরুদ্ধার করে সেগুলোর ক্যাটালগ এবং প্রতিলিপি তৈরি করতে অনেক সময় চলে গেছে এবং পরিশ্রম করতে হয়েছে,” বলছিলেন থাভার। “আমরা প্রায় দুই বছর ধরে এর সম্পাদনার কাজ করেছি,” বলেন তিনি।

এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে তারা এমন কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছেন, যারা আগে কখনই ক্যামেরার সামনে আসেননি।

তাদের মধ্যে অধ্যাপক সালামের ব্যক্তিগত সহকারী থেকে শুরু করে আইসিটিপি পর্যন্ত সব ধরনের মানুষজন রয়েছে।

“তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ঘর পর্যন্ত খুলে দিয়েছে, যাতে আমরা অধ্যাপক সালামের নোটবুক ঘেটে দেখতে পারি এবং পরিবারের পুরনো ছবি ও ভিডিও খুঁজতে পারি,” বলেন থাভার।

তিনি আরও বলেন, “যখন আপনি একটি প্রকল্পের পেছনে এক দশকেরও বেশি সময় ব্যয় করেন, তখন অন্যরাও আপনার কাজের অংশ হতে চায় এবং আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে”

পরিবারের সদস্যরা মিস্টার সালামের বসবাসের ঘরের তালা খুলে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক সালামের বড় ছেলে আহমাদ সালাম তার বাবার জীবন নিয়ে কথা বলেছেন।

তিনি এই চলচ্চিত্রটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-
“দু’জন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ একটি দুর্দান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারা দেশের এমন ২০ কোটি মানুষকে অনন্য একটি গল্প বলতে চেয়েছে, যাদের অধিকাংশই আগে আবদুস সালামের কথা শোনেননি।”

চলচ্চিত্রে মি. সালামের এমন একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অধ্যাপক সালামের প্রাক্তন সহকর্মীরা তার গবেষণার অভ্যাস সম্পর্কে জানতে পারবেন যে, কী অদ্ভুততাভাবে তিনি একের পর এক ধারণা নিয়ে হাজির হতেন।

এসব ধারণার বেশিরভাগই শুনতে উদ্ভট মনে হলেও সেগুলোর অনেক ক’টিই আসলে নোবেল পুরস্কারের পাওয়ার মতো যোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যাপক সালামের ছেলে তার বাবাকে অত্যন্ত ভদ্র মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছিলেন যে, একবার তার বাবার একটি স্যুটের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটি বানানোর মতো পর্যাপ্ত সময় তখন হাতে ছিল না।

তারপরও মি. সালাম একটি দর্জির দোকানে গিয়েছিলেন এবং সেই দর্জি সময়মতোই তাকে স্যুট বানিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে সালাম কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জীবনভর কেবল ওই দর্জির দোকান থেকেই স্যুট কিনেছেন।

তবে চলচ্চিত্রটিতে অধ্যাপক সালামের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ অনুপস্থিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে।

“এটি মূলত পাকিস্তানকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফলে দুঃখজনকভাবে এখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি উন্নত দেশগুলির লোভ এবং অহংকার কাটিয়ে ওঠানোর জন্য আবদুস সালামের আবেগ ও ক্ষোভের জায়গাটি ব্যাখ্যা করার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়নি,” বলেন আহমাদ।

চলচ্চিত্রের নির্মাণের ধারণা মাথায় আসার পর থেকে যতই দিন গড়িয়েছে, ততই এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে জানাচ্ছিলেন থাভার।

“প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম যে, গল্পটি বলা জরুরি, কেননা এটি শিশুদের অনুপ্রাণিত করবে এবং একজন পাকিস্তানি মুসলিম নোবেল বিজয়ীর কাহিনী সবার সামনে তুলে ধরবে, যিনি পর্দার আড়ালে থাকা একজন নায়ক ছিলেন,” থাভার বলেছেন৷

“কিন্তু বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানে এবং এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশা আরও বেড়েছে। আর এ কারণেই গল্পটি বর্তমান সময়ের এসে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে,” বলেন তিনি।

“এছাড়া পশ্চিমে ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতিও অধ্যাপক সালামের জীবন কাহিনীকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে, বিশেষ করে বিজ্ঞানে মুসলমাদের অর্জন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। কারণ বিজ্ঞানে মুসলিমবিশ্বের অবদানকে কখনোই খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয়নি,” বলছিলেন মি. থাভার।

আর অধ্যাপক সালামের ছেলে আহমাদ বলেছিলেন, “ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবদিক থেকেই এখন বৈষম্য বেশি।”

তিনি বলেন, তার বাবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা বলেছিলেন, যা ৫০ বছর পরে এসে এখনও প্রাসঙ্গিক।

“আবদুস সালাম উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে উন্নত দেশগুলোকে বিনিয়োগ করানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, যাতে এর সহায়তায় তারা দ্রুত এবং আরও টেকসইভাবে এগিয়ে যেতে পারে।”

“তার সেই চিন্তা এখনও ততটাই প্রাসঙ্গিক, যতটা ৫০ বছর আগেও প্রাসঙ্গিক ছিল,” বলেন বিজ্ঞানী আবদুস সালামের বড় ছেলে আহমাদ সালাম।

আরও পড়ুন : রোজার বৈজ্ঞানিক দশ উপকারিতা

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

যে কারণে বিজ্ঞানী আবদুস সালাম হারিয়ে যাচ্ছেন

আপডেট সময় ০৩:২৬:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০২৪

১৯৭৯ সালে পাকিস্তানি বিজ্ঞানী আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন, যেটি পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা এখনও পদার্থবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হচ্ছে। বস্তুত এটিই ২০১২ সালের ‘হিগস বোসন’ কণা আবিষ্কারের ভিত্তি রচনা করেছিলো।

মি. সালাম ছিলেন প্রথম পাকিস্তানি, যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। সে হিসেবে এই অর্জনটি পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং এই কৃতিত্বের জন্য মি. সালামকে মনে রাখা উচিত ছিল।

কিন্তু মনে রাখার বদলে মাত্র ৪০ বছরের মধ্যে নিজ জন্মভূমিই মি. সালামকে ভুলে গেছে। আর এভাবে ভুলে যাওয়ার কারণ তার ধর্ম বিশ্বাস।

কয়েক বছর আগে তার উপর নির্মিত একটি ডকুমেন্টারি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেলে মি. সালামকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়৷

“সালামই প্রথম মুসলিম যিনি বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন,” চলচ্চিত্রটির অন্যতম প্রযোজক জাকির থাভার বিবিসি কালচারকে বলেন।

“তিনি তার শিকড়ের প্রতি এবং দেশের মানুষের দুর্দশার উন্নতির জন্য এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে, স্টকহোমে সুইডেনের রাজার কাছ থেকে (নোবেল) পুরস্কার নেওয়ার সময়ও তিনি পাগড়ি পরেছিলেন।”

এমনকি নোবেল ভোজসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময়ও মি. সালাম কোরান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।

চলচ্চিত্রটিতে তিনটি বিষয়ের প্রতি মি. সালামের অধ্যাবসায় ও আত্মত্যাগ তুলে ধরা হয়েছে।সেগুলো হচ্ছে: পদার্থবিজ্ঞান, তার বিশ্বাস এবং জাতীয়তা।

সালাম ১৯২৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ঝাং শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষক পিতার বিশ্বাস ছিল যে তার সন্তানের জন্ম স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া একটি স্বপ্নের ফল, যেটি তিনি শুক্রবারে জুমার প্রার্থনার সময় পেয়েছিলেন।ফলে ছোটবেলা থেকে পরিবারের সদস্যরা তাকে আলাদা নজরে দেখতেন এবং আদর যত্ন করতেন।

নিয়মিত পারিবারিক কাজ, যেমন: গরুর দুধ সংগ্রহ বা গোবর পরিষ্কার করা ইত্যাদি থেকে তাকে বিরত রাখা হয়েছিলো। ফলে মি. সালাম গণিতে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

তবে খুব বেশি বিলাসী শৈশব তিনি পাননি। সরকারি কলেজে পড়ার জন্য নিজ শহর ছেড়ে যখন মি. সালাম লাহোরে গিয়েছিলেন সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক বাতি দেখেছিলেন।

কলেজে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা তাকে অন্যান্য সহপাঠীদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।

পরে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পান। এছাড়া দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে তখন যে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থী সেন্ট জোনস কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন, মি. সালাম তাদেরই একজন।

কিন্তু মাতৃভূমির প্রতি টান ছিল প্রবল। ফলে ডক্টরেট ডিগ্রি শেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং লাহোরে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয়
জীবনভর সালাম ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম। লন্ডনে নিজের অফিসে বসেও তিনি কোরান শুনতেন। বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে ধর্ম কখনোই তার জীবনে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে এ দু’টির একটি অপরটির সহায়ক বলেই মনে করছেন মি. সালাম।

সহকর্মীদের কাছে তিনি এমন দাবিও করেছিলেন যে, বিজ্ঞান গবেষণায় তার অনেক আইডিয়া বা ধারণাই এসেছে সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে।

তিনি মূলত এমন একটি তত্ত্ব আবিষ্কারের প্রয়াস চালাচ্ছিলেন, যেটি সমগ্র পার্টিকেল ফিজিক্স বা কণা পদার্থবিদ্যাকে ব্যাখ্যা করবে। এটি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

“আমরা (তাত্ত্বিক পদার্থবিদরা) কিছু মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে জড় পদার্থের সমস্ত জটিলতাকে যতটা সম্ভব বুঝতে চাই,” একবার বলেছিলেন সালাম। যদিও বিগ ব্যাং তত্ত্বের মতো বিজ্ঞানের কিছু বিষয় তার ধর্ম বিশ্বাসের সাথে যায় না বলেও মেনে নিয়েছিলেন তিনি।

নিজের ধর্ম বিশ্বাস সালামের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও ধর্ম বিশ্বাসের কারণ তাকে অনেক নিপীড়ন ও বৈষম্য সহ্য করতে হয়েছে।

বিশেষ করে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে তখন পাকিস্তানে যেভাবে দেখা হতো, সেটির কারণেই ওইসব যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। মুসলামানদের এই সম্প্রদায়টির সাথে অন্যদের বিশ্বাসগত কিছু পার্থক্য আছে।

তবে আহমদিয়ারা আইন মান্যকারী চমৎকার সম্প্রদায় বলে মনে করেন আদিল শাহ, যিনি লন্ডনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন ইমাম।

“যদিও পাকিস্তানে বারবার তারা নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে।” পাকিস্তানে আহমদিয়াদের সমস্যা শুরু হয় মূলত ১৯৫৩ সালে। তখন লাহোরে বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে।

পাঞ্জাব সরকার তখন মাত্র ২০ জন মারা যাওয়ার কথা বললেও সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশি। পরে ১৯৭৪ সালে আইন করে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। কিছু অধিকার থেকেও তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১০ সালেও দু’টি আহমদিয়া মসজিদে হামলার ঘটনা ঘটে, যাতে ৯৪ জন নিহত হন।

জাকির থাভার বলছেন, নোবেল জয়ী প্রথম মুসলিম বিজ্ঞানী আবদুস সালামের সমাধিফলক থেকে মুসলিম শব্দটা মুছে ফেলা হয়েছে।

“এমনকি কোনো আহমদিয়া মুসলিম ইসলামি কায়দায় সালাম দিলেও তার জেল জরিমানা হতে পারে। তাদের মসজিদ, কবরখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রমণের শিকার হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র এসব বিষয়ে বরাবরই নিরব এবং দেখেও না দেখার ভান করছে,” বলেন মি. থাভার।

১৯৫৩ সালের দাঙ্গার পর পাকিস্তান ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী আবদুস সালাম। তিনি ক্যামব্রিজে ফিরে যান এবং পরে লন্ডনে ইমপেরিয়াল কলেজে যোগ দেন।

নিজ দেশে প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি পাকিস্তানকে ছেড়ে দেননি। বরং দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক বড় বড় সকল প্রকল্পে সংযুক্ত থেকে সাহায্য করেছেন।

১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান স্পেস প্রোগ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচিতেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সেদেশের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আইন পাশ করলে তাকে ওইসব প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়।

পাকিস্তানে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার পাঁচ বছর পর সালাম নোবেল পুরস্কার জেতেন। বিশ্বের কাছে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম, যিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। অথচ তার দেশের মানুষের কাছেই অপরিচিত রয়ে গেলেন।

মৃত্যুর পর মি. সালামের কবরের স্মৃতিফলকে লেখা হয় যে, তিনি প্রথম মুসলিম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সেই ফলক থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা মুছে দিয়েছে।

একজন কিংবদন্তীকে আবিষ্কার
থাভার বলেছেন যে তিনি এবং তার সহপ্রযোজক ওমর ভানদাল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানেই তারা প্রথমবারের মতো তাদের দেশের বিজ্ঞানী আবদুস সালাম সম্পর্কে জানতে পারেন। “আমরা নিউইয়র্ক টাইমসে সালামকে নিয়ে একটি শোক সংবাদ পড়ি। দেশে তার জীবন কাহিনীকে রীতিমত সমাধিস্থ করা হয়েছে।”

বিষয়টি নিয়ে আরও খোঁজ-খবর করার পর এই দুই যুবক আবিষ্কার করেন যে, ধর্ম বিশ্বাসের কারণেই মি. সালামের জীবন কাহিনী কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি।

“সালামের এই অসাধারণ জীবন কাহিনী জানার পর আমরা বুঝতে পারছিলাম যে, এটি অন্যদেরকেও বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহিত করবে এবং তার সম্পর্কে জানার পর অনেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন,” বলছিলেন থাভার।

পদার্থবিজ্ঞানে মি. সালাম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। মৌলিক কণার মধ্যে দুর্বল ও তড়িৎ চৌম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া বিষয়ক তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

ধর্মের কারণে নিজ দেশে অনেক নিপীড়নের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

তাকে ব্রিটেন ও ইটালির নাগরিকত্বের প্রস্তাব দেয়া হলেও মি. সালাম সেটি গ্রহণ করেননি। আমৃত্যু তিনি ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক।

ইমাম আদেল বলছিলেন, এটাকেই বলা হয় আহমদিয়া চিন্তাধারা। মি. আদেল নিজেও পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু ধর্মীয় বৈষম্যের কারণে পরে তিনি যুক্তরাজ্যে লন্ডনে চলে আসেন।

“আমার মতো আহমদিয়া মুসলিমদের বাকি সবাই এখনও তাদের হৃদয়ে পাকিস্তানের প্রতি অগাধ ভালবাসা পোষণ করে। দেশের যেকোনো প্রয়োজনে যখনই ডাক আসবে, তখনই সবার আগে তারা গিয়ে হাজির হবে,” বলেন তিনি।

দেশের জন্য কাজ করার পাশাপাশি মি. সালাম উন্নয়নশীল বিশ্বের মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার প্রচার ঘটানোর ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন।

এ লক্ষ্যে তিনি ১৯৬৪ সালে ইতালির ত্রিয়েস্তে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসিটিপি) প্রতিষ্ঠা করেন।

এই প্রতিষ্ঠানটি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাবিদদের যোগাযোগ স্থাপন করার দারুণ এক সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।

বিজ্ঞানী আবদুস সালামের জীবনের টুকরো টুকরো সব ঘটনা একত্রিত করে চলচ্চিত্র বানাতে থাভার ও ভানদালের প্রায় ১৪ বছর সময় লেগে গিয়েছে।

থাবার বলেন, “তখন আমরা ছিলাম অপরিচিত তরুণ ও বোকা ধরনের উচ্চাভিলাষী, নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতা। আমরা তাৎপর্যপূর্ণ এমন একটি কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, ইতিহাস যেটাকে বিশেষভাবে মনে রাখবে।”

চলচ্চিত্রটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্কাইভ ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষত মি. সালামের। তার এমন কিছু ছবি এখানে দেখা যাবে, যা আগে কখনো কেউ দেখায়নি।

“এসব ফুটেজ সংরক্ষণাগার থেকে পুনরুদ্ধার করে সেগুলোর ক্যাটালগ এবং প্রতিলিপি তৈরি করতে অনেক সময় চলে গেছে এবং পরিশ্রম করতে হয়েছে,” বলছিলেন থাভার। “আমরা প্রায় দুই বছর ধরে এর সম্পাদনার কাজ করেছি,” বলেন তিনি।

এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে গিয়ে তারা এমন কিছু মানুষের সাথে কথা বলেছেন, যারা আগে কখনই ক্যামেরার সামনে আসেননি।

তাদের মধ্যে অধ্যাপক সালামের ব্যক্তিগত সহকারী থেকে শুরু করে আইসিটিপি পর্যন্ত সব ধরনের মানুষজন রয়েছে।

“তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ঘর পর্যন্ত খুলে দিয়েছে, যাতে আমরা অধ্যাপক সালামের নোটবুক ঘেটে দেখতে পারি এবং পরিবারের পুরনো ছবি ও ভিডিও খুঁজতে পারি,” বলেন থাভার।

তিনি আরও বলেন, “যখন আপনি একটি প্রকল্পের পেছনে এক দশকেরও বেশি সময় ব্যয় করেন, তখন অন্যরাও আপনার কাজের অংশ হতে চায় এবং আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে”

পরিবারের সদস্যরা মিস্টার সালামের বসবাসের ঘরের তালা খুলে দিয়েছিলেন। অধ্যাপক সালামের বড় ছেলে আহমাদ সালাম তার বাবার জীবন নিয়ে কথা বলেছেন।

তিনি এই চলচ্চিত্রটিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে-
“দু’জন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ একটি দুর্দান্ত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারা দেশের এমন ২০ কোটি মানুষকে অনন্য একটি গল্প বলতে চেয়েছে, যাদের অধিকাংশই আগে আবদুস সালামের কথা শোনেননি।”

চলচ্চিত্রে মি. সালামের এমন একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। অধ্যাপক সালামের প্রাক্তন সহকর্মীরা তার গবেষণার অভ্যাস সম্পর্কে জানতে পারবেন যে, কী অদ্ভুততাভাবে তিনি একের পর এক ধারণা নিয়ে হাজির হতেন।

এসব ধারণার বেশিরভাগই শুনতে উদ্ভট মনে হলেও সেগুলোর অনেক ক’টিই আসলে নোবেল পুরস্কারের পাওয়ার মতো যোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।

অধ্যাপক সালামের ছেলে তার বাবাকে অত্যন্ত ভদ্র মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছিলেন যে, একবার তার বাবার একটি স্যুটের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেটি বানানোর মতো পর্যাপ্ত সময় তখন হাতে ছিল না।

তারপরও মি. সালাম একটি দর্জির দোকানে গিয়েছিলেন এবং সেই দর্জি সময়মতোই তাকে স্যুট বানিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে সালাম কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জীবনভর কেবল ওই দর্জির দোকান থেকেই স্যুট কিনেছেন।

তবে চলচ্চিত্রটিতে অধ্যাপক সালামের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ অনুপস্থিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার ছেলে।

“এটি মূলত পাকিস্তানকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফলে দুঃখজনকভাবে এখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি উন্নত দেশগুলির লোভ এবং অহংকার কাটিয়ে ওঠানোর জন্য আবদুস সালামের আবেগ ও ক্ষোভের জায়গাটি ব্যাখ্যা করার মতো পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়নি,” বলেন আহমাদ।

চলচ্চিত্রের নির্মাণের ধারণা মাথায় আসার পর থেকে যতই দিন গড়িয়েছে, ততই এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে জানাচ্ছিলেন থাভার।

“প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম যে, গল্পটি বলা জরুরি, কেননা এটি শিশুদের অনুপ্রাণিত করবে এবং একজন পাকিস্তানি মুসলিম নোবেল বিজয়ীর কাহিনী সবার সামনে তুলে ধরবে, যিনি পর্দার আড়ালে থাকা একজন নায়ক ছিলেন,” থাভার বলেছেন৷

“কিন্তু বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানে এবং এই উপমহাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দুর্দশা আরও বেড়েছে। আর এ কারণেই গল্পটি বর্তমান সময়ের এসে আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে,” বলেন তিনি।

“এছাড়া পশ্চিমে ক্রমবর্ধমান ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতিও অধ্যাপক সালামের জীবন কাহিনীকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে, বিশেষ করে বিজ্ঞানে মুসলমাদের অর্জন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। কারণ বিজ্ঞানে মুসলিমবিশ্বের অবদানকে কখনোই খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয়নি,” বলছিলেন মি. থাভার।

আর অধ্যাপক সালামের ছেলে আহমাদ বলেছিলেন, “ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে সবদিক থেকেই এখন বৈষম্য বেশি।”

তিনি বলেন, তার বাবা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের কথা বলেছিলেন, যা ৫০ বছর পরে এসে এখনও প্রাসঙ্গিক।

“আবদুস সালাম উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিখাতে উন্নত দেশগুলোকে বিনিয়োগ করানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, যাতে এর সহায়তায় তারা দ্রুত এবং আরও টেকসইভাবে এগিয়ে যেতে পারে।”

“তার সেই চিন্তা এখনও ততটাই প্রাসঙ্গিক, যতটা ৫০ বছর আগেও প্রাসঙ্গিক ছিল,” বলেন বিজ্ঞানী আবদুস সালামের বড় ছেলে আহমাদ সালাম।

আরও পড়ুন : রোজার বৈজ্ঞানিক দশ উপকারিতা