বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি অভিনেতা ও পরিচালক নায়ক রহমানের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে স্মৃতিচারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আটোয়ারী উপজেলা প্রেসক্লাবের আয়োজনে এবং নায়ক রহমান স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ আটোয়ারী উপজেলা কমিটির বাস্তবায়নে শুক্রবার (১৮ জুলাই) সন্ধায় উপজেলা প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও নায়ক রহমান স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইউসুফ আলীর সভাপতিত্বে নায়ক রহমানের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনায় কমিটির সদস্য, সাংবাদিক, পরিবারের সদস্য সহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার সুধিজন বক্তব্য রাখেন। বক্তারা কিংবদন্তি এই মহা নায়কের স্মরনে জাতীয়ভাবে তার মৃত্যু বার্ষিকী পালনের দাবী জানান। বক্তারা বলেন, ষাটের দশকের বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নায়ক রহমানর পুরো নাম আব্দুর রহমান। বাংলাদেশের সিনেমায় বিশেষ অবদান রাখা এই মানুষটি মহানায়ক আব্দুর রহমান ১৯৩৭ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের রসেয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হাফিজ উদ্দীন। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে রহমান ছিলেন ৪র্থ। ১৯৫৩ সালে ঠাকুরগাঁও হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। আইএসসি-তে অকৃতকার্য হওয়ায় বাবা বাড়ি থেকে বের করে দেন। গৃহত্যাগী হয়ে ঢাকায় মেঝভাই দেলোয়ার রহমানের কাছে আসেন। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং আইএসসি পাস করেন। রহমানের মামা মির্জা রকিব সাহেব হোটেল শাহবাগের রেসিডেন্সিয়াল ডিরেক্টর ছিলেন। সেই সুবাদে রিসিপশনিস্ট হিসেবে চাকুরী নেন শাহবাগ হোটেলে। সাদা কালো যুগের সুপার হিট ‘ জোয়ার ভাটা ’। এই সিনেমার জুটি ছিলেন শবনম। পরে একই জুটির রঙ্গিণ ছবি ‘ আমার সংসার ’। সেই সময়ের সব সেরা রোমান্টিক জুটি ছিলেন তারা। বাংলা ও উর্দু ভাষায় চলচ্চিত্রের দাপুটে জুটিও ছিলেন তারা।
সেই সময় কোন মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ অভিনয় করবে ভাবাই যেত না। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এহতেশাম পরিচালিত ‘ এ দেশ তোমার আমার ’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় রহমানের। তারপর একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে গেছেন। ১৯৬৭ সালে ‘ দর্শন ’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় আসেন তিনি। এগুলোর মধ্যে ১৯৮১ সালে দীলিপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘ অংশীদার ’ চলচ্চিত্রটি কালজয়ী হয়ে আছে। তার পরিচালিত উর্দু চলজ্জিত্র ‘ চাহাত ’, কঙ্গন’,‘ যাহা বাজে সেহনাই’ ইত্যাদি। আর বাংলা চলচ্চিত্র ‘ নিকাহ’। তিনি উর্দু চলচ্চিত্র ‘চাহাত’, ‘দোরাহা’ ও ‘লগান’- এ অভিনয় করেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন ‘ দেবদাস’ নির্মাণ করেন। সেখানে নায়ক রহমান চুনি লালের চরিত্রে অভিনয় করেন। রহমান অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘ আমার সংসার’। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে মাসুদ চৌধুরী পরিচালিত ‘প্রীত না জানে রীত’ চলচ্চিত্রে শুটিং শেষে সিলেট থেকে ঢাকা ফেরার পথে এক সড়ক দুর্ঘটনায়( জীপগাড়ী ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে) একটি পা হারাতে হয় নায়ক রহমানকে। এ দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়েও দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন রহমান। বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষায় চলচ্চিত্রে সমানভাবে জনপ্রিয় অভিনেতা রহমান অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো উর্দুতে ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘মিলন’, ‘বাহানা’, ‘ইন্ধন’, ‘ দর্শন’, ‘জাঁহা বাজে সেহনাই’, ‘গোরি’, ‘প্যায়াসা’, ‘ কঙ্গন, ‘ দোস্তি’, ‘ নাদান’। বাংলায় ‘ এ দেশ তোমার আমার ’, ‘ রাজধানীর বুকে’ ,‘ এই তো জীবন’, ‘ হারানো দিন’, ‘ নতুন দিগন্ত’, ‘নিকাহ’,‘যে নদী মরু পথে ’,‘স্বর্গ নরক’, ‘ বেপরোয়া’, ‘ বিশাল; পাহাড়ী ফুল; টাকার অহংকার; ‘আমার সংসার; ‘ মেঘের পরে মেঘ;‘ দেবদাস’ কিংবদন্তি অভিনেতা রহমান ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই চলে যান না ফেরার দেশে।
বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রহমান ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান। পাকিস্তানে উর্দৃ চলচ্চিত্র-চাহাত, দো সাথী ও লগন ছবিতে অভিনয় করেন। পরে আবার তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নিগার পুরস্কার, দেবদাস ছবিতে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার।
ব্যক্তি জীবনে রহমান কুমকুম(জুলেখা)-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ৫ কন্যা সন্তান। তিন মেয়ে আমেরিকা, এক মেয়ে লন্ডন প্রবাসী এবং সবার ছোট মেয়ে থাকেন ঢাকায়।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের শুরুর দিকে, চলচ্চিত্র শিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সুদৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে চিত্র নায়ক রহমান-এর বিশেষ অবদান রয়েছে। আমাদের দেশের প্রথম সফল রোমান্টিক চিত্র নায়ক তিনি। তখনকার সময়ে পাকিস্তানের দুই অংশে বাংলা- উর্দু দুই ভাষার চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তা ও সফলতার শীর্ষে ছিলেন নায়ক রহমান।
বক্তারা বলেন, রহমানই প্রথম বাঙ্গারী, যিনি ঢাকায় ‘ বেলবটম প্যান্ট’-এর প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নায়ককুলের শিরোমনি চিত্রনায়ক রহমান, কোটি মানুষের ভালোবাসায় চিরঞ্জীব।