বছরের শুরুতে সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা এবং তার পরে কোটা আন্দোলন ঘিরে সরকার পতন ও সংঘাত-সহিংসতায় চলচ্চিত্র শিল্প বছরজুড়েই ‘সংকটকালীন’ দশা পার করলেও, এবার ছিল সিনেমা মুক্তির হিড়িক।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক, প্রযোজক ও পরিবেশকরা জানিয়েছেন, প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে অর্ধ শতাধিক সিনেমা; তবে সেগুলোর মধ্যে এক দুটি ছাড়া কোনোটিই ‘দর্শক টানেনি’। ফলে ব্যবসাতে হয়েছে ‘ভরাডুবি’।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোভিড মহামারীর আগে পরে মিলিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই চলচ্চিত্রের যে দুর্দিন গেছে, সেটি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে চলতি বছরে এসে।
কারণ হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন ব্যবসাসফল সিনেমা না থাকা, প্রেক্ষাগৃহের সংকট, প্রযোজ-নির্মাতা-শিল্পী সংকট এবং পুঁজির সংকট।
প্রযোজকরা বলছেন, প্রেক্ষাগৃহের স্বল্পতার কারণে কোনো সিনেমায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে লাভ তো দূরের কথা, খরচ তুলে আনার জায়গা নেই। এছাড়া দর্শক খরার পেছনে ‘মানহীন সিনেমা তৈরির’ বিষয়টিকেও কারণ হিসেবে তুলে ধরেছেন প্রদর্শকরা।
আর নির্মাতারা বলছেন, ‘শিল্পী সংকট এবং প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী তৈরি হচ্ছে না’ বলে সিনেমার ব্যবসা মার খাচ্ছে
চলচ্চিত্র প্রযোজক-পরিবেশক সমিতির অফিস সচিব সৌমেন রায় বাবু গ্লিটজকে জানিয়েছেন, বছরের শেষ শুক্রবার ‘নকশি কাঁথার জমিন’ সিনেমাটি মুক্তির মধ্য দিয়ে চলতি বছরে ৫৩ টি সিনেমা মুক্তির তালিকার খাতা বন্ধ করেছেন তিনি।
“এর মধ্যে চারটি সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়েছে ‘সাফটা চুক্তির’ মাধ্যমে। একটি ভারতীয় বাংলা সিনেমা ও তিনটি ভারতীয় হিন্দি সিনেমা।
ঢাকাই সিনেমা ‘আমের মৌসুমের’ মত
শেষ হয়ে আসা বছরে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ৯টি। এর মধ্যে অভিনেতা মোশাররফ করিমের ভারতীয় বাংলা সিনেমা ‘হুব্বা’, জয়া আহসান অভিনীত ‘পেয়ারার সুবাস’ এবং অপু বিশ্বাস অভিনীত দুটি সিনেমা ‘ট্র্যাপ’ ও ‘ছায়াবৃক্ষ’।
মার্চ মাসে কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি, তবে এপ্রিলে ঈদের আগে সাফটা চুক্তির মাধ্যমে ১০ দিনের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বলিউডের নায়িকা কারিনা কাপুর, টাবু ও কৃতি শ্যানন অভিনীত হিন্দি সিনেমা ‘ক্রু’।
এপ্রিলে রোজার ঈদে একসঙ্গে মুক্তি পায় ১১টি সিনেমা। সেসময় ১১টি সিনেমাকেই ফ্লপ বা সুপারফ্লপ বলে বর্ণনা করেছেন প্রদর্শকরা।
এমনকি দর্শক টানতে ব্যর্থ হয় সুপারস্টার শাকিব খানের ‘রাজকুমার’ সিনেমাও, যে সিনেমার নায়িকা কোর্টনি কফি এসেছিলেন হলিউড থেকে।
ঈদে একসঙ্গে এত সিনেমা মুক্তি পাওয়া এবং আশানুরূপ দর্শক টানতে না পারায় হল মালিকদের মুখে ছিল হতাশার সুর।
ঈদের পরে মে মাসে মুক্তি পায় ৭টি সিনেমা। এর মধ্যে একটি ছিল ভারতীয় হিন্দি সিনেমার রাজকুমার রাও ও জাহ্নবী কাপুর অভিনীত ‘মি. অ্যান্ড মিসেস মাহি’।
রোজার ঈদে ব্যবসা না হলেও কোরবানির ঈদে রায়হান রাফীর পরিচালনায় শাকিব খান অভিনীত ‘তুফান’ সিনেমা দিয়ে পরিস্থিতির ‘পরিবর্তন এসেছিল’ বলে জানিয়েছেন হল মালিকরা।
‘তুফান’ নিয়ে দর্শকের উন্মাদনা সৃষ্টি হওয়া, টিকেট না পেয়ে হল ভাংচুরের ঘটনা, দর্শকদের চাপ সামলাতে মধ্যরাতে বিশেষ প্রদর্শনীসহ বছরের ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে ‘তুফান’কেই তুলে ধরছেন হল মালিক, প্রযোজক ও পরিচালকরা।
কোরবানির ঈদে জুন মাসে ‘তুফান’ ছাড়াও মুক্তি পেয়েছে ‘ডার্ক ওয়ার্ল্ড’, ‘আগন্তুক’, ‘ময়ূরাক্ষী’ ও ‘রিভেঞ্জ’ সিনেমা। জুলাই মাসে মুক্তি পায় একটি সিনেমা ‘আজব কারখানা’।
এরপরই সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন, কারফিউয়ের কারণে স্থবিরতা বিরাজ করে বিনোদন অঙ্গনে। জুলাইয়ের ওই ছাত্র আন্দোলন এক সময় রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। তাই আন্দোলন-সংঘাত ঘিরে জুলাই-অগাস্টে দেড় মাসের মত বন্ধ থাকে দেশের প্রেক্ষাগৃহ।
অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তি পায় ‘অমানুষ হলো মানুষ’ সিনেমা। সেপ্টেম্বরে একটি সিনেমাও মুক্তি পায়নি।
অক্টোবরে হলে আসে ৫টি সিনেমা। নভেম্বরেও ৫টি, এর মধ্যে ছিল শাকিব খানের ‘দরদ’ এবং একটি ভারতীয় হিন্দি সিনেমা। ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছে ৮টি সিনেমা।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং বছরজুড়ে চলচ্চিত্রের কী অবস্থা ছিল জানতে গ্লিটজের কথা হয় পরিচালক সমিতির সাবেক সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “বাংলা চলচ্চিত্র শুধু এ বছর না, গত কয়েক বছর ধরেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। বিক্ষিপ্তভাবে দুই একটা সিনেমা চললেও ব্যবসাসফল হিসেবে বলার মত চলচ্চিত্র সারা বছরে হয়নি। চলচ্চিত্রের অবস্থা একদম সমতল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে একটা ধাক্কা তো আছেই, এর আগের সিনেমাগুলোও তো ব্যবসা করতে পারেনি। নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত আমাদের ইন্ডাস্ট্রি।”
প্রেক্ষাগৃহে সিনেমাগুলো ব্যর্থ হওয়ার কারণ হিসেবে এই পরিচালক বলেন, “এত কম সংখ্যক হল আগে ছিল না, আমাদের প্রচণ্ড শিল্পীসংকট, মানসম্পন্ন দর্শকপ্রিয় শিল্পী নাই। বছরে শাকিবের তিনটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এগুলোর কিছু দর্শক ছিল। এর মধ্যে ‘তুফান’ হিট হয়েছে। ‘রাজকুমার’ ওরকম আশা পূরণ করতে পারেনি। ‘দরদ’ সিনেমায় গণঅভ্যুত্থানের একটা প্রভাব ছিল। হলে দর্শক যায়নি। বাকি সিনেমাগুলোর কোনটির নাম বলার মত নয়। একক শিল্পীকেন্দ্রিক হয়ে গেলে ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখা যায় না।”
চলচ্চিত্রের অবস্থা ‘আমের মৌসুমের’ সঙ্গে তুলনা দিয়ে পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক বলেন, “আমের মৌসুমে যেমন ব্যবসায়ীদের কিছুটা ব্যবসা হয়, তেমনি আমাদের চলচ্চিত্র একটা নির্দিষ্ট উৎসব কেন্দ্রিক ব্যবসা হয়ে গিয়েছে। বছরজুড়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোও সিনেমা হলের চেয়ে ভালো কনটেন্ট দিচ্ছে।”
পোস্টারের টাকা তোলাই দায়
বছরের কোন সময়টা ভালো ব্যবসা করেছেন ? এমন প্রশ্নে ঢাকার কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমা হলের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক বলেন, “এই বছরে দুই ঈদে তিন চারটা সিনেমা ভালো চালিয়েছি, তাছাড়া আর কোনো ব্যবসা ছিল না। এত এত সিনেমা মুক্তি দিয়ে তো লাভ হয়নি, ওটিটির কনটেন্ট সিনেমা হলে মুক্তি দিয়ে সিনেমার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। চলতি বছরটাই নানা কারণে দর্শকের সংখ্যা লিমিটেড ছিল। মানসিকভাবে একটা অস্থিরতা সবার মধ্যেই ছিল।”
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া থেকে এই বছর দুটি সিনেমা করা হয়েছে। প্রযোজক হিসেবে পুরো বছরের চলচ্চিত্রর অবস্থা কেমন দেখেছেন প্রশ্নে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও প্রযোজক আব্দুল আজিজ বলেন, ” চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালো না, দেশে সিনেমা হল কমতে কমতে ৩০-৩৫ এ এসে দাঁড়িয়েছে, বড় বাজেটের সিনেমা করে মিনিমান ক্যাপিটাল তো ফেরত পাই না।
“অনেক সিনেমার প্রযোজক আছে যাদের বেশিরভাগই পোস্টারের টাকাই উঠাতে পারে না। ভারতের সাথে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যৌথ সিনেমা হচ্ছে না, চলচ্চিত্রের অবস্থা সামনে জিরোতে নেমে যাবে।”
বছরে ৫৩ টি সিনেমা মুক্তি পেলেও ব্যবসায়িক এই মন্দার কারণ হিসেবে প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, “সিনেমাগুলোতে মূল ধারার অভিনয়শিল্পী না থাকা, মানহীন নির্মাণ, মানসম্মত গল্পের অভাব, দর্শকের রুচি বুঝতে না পারা, সিনেমার উপস্থাপন সুন্দর না হওয়া, মুক্তির উদ্দেশ্যে নাম মাত্র প্রেক্ষাগৃহ বাছাই করা এবং প্রচারণায় অভাবেই ব্যর্থ হয়েছে সিনেমাগুলো।”
বছর জুড়ে শাকিবের রাজত্ব
চলতি বছরে অভিনেত্রী জয়া আহসানের ২টি, শাকিব খানের ৩টি, অপু বিশ্বাসের ২টি, নিরব হোসেনের ৩টি, শবনম বুবলীর ৩টি, শরিফুল রাজের ৩টি, সাইমন সাদিকের ২টি, আদর আজাদের ১টি এবং জিয়াউল রোশানের ৩টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
প্রযোজক, পরিচালক ও প্রদর্শকরা বলছেন, প্রেক্ষাগৃহে দর্শক ধরে রেখেছেন ‘একমাত্র শাকিব’।
শাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি হচ্ছে না জানিয়ে মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, “গত বছর শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার সঙ্গে বিকল্প হিসেবে আফরান নিশোর ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমা ছিল। নিশো দর্শক ধরে রাখতে পেরেছেন। এ বছর বিকল্প কেউ ছিল না। আমাদের এখানে অনেক অনেক শিল্পী আছে কিন্তু গত ১৫ বছরেও তারা নিজেদের দর্শক তৈরি করতে পারেনি।
“সিয়াম আহমেদ, শরিফুল রাজ, আরিফিন শুভ এরা ভালো শিল্পী। দর্শক আছে। তারা পারত সিনেমা শিল্পকে এগিয়ে নিতে, কিন্তু তাদের পরিকল্পনায় অনেক ভুল আছে। তারা তাদের নির্দিষ্ট ডিরেক্টর, নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বাইরে বের হতে পারে না। তাই তাদের সিনেমা কম হয়”, বলছিলেন পরিচালক গুলজার।
দেখা মেলেনি শুভ-বাঁধনদের
এই বছর প্রেক্ষাগৃহে দেখা যায়নি অভিনেতা সিয়াম আহমেদ, আরিফিন শুভ, আফরান নিশো, বিদ্যা সিনহা মিম, মাহিয়া মাহি, নুসরাত ফারিয়া, তমা মির্জা, আজমেরী হক বাঁধনসহ অনেক অভিনয়শিল্পীকেই।
‘জংলি’, ‘এশা মার্ডার কর্মফল’, ‘কবি’, ‘নূর’, ‘নীলচক্র’, রঙবাজার সিনেমাসহ আরো কয়েকটি সিনেমা মুক্তির কথা ছিল চলতি বছর শেষের আগেই। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরে বড় সিনেমা মুক্তি থেকে পিছিয়ে গিয়েছেন পরিচালক এবং প্রযোজকরা।
তবে এবার বড় পর্দায় অভিষেক হয়েছে ছোট পর্দার বেশকিছু অভিনয়শিল্পীরও। তাদের মধ্যে মেহজাবীন চৌধুরী, তাসনিয়া ফারিণ, ইরফান সাজ্জাদ, আইশা খান, সোহেল মণ্ডল, নীলাঞ্জনা নীলা, শ্যামল মাওলাসহ তালিকায় ছিলেন অনেকে।