অন্তর্বর্তী সরকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে, সেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে- তা নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বিশ্লেষকরা কেউ কেউ বলছেন, জুলাই অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের বিচার হতে হবে কিন্তু ‘যে প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধের দাবিটি সামনে এনে সরকার অগ্রসর হয়েছে’ তা ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষ দমনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠতে পারে।
আবার কেউ বলছেন, শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দিকে গড়ালে এবং সেই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলে সংঘাত সংঘর্ষের রাজনীতিই আবার ফিরে আসতে পারে। আর সংঘর্ষ, সহিংস রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার সরকারি আদেশ হাতে পাওয়ার পর দলটির নিবন্ধন বাতিলে করণীয় ঠিক করার কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ হলে বা চূড়ান্তভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগের পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।
সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন ‘বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত ভাবে নিষিদ্ধ হওয়াই অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী বন্দোবস্ত। এবং তা করার জন্য ছাত্র-জনতার দাবি অনুযায়ী আইসিটি আইনে যাবতীয় সংশোধন করা হয়েছে”।
এর আগে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, জুলাই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাদী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার জন্য সন্ত্রাস বিরোধী আইনের অধীনে সাইবার স্পেসসহ আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে”।
সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘সরকারের সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেই আওয়ামী লীগ যথোচিতভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাবে’। একই সাথে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘জনগণ দাঁতভাঙ্গা জবাব দিবে’ বলেও ওই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবার অনেকের ধারণা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশী সোচ্চার দেখা যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীকে। দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিতে যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে, তাতে উগ্রপন্থী হিসেবে সমালোচিত অনেককেও যোগ দিতে দেখা গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পরপরই এই গোষ্ঠীগুলো সামনে উঠে এসেছে। এখন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ থাকলে ধর্ম নিরপেক্ষতা, সংস্কৃতি ও নারীর অগ্রযাত্রার মতো বিষয়গুলো সংকটে পড়তে পারে।
যে কোন পরিস্থিতিতেই কোন দল নিষেধাজ্ঞায় পড়লে সে আরও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। আওয়ামী লীগকে বিনাশ করতে গিয়ে যদি ধর্মীয় উন্মাদনাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তার পরিণতি ভালো হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় এমন উদাহরণ কিন্তু আছে। এই উন্মাদনার বিরুদ্ধে বিএনপির পদক্ষেপ কেমন হয়, তার ওপরও দেশের রাজনৈতিক চিত্র অনেকটা নির্ভর করবে।
এবার যা হয়েছে তা শুধু আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয় নয় বরং এর সাথে একটি গোষ্ঠীর ক্ষমতার চর্চার যে বহি:প্রকাশ দেখা গেছে। সেটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সুখকর হবে না।
মবক্রেসি একটা স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হবে । ভবিষ্যতের সরকারগুলোও এই কৌশল ব্যবহারের সুযোগ পাবে বা নিবে। সবমিলিয়ে একটা অস্থিতিশীলতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে দলটি নিষিদ্ধ হয়ে গেলে সমাজের ভেতরে থাকা সমর্থকদের কারণেই দীর্ঘমেয়াদে হলেও দলটি যখন ফিরে আসবে, তখনই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই হলো দুই ধারায়- মোটাদাগে যার একটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আর অপরটির নেতৃত্বে বিএনপি। দল হিসেবে ৩৫-৪০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের। এখন তারা তাদের ভুল স্বীকার করে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে আসার চেষ্টা যখন করবে, তখন রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বে। নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে ঠেলে দিতে চাইলে রাজনীতি আরও অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা আছে।
ফলে সহিংসতাই তখন রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ শক্তির জোরে টিকে থাকাটাই বড় হয়ে উঠতে পারে। আবার এমন পরিস্থিতির সুযোগে বিদেশীরাও আরও প্রভাবক হতে পারে, যা আরও বড় সংকট তৈরি করবে।