রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি সংঘর্ষকালে গুলিবিদ্ধ ও ককটেল বিস্ফোরণে শিশুসহ সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন নারী-শিশুসহ শতাধিক মানুষ। গত তিন মাসে ক্যাম্পের ভেতরে বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায় সেখানে বসবাস করা ৫০ হাজার বিহারি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি সংঘাতে উভয়পক্ষের একাধিক ব্যক্তির হাতে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। জুলাইয়ের ছাত্র আন্দোলন এবং সরকার পতনের পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা শাহিনুর রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের ৫৩ বছরের ইতিহাসে আগ্নেয়াস্ত্রের এরকম প্রকাশ্য ব্যবহার আগে দেখা যায়নি। বিগত সময়ে ক্যাম্পের ভেতরে মারামারিতে লাঠিসোঁটা ও ইটপাটকেলের ব্যবহার ছিল। সংঘাতের সময় দুর্বৃত্তদের হাতে কখনও কখনও দেশীয় অস্ত্র ছুরি-চাপাতি দেখা গেছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর রাত থেকেই ক্যাম্পের ভেতরে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। ক্যাম্পজুড়ে গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ। সবার মধ্যে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ কেন এমন সংঘর্ষ, গুলি করছে কারা—ক্যাম্পে বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিমের গ্রুপ, যারা বিগত ১৫-১৬ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল, এখন তারা প্রকাশ্যে এসেছে। চুয়া সেলিম পুরো ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুনিয়া সোহেল ও তার গ্রুপের সদস্যরা প্রতিরোধ শুরু করে। কেননা এরই মধ্যে তাদের কাছে বেশ কিছু অস্ত্র ছিল। ক্ষমতা তারাও ধরে রাখতে চায়। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট রাত থেকে শুরু হয় ক্যাম্পে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। পরদিন ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান হোটেল কর্মচারী শাহেন শাহ ওরফে কালো। এরপর এক এক করে দুজন শিশুসহ ৭ জনের প্রাণ গেলো। এখনও সংঘাত থামার কোনও শঙ্কা নেই। অস্ত্রের আতঙ্কে সবাই।’
গত তিন মাসে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে একাধিক গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনার বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে চাইনিজ অস্ত্র, শটগান, পাইপগানসহ বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র হাতে ক্যাম্পের চিহ্নিত মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের। ক্যাম্পের ভেতরে কীভাবে এবং কারা এসব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলো, কতগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে ক্যাম্পের ভেতরে—এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বাংলা ট্রিবিউন। জেনেভা ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা এবং বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেনেভা ক্যাম্পে তিন ধাপে শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে। মূলত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীকে অন্তত ১০টি অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। এরপর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোহাম্মদপুর থানা, আদাবর থানা এবং শেরেবাংলা থানায় লুটপাটের সময় বিভিন্ন ধরনের অন্তত আরও ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র হস্তগত করে বিহারি সন্ত্রাসীরা। এরপর ক্যাম্পের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চুয়া সেলিম ও তার ক্যাডাররা টাকার বিনিময়ে বাইরে থেকে তৃতীয় ধাপে অন্তত আরও ৩০টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসে।
জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার বিস্তার ঘটায় আওয়ামী লীগের নেতা মোল্লা বশির ও বুনিয়া সেলিম। এছাড়াও ৭ নম্বর সেক্টরের ক্যাডার জয়নাল আবেদিন জয়, ইকবাল ও আমির ছিলেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা। আর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল ক্যাম্পের আরমান, সেলিম, নাছির ও মাহমুদসহ আরও কয়েকজন ক্যাডার। জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে মূলত এদের মাধ্যমে ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র দেয় স্থানীয় সাবেক এমপি ও ডিএনসিসি ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক এক কাউন্সিলর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেনেভা ক্যাম্পের এক বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের জন্য প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগকে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। সেসময় ক্যাম্পের বুনিয়া সোহেলসহ যারা সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে ১০ জন ক্যাডারকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। এরপর হুট করে সরকার পতন হয়। সরকার পতনের পর থানা লুটপাটের সময় দ্বিতীয় ধাপে ক্যাম্পে অস্ত্র ঢুকে। আসলে থানায় হামলার সময় যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, তার সিংহভাগই নিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজন। কেননা থানা থেকে অস্ত্র লুট হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
তিনি আরও বলেন, এরপর জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন বিএনপি সমর্থিতরা দেখলো তাদের (বুনিয়া ও তার সমর্থিতরা) কাছে অনেক অস্ত্র আছে। খালি হাতে তাদের সঙ্গে পারা যাবে না। তখন চুয়া সেলিম ও তার লোকজন বাইরে থেকে টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে আনলো। তৃতীয় ধাপেও প্রায় ৩০টিরও বেশি অস্ত্র ঢুকেছে ক্যাম্পে।
জানা যায়, ৫ আগস্টের পর সরকার যখন অস্ত্র জমা দিতে বলেছিল, তখন ক্যাম্পের আশপাশের ময়লার স্তূপ থেকে তিনটি অস্ত্র সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গিয়েছিল। এরপর গত তিন মাসে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বুনিয়া সোহেলসহ দুপক্ষের প্রায় ৫০ জন মাদক কারবারি ও ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জেনেভা ক্যাম্পে বুনিয়া সেলিম ও চুয়া সেলিমের দুই পক্ষের একাধিক সংঘর্ষে অনেকের হাতে পিস্তল, রিভলবার, শটগান, পাইপগানসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। এর মধ্যে চুয়া সেলিম গ্রুপের চুয়া সেলিমের হাতে একাধিকবার পিস্তল ও রিভলবার দেখা গেছে। এছাড়াও তার গ্রুপের কিলার আকরাম, পারমনু, শাহ আলম, গালকাটা মনু, পিচ্চি রাজা, উলটা সালাম, বোবা বিরিয়ানির আলতাফ, ফরমা কামরান, বিল্লা ইমরান, এরশাদ, আলতাফের ছেলে ইরফান, পিচ্চি শাকিব ও মোল্লা বশিরসহ অনেককে অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেছে কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে।
বুনিয়া সোহেলে গ্রুপের বুনিয়া সোহেল, তার ভাই রানা, টুনটুন, রাজন ও কালোর হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র দেখা দেখা গেছে। এছাড়াও একাধিক সংঘর্ষে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে সৈয়দপুরিয়া বাবু, লাড্ডু কসাই ও তার ছেলে পারভেজ ও পিচ্চি শাকিল, নিয়াজ, কালো আনোয়ার, কলিম জাম্বু, মো. দ্বীন, নওশাদ, ডানো, আমির জয়নাল আবেদিন জয়, আরমান, চাকু ওরফে নুর ইসলাম, গাপ্পি দালাল, নিয়াজ, ইকবাল, মোটকি শিমার ছেলে ফরিদ, আরিফ, সৈয়দপুরিয়ার ডানো, বোম, নওশাদ, রকি, হীরা, জামাই আমিন, কানা আনোয়ার, ভাগিনা মুক্তার, এসকে জিলানির ছেলে নাসিম, কামাল বিরিয়ানির ইরফান, দিল্লি সাহিদ, গোলি জাহিদ, জিন্দা মোহাম্মদ আলি, মুরগী সুমনকে।
মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের ফাঁসির দাবিতে জেনেভা ক্যাম্পের প্রবেশ পথে ব্যানার
বিহারি জনগোষ্ঠীদের উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন এসপিজিআরসি’র আহ্বায়ক সৈকত আলী মাস্টার বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে আমরা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। সন্ধ্যা হলেই মারামারি, ককটেল বিস্ফোরণসহ গোলাগুলি হচ্ছে। এদিক থেকে এক গ্রুপ গুলি ছোড়ে, আবার ওদিক থেকে আরেক গ্রুপ গুলি ছোড়ে। এরা সবাই মাদক ব্যবসায়ী। প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। তারা মানুষ মারা থেকে শুরু করে বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর এমনকি লুটপাটও করছে। গত তিন মাস ধরে ক্যাম্পের কোনও বাসিন্দা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পের সংঘর্ষের মূল কারণ হলো মাদক কারবারি। ক্যাম্পের সবাই তো মাদকের সঙ্গে জড়িত না। একটা গোষ্ঠী আছে, একটা সিন্ডিকেট আছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই সিন্ডিকেট বানিয়ে রেখেছে। তারা মাদক ব্যবসার জন্য গোলাগুলি ও মানুষ মারছে। এই অল্প দিনে অনেক অস্ত্র ক্যাম্পের ভেতরে এসেছে। এগুলো কেমনে এলো, কারা দিলো? তাদের অস্ত্রের অনেক ভিডিও গণমাধ্যমে আসছে।
এসপিজিআরসি সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, গত ২৭ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে ক্যাম্পের সার্বিক বিষয় জানিয়ে আমরা একটা চিঠি দিয়েছি। প্রধান উপদেষ্টার এপিএস সাব্বির হোসেন চিঠি রিসিভ করেছেন। এরপর থেকে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। কী ছিল সেই চিঠিতে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে কী কী অসুবিধা আছে, আমাদের কী কী চাহিদা আছে, এই ক্যাম্পে আমরা কেন থাকতে পারছি না, এসব বিষয়ে উল্লেখ করা আছে চিঠিতে। এছাড়াও জেনেভা ক্যাম্পে কারা সংঘর্ষ করছে, কেন সংঘর্ষ হচ্ছে, কারা কারা মাদক ব্যবসা করছে, আমাদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানানো হয়েছে।
অস্ত্র উদ্ধারে জেনেভা ক্যাম্পে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হবে জানিয়ে সেনাবাহিনীর মোহাম্মদপুরে অস্থায়ী ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ও ২৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার মেজর নিয়ামুল বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশ ও র্যাবসহ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একাধিক যৌথ অভিযান চালানো হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে আমরা ক্যাম্পেকে মনিটরিংয়ে রেখেছি, যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। এরইমধ্যে জেনেভা ক্যাম্প থেকে কয়েকটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। ক্যাম্পে আরও যে কয়েকটি অস্ত্র রয়েছে, তার জন্য পুলিশ, র্যাবসহ আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন। তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধারে খুব শিগগিরই সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক সংশ্লিষ্ট ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা শুনেছি বিভিন্নভাবে ক্যাম্পে কিছু অস্ত্র ঢুকেছে। তবে কী পরিমাণে আছে, এটা নিশ্চিত নয়। ক্যাম্পে সংঘর্ষ ঠেকাতে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং অভিযান চলমান আছে। ক্যাম্পের দুই পাশে সবসময়ের জন্য পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। এরইমধ্যে ক্যাম্পের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ক্যাম্পের ৯টি ব্লকে অন্তত ২২টি সক্রিয় মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গ্রুপগুলো দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিতে সংঘাতে জড়িয়েছে। একটি আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুনিয়া সোহেল গ্রুপ ও অন্যটি বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিম গ্রুপ। এ ক্যাম্পে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। মাদক বিক্রির টাকার একটি অংশ যেতো স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিসহ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পকেটে। মূলত ক্যাম্পের আরেক নেতা মোল্লা বশিরের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে ভাগবাটোয়ারার অর্থ পৌঁছানো হতো। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মোল্লা বশিরের সঙ্গে মাদক ব্যবসার টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব হয় মাদক কারবারিদের আরেক নেতা বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে। এরপর মোল্লা বশির বিএনপি সমর্থিত চুয়া সেলিমের সঙ্গে যোগ দিলে বুনিয়া সোহেল গ্রুপের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়।
জেনেভা ক্যাম্পে সংঘাতকে কেন্দ্র করে বুনিয়া সোহেলের গ্রুপে যোগ দেয় ৭, ৩ ও ৫ নম্বর সেক্টরের কয়েকটি গ্রুপ। এর মধ্যে কামাল বিরিয়ানি গ্রুপ, সৈয়দপুরিয়া গ্রুপ, লাড্ডু কসাই ও ভাইয়া সেলিম গ্রুপ অন্যতম। অন্যদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা বশির চুয়া সেলিমের সঙ্গে যোগ দেয়। এছাড়াও ক্যাম্পের ১, ২, ৪, ৬ ও ৮ নম্বর সেক্টরের গ্রুপগুলোও চুয়া সেলিমের গ্রুপে যুক্ত হয়ে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপকে বিতাড়িত করতে শক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছে। চুয়া সেলিমের সঙ্গে রয়েছে বোবা বিরিয়ানি গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, চার্কু নুর ইসলাম গ্রুপ ও পিচ্চি রাজা গ্রুপ। ক্যাম্পের প্রত্যেকটা গ্রুপের ভেতরে রয়েছে আরও কয়েকটি উপ-গ্রুপ। মূলত ছোট ছোট গ্রুপের মাধ্যমে মাদক বিক্রি করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে মাদক বিক্রির স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। অন্যদিকে প্রধান গ্রুপ ও গ্রুপের সদস্যরা প্রশাসন, ক্যাম্পের অন্যান্য সমস্যা এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে কাজ করে থাকে। সম্প্রতি ক্যাম্পের বিভিন্ন সংঘর্ষে গ্রুপগুলোর নেতাদের কাছে ভারী অস্ত্র দেখা গেছে।
জেনেভা ক্যাম্প পরিচালনার জন্য এনএলআরসি এবং এসপিজিআরসি নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এ দুটি কমিটির সবাই পালিয়ে গেছে। এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দারা কমিটি দুটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে এসপিজিআরসির একটি আহ্বায়ক কমিটি দেয়।
ক্যাম্পের চারপাশটা উন্মুক্ত। ফলে বাধাহীনভাবেই এখানে মাদকদ্রব্য ঢুকছে। মাদক বহনের কাজে নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়াও ময়লার গাড়ি কিংবা বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মধ্যে ঢুকিয়ে এসব মাদকদ্রব্য নিয়ে আসা হচ্ছে ক্যাম্পের ভেতরে। হেরোইন ও ইয়াবা আকারে ছোট হওয়ায় যেকোনোভাবেই আনা যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মাদক কারবারি বলেন, দেশে যতদিন মাদক ঢুকবে, ততদিন এই ক্যাম্পেও মাদক আসবে। যখন প্রশাসনের অনেক কড়াকড়ি থাকে তখন লুকিয়ে বিভিন্নভাবে আনা হয়। এখানে প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়।
এসব বিষয়ে নন-লোকাল জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক এসপিজিআরসি সংগঠনের আহ্বায়ক সৈকত আলী মাস্টার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ক্যাম্পের বাইরে ও ভেতরে খোলামেলা মাদক বিক্রি হচ্ছে। আর নিয়ে আসা তো কোনও বিষয়ই নয়। দেশের সীমান্তে এত চেকপোস্টের পরও কীভাবে মাদক আসছে—এটার জবাব সরকারকে দিতে হবে। সরকার চাইলে দেশে আর মাদক ঢুকবে না। ক্যাম্পেও মাদক ব্যবসা থাকবে না।
এসপিজিআরসি সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘাত চলছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তারা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো তাহলে সাতটা তাজা প্রাণ চলে যেতো না, এতগুলো মানুষ আহত হতো না। পুলিশ ক্যাম্পের গেটে অবস্থান করে, অথচ ভেতরে সংঘর্ষ চলে। পুলিশ বলে ভেতরে তাদের দায়িত্ব না। মাঝে মধ্যে ক্যাম্পের ভেতরে অভিযান হচ্ছে ঠিকই। তারপরও এতগুলো মার্ডার হয়েছে। প্রতিনিয়ত সংঘাত হচ্ছে, মানুষ মরছে। আর আমরা সাধারণ বাসিন্দারা জিম্মি হয়ে আছি।
তিনি বলেন, আমরা সবসময় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তাদের সহযোগিতা চাইছি। তারাও বিচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা করছে। তবে মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে এখানকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারা তো সিলেটের কোনও এক এলাকা থেকে বুনিয়া সোহেলকে গ্রেফতার করেছে। এখনও অনেক রাঘববোয়াল রয়ে গেছে।