কাজী নজরুল ইসলাম। এই নামের উচ্চারণ শব্দাকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তেই ফেনায়িত ঊর্মিালার মতো তোলপাড় সৃষ্টি হয় ভাবরাজ্যে। মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত বিদ্রোহের ব্যঞ্জনা হৃদয়পাড়ে আছড়ে পড়ে সুরের মায়াজালে। কল্পরাজ্যে বেজে ওঠে সঙ্গীতের এক মায়াবী মুর্ছনা। বিদ্রোহী মেঘের উপরে আমরা তখন উড়তে দেখি রোমান্টিক এক সুর পাগল মুক্ত জীবনানন্দ। আমরা তাকে এভাবেই চিনি। এভাবেই জানি। এক হাতে কবিতা আর হাতে সঙ্গীত নিয়ে হাটতে গিয়ে তিনি সঙ্গীতকে এতটাই উচ্চে আরোহন করিয়েছেন যে কক্ষপথে সৃষ্টি হয়েছে গানের এক উজ্জ্বল আকাশ। তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। সংখ্যার বিচারে যা প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি। চড়িয়েছেন নিজস্ব সুরের ভেলায়। সুরগুলোকে আবার সাজিয়েছেন রাগরাগিণীর মিলন মালায়। প্রেমের গান, দেশের গান, লোক গান, মরমী গান, পল্লী গান, ইসলামী গান, গজল, টপ্পা, ঠুমরী, ধ্রুপদ, খেয়াল, কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, কজরী, ভজন এবং হাসির গানসহ রচনা করেছেন প্রায় আশি প্রকারের গান।
শুধু গান রচনা করেই ক্ষ্যান্ত হন নাই তিনি। সৃষ্টি করেছেন ১৮টি নতুন রাগের। এর ভিতরে ১৭টি গান কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে প্রচারিত হয়েছিল ৬ টি গান। ‘উদাসী ভৈরব’ গীতিনাট্যের সাথে। সময়টা ছিল ১৩৩৯ সালের নভেম্বর মাস। এরপর কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘নব রাগ মালিকা’র দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে প্রচারিত হয় ১১টি রাগ। এটি হয়েছিল ১৯৪০ সালের মে মাসে।
এই পর্যায়ে এসে আমরা পাঠককে নজরুল সঙ্গীতে নজরুলসৃষ্ট রাগ ও সুরের গানগুলো সম্পর্কে একটা নাতিদীর্ঘ ধারণা দেবার চেষ্টা করবো। তবে তার আগে রাগের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচিতি অবশ্যই রাগপাগল পাঠকের ক্ষুধিত হৃদয়ে কিছুটা বরফ শীতল পেলবতা এনে দেবে বলে মনে করি।
রাগ কি ও কেন প্রয়োজন
প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে স্বর ও বর্ণ দ্বারা ভূষিত ধ্বনিবিশেষকে রাগ বলা হয়। রাগ মানবচিত্তে এক ধরনের রঞ্জক ধ্বনির আবহ সৃষ্টি করে। ধাতুগত অর্থ করতে হলে, যে স্বর লহরী মনকে রঞ্জিত করে তাকে রাগ বলা হয় । রাগের এই ধ্বনিসমাবেশ আরোহী ও অবরোহীর একটি বিশেষ নিয়মে ঘটে, যাকে বলা হয় রাগলক্ষণ।
গতি প্রকৃতি ও বৈচিত্র্য অনুযায়ী রাগের জাতী নির্ধারিত হয়। সাধারণত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তিন জাতের রাগ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ, ষাড়ব ও ঔড়ব। সাধারণত ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা এবং ঠুমরী জাতীয় গানে রাগ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন আলাদা মুন্সিয়ানা। তিনি তার রচিত গজল ও ইসলামী গানেও করেছেন রাগের নিখুঁত ব্যবহার। এ ছাড়া তিনিই প্রথম সৃষ্টি করেছেন মিশ্র রাগ। একই গানে কয়েকটি রাগের চমৎকার মিশ্রণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন সম্পূর্ণ নতুন রাগ। যেমন ‘জাগো অরুণ ভৈরব, জাগো হে শিব ধ্যানী’ এই গানটির পূর্বাঙ্গের আরোহনে রাগ খাম্বাজ, অবরোহনে রাগ নির্ঝরিণী, উত্তারাঙ্গের আরোহনে রাগ আহির ভৈরব এবং স্থায়ী অংশে ব্যবহার করেছেন অরুণ ভৈরব রাগের শুদ্ধরুপ।
নারায়ণ চৌধুরীর ভাষায়: ‘নজরুল সম্পর্কে এই নিশ্চিত উক্তি করা যায় যে, তিনি তার প্রতিভার যাদুর দ্বারা ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের মর্মবস্তুটিকে সম্পূর্ণ অধিগত করতে সমর্থ হয়েছিলেন’।
আগেই বলেছি নজরুল তার মাত্র ১০/১২ বছরের সঙ্গীত জীবনে সৃষ্টি করেছেন ১৮টি নতুন রাগের। যেমন- রাগ বেণুকা, রাগ রুদ্র ভৈরব, রাগ অরুণ ভৈরব, রাগ আশা ভৈরব, রাগ শিবানী ভৈরব, রাগ উদাসী ভৈরব, রাগ সন্ধ্যামালতী, রাগ বনকুন্তলা, রাগ শঙ্করী, রাগ যোগিনী, রাগ রমলা, রাগ নির্ঝরিণী, রাগ রূপমঞ্জরী, রাগ দেবযানী, রাগ দোলন চম্পা, রাগ মীনাক্ষী, রাগ অরুণ রঞ্জনী, রাগ শিব সরস্বতী। এছাড়াও তিনি সৃষ্টি করেছেন ১০ টি নতুন ছন্দ, যেমন-প্রিয়া ছন্দ, মধুমতি ছন্দ, দীপক মালা ছন্দ, মত্ত ময়ূর ছন্দ, চগুবৃষ্টিপ্রপাত ছন্দ, স্বগতা ছন্দ, মন্দাকিনী ছন্দ, মণিমালা ছন্দ, রুচিরা ছন্দ, এবং মধু ভাষিণী ছন্দ৷ শুধু এখানেই শেষ নয়। সঙ্গীতের অপরিহার্য উপাদান তাল। নজরুল ৬টি সম্পূর্ণ নতুন তালের জন্ম দিয়েছেন যা তাল সঙ্গীতে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা ও বৈচিত্র্য। যেমন- তাল প্রিয়া, তাল মণিমালা, তাল মঞ্জুভাষিণী, তাল স্বগতা, তাল মন্দাকিনী এবং তাল নব নন্দন।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমে গজল গানের সুরেই রাগের ব্যবহার শুরু করেন, যা পরবর্তী সময়ে ক্রমশ বিচিত্র ও ব্যাপক আকারে পরিক্ষা নিরিক্ষায় রুপান্তরিত হয়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গজল হলো: ‘আসে বসন্ত ফুলবনে’ (ভীমপলশ্রী), ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ (ভৈরবী), ‘দুরন্ত বায়ু পুরবইয়া’ (কাফি-সিন্ধু), ‘এত জল ও কাজল চোখে’ (মান্দ), ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’ (পিলু), ‘কার নিকুঞ্জে রাত কাটায়ে’ (গারা-ভৈরবী), ‘কেন কাঁদে এ পরাণ’ (মিশ্র বেহাগ-খাম্বাজ), ‘চেয়ো না সুনয়না’ (বাগেশ্রী পিলু), ‘বসিয়া নদীকূলে’ (কালাংড়া) ইত্যাদি।
নজরুলসৃষ্ট রাগ ও সুর সংবলিত গানের উদাহরণ
১. ধ্রুপদ অঙ্গের গান- জাগো হে অরুণ ভৈরব জাগো হে শিব ধ্যানী, শোনাও তিমির-ভীত বিশ্বে নব দিনের বাণী। গানটি নজরুল সৃষ্ট অরুণ ভৈরব রাগে রচিত। সাদ্রা প্রকৃতির এই গানটি ঝাঁপতালে গাওয়া হয়।
২. খেয়াল অঙ্গের গান- মধু রাতে হে হৃদয়েশ মাধবী চাঁদ হয়ে এসো। গানটিতে মধুমাধবী সারং রাগের ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ত্রিতাল রীতিতে গাওয়া হয়।
৩. ঠুমরী অঙ্গের গান- রহি রহি কেন সে মুখ পড়ে মনে, ফিরায়ে দিয়াছি যারে অনাদরে অকারণে। গানটিতে রাগ নারায়ণীর কোমল ভাব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ গানটব ত্রিতাল ব্যবহার করে গাওয়া হয়।
৪. টপ্পা অঙ্গের গান- আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে যপি আমি শ্যামের নাম, মা হলেন মোর মন্ত্র গুরু ঠাকুর হলেন রাধা শ্যাম। নজরুলের নিজের সুর করা টপ্পা অঙ্গের যে দুটি গান উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। এই গানটিতে জয় জয়ন্তী রাগ ব্যবহার করে যৎ তালে গাওয়া হয়ে থাকে।
৫. কাজরী অঙ্গের গান- শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না, বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না। ভৈরবী কাফি ও পিলু রাগের মিশ্রণে রচিত এই গানটিতে কার্ফা তাল ব্যবহার করা হয়। এটিও নজরুলের নিজস্ব সুরে গায়িত হয়ে থাকে।
৬. ভজন অঙ্গের গান- শ্যাম সুন্দর গিরিধারী, মানস মধুবনে মাধবী সুরে, মুরলী বাজাতো বনচারী। গানটি মধুমাধবী সারং রাগে ত্রিতাল সহযোগে গাওয়া হয়।
৭. শ্যামা অঙ্গের গান- শ্মশানে জাগিছে শ্যামা অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে, জননী শান্তিময়ী বসিয়া আছে ঐ চিতার আগুন ঢেকে স্নেহ-আঁচলে। গানটি অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ কৌশিকী রাগে রচিত এবং ত্রিতাল সহযোগে গায়িত হয়।
৮. দক্ষিণ ভারতীয় ঘরানার গান- নিশিরাতে রিম ঝিম ঝিম বাদল নূপুর, বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর। প্রতাপ বরালী রাগের খাম্বাজ ঠাঠে গাওয়া এই গানটিতে আন্ধা তালের অপূর্ব মিলনে রাত্র দ্বিতীয় প্রহরে গাওয়া হয়।
এছাড়াও নজরুল সৃষ্ট ১৮টি রাগের ১৮টি গানের উদাহরণ নিচে দেয়া হল। গানগুলো নিয়ে সামান্য চিন্তাভাবনা করলেই ১৮টি রাগের গতি, প্রকৃতি, বৈচিত্র্য, সুরের ধরণ, সুরের আরোহন-অবরোহন, তানাঙ্ক, গায়নরীতি, ঠাট, স্বরের প্রক্ষেপণ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ ধারণা লাভ করা যাবে। রাগাগ্রহীদের সঙ্গীত সাধনায় যা রসদ হিসেবে কাজে দেবে।
১. জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে শিব-ধ্যানী।
শোনাও তিমির- ভীত-বিশ্বে নব দিনের বাণী।।
রাগ অরুণ ভৈরব। তালে ঝাঁপতাল।
২. মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ, আছে শুধু প্রাণ
অনন্ত আনন্দ হাসি অফুরান।।
রাগ আশা ভৈরব। তাল-ত্রিতাল।
৩. ভগবান শিব জাগো জাগো ছাড়িয়া গেছে দেবী
শিবানী সতী
শক্তিহীন আজি সৃষ্টি চন্দ্র- সূর্য তারা হীন জ্যোতি।।
রাগ শিবানী ভৈরব। তাল- ত্রিতাল।
৪. শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া শঙ্করী শিবানী
বালিকা-সম লীলাময়ী নীল উৎপল পাণি।।
রাগ শঙ্করী। তাল- একতাল।
৫. সতী-হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে
বিষাণ ত্রিশূল ফেলি গভীর বিষাদে।।
রাগ উদাসী ভৈরব। তাল- ত্রিতাল।
৬. রুম্ ঝুম্ রুমু ঝুম্ কে বাজায় জল ঝুমঝুমি
চমকিয়া জাগে ঘুমন্ত বনভূমি।।
রাগ নির্ঝরিণী। তাল ত্রিতাল
৭. বেণুকা ও- কে বাজায় মহুয়া বনে
কেন ঝড় তোলে তার সুর আমার মনে।।
রাগ বেণুকা। তাল- ত্রিতাল।
৮. চপল আঁখির ভাষায়, হে মীণাক্ষী কয়ে যাও
না বলা কোন বাণী বলিতে চাও।।
রাগ- মীনাক্ষী। তাল- ত্রিতাল।
৯. শোন্ ও সন্ধ্যামালতী, বালিকা তপতী
বেলা শেষের বাঁশি বাজে।
রাগ- সন্ধ্যামালতী। তাল- সেতারখানি।
১০. বন-কুন্তল এলায়ে বন-শবরী ঝুরে সকরুণ সুরে
বিষাদিত ছায়া তার চৈতালি সন্ধ্যার চাঁদের মুকুরে।।
রাগ- বন কুন্তলা। তাল- ত্রিতাল।
১১. দোলন চাঁপা বনে দোলে দোল
পূর্ণিমা- রাতে চাঁদের সাথে।
রাগ- দোলন-চাঁপা। তাল- ত্রিতাল।
১২. হাসে আকাশে শুকতারা হাসে
অরুণ- রঞ্জনী ঊষার পাশে।।
রাগ- অরুণ- রঞ্জনী। তাল- ত্রিতাল।
১৩. পায়েলা বোলে রিনিঝিনি
নাচে রুপ- মঞ্জরি শ্রীরাধার সঙ্গিনী।।
রাগ- রুপ মঞ্জরি। তাল- ত্রিতাল।
১৪. এসো শঙ্কর ক্রোধাগ্নি হে প্রলয়ঙ্কর
রুদ্র ভৈরব! সৃষ্টি সংহর, সংহর।।
রাগ- রুদ্র ভৈরব। তাল- সুরফাঁকতা।
১৫. দেবযানীর মনে প্রথম প্রীতির কলি জাগে
কাঁপে অধর- আঁখি অরুণ অনুরাগে।।
রাগ- দেবযানী। তাল- নবনন্দন।
১৬. শান্ত হও, শিব, বিরহ- বিহ্বল
চন্দ্র লেখায় বাঁধো জটাজুট পিঙ্গল।।
রাগ- যোগিনী। তাল- ত্রিতাল।
১৭. জয় ব্রহ্ম বিদ্যা শিব- স্বরস্বতী
জয় ধ্রুব জ্যোতি, জয় দেববতী।।
রাগ- শিব- স্বরস্বতী। তাল- ত্রিতাল।
১৮. ফিরিয়া যদি সে আসে আমার খোঁজে ঝরা গোলাবে
আনিয়া সমাধি পাশে আমার বিদায় বাণী শোনাবে।।
এই গানটি শুরুতে নজরুল নিজেই সুর করেছিলেন এবং তাতে রাগ রমলার সুর বৈচিত্র্য দিয়ে সাজিয়েছিলেন। কিন্ত পরবর্তী কালে গানটির নজরুল সৃষ্ট সুর স্বরলিপি পাওয়া যায় না। ফলে নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহে এর রাগের উল্লেখ পাওয়া যায় নাই। উল্লেখ্য নজরুল সৃষ্ট ১৮ টি রাগের মধ্য থেকে ১৭টি রাগের উপরে সতেরোটি গানের যে উদাহরণ দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, নজরুল রাগ সৃষ্টির পরে উক্ত রাগ সমূহের যে নামকরণ করেছেন প্রত্যেকটা গানের ভিতরে কিন্ত সেই নামে উল্লেখ আছে। শুধুমাত্র রাগ রমলার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে৷ আর এই জন্যই হয়তো নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহে এই গানটির রাগ এবং মূল সুরের উল্লেখ নাই।
তথ্য সূত্র :
১. নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ- নজরুল ইনস্টিটিউট।
২. নজরুল সঙ্গীতে রাগের ব্যবহার- লীনা তাপসী খান
৩. বাংলা গানের গতিপথ- চিন্ময় চট্রোপাধ্যায়।
৪. বাংলা গানের ইতিহাস- গোলাম মুরশিদ।