বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও সংগীত সবখানে ছিল অবাধ বিচরণ। আমরা তার যে বিদ্রোহী সত্ত্বার পরিচয় পাই সেটা তাঁর জীবনেও প্রবল ছিল। তাঁর সকল সাহিত্য ও শিল্পকর্মেও রাজনৈতিক মননেরও বাঙালি জাতীয়তাবোধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নজরুলের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যসাধনার মূল উদ্দেশই ছিল রাজনীতি করা। রাজনীতির মাধ্যমে তিনি সমাজ পরিবর্তন, উন্নয়ন ও নবজাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন। অবহেলিত ও সাধারণ জনগণের প্রতি ছিল কবির প্রগাঢ় ভালোবাসা। পরাধীন ভারতের মুক্তির জন্য তিনি ছিলেন ব্যাকুল প্রাণ। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য, স্বাধীনতার প্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি ভারতবাসীর অন্তরে অন্তরে। ইংরেজ শাসনে বিধ্বস্ত দেশ থেকে তিনি মরিয়া ছিলেন ফিরিঙ্গিদেও তাড়াতে। দেশপ্রেমের অগ্নিমশাল জ্বেলে একদিকে যেমন চেয়েছেন ইংরেজদের তাড়াতে, আবার চেয়েছেন সামাজিক শেঅষন মুক্ত করে শ্রেণিচেতনার প্রতিষ্ঠা—যার মধ্য দিয়ে দরিদ্র মানুষ সমাজের শোষক শ্রেণির হাত থেকে মুক্ত হবে।
স্বরাজের জন্য গণজাগরণ জরুরি—এটা তিনি বুঝতেন আর তাই মননশীলতাকে বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে। যে কারণে তার কবিতার মধ্যে যে অগ্নিমশাল জ্বেলেছিলেন আজও তা আমাদের চলার পথকে মসৃন রাখে। আজও আমরা উজীজ্জীবিত হই বিদ্রোহী কবির চেতনার ধারায়।
ভারতবর্ষে সম্প্রদায় চেতনার বিরুদ্ধে যারা তখন সক্রিয় ডয়লো কবি নজরুল তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। যে কারণে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান বিভেদের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী লিখে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ইস্তেহারের মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন সবখানে। তিনি লিখেছেন, ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা। বলেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন? কান্ডারী বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ আবার ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান,/ মুসলিম তার নয়নমণি,/হিন্দু তার প্রাণ।’
দরিদ্র, নীপিড়িত মানুষের জন্য কবি কাজী নজরুল ইসলামের মমত্ব কতোটা অসীম সেটা তার বিভিন্ন লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে তিনি লিখেছেন দুহাতে। তার সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থে এর পরিষ্কার অভিব্যক্তি দেখা যায়। এই কাব্যগ্রন্থের ‘কুলি মজুর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘দেখিনু সেদিন রেলে,/কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল,/এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’ সময় বহু পার হলেও এই কবিতার বাস্তবতা আমাদের অন্তরে নিপীড়কের বিরুদ্ধে অভিঘাত তোলে। প্রতিনিয়তই মনে হয়, এই সমাজ না ভাঙা পর্যন্ত এসব দৃশ্য কোনকালেই যাবে না। এই সমাজ ভাঙার জন্য শ্রেণি-সংগ্রামের বিকল্প নেই, কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো—আজ যে কবিতা দেখে শ্রেণি-সংগ্রামের কথা মাথায় আসে, সেই কবিতা যিনি লিখেছেন তার শ্রেণি-সংগ্রামের এই চেতনার উৎস আছে কি?
‘বিদ্রোহী’ কবিতায়ও নজরুলের যে খেদ ভাঙার তেজ তার উৎস কি শুধু ইংরেজরা? নজরুল বিদ্রোহী কবি, সাম্যেও কবি—এটা নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার চেতনায় বলয় বৃদ্ধিতে আরেকজন মানুষের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি হলেন ভারতবর্ষেও কমিউনিস্ট পার্টিও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ। মুজাফফর আহমদের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়, সখ্য ও বসবাস একটি বিশেষ ঘটনা। মেহনতী মানুষের প্রতি অসীম দরদ ও তাদেও শ্রেণিমুক্তির জন্য শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণা—এটা পরিশীলিত এজন্যে যে, হুহাট করে কোনো চিন্তা করে কবি লেখেননি। সমাজের অধিকারহারা বঞ্চিত মানুষের প্রতি নজরুলের ভালোবাসা, দেশপ্রেম ইত্যাদি সাম্যবাদী চেতনায়, প্রলেতারিয়েত শ্রেণির রাজনীতিতে প্রবাহিত হয়েছিল কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের সান্নিধ্যে এসেই। কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা শিরোনামে যে বই তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে তাঁর অদেখা অতীত জীবনের অনেক ঘটনা উল্লেখ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ওই অর্থে বিপ্লবী না, তিনি বিপ্লবী হতেও চাননি। তবু তৎকালীন ভারতবর্ষেও খোল-নলচে বদলে দিতে একজন বিপ্লবীর আবির্ভাব কামনা করেছিলেন একান্তভাবে। সেজন্যে তিনি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,/নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,/নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ/পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা,/পথে পথে গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।/নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ/এই তোর রুদ্রের প্রসাদ। তবে কি রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অপেক্ষায়ই ছিলেন? তবে, এ কথা ঠিক যে কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের কারণে নজরুল সাংবাদিক হিসেবে ও সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।
নজরুল মানুষকে জাতির ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। তিনি জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে একাত্ম করে নির্যাতিত শ্রেণির মুক্তির কথা ভেবেছেন। নজরুল বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে বৈষম্য ছিল, সে বৈষম্যের বিরুদ্ধ্বে তাঁর অধিকাংশ সাহিত্য সৃষ্টি করে গেছেন।
মূলত সাম্প্রদায়িকতার খোলসকে সামনে নিয়ে এসে বাংলা ভাষাকে শেকড় ছাড়া করার প্রয়াস চালান হয়। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে ঔপনিবেশ স্থাপনের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালি রুখে দাঁড়ায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবিদের চেতনা ধারণ করে। নজরুল ছিলেন স্বাধীনচেতা মুক্ত মনের মানুষ। হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির ঐক্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি সারাটি জীবন বৈষম্যে সৃষ্টির রাজনীতির বিরুদ্ধ্বে কথা বলে গেছেন।
নজরুল শ্রেণি চেতনার বিষয়টি বুঝেছিলেন নিজের জীবন থেকে। তার যে পোড় খাওয়া জীবন, সেখানে তিনি যেভাবে ধনীক শ্রেণির সাথে দরিদ্র মানুষের শাসন-শোষনের চিত্র দেখেছেন, তার মধ্য দিয়ে সাম্যের বার্তা তিনি দিয়েছেন সাধারণ মানুষকে। তার কবিতার ভিতরে এ উদাহরণ শত শত আছে। নজরুলের গান, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র- এককথায় সমগ্র নজরুল সাহিত্যে দুটি ভাবকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। সামাজিক বৈষম্য ও সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে বৈরী মনোভাব তার মধ্যে তিনি লিখেছেন সম্প্রীতির কবিতা লিখেছেন সমন্বয়ের কবিতা। তার মধ্যে যে সাম্যবাদী চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিলে, সেই চেতনা তার কবিতাকে ঝৃদ্ধ করেছে, ঋদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে। সাম্যবাদী চেতনায় ভাস্বর কবি নজরুল ইসলাম প্রেম, দ্রোহ, সংগ্রাম, বৈষম্যেও বিরুদ্ধে আজও বয়ে চলেছেন চেতনার অন্তর্গত ভেতর-বাহির দিয়ে। নজরুল আমাদেও সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ।