ঢাকা ০৬:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেনে নিন; সাপে কামড়ালে কি করবেন

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সর্পদংশন প্রায়ই ঘটে থাকে। দেশে ১২ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এদের মধ্যে শুধু ছয় ধরনের সাপ বিষধর। এগুলো হলো—চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার, গোখরা বা কোবরা, পদ্মগোখরা বা রাজগোখরা বা কিং কোবরা, শঙ্খিনী বা ব্যান্ডেড ক্রেইট বা কেউটে, সবুজ সাপ বা গ্রিন স্নেক এবং সামুদ্রিক সাপ বা সি স্নেক।

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩ লাখের মতো বিষাক্ত সাপে কামড়ানোর দুর্ঘটনা ঘটে থাকে এবং এদের ১০ শতাংশ মারা যায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এরূপ বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ কোবরা সাপের কামড় থেকে হয়ে থাকে। সব বিষাক্ত সাপ চার পরিবারের যেকোনো একটির অন্তর্ভুক্ত—যেগুলো হলো ইলাপিডে, হাইড্রোপিডে (সামুদ্রিক বিষাক্ত সাপ), ভাইপারিডে ও কলুব্রিডে। সবচেয়ে বিষধর সাপ ইলাপিডে প্রজাতির হতে দেখা যায়, যেমন—কোবরা, কোরাল ইত্যাদি।

বড় চাকের কালো ও লাল রঙের মধ্যখানে হলুদ বর্ণের ডোরাকাটা দেখে কোরাল সাপ চেনা যায়। যে কারণে প্রবচন আছে—‘হলুদের সঙ্গে লাল রং; মৃত্যুক্ষণ’।
সর্পবিষ পলিপেপটাইড, প্রোটিন বিনষ্টকারী ও অন্যান্য বিষালো পদার্থের যৌগবিশেষ। সাধারণভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষ নির্দিষ্ট ধরনের হয়ে থাকে।

যেমন—ইলাপিডে ও হাইড্রোপিডে প্রজাতির বিষ মূলত নিউরোটক্সিক, স্নায়ুতন্ত্রের প্রবাহপথে বিশেষ করে সন্ধিগুলোতে বাধা সৃষ্টি করে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার কেন্দ্রগুলো অবশ করে দেয় ও সেভাবে মৃত্যু ঘটায়। অন্যদিকে ভাইপারিডের বিষ প্রধানত কোষ ধ্বংসকারী, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে, তীব্র রক্তক্ষরণ ঘটায়। এতে করে রক্তপাতের কারণে, শকে কিংবা কিডনি ফেইলিওরে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
সাপের কামড়ের লক্ষণগুলো :

■ আনুমানিক ২০% ক্ষেত্রে বিষাক্ত সাপের কামড়ের পরও বিষক্রিয়া না ঘটতে পারে। বাকি সব বিষক্রিয়ার পরিমাণ অনেক ‘যদি’র ওপর নির্ভর করে। আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্য, আকার, ক্রুদ্ধ সাপের প্রজাতি, সাপের বিষথলি কামড়ানোর সময় কতটা পূর্ণ ছিল, বিষদাঁত বা কিরূপ—এসবের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া কামড়ের সংখ্যা, স্থান, গভীরতা, কতটুকু বিষ ঢেলেছে এবং কত ক্ষিপ্রতা ও সফলতার সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা হলো—এসব কিছুর সঙ্গে বিষক্রিয়ার তীব্রতার সম্পর্ক রয়েছে।

■ ভাইপারিডে সাধারণত পায়ে বা হাতে কামড়ে থাকে। কামড়ানোর স্থান দাঁত বসে গিয়ে গর্তের মতো হয়ে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই স্থানে জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভূত হয় এবং তা ফুলে যায়। পরবর্তী সময়ে বিষ যখন লিমফাটিকস ও শিরাপথ বেয়ে ছড়াতে থাকে, তখন কামড়ানোর স্থানের ওপরের দিক ফুলে যেতে থাকে, সেখানে চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তা মারাত্মক প্রকৃতির হলে ওই সব স্থানে ফোসকা কিংবা পচা ঘা দেখা দিতে পারে। এসব স্থানিক লক্ষণ ছাড়া রোগীর বমিভাব, বমি, মাংসপেশির অনৈচ্ছিক সঞ্চালন দেখা দিতে পারে বা বিষক্রিয়া তীব্রতর হলে হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন, শকে চলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মৃত্যু ঘটে।

■ তুলনামূলকভাবে ইলাপিডে ও সামুদ্রিক বিষাক্ত সাপের দংশনের স্থানে কম যন্ত্রণা থাকে। তবে কোবরার দংশন খুব ব্যথা ও পচা ঘা যুক্ত হয়ে থাকে। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, এ দুই প্রজাতির সর্পবিষ প্রধানত স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে, রোগী মানসিক আচ্ছন্নতা, জ্ঞান লোপ পাওয়া, প্যারালাইসিসগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসকেন্দ্রগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার ফলে মারা যায়।

বিষাক্ত সর্পদংশনের লক্ষণগুলো :
■ দংশিত স্থানে কোনোরূপ চিহ্ন না-ও থাকতে পারে। চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোসকা পড়া, পচন, দংশিত স্থানে হতে ক্রমাগত রক্তপাত।
■ ঘুম ঘুম ভাব।
■ অস্বাভাবিক দুর্বলতা। চোখের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা। জিহবা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া। ঢোক গিলতে অসুবিধা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি চলে আসা।
■ হাঁটতে অসুবিধা, হাত-পা অবশভাব।
■ ঘাড় দুর্বল, মাথা হেলে যায়।
■ শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা।
■ কালো রঙের প্রস্রাব।

প্রাথমিক চিকিৎসা :
■ ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই, সর্পদংশনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে’—এই মর্মে রোগীকে আশ্বস্ত করা। রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখা। দংশিত অঙ্গ (হাত, পা) স্প্লিন্ট/চ্যাপ্টা/বাঁশের চেলা এবং ব্যান্ডেজ/লম্বা কাপড় (৩ থেকে ৪ ইঞ্চি চওড়া) যেমন—গামছা, ওড়না ইত্যাদি দ্বারা নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। এমনভাবে যেন বাঁধুন যেন অনেক বেশি শক্ত অথবা ঢিলা না হয়। বাঁধনের নিচ দিয়ে যাতে দুটি আঙুল ঢোকানো যায়, তা যেমন বিষের প্রবাহের বাধা দিতে যথেষ্ট কার্যকরী, তেমনি রক্ত চলাচলেরও উপযোগী থাকবে বলা যায়।
■ রোগীকে নিথর এবং নিশ্চল হয়ে শুয়ে যেতে হবে, যাতে আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়া না হয়। কপালের দংশনে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতের দংশনে হাত নড়াচড়া করা যাবে না।
■ দংশিত অঙ্গের (হাত-পা) হাড় ভেঙে গেলে স্প্লিন্টের সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা উচিত। যদি ক্রেপ ব্যান্ডেজ থাকে, তাহলে তা-ই ব্যবহার করা চলে। দংশনকৃত হাত-পা এমনভাবে কাপড় ও কাঠ (বা বাঁশের কঞ্চি) দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিরা নড়াচড়া করা না যায়। গিরা নড়াচড়াতে মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
■ দংশনকৃত ক্ষতস্থান শুধু একবার ভিজা কাপড় কিংবা জীবানুনাশক লোশনে মুছে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
■ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দংশিত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, তাগা খুলে ফেলতে হবে। দংশিত অঙ্গ ফুলে গেলে পরবর্তী সময়ে এগুলো খুলতে অসুবিধা হয়।
■ দংশিত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মোটর বাইক বা অ্যাম্বুল্যান্সের সাহায্য গ্রহণ করা।
■ রোগীকে এক পাশ কাত করে রাখা।
■ যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে, তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল ব্যবহার করা এবং প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।
■ কেউ যদি সাপ মেরে থাকে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় শনাক্তকরণের জন্য তা নিয়ে যেতে হবে। তবে সাপ মারার জন্য, ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না।

ব্যবস্থাপত্র :
■ চিকিৎসার স্বার্থে প্রথমে জেনে নেওয়া চাই-ওই দংশন বিষাক্ত সাপের ছিল কি না বা আদৌ বিষক্রিয়া ঘটেছে কি না। কেননা সর্পদংশনের প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটে বিষহীন জ্যান্ত সাপের কামড়ে।
■ সাধারণভাবে দংশন স্থানে যদি বিষদাঁতের ফুটো না পাওয়া যায় এবং সেই স্থানে কোনো ব্যথা, জ্বালা বা ফুলে যাওয়া অবস্থার সৃষ্টি না হয়, তবে তা বিষাক্ত সাপের কামড়ে নয়—এ ধারণা সমীচীন। যদিও পুরোপুরি তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে নির্বিষ দংশনে ওষুধের সাহায্যে কোনোরূপ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
■ স্বাস্থ্য সুবিধা নিতে হাসপাতালে পৌঁছতে বিলম্ব না করা। রোগীকে দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেখানে সার্বিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি শিরায় স্যালাইন, প্রয়োজনে রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন অংশ, ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক ব্যবস্থা, অ্যান্টিবায়োটিকস; ব্যথানাশক ওষুধ শিশুর প্রতি কেজি ওজন হিসেবে প্রয়োগ করে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সর্বোপরি সাপের বিষের প্রতিষেধক ওষুধ ‘অ্যান্টিভেনিন’ ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
■ এখানে উল্লেখ্য যে, কামড়ানোর চার ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিভেনিন ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে বেশি সুফল মেলে। কিন্তু ১২ ঘণ্টা পরে প্রয়োগ করা হলে তার কার্যক্ষমতা নিয়ে সংশয় থাকে। হাত বা পা অত্যধিক ফুলে যাওয়াসহ দংশনের স্থানে পচা ঘায়ের চিকিৎসায় কোনো কোনো সময় সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

সর্পসংশনের পর যা করা উচিত নয় :
■ দংশিত অঙ্গে কোনো রকম গিঁট দেওয়া যাবে না। বিশেষ সতর্কতা: ইতিমধ্যে যদি গিঁট প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, চিকিৎসকের উপস্থিতিতে, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা নিশ্চিত করে অ্যান্টিভেনম শুরু করা, অতপর গিঁট অপসারণ করা।
■ দংশিত স্থানে কাটা, সুঁই ফুটানো কিংবা কোনো রকম প্রলেপ না লাগানো।
■ ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়-ফুঁক করে অযথা সময়ক্ষেপণ না করা।
■ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে না দেওয়া।
■ দংশিত স্থানে কোনোভাবেই হারবাল ওষুধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাশিয়াম, কাদা, গোবর, রাসায়নিক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। কামড়ানোর জায়গায় অ্যালকোহল জাতীয় কিছু দেওয়া যাবে না।
■ ব্যথা উপশমের জন্য অ্যাসপিরিন দেওয়া যাবে না।

যেসব ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না :
■ অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ : হিস্টাসিন, এভিল, ফেনারগন।
■ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ : ওরাডেক্সন, ডেকাসন, হাইড্রোকরটিসন।
■ সিডেটিভ জাতীয় ওষুধ : সেডিল, রিলাক্সেন।
■ অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য ব্যথা নিরাময়কারী ওষুধ : ডিসপ্রিন ক্লোফেনাক, সিলেকক্সিব, রোফেকক্সিব।
■ প্রচলিত বিভিন্ন বনাজি বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ।

সূত্র  : কালেরকণ্ঠ।

আরো পড়ুন : ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

জেনে নিন; সাপে কামড়ালে কি করবেন

আপডেট সময় ১১:৩৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সর্পদংশন প্রায়ই ঘটে থাকে। দেশে ১২ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এদের মধ্যে শুধু ছয় ধরনের সাপ বিষধর। এগুলো হলো—চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার, গোখরা বা কোবরা, পদ্মগোখরা বা রাজগোখরা বা কিং কোবরা, শঙ্খিনী বা ব্যান্ডেড ক্রেইট বা কেউটে, সবুজ সাপ বা গ্রিন স্নেক এবং সামুদ্রিক সাপ বা সি স্নেক।

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৩ লাখের মতো বিষাক্ত সাপে কামড়ানোর দুর্ঘটনা ঘটে থাকে এবং এদের ১০ শতাংশ মারা যায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এরূপ বেশির ভাগ মৃত্যুর কারণ কোবরা সাপের কামড় থেকে হয়ে থাকে। সব বিষাক্ত সাপ চার পরিবারের যেকোনো একটির অন্তর্ভুক্ত—যেগুলো হলো ইলাপিডে, হাইড্রোপিডে (সামুদ্রিক বিষাক্ত সাপ), ভাইপারিডে ও কলুব্রিডে। সবচেয়ে বিষধর সাপ ইলাপিডে প্রজাতির হতে দেখা যায়, যেমন—কোবরা, কোরাল ইত্যাদি।

বড় চাকের কালো ও লাল রঙের মধ্যখানে হলুদ বর্ণের ডোরাকাটা দেখে কোরাল সাপ চেনা যায়। যে কারণে প্রবচন আছে—‘হলুদের সঙ্গে লাল রং; মৃত্যুক্ষণ’।
সর্পবিষ পলিপেপটাইড, প্রোটিন বিনষ্টকারী ও অন্যান্য বিষালো পদার্থের যৌগবিশেষ। সাধারণভাবে নির্দিষ্ট প্রজাতির সাপের বিষ নির্দিষ্ট ধরনের হয়ে থাকে।

যেমন—ইলাপিডে ও হাইড্রোপিডে প্রজাতির বিষ মূলত নিউরোটক্সিক, স্নায়ুতন্ত্রের প্রবাহপথে বিশেষ করে সন্ধিগুলোতে বাধা সৃষ্টি করে, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার কেন্দ্রগুলো অবশ করে দেয় ও সেভাবে মৃত্যু ঘটায়। অন্যদিকে ভাইপারিডের বিষ প্রধানত কোষ ধ্বংসকারী, রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে, তীব্র রক্তক্ষরণ ঘটায়। এতে করে রক্তপাতের কারণে, শকে কিংবা কিডনি ফেইলিওরে রোগীর মৃত্যু ঘটে।
সাপের কামড়ের লক্ষণগুলো :

■ আনুমানিক ২০% ক্ষেত্রে বিষাক্ত সাপের কামড়ের পরও বিষক্রিয়া না ঘটতে পারে। বাকি সব বিষক্রিয়ার পরিমাণ অনেক ‘যদি’র ওপর নির্ভর করে। আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স, স্বাস্থ্য, আকার, ক্রুদ্ধ সাপের প্রজাতি, সাপের বিষথলি কামড়ানোর সময় কতটা পূর্ণ ছিল, বিষদাঁত বা কিরূপ—এসবের ওপর নির্ভর করে। তা ছাড়া কামড়ের সংখ্যা, স্থান, গভীরতা, কতটুকু বিষ ঢেলেছে এবং কত ক্ষিপ্রতা ও সফলতার সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা হলো—এসব কিছুর সঙ্গে বিষক্রিয়ার তীব্রতার সম্পর্ক রয়েছে।

■ ভাইপারিডে সাধারণত পায়ে বা হাতে কামড়ে থাকে। কামড়ানোর স্থান দাঁত বসে গিয়ে গর্তের মতো হয়ে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই স্থানে জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভূত হয় এবং তা ফুলে যায়। পরবর্তী সময়ে বিষ যখন লিমফাটিকস ও শিরাপথ বেয়ে ছড়াতে থাকে, তখন কামড়ানোর স্থানের ওপরের দিক ফুলে যেতে থাকে, সেখানে চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তা মারাত্মক প্রকৃতির হলে ওই সব স্থানে ফোসকা কিংবা পচা ঘা দেখা দিতে পারে। এসব স্থানিক লক্ষণ ছাড়া রোগীর বমিভাব, বমি, মাংসপেশির অনৈচ্ছিক সঞ্চালন দেখা দিতে পারে বা বিষক্রিয়া তীব্রতর হলে হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন, শকে চলে যাওয়া ইত্যাদি কারণে মৃত্যু ঘটে।

■ তুলনামূলকভাবে ইলাপিডে ও সামুদ্রিক বিষাক্ত সাপের দংশনের স্থানে কম যন্ত্রণা থাকে। তবে কোবরার দংশন খুব ব্যথা ও পচা ঘা যুক্ত হয়ে থাকে। আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, এ দুই প্রজাতির সর্পবিষ প্রধানত স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে, রোগী মানসিক আচ্ছন্নতা, জ্ঞান লোপ পাওয়া, প্যারালাইসিসগ্রস্ত অবস্থায় পতিত হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসকেন্দ্রগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার ফলে মারা যায়।

বিষাক্ত সর্পদংশনের লক্ষণগুলো :
■ দংশিত স্থানে কোনোরূপ চিহ্ন না-ও থাকতে পারে। চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোসকা পড়া, পচন, দংশিত স্থানে হতে ক্রমাগত রক্তপাত।
■ ঘুম ঘুম ভাব।
■ অস্বাভাবিক দুর্বলতা। চোখের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা। জিহবা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া। ঢোক গিলতে অসুবিধা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি চলে আসা।
■ হাঁটতে অসুবিধা, হাত-পা অবশভাব।
■ ঘাড় দুর্বল, মাথা হেলে যায়।
■ শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা।
■ কালো রঙের প্রস্রাব।

প্রাথমিক চিকিৎসা :
■ ‘ভয়ের কোনো কারণ নেই, সর্পদংশনের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে’—এই মর্মে রোগীকে আশ্বস্ত করা। রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখা। দংশিত অঙ্গ (হাত, পা) স্প্লিন্ট/চ্যাপ্টা/বাঁশের চেলা এবং ব্যান্ডেজ/লম্বা কাপড় (৩ থেকে ৪ ইঞ্চি চওড়া) যেমন—গামছা, ওড়না ইত্যাদি দ্বারা নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। এমনভাবে যেন বাঁধুন যেন অনেক বেশি শক্ত অথবা ঢিলা না হয়। বাঁধনের নিচ দিয়ে যাতে দুটি আঙুল ঢোকানো যায়, তা যেমন বিষের প্রবাহের বাধা দিতে যথেষ্ট কার্যকরী, তেমনি রক্ত চলাচলেরও উপযোগী থাকবে বলা যায়।
■ রোগীকে নিথর এবং নিশ্চল হয়ে শুয়ে যেতে হবে, যাতে আক্রান্ত অঙ্গ নড়াচড়া না হয়। কপালের দংশনে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতের দংশনে হাত নড়াচড়া করা যাবে না।
■ দংশিত অঙ্গের (হাত-পা) হাড় ভেঙে গেলে স্প্লিন্টের সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা উচিত। যদি ক্রেপ ব্যান্ডেজ থাকে, তাহলে তা-ই ব্যবহার করা চলে। দংশনকৃত হাত-পা এমনভাবে কাপড় ও কাঠ (বা বাঁশের কঞ্চি) দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিরা নড়াচড়া করা না যায়। গিরা নড়াচড়াতে মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
■ দংশনকৃত ক্ষতস্থান শুধু একবার ভিজা কাপড় কিংবা জীবানুনাশক লোশনে মুছে ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
■ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দংশিত অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, তাগা খুলে ফেলতে হবে। দংশিত অঙ্গ ফুলে গেলে পরবর্তী সময়ে এগুলো খুলতে অসুবিধা হয়।
■ দংশিত ব্যক্তিকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য মোটর বাইক বা অ্যাম্বুল্যান্সের সাহায্য গ্রহণ করা।
■ রোগীকে এক পাশ কাত করে রাখা।
■ যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে, তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল ব্যবহার করা এবং প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।
■ কেউ যদি সাপ মেরে থাকে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় শনাক্তকরণের জন্য তা নিয়ে যেতে হবে। তবে সাপ মারার জন্য, ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না।

ব্যবস্থাপত্র :
■ চিকিৎসার স্বার্থে প্রথমে জেনে নেওয়া চাই-ওই দংশন বিষাক্ত সাপের ছিল কি না বা আদৌ বিষক্রিয়া ঘটেছে কি না। কেননা সর্পদংশনের প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটে বিষহীন জ্যান্ত সাপের কামড়ে।
■ সাধারণভাবে দংশন স্থানে যদি বিষদাঁতের ফুটো না পাওয়া যায় এবং সেই স্থানে কোনো ব্যথা, জ্বালা বা ফুলে যাওয়া অবস্থার সৃষ্টি না হয়, তবে তা বিষাক্ত সাপের কামড়ে নয়—এ ধারণা সমীচীন। যদিও পুরোপুরি তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে নির্বিষ দংশনে ওষুধের সাহায্যে কোনোরূপ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
■ স্বাস্থ্য সুবিধা নিতে হাসপাতালে পৌঁছতে বিলম্ব না করা। রোগীকে দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেখানে সার্বিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি শিরায় স্যালাইন, প্রয়োজনে রক্ত বা রক্তের বিভিন্ন অংশ, ধনুষ্টংকারের প্রতিষেধক ব্যবস্থা, অ্যান্টিবায়োটিকস; ব্যথানাশক ওষুধ শিশুর প্রতি কেজি ওজন হিসেবে প্রয়োগ করে থাকেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। সর্বোপরি সাপের বিষের প্রতিষেধক ওষুধ ‘অ্যান্টিভেনিন’ ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
■ এখানে উল্লেখ্য যে, কামড়ানোর চার ঘণ্টার মধ্যে অ্যান্টিভেনিন ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে বেশি সুফল মেলে। কিন্তু ১২ ঘণ্টা পরে প্রয়োগ করা হলে তার কার্যক্ষমতা নিয়ে সংশয় থাকে। হাত বা পা অত্যধিক ফুলে যাওয়াসহ দংশনের স্থানে পচা ঘায়ের চিকিৎসায় কোনো কোনো সময় সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

সর্পসংশনের পর যা করা উচিত নয় :
■ দংশিত অঙ্গে কোনো রকম গিঁট দেওয়া যাবে না। বিশেষ সতর্কতা: ইতিমধ্যে যদি গিঁট প্রদান করা হয়ে থাকে তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে, চিকিৎসকের উপস্থিতিতে, কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা নিশ্চিত করে অ্যান্টিভেনম শুরু করা, অতপর গিঁট অপসারণ করা।
■ দংশিত স্থানে কাটা, সুঁই ফুটানো কিংবা কোনো রকম প্রলেপ না লাগানো।
■ ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়-ফুঁক করে অযথা সময়ক্ষেপণ না করা।
■ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে না দেওয়া।
■ দংশিত স্থানে কোনোভাবেই হারবাল ওষুধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাশিয়াম, কাদা, গোবর, রাসায়নিক জাতীয় পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না। কামড়ানোর জায়গায় অ্যালকোহল জাতীয় কিছু দেওয়া যাবে না।
■ ব্যথা উপশমের জন্য অ্যাসপিরিন দেওয়া যাবে না।

যেসব ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না :
■ অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ : হিস্টাসিন, এভিল, ফেনারগন।
■ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ : ওরাডেক্সন, ডেকাসন, হাইড্রোকরটিসন।
■ সিডেটিভ জাতীয় ওষুধ : সেডিল, রিলাক্সেন।
■ অ্যাসপিরিন এবং অন্যান্য ব্যথা নিরাময়কারী ওষুধ : ডিসপ্রিন ক্লোফেনাক, সিলেকক্সিব, রোফেকক্সিব।
■ প্রচলিত বিভিন্ন বনাজি বা হোমিওপ্যাথি ওষুধ।

সূত্র  : কালেরকণ্ঠ।

আরো পড়ুন : ডায়রিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়