ঢাকা ০৮:৩৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বীয় জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ

সুজিত মোস্তফা রাসেল
বাংলাদেশে বিভিন্ন দিবসের মাঝে বিশেষ একটি দিবস হলো ‘জাতীয় শিশু দিবস’। যে দিবস আসলেই মনে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও তাঁর অবিস্মরণীয় স্মৃতিকথা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিনকে স্মৃতিতে রাখার মানে মানুষটির অসামান্য ত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়া। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির লড়াই নিয়ে বিন্দু মাত্র প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনন্য ও নির্ভরযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক বই দুটি। বর্তমান প্রজন্ম বই দু’টি পাঠ করে জানতে পারে রাজনীতিতে কতটা নীতি ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না , তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/পৃষ্ঠা- ১৬৪)

শেখ মুজিবুর রহমান যে মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা তাঁর নিজ জন্মবার্ষিকী নিয়ে ভাবনা ও উদযাপন থেকে বোঝা যায়। পাঠকের জন্য জন্মদিবস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজ ভাষ্যটি সরাসরি উদ্ধৃত হল- “আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে- শেখ বংশে। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি। আমি বংশের বড় ছেলে তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/পৃষ্ঠা- ১,৩,৮)
‘‘১৭ই মার্চ ১৯৬৭ (শুক্রবার): আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’! দেখে হাসলাম।”

“ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম- আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বললো, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।”

“ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পড়াইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।”

“আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলে মেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও’ ।” (কারাগারের রোজনামচা/পৃষ্ঠা: ২০৯-১১)
শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন, তেমনি ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী। সত্যিকার অর্থে কোনো বিশেষ দলীয় অন্ধ রাজনীতি নয়, নিপীড়িত মানুষের অধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রামই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন। এই মহান ব্যক্তিকে পুঁজি করে কোনো নীতি-ভ্রষ্ট ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা রুখে দেওয়াই হোক সচেতন নাগরিকের সংকল্প। ১৭ই মার্চ হচ্ছে এককথায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ও শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হচ্ছে সমার্থক শব্দ। ২০২৪ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর ১০৫তম জন্মবার্ষিকীতে রইল অজস্র রক্ত গোলাপের শুভেচ্ছা।

আরও পড়ুন : যে কারণে বিজ্ঞানী আবদুস সালাম হারিয়ে যাচ্ছেন

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

স্বীয় জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ

আপডেট সময় ১২:৫৬:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ মার্চ ২০২৪

সুজিত মোস্তফা রাসেল
বাংলাদেশে বিভিন্ন দিবসের মাঝে বিশেষ একটি দিবস হলো ‘জাতীয় শিশু দিবস’। যে দিবস আসলেই মনে হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও তাঁর অবিস্মরণীয় স্মৃতিকথা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিনকে স্মৃতিতে রাখার মানে মানুষটির অসামান্য ত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়া। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন যার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শোষণ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তির লড়াই নিয়ে বিন্দু মাত্র প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনন্য ও নির্ভরযোগ্য সৃষ্টি হচ্ছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ নামক বই দুটি। বর্তমান প্রজন্ম বই দু’টি পাঠ করে জানতে পারে রাজনীতিতে কতটা নীতি ও আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না , তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/পৃষ্ঠা- ১৬৪)

শেখ মুজিবুর রহমান যে মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তা তাঁর নিজ জন্মবার্ষিকী নিয়ে ভাবনা ও উদযাপন থেকে বোঝা যায়। পাঠকের জন্য জন্মদিবস নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজ ভাষ্যটি সরাসরি উদ্ধৃত হল- “আমার জন্ম হয় ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে- শেখ বংশে। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি। আমি বংশের বড় ছেলে তাই সমস্ত আদর আমারই ছিল।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী/পৃষ্ঠা- ১,৩,৮)
‘‘১৭ই মার্চ ১৯৬৭ (শুক্রবার): আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’! দেখে হাসলাম।”

“ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম- আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বললো, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।”

“ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পড়াইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।”

“আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না।’ আমার ছেলে মেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও’ ।” (কারাগারের রোজনামচা/পৃষ্ঠা: ২০৯-১১)
শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একজন প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন, তেমনি ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী। সত্যিকার অর্থে কোনো বিশেষ দলীয় অন্ধ রাজনীতি নয়, নিপীড়িত মানুষের অধিকার ও বৈষম্য দূরীকরণের সংগ্রামই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন। এই মহান ব্যক্তিকে পুঁজি করে কোনো নীতি-ভ্রষ্ট ও সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ফায়দা নেওয়ার অপচেষ্টা রুখে দেওয়াই হোক সচেতন নাগরিকের সংকল্প। ১৭ই মার্চ হচ্ছে এককথায় স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম ও শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হচ্ছে সমার্থক শব্দ। ২০২৪ সালে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর ১০৫তম জন্মবার্ষিকীতে রইল অজস্র রক্ত গোলাপের শুভেচ্ছা।

আরও পড়ুন : যে কারণে বিজ্ঞানী আবদুস সালাম হারিয়ে যাচ্ছেন