ঢাকা ০৯:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অন্ধকারে মাকে দেখে আঁতকে উঠলাম, হারিকেনটা নেভালো কে!

জামিউর রহমান লেমন: 

তখন ১৯৭১, দিনাজপুরের পুলহাটে মালেক পানুয়ার বাসায় আমরা ভাড়া থাকি। বাসাটা বেশ ছিমছাম ছিল। একতলা পুরোনো আমলের। জানালার শিকগুলো দেখলে মাঝে মধ্যে মনে হতো যেন জেলখানায় আটকে আছি। অতো ছোট বয়সে জেলখানা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা না থাকলেও বড়দের কাছে শোনা যেত পাকিস্তানীরা নাকি বাঙালীদের ধরে ধরে জেলে ঢুকায়। জেলে নাকি অনেক কষ্ট, মোটা মোটা শিকওয়ালা ছোট ছোট কক্ষ, মেঝেতে শুতে হয়, দুটো কম্বলই নাকি সম্বল, খাওয়ার কষ্ট। দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার পেরিয়ে মডার্ণ সিনেমা হলের দিকে যেতেই জেলখানা পড়তো। আব্বার সাথে নারায়ণ রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চেপে ওদিকে গেলেই আব্বা সব কিছু চিনিয়ে দিতেন। বলতেন, বাবু, যে শহরে থাকো সেখানকার সব কিছু চিনে নিতে হয়। কারণ, কোন না কোন সময় তোমাকে একা একা সবকিছু করতে হবে। আব্বা বলতেন, দেখ বাবু, ঐটা নাজিমুদ্দিন হল, ওখানে জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞানের ভাণ্ডার কিÑ সেই বয়সে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
আব্বা সন্ধ্যের পর বাড়তি টাকা আয়ের জন্য বাড়তি কাজ করতেন। নাজিমুদ্দিন পাবলিক লাইব্রেরির অডিট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অডিটের কাজটি আব্বা করতেন। ৪৭ এর দাঙ্গায় জন্মস্থান ছাড়ার কষ্ট খুব দেখিনি তার চোখে মুখে। যতটা কষ্ট দেখেছি আমাদেরকে ভাল রাখার চেষ্টার জন্য কাজ করতে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আব্বা পুলহাট গনি মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বললেন, বাবু, আজ তোকে নাজিমুদ্দিন লাইব্রেরিতে নিয়ে যাবো। দেখবি কত বই আর বই। এমনিতেই আমি ছিলাম বই পাগল। ছোট বয়সে জন্মদিনে কেউ যদি ছড়ার বই, আঁকা ঝোঁকার বই উপহার দিতো সারাদিন সেই সব বই বালিশের পাশে রেখে দিতাম। নতুন বই পড়ার পাশাপাশি এর গন্ধ আমাকে আকর্ষণ করতো।
নাজিমুদ্দিন হলে ঢুকেই আব্বা তার কাজের রুমে বসে পড়লেন। আমাকে বললেন, বাবু যাও ওই সেলফগুলোতে ছোটদের বই আছে ছবিওয়ালা অনেক। দেখো ভাল লাগবে। আব্বার সাথে বাইরে যাওয়ার একটা অন্য ধরনের লোভ ছিল, আর সেটা হলো বাইরে গেলেই আবার খাওয়াতেন নিতাইয়ে দোকানের হিং সিঙ্গাড়া, আর সন্দেশ। কোন কোন দিন ঢাকা বেকারীর বিস্কুট।
আমি অনেক উৎসাহ নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি-উল্টাচ্ছি হঠাৎ দেখি বইয়ের পাতার একটি টিকটিকি জীবন্ত হয়ে আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। সম্ভবত এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ইলিউশন। আমি ভয়ে হাত থেকে বইটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকি। স্বারেদশ্বরী স্কুলের পিয়ন সত্যকাকা সে সময় কি কাজে যেন আব্বার কাছে এসেছিলেন। আমার চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নেন, বলেন, বাবুজি কি হয়েছেগো। আমি বললাম, কুমিরের মত একটা টিকটিকি বইয়ের ভেতরে। সত্যকাকা বললো, থাকতেই পারে, ওরাতো বইয়ের পাতাও খায়। আমি বললাম, মানুষ খায় নাকি? সত্যকাকা বললেন, বোকা বাবু, কই দেখি, কিছুইতো নাই। চলো তোমার আব্বার কাছে। আব্বা ঘটনাটা শুনেই বললেন, বাবু, তুমি নিঃশ্চয়ই ছবিটা দেখে মনে মনে কুমিরের কথা ভেবেছো। আমি সে সময় কি করে তাকে বোঝাবো যে আমি কিছুই ভাবিনি, ওটা সত্যি সত্যি বই এর ভিতর থেকে আমার দিকে তেড়ে আসছিল। যাই হোক, আব্বা বললেন তোমার চোখটা কাল একটু দেখিয়ে নেবো। চোখ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার বাবু বলেছিলেন চোখে কোন সমস্যা নাই। কথাটা শুনে আব্বা একটু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন। যাইহোক, সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রাইভেট ঐ বাসায় তখন বিজলীবাতি ছিল না। উজ্জ্বল ব্র্যাণ্ডের দামী হ্যারিকেনের আলোয় আমরা চলতাম। প্রত্যেকের পড়ার টেবিলে ছিল তেলের টেবিল ল্যাম্প। আমাদের বাসাটা ছিল একেবারে সুনসান ঘাগরা ব্রীজের পাশে। ঘাগরায় পানি ভরে গেলে ব্যাঙ ও ঝিঝি পোকার ডাক আরো বেড়ে যেত। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হতো যেন কোন ডাইনি বুড়ি কোঁকিয়ে কেঁকিয়ে কাঁদছে। বড় আপা প্রায়ই আমাকে পাশে বসিয়ে ডাইনি বুড়ির গল্প শোনাতেন। তার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক। তবুও তার বন্ধু ছিলাম আমি। নতুন বই হাতে পেলেই কাছে ডেকে আমাকে পড়ে শোনাতেন। বলতেন, দাদু তুই বড় হয়ে গল্প লিখতে পারবি? আমি বলতাম আমি ডাইনী বুড়ির গল্প কেন লিখবো? এতে তো ছোটরা ভয় পায়! আমি অনেক ভাল কিছু নিয়ে গল্প লিখবো। তখন অবশ্য মনের খেয়ালেই কথাগুলো বলেছিলাম, ভালটা যে কি সেটাই বুঝতাম না। অবশ্য এখনো ভালোর সংজ্ঞা আমি খুঁজে পাইনি।
বাসার কাছেই এসে স্বভাবসুলভ নিয়মে আব্বা আম্মার নাম ধরে ডাকলেন। বাসার দরজা খোলা। আম্মা সবাইকে নিয়ে পাশের কাশ্মিরি সাহেবদের বাসায় বেড়াতে গেছেন। দরজাটা ভেজানো ছিল। তখন অবশ্য এতো চুরি ধারির ভয় ছিল না। আশে পাশে কেউ বেড়াতে গেলে দরজা ভেজিয়েই চলে যেতেন- যেমনটা আম্মা গেছেন।
আমাদের বাসার ভিতরে একটা চমৎকার আঙিনা ছিল। এখনো ওরকম আঙিনাওয়ালা বাড়ি দেখলেই আমার মনটা আনচান করে ওঠে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, চলে যাই আমার প্রিয় শৈশবে।
আব্বা হারিকেন নিয়ে টানা পায়খানায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন। আমি খোলা আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমান দোকানদারের দোকান থেকে নেয়া লাঠি লজেন্স চুসছি। এমন সময় মনে হলো কে যেন ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে। টুক করে শব্দ, তার পর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ঠিক আমার আম্মার মতো। হয়তো আম্মাই এসেছেন। আমি আম্মা আম্মা বলে দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকলাম। আমাদের শোবার ঘরটায় ছিল ঢালাও দুইটা চৌকি সেখানে আমি আব্বা আম্মা আর হ্যাপী শুতাম।
গিয়ে দেখলাম দরজাটা আব্বা যেভাবে ভেজিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সেভাবেই আছে, হারিকেনটা নেভানো। অন্ধকারেই আম্মা মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছেন। অন্ধকারে আম্মাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। ছোট্ট মনে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ আম্মার গলার শব্দে আমি বাস্তবে ফিরলাম- দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আম্মা বললেন, তোরা কখন আসলি বাবু? আমি কিছুই বললাম না। বুঝতে পারলাম না হারিকেনটা কে নিভিয়েছে? কে বসে নামাজ পড়ছিলেন? আজও এই ঘটনার কোন সমাধান আমি পাইনি। (চলবে)

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

অন্ধকারে মাকে দেখে আঁতকে উঠলাম, হারিকেনটা নেভালো কে!

আপডেট সময় ০১:০৪:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ ২০২৪

জামিউর রহমান লেমন: 

তখন ১৯৭১, দিনাজপুরের পুলহাটে মালেক পানুয়ার বাসায় আমরা ভাড়া থাকি। বাসাটা বেশ ছিমছাম ছিল। একতলা পুরোনো আমলের। জানালার শিকগুলো দেখলে মাঝে মধ্যে মনে হতো যেন জেলখানায় আটকে আছি। অতো ছোট বয়সে জেলখানা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা না থাকলেও বড়দের কাছে শোনা যেত পাকিস্তানীরা নাকি বাঙালীদের ধরে ধরে জেলে ঢুকায়। জেলে নাকি অনেক কষ্ট, মোটা মোটা শিকওয়ালা ছোট ছোট কক্ষ, মেঝেতে শুতে হয়, দুটো কম্বলই নাকি সম্বল, খাওয়ার কষ্ট। দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার পেরিয়ে মডার্ণ সিনেমা হলের দিকে যেতেই জেলখানা পড়তো। আব্বার সাথে নারায়ণ রিক্সাওয়ালার রিক্সায় চেপে ওদিকে গেলেই আব্বা সব কিছু চিনিয়ে দিতেন। বলতেন, বাবু, যে শহরে থাকো সেখানকার সব কিছু চিনে নিতে হয়। কারণ, কোন না কোন সময় তোমাকে একা একা সবকিছু করতে হবে। আব্বা বলতেন, দেখ বাবু, ঐটা নাজিমুদ্দিন হল, ওখানে জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞানের ভাণ্ডার কিÑ সেই বয়সে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
আব্বা সন্ধ্যের পর বাড়তি টাকা আয়ের জন্য বাড়তি কাজ করতেন। নাজিমুদ্দিন পাবলিক লাইব্রেরির অডিট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অডিটের কাজটি আব্বা করতেন। ৪৭ এর দাঙ্গায় জন্মস্থান ছাড়ার কষ্ট খুব দেখিনি তার চোখে মুখে। যতটা কষ্ট দেখেছি আমাদেরকে ভাল রাখার চেষ্টার জন্য কাজ করতে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আব্বা পুলহাট গনি মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বললেন, বাবু, আজ তোকে নাজিমুদ্দিন লাইব্রেরিতে নিয়ে যাবো। দেখবি কত বই আর বই। এমনিতেই আমি ছিলাম বই পাগল। ছোট বয়সে জন্মদিনে কেউ যদি ছড়ার বই, আঁকা ঝোঁকার বই উপহার দিতো সারাদিন সেই সব বই বালিশের পাশে রেখে দিতাম। নতুন বই পড়ার পাশাপাশি এর গন্ধ আমাকে আকর্ষণ করতো।
নাজিমুদ্দিন হলে ঢুকেই আব্বা তার কাজের রুমে বসে পড়লেন। আমাকে বললেন, বাবু যাও ওই সেলফগুলোতে ছোটদের বই আছে ছবিওয়ালা অনেক। দেখো ভাল লাগবে। আব্বার সাথে বাইরে যাওয়ার একটা অন্য ধরনের লোভ ছিল, আর সেটা হলো বাইরে গেলেই আবার খাওয়াতেন নিতাইয়ে দোকানের হিং সিঙ্গাড়া, আর সন্দেশ। কোন কোন দিন ঢাকা বেকারীর বিস্কুট।
আমি অনেক উৎসাহ নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি-উল্টাচ্ছি হঠাৎ দেখি বইয়ের পাতার একটি টিকটিকি জীবন্ত হয়ে আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। সম্ভবত এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ইলিউশন। আমি ভয়ে হাত থেকে বইটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকি। স্বারেদশ্বরী স্কুলের পিয়ন সত্যকাকা সে সময় কি কাজে যেন আব্বার কাছে এসেছিলেন। আমার চিৎকার শুনে তিনি দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নেন, বলেন, বাবুজি কি হয়েছেগো। আমি বললাম, কুমিরের মত একটা টিকটিকি বইয়ের ভেতরে। সত্যকাকা বললো, থাকতেই পারে, ওরাতো বইয়ের পাতাও খায়। আমি বললাম, মানুষ খায় নাকি? সত্যকাকা বললেন, বোকা বাবু, কই দেখি, কিছুইতো নাই। চলো তোমার আব্বার কাছে। আব্বা ঘটনাটা শুনেই বললেন, বাবু, তুমি নিঃশ্চয়ই ছবিটা দেখে মনে মনে কুমিরের কথা ভেবেছো। আমি সে সময় কি করে তাকে বোঝাবো যে আমি কিছুই ভাবিনি, ওটা সত্যি সত্যি বই এর ভিতর থেকে আমার দিকে তেড়ে আসছিল। যাই হোক, আব্বা বললেন তোমার চোখটা কাল একটু দেখিয়ে নেবো। চোখ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তার বাবু বলেছিলেন চোখে কোন সমস্যা নাই। কথাটা শুনে আব্বা একটু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলেন। যাইহোক, সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের প্রাইভেট ঐ বাসায় তখন বিজলীবাতি ছিল না। উজ্জ্বল ব্র্যাণ্ডের দামী হ্যারিকেনের আলোয় আমরা চলতাম। প্রত্যেকের পড়ার টেবিলে ছিল তেলের টেবিল ল্যাম্প। আমাদের বাসাটা ছিল একেবারে সুনসান ঘাগরা ব্রীজের পাশে। ঘাগরায় পানি ভরে গেলে ব্যাঙ ও ঝিঝি পোকার ডাক আরো বেড়ে যেত। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হতো যেন কোন ডাইনি বুড়ি কোঁকিয়ে কেঁকিয়ে কাঁদছে। বড় আপা প্রায়ই আমাকে পাশে বসিয়ে ডাইনি বুড়ির গল্প শোনাতেন। তার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক। তবুও তার বন্ধু ছিলাম আমি। নতুন বই হাতে পেলেই কাছে ডেকে আমাকে পড়ে শোনাতেন। বলতেন, দাদু তুই বড় হয়ে গল্প লিখতে পারবি? আমি বলতাম আমি ডাইনী বুড়ির গল্প কেন লিখবো? এতে তো ছোটরা ভয় পায়! আমি অনেক ভাল কিছু নিয়ে গল্প লিখবো। তখন অবশ্য মনের খেয়ালেই কথাগুলো বলেছিলাম, ভালটা যে কি সেটাই বুঝতাম না। অবশ্য এখনো ভালোর সংজ্ঞা আমি খুঁজে পাইনি।
বাসার কাছেই এসে স্বভাবসুলভ নিয়মে আব্বা আম্মার নাম ধরে ডাকলেন। বাসার দরজা খোলা। আম্মা সবাইকে নিয়ে পাশের কাশ্মিরি সাহেবদের বাসায় বেড়াতে গেছেন। দরজাটা ভেজানো ছিল। তখন অবশ্য এতো চুরি ধারির ভয় ছিল না। আশে পাশে কেউ বেড়াতে গেলে দরজা ভেজিয়েই চলে যেতেন- যেমনটা আম্মা গেছেন।
আমাদের বাসার ভিতরে একটা চমৎকার আঙিনা ছিল। এখনো ওরকম আঙিনাওয়ালা বাড়ি দেখলেই আমার মনটা আনচান করে ওঠে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি, চলে যাই আমার প্রিয় শৈশবে।
আব্বা হারিকেন নিয়ে টানা পায়খানায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন। আমি খোলা আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমান দোকানদারের দোকান থেকে নেয়া লাঠি লজেন্স চুসছি। এমন সময় মনে হলো কে যেন ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকছে। টুক করে শব্দ, তার পর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ঠিক আমার আম্মার মতো। হয়তো আম্মাই এসেছেন। আমি আম্মা আম্মা বলে দৌড়ে শোবার ঘরে ঢুকলাম। আমাদের শোবার ঘরটায় ছিল ঢালাও দুইটা চৌকি সেখানে আমি আব্বা আম্মা আর হ্যাপী শুতাম।
গিয়ে দেখলাম দরজাটা আব্বা যেভাবে ভেজিয়ে দিয়ে এসেছিলেন সেভাবেই আছে, হারিকেনটা নেভানো। অন্ধকারেই আম্মা মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছেন। অন্ধকারে আম্মাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। ছোট্ট মনে বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ আম্মার গলার শব্দে আমি বাস্তবে ফিরলাম- দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আম্মা বললেন, তোরা কখন আসলি বাবু? আমি কিছুই বললাম না। বুঝতে পারলাম না হারিকেনটা কে নিভিয়েছে? কে বসে নামাজ পড়ছিলেন? আজও এই ঘটনার কোন সমাধান আমি পাইনি। (চলবে)