ঢাকা ০৯:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অলৌকিক: জানালায় বড় একটা পাখির ডানার ঝাপটার শব্দ আজও কানে বাজে!

জামিউর রহমান লেমন
ছোটবেলায় আব্বার গায়ের উপর পা তুলে ঘুমানো আমার একটা স্বভাবসুলভ আচরণ ছিল। আব্বা অনেক কর্মক্লান্ত থাকলেও আমার সেসব যন্ত্রণা মেনে নিতেন। তখন পুরো দিনাজপুর শহরে স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার সবাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সবে শেষ হয়েছে। জুয়েল ভাই, মান্নান ভাইসহ বেশকিছু ছেলেদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আব্বা, মানিকের আব্বা, খলিলের আব্বার আলোচনা শুনলেও আমি তার তেমন কিছু বুঝতে পারতাম না। পাশের পাড়া নিউটাউনের বিহারীদের নিয়ে সবার মাথা ব্যথা। ওরা কেন আমাদের শত্রু হয়ে গেল বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বিহারী মিষ্টার ভাই, আসিয়া আপা, কাশ্মিরী ডলি, মুন্নী আপা, জান ভাইয়া ওরাও কেন জানি আমাদের একটু একটু এড়িয়ে চলছেÑ বেশ বুঝতে পারি। আগের মতো আসা যাওয়া আর নেই। সন্ধ্যায় বশির রিক্সাওয়ালা আব্বাকে এসে বলছিল স্যার নিউটাউনের বিহারীরা বড় বড় চাকু ছুরি সান দিচ্ছে, আমি দেখেছি। আব্বা তাকে সাহস দিয়ে বললেন, যাও শান্ত থাকো কিছু হবে না।

ঘাগরা ব্রীজ পেরিয়ে বড় মাঠ তার উল্টোদিকেই কুটি বাড়ি পাঠান আর্মিদের ক্যাম্প। মাঝে মধ্যে ঘাগরা ব্রীজে দাঁড়িয়ে তাদের গাড়ির বহর দেখতে বেশ ভালই লাগতো। তাদের সান্ডা গোন্ডা চেহারা দেখে মনে হতো আহা আমি যদি ওরকম হতাম।
রাতে ঘুম আসছিল না। ঘুমাতে গেলে হ্যাপীর সাথে খোঁচাখুঁচি করা ছিল আমার স্বভাব। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। হ্যাপী চেঁচিয়ে উঠলো। বললো, আব্বা দাদুকে ঘুমাতে বলো। আব্বা ধমক দিয়ে বললেন, বাবু ঘুমাও বিহারীরা কিন্তু আমাদের ধরতে আসবে। পরক্ষণে আবার বললেন ভয় পেয়েছিস, আমি আছি না। অবশ্য বিহারীরা চাকু ছুরি সান দিচ্ছে এ কথাটা তখন আমার মনে গেঁথে গেছে। শেখ মুজিবের ভাষণ আমাদের আট ব্যাটারীর মারফি রেডিওতে আমি শুনেছিলাম। ভাল লেগেছিল কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।

আধো ঘুমের মাঝেই আম্মা এসব শুনে আব্বাকে বললেন, বাবুর আব্বা এই পাঁচ মেয়েকে নিয়ে গণ্ডগোল লাগলে আমরা কি করবো। আব্বা সহজ ভাবেই বললেন, আল্লাহ একটা ব্যবস্থা নিঃশ্চয়ই করবেন। রাত দশটার ঘন্টা দেয়াল ঘড়িতে পড়তেই বুঝলাম ১০টা বাজে। মফস্বল শহরে তখন রাত দশটা মানে অনেক রাত। অন্য ঘরে চার বোন একসাথে এক বিছানায় শুয়ে রেডিওতে যেন কি শুনছে। আম্মা চেঁচিয়ে উঠলেন, রেডিও বন্ধ কর শুয়ে পড়। দেশের অবস্থা ভাল না।

হঠাৎ একটা ব্রাশ ফায়ার ও একটা রাইফেলের শব্দ। কোথা থেকে শব্দটা আসলো কে জানে। আব্বা উঠে বসলেন সেই সাথে আম্মাও। হ্যাপী ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় আপা লম্বা ফ্রক পরে দৌড়ে আমাদের ঘরে আসে। বলে, আব্বা বাংলাদেশের মানচিত্রের পতাকাটা আমি সরিয়ে রেখেছি। কেউ খুঁজে পাবে না। বড়আপা আর রোজী আপা যেকোন ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেই গান করতেন আমারও দেশের মাটির গন্ধে। এসবের কিছুই আমি বুঝতাম না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আম্মা কে কে করে উঠলেন। আব্বা বললেন, চুপ করো দেখি না। মানিকের আব্বা নিচু গলায় বলছেন, মাষ্টার সাহের দরজাটা খোলেন, কিছু শুনেছেন। দরজা খুলতেই আমাদের মশারী সরিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। আব্বা বললেন, বুঝতে পারছেন কোন দিক থেকে, নিউ টাউন থেকে কি? যান শুয়ে পড়েন, কাল সকালে একটা কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ভয় পাবেন না।

আবার শুয়ে পড়লাম সবাই। আমার ঘুম আসছে না। কিছুতেই আসছে না। ছোটবেলায় আম্মা আয়াতুল কুরসী মুখস্ত করতে শিখিয়েছিলেন। আম্মা বলতেন, বাবু ভয় পেলে এটা পড়ে বুকে একটা ফু দেবে দেখবে ভয় শেষ। আজ সেই আয়াতুল কুরসীও আমি ভুলে গেছি। যাই হোক চোখে ঘুম ঘুম ভাব হঠাৎ দেখি আমাদের বিছানার উল্টোদিকে মোটা মোটা লোহার শিকের জানালায় একটা বড় ধরনের পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। পাখি যে এতো বড় হতে পারে এটা আজও আমার বিশ্বাস হয়না। আমি আব্বা আব্বা করে চিৎকার করছি। আম্মা আধো ঘুম ভেঙে বললেন আমিও শব্দ শুনেছি বাবুর আব্বা। পাখির ডানার। আব্বা বললেন, কি যে বলো। দেখি দেশের কি অবস্থা হয়। এ বাসাটা ছেড়ে দেবো। বাবু ঘুমাও, আসো আমার বুকের কাছে। আমি গুটি গুটি মেরে আব্বার বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু সেই পাখির ডানা ঝাপটা আজও কোন কোন রাতে আমার চোখে ভাসে। কখনো ভয় পাই, কখনো মন ভরে যায়। (চলবে)।

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

অলৌকিক: জানালায় বড় একটা পাখির ডানার ঝাপটার শব্দ আজও কানে বাজে!

আপডেট সময় ১১:৩৪:৫২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ মার্চ ২০২৪

জামিউর রহমান লেমন
ছোটবেলায় আব্বার গায়ের উপর পা তুলে ঘুমানো আমার একটা স্বভাবসুলভ আচরণ ছিল। আব্বা অনেক কর্মক্লান্ত থাকলেও আমার সেসব যন্ত্রণা মেনে নিতেন। তখন পুরো দিনাজপুর শহরে স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার সবাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সবে শেষ হয়েছে। জুয়েল ভাই, মান্নান ভাইসহ বেশকিছু ছেলেদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে আব্বা, মানিকের আব্বা, খলিলের আব্বার আলোচনা শুনলেও আমি তার তেমন কিছু বুঝতে পারতাম না। পাশের পাড়া নিউটাউনের বিহারীদের নিয়ে সবার মাথা ব্যথা। ওরা কেন আমাদের শত্রু হয়ে গেল বিষয়টা আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বিহারী মিষ্টার ভাই, আসিয়া আপা, কাশ্মিরী ডলি, মুন্নী আপা, জান ভাইয়া ওরাও কেন জানি আমাদের একটু একটু এড়িয়ে চলছেÑ বেশ বুঝতে পারি। আগের মতো আসা যাওয়া আর নেই। সন্ধ্যায় বশির রিক্সাওয়ালা আব্বাকে এসে বলছিল স্যার নিউটাউনের বিহারীরা বড় বড় চাকু ছুরি সান দিচ্ছে, আমি দেখেছি। আব্বা তাকে সাহস দিয়ে বললেন, যাও শান্ত থাকো কিছু হবে না।

ঘাগরা ব্রীজ পেরিয়ে বড় মাঠ তার উল্টোদিকেই কুটি বাড়ি পাঠান আর্মিদের ক্যাম্প। মাঝে মধ্যে ঘাগরা ব্রীজে দাঁড়িয়ে তাদের গাড়ির বহর দেখতে বেশ ভালই লাগতো। তাদের সান্ডা গোন্ডা চেহারা দেখে মনে হতো আহা আমি যদি ওরকম হতাম।
রাতে ঘুম আসছিল না। ঘুমাতে গেলে হ্যাপীর সাথে খোঁচাখুঁচি করা ছিল আমার স্বভাব। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হলো না। হ্যাপী চেঁচিয়ে উঠলো। বললো, আব্বা দাদুকে ঘুমাতে বলো। আব্বা ধমক দিয়ে বললেন, বাবু ঘুমাও বিহারীরা কিন্তু আমাদের ধরতে আসবে। পরক্ষণে আবার বললেন ভয় পেয়েছিস, আমি আছি না। অবশ্য বিহারীরা চাকু ছুরি সান দিচ্ছে এ কথাটা তখন আমার মনে গেঁথে গেছে। শেখ মুজিবের ভাষণ আমাদের আট ব্যাটারীর মারফি রেডিওতে আমি শুনেছিলাম। ভাল লেগেছিল কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।

আধো ঘুমের মাঝেই আম্মা এসব শুনে আব্বাকে বললেন, বাবুর আব্বা এই পাঁচ মেয়েকে নিয়ে গণ্ডগোল লাগলে আমরা কি করবো। আব্বা সহজ ভাবেই বললেন, আল্লাহ একটা ব্যবস্থা নিঃশ্চয়ই করবেন। রাত দশটার ঘন্টা দেয়াল ঘড়িতে পড়তেই বুঝলাম ১০টা বাজে। মফস্বল শহরে তখন রাত দশটা মানে অনেক রাত। অন্য ঘরে চার বোন একসাথে এক বিছানায় শুয়ে রেডিওতে যেন কি শুনছে। আম্মা চেঁচিয়ে উঠলেন, রেডিও বন্ধ কর শুয়ে পড়। দেশের অবস্থা ভাল না।

হঠাৎ একটা ব্রাশ ফায়ার ও একটা রাইফেলের শব্দ। কোথা থেকে শব্দটা আসলো কে জানে। আব্বা উঠে বসলেন সেই সাথে আম্মাও। হ্যাপী ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় আপা লম্বা ফ্রক পরে দৌড়ে আমাদের ঘরে আসে। বলে, আব্বা বাংলাদেশের মানচিত্রের পতাকাটা আমি সরিয়ে রেখেছি। কেউ খুঁজে পাবে না। বড়আপা আর রোজী আপা যেকোন ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেই গান করতেন আমারও দেশের মাটির গন্ধে। এসবের কিছুই আমি বুঝতাম না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আম্মা কে কে করে উঠলেন। আব্বা বললেন, চুপ করো দেখি না। মানিকের আব্বা নিচু গলায় বলছেন, মাষ্টার সাহের দরজাটা খোলেন, কিছু শুনেছেন। দরজা খুলতেই আমাদের মশারী সরিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন। আব্বা বললেন, বুঝতে পারছেন কোন দিক থেকে, নিউ টাউন থেকে কি? যান শুয়ে পড়েন, কাল সকালে একটা কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাবে। ভয় পাবেন না।

আবার শুয়ে পড়লাম সবাই। আমার ঘুম আসছে না। কিছুতেই আসছে না। ছোটবেলায় আম্মা আয়াতুল কুরসী মুখস্ত করতে শিখিয়েছিলেন। আম্মা বলতেন, বাবু ভয় পেলে এটা পড়ে বুকে একটা ফু দেবে দেখবে ভয় শেষ। আজ সেই আয়াতুল কুরসীও আমি ভুলে গেছি। যাই হোক চোখে ঘুম ঘুম ভাব হঠাৎ দেখি আমাদের বিছানার উল্টোদিকে মোটা মোটা লোহার শিকের জানালায় একটা বড় ধরনের পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। পাখি যে এতো বড় হতে পারে এটা আজও আমার বিশ্বাস হয়না। আমি আব্বা আব্বা করে চিৎকার করছি। আম্মা আধো ঘুম ভেঙে বললেন আমিও শব্দ শুনেছি বাবুর আব্বা। পাখির ডানার। আব্বা বললেন, কি যে বলো। দেখি দেশের কি অবস্থা হয়। এ বাসাটা ছেড়ে দেবো। বাবু ঘুমাও, আসো আমার বুকের কাছে। আমি গুটি গুটি মেরে আব্বার বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু সেই পাখির ডানা ঝাপটা আজও কোন কোন রাতে আমার চোখে ভাসে। কখনো ভয় পাই, কখনো মন ভরে যায়। (চলবে)।