ঢাকা ০৯:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অলৌকিক! সাদা ছায়ামূর্তিটা পানির মধ্যে ডুব দিলো!

জামিউর রহমান লেমন
স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশ পরে তখনও দিনাজপুরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়নি। ঘাগরা নদীতে অনেক মানুষকে মেরে লাশ ফেলা হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। মিষ্টার ভাই, আসিয়া আপাদের ঘরটা খালি পড়ে রয়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও পুতে রাখা ডিনামাইট বিস্ফোরণের শব্দ বাতাসে ভেসে আসে। আমাদের বাসার রান্না ঘরের মেঝেটা একবারে ওলট পালট করা মাটি বের হয়ে আছে। তাহলে কি ওখানেও মানুষ পুঁতে রাখা হয়েছে। তবুও প্রায় নয় মাস ভারতে থেকে নিজ বাসায় ফিরে এসে সবাই যেন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। নালাহার বর্ডার দিয়ে আমরা পালিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে, গরুর গাড়িতে আমরা সবাই, রেজাউল ভাই আর আব্বা একরকম হেঁটেই। একই ভাবে ফেরা।

সাতচল্লিশ এর রায়টে সর্বস্ব ফেলে প্রেসিডেন্সী কলেজের মেধাবী ছাত্র, ভারত সিভিল সার্ভিসের তরুণ কর্মকর্তা আমার বাবা আবদুর রহমান পাড়ি জমিয়েছিলেন এদেশে। আজও তার আবার ফেরা, জীবনের সঞ্চয় করা, আয় করা, ফেলে যাওয়া বাসার সব সামগ্রী লুটেরাদের হাতে চলে গেছে। সাংসারিক সব কিছু লুট হওয়ায় কেবল খালি ঘরে আমরা প্রবেশ করেছিলাম। এ যেন এক নির্জন মৃত্যুপুরি। সকল কিছু হারিয়ে আব্বা মোটেও বিচলিত হননি। বরং তিনি সাহস দিয়ে বলেছিলেন, মানুষ বেঁচে থাকলে সব কিছু হয়ে যায় বাবুর মা। আবার শুরু হলো তাঁর জীবন সংগ্রাম। চৌকি, হাড়ি পাতিল বদনা সব কিছুই আবার নতুন করে কেনা।
ভারত থেকে ফেরার দিনেই পাশের বাসার বিকট শব্দে আমরা বিভ্রান্ত হলাম, তবে কি খানেরা এখনো কোথাও ঘাপটি মেরে আছে! সবাই হাশেম ভাইদের বাড়ি থেকে ধরাধরী করে হাবিবকে বের করছে, জানলাম পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া গ্রেনেড নিয়ে হাবিব খেলা করছিল হঠাৎ সেটা বাষ্ট হয়ে হাবিবের হাতের কব্জি উড়ে গেছে। হাবিব আমার থেকে বয়সে কিছু বড় হলেও তার সাথে আমার সখ্যতা ছিল।

আমাদের বাসাটা ঘাগরা নদীর পাড়ে ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সেখানের অনেক ঘটনাই জনশ্রতিতে ছিল। রাতে ভরা নদীতে পানির শব্দ শুনলে মনে হতো, সেটা যেন মানুষের কান্না। লুটতরাজের ভীতি আমাদের সবার মনে তখনো রয়েছে, তাই সদর দরজায় দুটি কপাট লাগানোর ব্যবস্থা করা হলো। অন্ধকার রাতে ভিতরের উঠানে একা নামলেই গাটা ছম্ছম্ করে উঠতো। পাওয়ার সুইটের আব্বাকে বলতে শুনেছি যে, যে সব মানুষের মৃত্যু অপঘাতে বা অপমৃত্যু হয় তাদের আত্মা নাকি শান্তির জন্য ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়, অন্ধকার ও সুনসান জায়গায় তাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অবশ্য এসবের কিছুই আমি বুঝিনা। আমাদের বাসার কিছু দুরেই ফরিদপুর গোরস্থান, সেখানে আমার একদিনের ছোট ভাইকে দাফন করা হয়েছিল বেশ মনে আছে। যে গোরকান তার দাফনের ব্যবস্থা করেছিল তার সাথে আমাদের পারিবারিক একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। গোরকান কবর খানার কিছু ঘটনার নিরব স্বাক্ষী ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে বাসায় এসে গুড়ের চা খেতে খেতে এসব কিছু রসিয়ে রসিয়ে বলতেন। আমার কিশোর মনে সেসব ভাবনা খোরাক হয়ে জমে উঠতো। তিনি বলতেন, ঘাগরা নদীতে অনেক লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে, তাদের দাফন কাফন হয়নি, সন্ধ্যে রাতে তাদের আত্মা ঘোরাফেরা করে, রাত বিরাতে বাইরে না বেরোনোই ভালো। আমার মনে পড়তো তাহলে কি রাজপুত্রের মতো চেহারার মিষ্টার ভাই, আছিয়া আপা, হাফেজ রফিক চাচাও তাদের মধ্যে আছেন? প্রতি শবে বরাতে হাফেজ রফিক চাচার কথা আমার স্মৃতিতে ভাসে। কারণ, শবে বরাতের আগের সাতদিন তিনি আমাদের দিনাজপুরের বাসায় বসে কোরান খতম করতেন। শবে বরাতের দিন আনুষ্ঠানিক দোয়ার মাধ্যমে এই কাজ শেষ হতো। স্বাধীনতার পর এই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটলো। রফিক হাফেজের খোঁজ নেই। কোথায় গেল শবে বরাতের দিন। ঘাগরা পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই গোরকানের কথা মনে হলো। মনে হচ্ছে রফিক হাফেজ ঘাগরা নদীতে শুয়ে শুয়ে তার দরাজ কণ্ঠে কোরান তেলওয়াত করছেন “আর রাহমান ওয়াল্লামাল কোরআন”। ছোট বেলায় তাঁর কণ্ঠেই এটি শুনে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।

ঘরের পবিত্রতা ও অপশক্তির থেকে বাঁচার জন্য বাসায় আবারো সপ্তাহব্যাপী কোরান খতমের আয়োজন করা হলো। রোজী আপা সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার নামাজের পর বাড়ির ভিতরের উঠানে ঘুরে ঘুরে সুরে সুরে ঘর বন্ধের দোয়া/শোলক পাঠ করতেন “লিখাম সিতাম নাফসি বেহা” আজ যা কানে ভাসে।

এভাবেই কেটে গেল স্বাধীনতা উত্তর কিছু সময়। আবার জীবন সংগ্রাম। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। জীবন যুদ্ধে আব্বা পরাজিত হননি। শিক্ষিত করেছিলেন সবাইকে। আব্বার বিষয়টি এখনো আমাকে ভাবায়। এক জীবনে দুবার হেঁচোট খেলে, সর্বশান্ত হলে সে মানুষ সে পরিবার কিভাবে ঘুরে দাঁড়ায়! এখন তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

একবার এই শবে বরাতের দিনে, তখন কাশ্মীরি সাহেবদের বাড়িটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। সুন্দর ঐ বাড়িটির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই চোখে ভাসে জান ভাই, মুন্নি আপা, ডলি আপার চেহারা। বাড়িটি এখন সহকারি পুলিশ সুপারের বাংলো। নতুন এএসপি উঠেছেন। তার একটা রাজপুত্রের মতো ছেলে আছে, আমাদের মতই অনেকগুলো বোন ভাই। সেই ছোট রাজপুত্র কামরুলের সাথে হঠাৎ করেই আমার সখ্য হয়। প্রতিদিন একবার দেখা না হলেই যেন নয়। যদিও কামরুল বয়সে আমার বেস ছোট ছিল। কামরুল আমি পাওয়ার রাব্বি আর আমু দলবেঁধে গনি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম। একসাথে নামাজে যাওয়ার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সবাই একসাথে হলেই একটা ভিন্ন ধরনের আনন্দে মনটা একেবারে ভরে যেতো। একসময় সিদ্ধান্ত হলো এবারের শবে বরাতে আমরা গনি মসজিদে রাত্রিযাপন করবো। আম্মা বাঁধ সাধলেন। না, রাত্রিতে থাকা যাবে না।

ঘাগরা পাড়টা ভাল না। তবুও ম্যানেজ হয়ে গেল আব্বার হস্তক্ষেপে। আমি, আমু, পাওয়ার, সুইট, কামরুল একত্রে এশার নামাজের আগে পাটি জায়নামাজ নিয়ে রওনা হলাম গনি মসজিদের দিকে। কামরুলদের বাড়ি পেরিয়ে দুপা এগুতেই আমার চোখে পড়ে একটা সাদা ধবধবে বিড়াল রাস্তার পাশে ওৎপেতে বসে আছে, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। আমু বাম পা-দিয়ে লেং দিতে গেলে সেটা দৌড়ে চলে যায়। আমি জোরে হেসে উঠি। কামরুল সেদিকে খেয়াল না করেই হন হন করে স্বভাবসুলভ হেঁটে চলে। ও অবশ্য তখন থেকেই বেশি নামাজী ছিল। সব কিছুতেই সিরিয়াস। ধর্ম পালনের বিষয়ে আরো বেশি। এশার নামাজ পড়ে নফল নামাজ পড়তে পড়তে কখন যে মসজিদের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ভোরের আজানের আগে মুয়াজ্জিনের ডাকে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চট জলদি অজু সেরে নামাজ শেষ করে বাসার দিকে পা বাড়াই। ঘুম কম হওয়ার কারণে সবাই ক্লান্ত যে যার মত মসজিদ থেকে বেরিয়ে হন হন করে যার যার বাসার দিকে রওয়ানা হয়। আমি আর কামরুল হেলে দুলে ধীরে সুস্থে বাসার দিকে এগুতে থাকি। কামরুল তার বাসায় ঢুকে যায় আমি সুবেহ সাদেকের আলো আঁধারীতে এগিয়ে যাই। হঠাৎ ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখি সেই বিড়ালটি। আমি মসজিদে পাওয়া জিলাপী শুকরানার কিছু অংশ তার দিকে ছুড়ে দিতেই সে সেটা মুখে পুরে পানির মধ্যে হারিয়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব! আমার কিশোর মন তখন ভয়ে অস্থির, পুরো রাস্তা নিরব। নিশাচর প্রাণি তক্কের ডাক আমার ভয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি উর্ধ্বশ্বাসে বাসার দিকে দৌড়াতে থাকলাম। এসময় মায়ের নিষেধের কথা মনে হলো। আবারো ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, আরে বিড়াল কোথায় একটা সাদা ঘোমটা পরা ছায়ামূর্তি ঘাগরা নদীর পানিতে ডুব দিচ্ছে। বিষয়টি আজও আমায় গোলক ধাঁধায় ফেলে, তবে কি ওটা মিষ্টার ভাই, আছিয়া আপা নাকি অপঘাতে মৃত্যু হওয়া অন্য কেউ।

আরও পড়ুন : অলৌকিক: জানালায় বড় একটা পাখির ডানার ঝাপটার শব্দ আজও কানে বাজে!

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

অলৌকিক! সাদা ছায়ামূর্তিটা পানির মধ্যে ডুব দিলো!

আপডেট সময় ০১:০১:৩৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ মার্চ ২০২৪

জামিউর রহমান লেমন
স্বাধীনতা যুদ্ধের বেশ পরে তখনও দিনাজপুরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়নি। ঘাগরা নদীতে অনেক মানুষকে মেরে লাশ ফেলা হয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। মিষ্টার ভাই, আসিয়া আপাদের ঘরটা খালি পড়ে রয়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও পুতে রাখা ডিনামাইট বিস্ফোরণের শব্দ বাতাসে ভেসে আসে। আমাদের বাসার রান্না ঘরের মেঝেটা একবারে ওলট পালট করা মাটি বের হয়ে আছে। তাহলে কি ওখানেও মানুষ পুঁতে রাখা হয়েছে। তবুও প্রায় নয় মাস ভারতে থেকে নিজ বাসায় ফিরে এসে সবাই যেন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। নালাহার বর্ডার দিয়ে আমরা পালিয়েছিলাম স্পষ্ট মনে আছে, গরুর গাড়িতে আমরা সবাই, রেজাউল ভাই আর আব্বা একরকম হেঁটেই। একই ভাবে ফেরা।

সাতচল্লিশ এর রায়টে সর্বস্ব ফেলে প্রেসিডেন্সী কলেজের মেধাবী ছাত্র, ভারত সিভিল সার্ভিসের তরুণ কর্মকর্তা আমার বাবা আবদুর রহমান পাড়ি জমিয়েছিলেন এদেশে। আজও তার আবার ফেরা, জীবনের সঞ্চয় করা, আয় করা, ফেলে যাওয়া বাসার সব সামগ্রী লুটেরাদের হাতে চলে গেছে। সাংসারিক সব কিছু লুট হওয়ায় কেবল খালি ঘরে আমরা প্রবেশ করেছিলাম। এ যেন এক নির্জন মৃত্যুপুরি। সকল কিছু হারিয়ে আব্বা মোটেও বিচলিত হননি। বরং তিনি সাহস দিয়ে বলেছিলেন, মানুষ বেঁচে থাকলে সব কিছু হয়ে যায় বাবুর মা। আবার শুরু হলো তাঁর জীবন সংগ্রাম। চৌকি, হাড়ি পাতিল বদনা সব কিছুই আবার নতুন করে কেনা।
ভারত থেকে ফেরার দিনেই পাশের বাসার বিকট শব্দে আমরা বিভ্রান্ত হলাম, তবে কি খানেরা এখনো কোথাও ঘাপটি মেরে আছে! সবাই হাশেম ভাইদের বাড়ি থেকে ধরাধরী করে হাবিবকে বের করছে, জানলাম পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া গ্রেনেড নিয়ে হাবিব খেলা করছিল হঠাৎ সেটা বাষ্ট হয়ে হাবিবের হাতের কব্জি উড়ে গেছে। হাবিব আমার থেকে বয়সে কিছু বড় হলেও তার সাথে আমার সখ্যতা ছিল।

আমাদের বাসাটা ঘাগরা নদীর পাড়ে ছিল, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সেখানের অনেক ঘটনাই জনশ্রতিতে ছিল। রাতে ভরা নদীতে পানির শব্দ শুনলে মনে হতো, সেটা যেন মানুষের কান্না। লুটতরাজের ভীতি আমাদের সবার মনে তখনো রয়েছে, তাই সদর দরজায় দুটি কপাট লাগানোর ব্যবস্থা করা হলো। অন্ধকার রাতে ভিতরের উঠানে একা নামলেই গাটা ছম্ছম্ করে উঠতো। পাওয়ার সুইটের আব্বাকে বলতে শুনেছি যে, যে সব মানুষের মৃত্যু অপঘাতে বা অপমৃত্যু হয় তাদের আত্মা নাকি শান্তির জন্য ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়, অন্ধকার ও সুনসান জায়গায় তাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। অবশ্য এসবের কিছুই আমি বুঝিনা। আমাদের বাসার কিছু দুরেই ফরিদপুর গোরস্থান, সেখানে আমার একদিনের ছোট ভাইকে দাফন করা হয়েছিল বেশ মনে আছে। যে গোরকান তার দাফনের ব্যবস্থা করেছিল তার সাথে আমাদের পারিবারিক একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। গোরকান কবর খানার কিছু ঘটনার নিরব স্বাক্ষী ছিলেন। তিনি মাঝে মধ্যে বাসায় এসে গুড়ের চা খেতে খেতে এসব কিছু রসিয়ে রসিয়ে বলতেন। আমার কিশোর মনে সেসব ভাবনা খোরাক হয়ে জমে উঠতো। তিনি বলতেন, ঘাগরা নদীতে অনেক লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে, তাদের দাফন কাফন হয়নি, সন্ধ্যে রাতে তাদের আত্মা ঘোরাফেরা করে, রাত বিরাতে বাইরে না বেরোনোই ভালো। আমার মনে পড়তো তাহলে কি রাজপুত্রের মতো চেহারার মিষ্টার ভাই, আছিয়া আপা, হাফেজ রফিক চাচাও তাদের মধ্যে আছেন? প্রতি শবে বরাতে হাফেজ রফিক চাচার কথা আমার স্মৃতিতে ভাসে। কারণ, শবে বরাতের আগের সাতদিন তিনি আমাদের দিনাজপুরের বাসায় বসে কোরান খতম করতেন। শবে বরাতের দিন আনুষ্ঠানিক দোয়ার মাধ্যমে এই কাজ শেষ হতো। স্বাধীনতার পর এই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটলো। রফিক হাফেজের খোঁজ নেই। কোথায় গেল শবে বরাতের দিন। ঘাগরা পাড়ে দাঁড়িয়ে সেই গোরকানের কথা মনে হলো। মনে হচ্ছে রফিক হাফেজ ঘাগরা নদীতে শুয়ে শুয়ে তার দরাজ কণ্ঠে কোরান তেলওয়াত করছেন “আর রাহমান ওয়াল্লামাল কোরআন”। ছোট বেলায় তাঁর কণ্ঠেই এটি শুনে আমার প্রায় মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।

ঘরের পবিত্রতা ও অপশক্তির থেকে বাঁচার জন্য বাসায় আবারো সপ্তাহব্যাপী কোরান খতমের আয়োজন করা হলো। রোজী আপা সবাইকে নিয়ে সন্ধ্যার নামাজের পর বাড়ির ভিতরের উঠানে ঘুরে ঘুরে সুরে সুরে ঘর বন্ধের দোয়া/শোলক পাঠ করতেন “লিখাম সিতাম নাফসি বেহা” আজ যা কানে ভাসে।

এভাবেই কেটে গেল স্বাধীনতা উত্তর কিছু সময়। আবার জীবন সংগ্রাম। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। জীবন যুদ্ধে আব্বা পরাজিত হননি। শিক্ষিত করেছিলেন সবাইকে। আব্বার বিষয়টি এখনো আমাকে ভাবায়। এক জীবনে দুবার হেঁচোট খেলে, সর্বশান্ত হলে সে মানুষ সে পরিবার কিভাবে ঘুরে দাঁড়ায়! এখন তা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

একবার এই শবে বরাতের দিনে, তখন কাশ্মীরি সাহেবদের বাড়িটি শত্রু সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। সুন্দর ঐ বাড়িটির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই চোখে ভাসে জান ভাই, মুন্নি আপা, ডলি আপার চেহারা। বাড়িটি এখন সহকারি পুলিশ সুপারের বাংলো। নতুন এএসপি উঠেছেন। তার একটা রাজপুত্রের মতো ছেলে আছে, আমাদের মতই অনেকগুলো বোন ভাই। সেই ছোট রাজপুত্র কামরুলের সাথে হঠাৎ করেই আমার সখ্য হয়। প্রতিদিন একবার দেখা না হলেই যেন নয়। যদিও কামরুল বয়সে আমার বেস ছোট ছিল। কামরুল আমি পাওয়ার রাব্বি আর আমু দলবেঁধে গনি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতাম। একসাথে নামাজে যাওয়ার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সবাই একসাথে হলেই একটা ভিন্ন ধরনের আনন্দে মনটা একেবারে ভরে যেতো। একসময় সিদ্ধান্ত হলো এবারের শবে বরাতে আমরা গনি মসজিদে রাত্রিযাপন করবো। আম্মা বাঁধ সাধলেন। না, রাত্রিতে থাকা যাবে না।

ঘাগরা পাড়টা ভাল না। তবুও ম্যানেজ হয়ে গেল আব্বার হস্তক্ষেপে। আমি, আমু, পাওয়ার, সুইট, কামরুল একত্রে এশার নামাজের আগে পাটি জায়নামাজ নিয়ে রওনা হলাম গনি মসজিদের দিকে। কামরুলদের বাড়ি পেরিয়ে দুপা এগুতেই আমার চোখে পড়ে একটা সাদা ধবধবে বিড়াল রাস্তার পাশে ওৎপেতে বসে আছে, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। আমু বাম পা-দিয়ে লেং দিতে গেলে সেটা দৌড়ে চলে যায়। আমি জোরে হেসে উঠি। কামরুল সেদিকে খেয়াল না করেই হন হন করে স্বভাবসুলভ হেঁটে চলে। ও অবশ্য তখন থেকেই বেশি নামাজী ছিল। সব কিছুতেই সিরিয়াস। ধর্ম পালনের বিষয়ে আরো বেশি। এশার নামাজ পড়ে নফল নামাজ পড়তে পড়তে কখন যে মসজিদের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। ভোরের আজানের আগে মুয়াজ্জিনের ডাকে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চট জলদি অজু সেরে নামাজ শেষ করে বাসার দিকে পা বাড়াই। ঘুম কম হওয়ার কারণে সবাই ক্লান্ত যে যার মত মসজিদ থেকে বেরিয়ে হন হন করে যার যার বাসার দিকে রওয়ানা হয়। আমি আর কামরুল হেলে দুলে ধীরে সুস্থে বাসার দিকে এগুতে থাকি। কামরুল তার বাসায় ঢুকে যায় আমি সুবেহ সাদেকের আলো আঁধারীতে এগিয়ে যাই। হঠাৎ ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখি সেই বিড়ালটি। আমি মসজিদে পাওয়া জিলাপী শুকরানার কিছু অংশ তার দিকে ছুড়ে দিতেই সে সেটা মুখে পুরে পানির মধ্যে হারিয়ে যায়। এটা কি করে সম্ভব! আমার কিশোর মন তখন ভয়ে অস্থির, পুরো রাস্তা নিরব। নিশাচর প্রাণি তক্কের ডাক আমার ভয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি উর্ধ্বশ্বাসে বাসার দিকে দৌড়াতে থাকলাম। এসময় মায়ের নিষেধের কথা মনে হলো। আবারো ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, আরে বিড়াল কোথায় একটা সাদা ঘোমটা পরা ছায়ামূর্তি ঘাগরা নদীর পানিতে ডুব দিচ্ছে। বিষয়টি আজও আমায় গোলক ধাঁধায় ফেলে, তবে কি ওটা মিষ্টার ভাই, আছিয়া আপা নাকি অপঘাতে মৃত্যু হওয়া অন্য কেউ।

আরও পড়ুন : অলৌকিক: জানালায় বড় একটা পাখির ডানার ঝাপটার শব্দ আজও কানে বাজে!