ঢাকা ১০:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একটা বিশাল ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!

জামিউর রহমান লেমন
১৯৮৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ্ হলের এক্সটেনশন ৫১০ নম্বর রুমে আমি নিজের সিট এলটমেন্ট পেয়েছি। সাথে থাকে আজিজ জসিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলে তখন আমি প্রচুর সময় দেই। প্রতিদিনই কোন না কোন কিছুর মহড়া লেগেই থাকে। সেই সাথে নতুন নাটক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মিউজিক করার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন আমার ব্যস্ততা অনেক। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ, বাসদ সব দলের অনুষ্ঠানেই গণসংগীত পরিবেশনের জন্য আমার ডাক পড়তো। কেউ টাকা দিতো কেউ দিতো না। অবশ্য সেসব নিয়ে তখন আমার খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না বললেই চলে। হল ডাইনিং এ ফুড মিল চার্জ ছিল মাত্র আড়াই টাকা। সেটার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হতো না। আব্বার পাঠানো মাসিক একশ থেকে দেড়শ টাকা আর দৈনিক বাংলায় লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে আয় নেহায়েত কম হতো না। তবে স্বভাবসুলভ খোলা হাতের কারণে সেসব বাড়তি টাকা মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর আর টিএসসিতে শেষ হয়ে যেতো।

মুকুল বোস একদিন আমাকে মধুর ক্যান্টিনে নাস্তা খাওয়ার সময়ে একান্তভাবে বলেছিল, তুই আসলে কি হতে চাস লেমন? আমি বলেছিলাম, ‘মানুষ হতে চাই। কাজ করতে চাই যা কিছু ভাল লাগে। কোন গন্তব্য নাই।’ মুকুল বোস বলেছিলেন, ফুল টাইম পলিটিক্স কর। তোর যোগাযোগ ভাল।

আমি কোন কিছুতেই ফুল টাইম হতে পারিনি। এতে আমার একটুও আক্ষেপ নেই। তবে মোটামুটি মানুষ হতে পেরেছি। মানুষ কে কি বললো সেদিকে আমি ভ্রুক্ষেপ করিনা। আমি কি, কতটা ভাল বা খারাপ সেটা আমিই জানি আর অর্ন্তজামি জানেন। অন্য কারোর জানায় আমার কিছু আসে যায় না। আমার শিক্ষক প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ড. আমিনুল ইসলাম আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। তারা ক্লাসে সেমিনারে এমনকি ভাইভা বোর্ডে আমাকে শিল্পী বলে সম্বোধন করতেন। তারা সব সময় আমাকে বলতেন, পড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ভাল করে চালিয়ে যাও। তুমি পারবে।

তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে দু’একটা অনুষ্ঠান করছি, গান করছি, ইউনিভার্সিটি ম্যাগাজিন, প্রচ্ছদ-এ। হঠাৎ একদিন প্রযোজক আল মনসুর ডাকলেন তার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বিশেষ দ্রষ্টব্যে গান করার জন্য। কবিতা পাঠ করবে বন্ধু আনিসুজ্জামান আর গান করবো আমি। উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হলো না। হলের ছোট বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। ভাবছি আমি কতই না ভাগ্যবান। দেশে গান জানা কত বড় বড় শিল্পী রয়েছেন অথচ আমাকে ডাকা এটা অনেক সম্মানের। আজিজ জসিম তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমি রাতে আলো জ্বালালেই জসিমের রাগন্বিত কণ্ঠ শুনতে হতো। লাইট নিভিয়ে দাও। তবু সেদিন বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালালাম। জসিম সেদিন কোন বিরক্তি প্রকাশ করলো না। বিটিভির গানের অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলাম বন্ধু সাবাব আলী আরজু ও জাকারিয়াকে। লেখালিখি শেষ করে রাত দুইটা নাগাদ যখন শুয়েছি কোথা থেকে ভয়াবহ ঘুম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ঘুমের মাঝেই আমি দেখছি একটা বড় কালো ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। দীর্ঘ পথের যেন শেষ হচ্ছে না কোথাও। ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন প্রায় ভোর। আমি সেটাকে নিছক স্বপ্ন মনে করেই তেমন কোন কিছু আর ভাবিনি।

সেদিন সকালে ক্লাস শেষ করে বিকেল তিনটে নাগাদ বিটিভিতে হাজির হই। গানটির অডিও ধারণ ও ভিডিও হতে হতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেল। আনিসের কবিতা আবৃত্তি চটজলদি হয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমি ও আনিস রামপুরা থেকে একটা রিক্সা ঠিক করি, উদ্দেশ্য বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে যাবো। কারণ, তখন আমরা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত উচ্চারণের একটা কোর্সের সাথে যুক্ত ছিলাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কাছাকাছি এসে, সম্ভবত উপস্থাপক বন্ধু নজরুল কবীরের সাথে দেখা। সে জানালো আজ ক্লাস হবে না। অগত্যা হলে ফিরতে হবে। আনিস যাবে টিএসসিতে আর আমি শহীদুল্লাহ্ হলে। বাংলামোটরের মোড়ে কাছে আসতেই ভীষণ ঝাঁকুনি খেলাম। তারপর আর কোন কিছুই আমার মনে নেই। রাত নয়টার পর আমার হুশ ফিরলে দেখলাম আমি ঢাকা মেডিক্যাল এর ৩২ নম্বর ওয়ার্ড-এ শুয়ে আছি। মাথায় ও চোখের উপরে সেলাই, হাতে পায়ে ব্যাণ্ডেজ। বুঝতে পারলাম এক্সিডেন্ট। অন্যপাশে চোখ যেতেই দেখলাম ছলছল চোখে রোজী আপা দাঁড়ানো। পাশে আনিসের বোন ও ফরিদা আপা। মাথার দিকে মুকুল বোস ও হলের জহির ভাই। মুকুল বোস স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললো, ভাইটি কিছু হয় নাই। সপ্তাহ খানেক লাগবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ততক্ষণে শহীদুল্লাহ্ হলের প্রায় শতাধিক ছাত্র সেখানে ভীড় করেছে, যারা আমাকে আমার গানকে পছন্দ করতো। টুলু, রিয়াজ পায়ের কাছে দাঁড়ানো, টুলু রসিকতার সুরে বললো, মরলে মরতি দোস্ত। চোখ দুইটাতো বাইচা গেছে।

কর্তব্যরত ডাক্তার সবাইকে চলে যেতে বললেন। শুধুমাত্র ওয়ার্ডে ছিলাম আমি ও রোজী আপা। স্যালাইন চলছে। ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে দেখি তখনো রোজী আপা পাশে বসে নির্ঘুম রাত পার করেছেন। আপনজনের অসুস্থতায় তার পাশে বসে থাকাটাও একটা দায়িত্ব এটা শিখিয়েছিলেন রোজী আপা।

সকালে নার্স এসে দেখে গেল। বললো, মুখে কিছু খেতে পারবেন কি? বললাম, না। তখন বললো তাহলে স্যালাইনটাই চলুক। ভিজিটিং ডাক্তার এসে সিদ্ধান্ত দেবেন। রেজাউল ভাই আমার বড় বোনের স্বামী, তাদের সম্পর্কটা টেকেনি, তবুও তার সাথে আমৃত্যু আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তিনি কিভাবে যেন খবর পেয়ে আমাকে দেখতে আসলেন। বলে গেলেন কিছুটা সুস্থ হয়ে যেন খুলনায় চলে যাই। একমাস বিশ্রাম নিয়ে আসি। বাংলাদেশ বিমানের দুটো ওপেন টিকিট তিনি দিয়ে গেলেন। সেটাই বিমানে আমার প্রথম চড়া।

কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, কি করে হলো? ঊললাম, জানিনা। তবে আনিস বললো বাসটা আমাদের রিক্সাটাকে ধাক্কা দিয়ে ব্রেক করে। আমি উঠতে গিয়ে প্রায় চাকার ফাঁকে আটকে গিয়ে আবার ছিটকে পড়ি। চাকাটা আর একপাক ঘুরলে যা হওয়ার তাই হতো। ও যখন আমাকে কোলে তুলে অন্য রিক্সায় শাহবাগ পার হচ্ছিল তখন আমার চোখ থেকে রক্তপাত হওয়া দেখে ওর ধারনা হয়েছিল আমি মরে গেছি। আউটডোরের ডাক্তার যখন নিশ্চিত করলো আমি বেঁচে আছি, তখন সে লক্ষ্য করলো তার ক্ষতস্থান থেকেও ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে। এই ছিল আমার প্রিয় বন্ধু আবৃত্তিকার আনিস।

যেদিন মেডিক্যাল থেকে আমার ছুটি হলো, জিনিষপত্র গুটিয়ে নিয়ে হল হয়ে আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হবো, গুড সোহেল তাদের গাড়িতে আমাদের এয়ারপোর্ট পৌছে দেবে, ঠিক তখন গাড়িতে বসে রোজী আপা আমায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী ডিপ্রেশনে ছিলে দাদু? আমি বললাম, তা ঠিক নয়। তবে এক্সিডেন্ট এর আগের রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা বিশাল ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বললেন, এখন থেকে এসব গুরুত্ব দিও, সাবধানে চলাচল করবে। (চলবে)

আরো পড়ুন : শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

একটা বিশাল ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে!

আপডেট সময় ১২:০৩:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪

জামিউর রহমান লেমন
১৯৮৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদুল্লাহ্ হলের এক্সটেনশন ৫১০ নম্বর রুমে আমি নিজের সিট এলটমেন্ট পেয়েছি। সাথে থাকে আজিজ জসিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক দলে তখন আমি প্রচুর সময় দেই। প্রতিদিনই কোন না কোন কিছুর মহড়া লেগেই থাকে। সেই সাথে নতুন নাটক রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মিউজিক করার দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন আমার ব্যস্ততা অনেক। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ, বাসদ সব দলের অনুষ্ঠানেই গণসংগীত পরিবেশনের জন্য আমার ডাক পড়তো। কেউ টাকা দিতো কেউ দিতো না। অবশ্য সেসব নিয়ে তখন আমার খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না বললেই চলে। হল ডাইনিং এ ফুড মিল চার্জ ছিল মাত্র আড়াই টাকা। সেটার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হতো না। আব্বার পাঠানো মাসিক একশ থেকে দেড়শ টাকা আর দৈনিক বাংলায় লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে আয় নেহায়েত কম হতো না। তবে স্বভাবসুলভ খোলা হাতের কারণে সেসব বাড়তি টাকা মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর আর টিএসসিতে শেষ হয়ে যেতো।

মুকুল বোস একদিন আমাকে মধুর ক্যান্টিনে নাস্তা খাওয়ার সময়ে একান্তভাবে বলেছিল, তুই আসলে কি হতে চাস লেমন? আমি বলেছিলাম, ‘মানুষ হতে চাই। কাজ করতে চাই যা কিছু ভাল লাগে। কোন গন্তব্য নাই।’ মুকুল বোস বলেছিলেন, ফুল টাইম পলিটিক্স কর। তোর যোগাযোগ ভাল।

আমি কোন কিছুতেই ফুল টাইম হতে পারিনি। এতে আমার একটুও আক্ষেপ নেই। তবে মোটামুটি মানুষ হতে পেরেছি। মানুষ কে কি বললো সেদিকে আমি ভ্রুক্ষেপ করিনা। আমি কি, কতটা ভাল বা খারাপ সেটা আমিই জানি আর অর্ন্তজামি জানেন। অন্য কারোর জানায় আমার কিছু আসে যায় না। আমার শিক্ষক প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, ড. আমিনুল ইসলাম আমাকে খুবই পছন্দ করতেন। তারা ক্লাসে সেমিনারে এমনকি ভাইভা বোর্ডে আমাকে শিল্পী বলে সম্বোধন করতেন। তারা সব সময় আমাকে বলতেন, পড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ভাল করে চালিয়ে যাও। তুমি পারবে।

তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে দু’একটা অনুষ্ঠান করছি, গান করছি, ইউনিভার্সিটি ম্যাগাজিন, প্রচ্ছদ-এ। হঠাৎ একদিন প্রযোজক আল মনসুর ডাকলেন তার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বিশেষ দ্রষ্টব্যে গান করার জন্য। কবিতা পাঠ করবে বন্ধু আনিসুজ্জামান আর গান করবো আমি। উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হলো না। হলের ছোট বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। ভাবছি আমি কতই না ভাগ্যবান। দেশে গান জানা কত বড় বড় শিল্পী রয়েছেন অথচ আমাকে ডাকা এটা অনেক সম্মানের। আজিজ জসিম তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আমি রাতে আলো জ্বালালেই জসিমের রাগন্বিত কণ্ঠ শুনতে হতো। লাইট নিভিয়ে দাও। তবু সেদিন বিছানা ছেড়ে উঠে লাইট জ্বালালাম। জসিম সেদিন কোন বিরক্তি প্রকাশ করলো না। বিটিভির গানের অনুষ্ঠানের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলাম বন্ধু সাবাব আলী আরজু ও জাকারিয়াকে। লেখালিখি শেষ করে রাত দুইটা নাগাদ যখন শুয়েছি কোথা থেকে ভয়াবহ ঘুম আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ঘুমের মাঝেই আমি দেখছি একটা বড় কালো ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। দীর্ঘ পথের যেন শেষ হচ্ছে না কোথাও। ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন প্রায় ভোর। আমি সেটাকে নিছক স্বপ্ন মনে করেই তেমন কোন কিছু আর ভাবিনি।

সেদিন সকালে ক্লাস শেষ করে বিকেল তিনটে নাগাদ বিটিভিতে হাজির হই। গানটির অডিও ধারণ ও ভিডিও হতে হতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে গেল। আনিসের কবিতা আবৃত্তি চটজলদি হয়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে আমি ও আনিস রামপুরা থেকে একটা রিক্সা ঠিক করি, উদ্দেশ্য বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে যাবো। কারণ, তখন আমরা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত উচ্চারণের একটা কোর্সের সাথে যুক্ত ছিলাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কাছাকাছি এসে, সম্ভবত উপস্থাপক বন্ধু নজরুল কবীরের সাথে দেখা। সে জানালো আজ ক্লাস হবে না। অগত্যা হলে ফিরতে হবে। আনিস যাবে টিএসসিতে আর আমি শহীদুল্লাহ্ হলে। বাংলামোটরের মোড়ে কাছে আসতেই ভীষণ ঝাঁকুনি খেলাম। তারপর আর কোন কিছুই আমার মনে নেই। রাত নয়টার পর আমার হুশ ফিরলে দেখলাম আমি ঢাকা মেডিক্যাল এর ৩২ নম্বর ওয়ার্ড-এ শুয়ে আছি। মাথায় ও চোখের উপরে সেলাই, হাতে পায়ে ব্যাণ্ডেজ। বুঝতে পারলাম এক্সিডেন্ট। অন্যপাশে চোখ যেতেই দেখলাম ছলছল চোখে রোজী আপা দাঁড়ানো। পাশে আনিসের বোন ও ফরিদা আপা। মাথার দিকে মুকুল বোস ও হলের জহির ভাই। মুকুল বোস স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বললো, ভাইটি কিছু হয় নাই। সপ্তাহ খানেক লাগবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। ততক্ষণে শহীদুল্লাহ্ হলের প্রায় শতাধিক ছাত্র সেখানে ভীড় করেছে, যারা আমাকে আমার গানকে পছন্দ করতো। টুলু, রিয়াজ পায়ের কাছে দাঁড়ানো, টুলু রসিকতার সুরে বললো, মরলে মরতি দোস্ত। চোখ দুইটাতো বাইচা গেছে।

কর্তব্যরত ডাক্তার সবাইকে চলে যেতে বললেন। শুধুমাত্র ওয়ার্ডে ছিলাম আমি ও রোজী আপা। স্যালাইন চলছে। ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে দেখি তখনো রোজী আপা পাশে বসে নির্ঘুম রাত পার করেছেন। আপনজনের অসুস্থতায় তার পাশে বসে থাকাটাও একটা দায়িত্ব এটা শিখিয়েছিলেন রোজী আপা।

সকালে নার্স এসে দেখে গেল। বললো, মুখে কিছু খেতে পারবেন কি? বললাম, না। তখন বললো তাহলে স্যালাইনটাই চলুক। ভিজিটিং ডাক্তার এসে সিদ্ধান্ত দেবেন। রেজাউল ভাই আমার বড় বোনের স্বামী, তাদের সম্পর্কটা টেকেনি, তবুও তার সাথে আমৃত্যু আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তিনি কিভাবে যেন খবর পেয়ে আমাকে দেখতে আসলেন। বলে গেলেন কিছুটা সুস্থ হয়ে যেন খুলনায় চলে যাই। একমাস বিশ্রাম নিয়ে আসি। বাংলাদেশ বিমানের দুটো ওপেন টিকিট তিনি দিয়ে গেলেন। সেটাই বিমানে আমার প্রথম চড়া।

কর্তব্যরত ডাক্তার বললেন, কি করে হলো? ঊললাম, জানিনা। তবে আনিস বললো বাসটা আমাদের রিক্সাটাকে ধাক্কা দিয়ে ব্রেক করে। আমি উঠতে গিয়ে প্রায় চাকার ফাঁকে আটকে গিয়ে আবার ছিটকে পড়ি। চাকাটা আর একপাক ঘুরলে যা হওয়ার তাই হতো। ও যখন আমাকে কোলে তুলে অন্য রিক্সায় শাহবাগ পার হচ্ছিল তখন আমার চোখ থেকে রক্তপাত হওয়া দেখে ওর ধারনা হয়েছিল আমি মরে গেছি। আউটডোরের ডাক্তার যখন নিশ্চিত করলো আমি বেঁচে আছি, তখন সে লক্ষ্য করলো তার ক্ষতস্থান থেকেও ঝর ঝর করে রক্ত ঝরছে। এই ছিল আমার প্রিয় বন্ধু আবৃত্তিকার আনিস।

যেদিন মেডিক্যাল থেকে আমার ছুটি হলো, জিনিষপত্র গুটিয়ে নিয়ে হল হয়ে আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হবো, গুড সোহেল তাদের গাড়িতে আমাদের এয়ারপোর্ট পৌছে দেবে, ঠিক তখন গাড়িতে বসে রোজী আপা আমায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী ডিপ্রেশনে ছিলে দাদু? আমি বললাম, তা ঠিক নয়। তবে এক্সিডেন্ট এর আগের রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা বিশাল ষাড় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তিনি বললেন, এখন থেকে এসব গুরুত্ব দিও, সাবধানে চলাচল করবে। (চলবে)

আরো পড়ুন : শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!