ঢাকা ০৯:৫৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যমুনা নদী ও পাঁচ পুরুষের কেচ্ছা

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
আশ্বিন মাস। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম এখনো আছে। তির তির করে বেলা বাড়ার সাথে তর তরিয়ে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। বোগল ছেঁড়া হাফ হাতা গেঞ্জি পড়ে দোচালা টিনের ঘর থেকে বের হন সত্তরোর্ধ্ব ছলিম মুন্সী। ঘাড়ে গামছা। তার এক মাথায় বড় গেদির রান্না করে দেয়া দুপুরের খাবার। অন্য মাথায় পুটলি করে বাঁধা পানের ডিব্বা। ঘরের কোনায় রাখায় বাঁশের লগি নিয়ে ডাক দেন নাতী পানুকে। পানু প্রতিদিনের মতো চারটি ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁঠাল গাছের নিচে। আওয়াজ দেয়, নানা, আমি এহানে।

ছাগল আর নাতীকে নিয়ে শতবর্ষী নৌকা ছাড়েন ছলিম। ভাঁজ পড়া চামড়ার হাতে বৈঠা ধরেন। কব্জিতে আর আগের মতো জোর পান না। বাজানের মামু যখন নৌকাটি পাঠান, তখন বড় ছই ছিল। মাঝখানে ছিল মস্তবড় মাস্তুল। লাল টকটকে রঙের ট্রেটন কাপড়ের পাল তুলে বাজান ব্যবসায়ীদের নিয়ে শাহজাদপুর কাপড়ের মোকামে যেতেন। বলরামপুরের পাটের হাটে যেতেন শনি ও মঙ্গলবার। গুণ টানার লোক ছিল তিনজন। দুইদিকে চারটি বৈঠা একসাথে টানা হতো। বাজান ছইয়ের উপর বসে শক্ত হাতে দাড় ধরতেন। কখনো কখনো কালুগাজীর গান গাইতেন তিনি। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তৈরি হতো মোহময় সুর তরঙ্গ।

এখন আর বৈঠা দিয়ে কেউ নৌকা চালায় না। সবাই শ্যালো মেশিন লাগিয়েছে। কিন্তু ছলিম বাবার স্মৃতি এখনো আগলে রেখেছেন। যদিও এখন আর সেই ছই নেই, মাস্তুল নেই। শুকনো মৌসুমে নিজের হাতে নৌকা মেরামত করেন। আলকাতরার সাথে গাবের রস মাখেন। এতে নাকি নৌকা টেকসই হয়। তার এসব কাণ্ড দেখে অনেকেই হাসাহাসি করে। অবশ্য ছলিমের সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই।

যমুনা নদীর পানিতে টান পড়েছে। জাগতে শুরু করেছে বানের পানিতে তলিয়ে থাকা বিস্তৃর্ণ চর। দখিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে কাশফুল। আকাশে উড়ছে গাঙ শালিকের দল। শিকার পেলেই ছোঁ মারছে পানিতে। ঠোটে করে ছোট মাছ ধরে উড়ে যাচ্ছে। আবারও আসছে। বালি হাঁসগুলো সাঁতার কাঁটছে আয়েশী ভঙ্গিতে। একটি হাঁস চেষ্টা করছে মাছ গিলতে। পারছে না। মাছটি ঠোট থেকে পানিতে পড়ছে। শিকারী হাঁস আবারো ডুব দিয়ে ধরে আনছে। বার কয়েক চেষ্টার পর মাছটি গিলে পানিতে ঠোট ভেজায়। তারপর তৃপ্ত মনে ভাসতে থাকে। আগে এই নদীতে শুশুক ছিল। এখন আর দেখা যায় না। বৃদ্ধ ছলিমের কাছে এ সবই চিরচেনা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেন না। ভালো বা মন্দ লাগার অনুভূতি স্পর্শ করে না তাকে। তার কাছে জীবন ধূ ধূ বালুচরের মতো। যেখানে উত্তাপ আছে। কিন্তু কোনো আনন্দ নেই।

মড় মড় শব্দে নৌকার সামনের গোলুই তীর ঘেঁষে জন্মানো কাশঝাড়ের মাঝে ঢুকিয়ে দেন ছলিম। বৈঠা তুলে লগি নিয়ে নেমে পড়েন হাঁটু পানিতে। লাল কাঁকড়ার দল শব্দ পেয়ে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে গর্তে। কানি বক দুটি উড়ে গিয়ে বসে সামান্য দূরে। ছলিম লগিটিকে শক্ত করে পুঁতে তার সাথে রশি দিয়ে নৌকাটিকে বেঁধে রাখেন। পানু ছাগলগুলোকে ছেড়ে দেয় সদ্য গজিয়ে উঠা ঘাসের মাঝে।

কয়েকটি কাশফুলের ডগা একসাথে বেঁধে তার নিচে বসেন ছলিম মুন্সী। গামছার পুটলি থেকে পাটায় ছেচা সুপারি দিয়ে পান মুখে দেন। এই চর তার কাছে জীবনের শিকর। পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব। দাদার দাদা আলী মামুদ মুন্সীর বাস ছিল এখানে। তখন গ্রামের নাম ছিল ঘাটাইল। সবুজে ঘেরা গ্রামটির পূর্ব পাশে ছিল একটি খাল। নামটা ঠিক মনে করতে পারেন না। গ্রামের উত্তরে ছিল হাট। প্রতি রবিবার সেখানে হাট বসতো। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো হাটে। দুপুরের পর শুরু হওয়া হাটের বেচাকেনা চলতো রাত পর্যন্ত। কূপির আলোয় দোকানিরা হিসেব কষতো। হাটের পশ্চিম পাশে ছিল বিশাল ছাতিয়ান গাছ। তার নিচে ছনের ঘরের মক্তবে আরবি পড়াতেন আলী মামুদ। সেই থেকে এলাকার মানুষ তাকে মুন্সী নামে ডাকতেন। তারা ছিলেন চার ভাই। একান্নবর্তী পরিবারের অন্যরা ছিলেন কৃষক। চারপাশে ছনের ঘর। মাঝে বড় উঠান। উঠানের দক্ষিণ-পূবে কূয়া। পাড়ার লোকেরা খাবার পানি এ কূয়া থেকেই সংগ্রহ করতেন। বড় ভাইয়েরা বিয়ে করলেও আলী মামুদ তখনো কুমার। বিয়ের কথা চলছিল। পাশের গাঁয়ের মণ্ডল বাড়ির মেয়ে। গায়ের রং কালো হলেও নেকজাত ও পরহেজগার হওয়ায় আলী মামুদের পছন্দ হয়েছিল। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল অগ্রায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার।

সেদিন গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে পানির ভয়াল গর্জনে। ঘোলা পানিতে পশ্চিমের খাল ভরে তীব্র গতিকে চলে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। দেখতে দেখতে খালের দুইপাড়ে শুরু হয় ভাঙন। পানির তোড়ে ভেসে যেতে থাকে ফসলি জমি ঘরবাড়ি গবাদি পশু সহ সবকিছু। কিয়ামতের আলামত ভেবে আলী মামুদ দৌড়ে যান মক্তবে। কোরান শরীফ খুলে দেখেন। না, অক্ষর সব ঠিক আছে। তার মানে কিয়ামত শুরু হয়নি। মক্তব থেকে বের হতেই আচমকা ঢেউ আছড়ে পড়ে তার উপর। সাঁতার না জানা মুন্সী কোনো মতে হালটের পাড়ে একটি কলাগাছকে জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরেন। ভেসে যেতে থাকেন দক্ষিণে। কয়েকবার জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়েছিল। দশ মাইল দূরে সমেশপুরের কাছে কলাগাছটি একটি কটিখড়ায় আটকায়। একজন সৌখিন মৎস্যশিকারীর সহায়তা প্রাণে বেঁচে যান আলী মামুদ। উদ্ধার পাওয়ার পর তার কাচারী ঘরে থাকেন সপ্তাহ খানেকের মতো। এ সময় পরিবার পরিজনের কথা কিছুই জানতে পারেন না। আচমকা পানির ভয়াল গর্জনে ভীত সন্ত্রস্ত স্থানীয়রা। অজানা আশঙ্কায় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। অনেকেই সহায় সম্বল হারিয়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। দু’দিন আগেও যার সব ছিল, আজ সে নিঃস্ব।

সপ্তাহ খানেক পর পায়ে হেঁটে সিরাজগঞ্জ থানা শহরে যান আলী মামুদ। ছল্ ছল্ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শহরের পূবে সদ্য তৈরি বিশাল নদীর দিকে। ক’দিন আগেও যেখানে সবুজ শস্যের বুকে বাতাস ঢেউ খেলতো, সেখানে আজ পানির ক্রমাগত ঢেউ চলে যাচ্ছে ভাটিতে। শুধু পানি আর পানি। ওপাড়ে কি আছে দেখা যায় না। বসতভিটা কোথায় ছিল তাও ঠাহর করতে পারেন না।
দিনের আলো যেমন করে মøান হয় রাতের গভীরে, তেমনিভাবে আলী মামুদের সুখস্মৃতি হারিয়ে যায় সময়ের দুর্বিপাকে। জীবিকার তাগিদে পা বাড়ায় সে। যেটুকু বিদ্যা আছে তাই দিয়ে চেষ্টা করে অন্ন আর বাসস্থানের।

নদীর পাড়ে ছোট মুদির দোকান। তার সামনে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে আছেন আলী মামুদ। শুকনো মুখ দেখে মায়া হয় দোকানি মাতাম শেখের। জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন বানের তোড়ে সবকিছু হারিয়ে যাওয়া অসহায় যুবকের করুণ কাহিনি। মাতাম শেখ দোকানের সামনে ঝোলানো ভিমা আইটা কলার ছড়ি থেকে দুইটা কলা আর বিস্কুট হাতে দিয়ে বলেন, খায়া নাও বাবা। চিন্তা কইরা আর কী কইরবা? যা অওয়ার অইয়া গ্যাছে। এহন নিজে বাঁচনের চিন্তা করো। ক্ষুধার্ত পেটে গোগ্রাসে কলা গিলতে দেখে অবাক হন দোকানি। কথায় কথায় একটা কাজের কথা বলেন আলী মামুদ। আশ্বাস দিয়ে মাতাম শেখ বসতে বলেন। রাতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান তাকে। দুই ছেলেকে কোরান শিক্ষার জন্য বলেন। বিনিময়ে থাকা খাওয়া। রাজী হয়ে যান আলী মামুদ। এর কিছুদিন পর আশে পাশের কয়েক কিশোর-কিশোরীও তার কাছে পড়তে আসে। বছর খানেক পর মাতাম শেখ তার বিধবা কন্যার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বলেন, তার নামে সাত পাখি ক্ষেতি জমি আছে। সংসার ভালোই চলবে। স্বজনহারা আলী মামুদের রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। বিয়ের পর শহরের পূবে নদীর বেশ পশ্চিমে ঘর নির্মাণ করেন। পাশে ছোট জায়গায় ছনের মসজিদ নির্মাণ করে নিজেই ইমামতি শুরু করে। চার সন্তানকে আরবী শিক্ষা দেন তিনি।

চার ছেলের মধ্যে বড়জন হলেন জাবেদ আলী মুন্সী। আরবি শিক্ষা করেও সে সড়কের পাশে মুদি দোকানের ব্যবসা শরু করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। মেঝ ছেলে বাপের মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নেন। মা-বাবা মারা যাওয়ার পরও সুখেই কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু হঠাৎ করে এক বছর আষাঢ় মাসের প্রবল বন্যায় শুরু হয় ভাঙ্গন। সাত দিনের মধ্যেই চোখের সামনে সবকিছু হারিয়ে যায় যমুনার বুকে। নিঃস্ব মানুষগুলোর ঠাঁই হয় সরকারি সড়কের নিচে। কোনো রকমে কলাপাতার ঘরে শুরু হয় বসবাস। জায়েদ আলীর কাছে যে কয়েকটা টাকা ছিল তা দিয়ে সামান্য কিছু মাল কিনে তা শহরের অলিতে গলিতে ফেরি করতে থাকেন। খরচের পর জমতে থাকে কিছু টাকা। এক সময় ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে আবারও দোকান শুরু করেন। বড় দোকানদারও হন এক সময়।

জাবেদ আলী বিয়ে করেন খালাতো বোন রিনাকে। সে ঘরে জন্ম নেন একমাত্র ছেলে কোবাদ আলী মুন্সী। দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছিল। মক্তবের পড়া শেষ করে একটি মিশনারী স্কুলে পড়েছিল কয়েক বছর। বাবার ব্যবসায় মনোযোগী হয়ে পিতার সুনাম বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। বেশ বড় হয়েছিল দোকান। দূরের পাইকাররা আসতো তার দোকান থেকে মাল কিনতে। বাবা জায়েদ আলী ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন উজানের এক নামকরা সওদাগরের মেয়ের সাথে। মেয়ে যেমন ছিল রূপসী তেমনি গুণবতী। চৌদ্দ গায়ের লোক জেনেছিল সে বিয়ের খবর। চার বেহারার পাল্কী করে যেদিন বউ নিয়ে আসেন, সেদিন আশে পাশের কয়েক’শ লোক ভিড় জমিয়েছিল।

বিয়ের পর কোবাদ আলী মুন্সী বাড়িতে টিনের ঘর দেন। সওদাগার শ্বশুর আসাম থেকে কাঠের পালঙ্ক আর সিন্ধুক বানিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে সাতনরী হার, কোমরবিছা, নদ, নোলক, বালা আরও অনেক গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের জন্য দিয়েছিলেন কাঁসার থালা বাটি জগ। আনন্দের সংসারে জন্ম নেয় দুই মেয়ে আর তিন ছেলে। বড় ছেলে দশ বছর বয়য়ে গুটি বসন্তে মারা যায়। ছোট ছেলেটা মানসিক প্রতিবন্ধি। মেয়ে দুজনকে বড় ঘরে বিয়ে দেন কোবাদ আলী। মেজ ছেলে ইবাদ আলী মুন্সী বাবার ব্যবসার হাল ধরেন। তিনি বিয়ে করেন মাতুলকূলের এক আত্মীয়াকে। পরের বছর তাদের ঘরে জন্ম নেয় ছলিম মুন্সী। তারপর দুই বোন। ছলিমের বয়স তখন ছয় কি সাত। মক্তবে ভর্তি হয় সে। যাওয়ার সময় দাদা-দাদির পা ছুঁয়ে কদমবুছি করেন। সে বছর ভাদ্র মাসে এলাকায় দেখা দেয় কলেরা রোগ। গাঁয়ের পর গাঁয়ের মানুষ মারা যায়। একদিন সকালে কলেরা রোগে মারা যান কোবাদ আলী। জানাযা আর লাশ দাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন পুত্র ইবাদ আলী। প্রায় সকল লোক গ্রামছাড়া। ইবাদ আলী বোনদের সাথে জানাযা ছাড়াই বাবাকে কবরে শুইয়ে দোয়া করেন। বাড়ি আসার পর দেখেন মায়ের অবস্থা ভালো না। সন্ধ্যার পর মা-ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একদিনে পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক হয়ে যান ইবাদ আলী। কি ভয়াবহ দিন গেছে তখন! চারিদিকে শুধু কান্নার রোল। অনেক মুর্দাকে দেখা গেছে মহিলারা কোন রকমে টেনে নিয়ে কবর নামক গর্তে মাটি চাপা দিতে।

বাপ-মা মারা যাওয়ার পর বাজান অনেকটা নির্বাক হয়ে পড়েন। কারো সাথে তেমন কোনো কথা বলতেন না। ব্যবসায়ও অমনোযোগী। এভাবেই কেটে যায় প্রায় দুই বছর। ব্যবসায় ধ্বস নামে। এক মামা তখন এই নৌকাটি দিয়ে বলেছিলেন, মোকাম করতে। পরিবারের কথা ভেবে নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে। ইবাদ আলী তখন দূরের মোকাম থেকে ধান গম কিনে এলাকায় বিক্রি করতেন। তখন দুই টাকায় এক ঘোড়া ধান পাওয়া যেত। এক ঘোড়া সমান কত মন তা জানা ছিল না ছলিমের। ব্যবসা ভালোই চলছিল। এরই মাঝে নদীর আবারও ভয়াল রূপ। উজান থেকে প্রবল বন্যার পানি নেমে আসে। তিনদিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হয় ইবাদ মুন্সীর বসতভিটা, দোকান। ঘর হারিয়ে গ্রামের মানুষ আশ্রয় নেয় সরকারি রাস্তার পশ্চিম পাশে। ইবাদ মুন্সীর সম্বল শুধু নৌকাটি। কোনো পূঁজি নেই। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিরুপায় হয়ে মায়ের স্মৃতি অলংকার বিক্রি করে চার কুড়ি বার টাকা দিয়ে বাঁধের পূবে খানিকটা দূরে এক খণ্ড জমি কেনেন। বাকি টাকা দিয়ে দেন ছোট মুদি দোকান। বাজানের শরীরটা দিনে দিনে কেমন যেন হলদে হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছিলেন না। একদিন সবাই বুঝলো, বাজানের কামালের ব্যারাম হইছে। কত বৈদ্য, কবিরাজকে দেখানো হলো। কিন্তু বাজান আর ভালো হলো না। একদিন সবাইকে ছেড়ে গোরস্তানের বাসিন্দা হলেন। সেই গোরস্তানও আজ নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে।

নদী তার জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। পূর্ব পুরুষদের কবরের চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ঠ নেই। এ সবই তার বাজান বলেছেন। বাজান শুনেছেন দাদার কাছে। দাদা শুনেছেন বাজানের দাদার কাছে। তিনি শুনেছেন আলী মামুদ মুন্সীর কাছে। অলিখিত সেই কেচ্ছা বুকের ওপর ভারী পাথরের মতো মনে হয় ছলিম মুন্সীর। এখন আর কেউ এ সব শুনতে চায় না। বিরক্ত হয়। গ্যাদা ম্যাট্রিক পাস করার পর সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গার্মেন্টেসে কাম নিলো। বউ মারা যাওয়ার পর অনেক করে বলেছিল, তার কাছে থাকতে। ছলিম মুন্সী রাজি হন নি। বাপ-দাদার স্মৃতি ছেড়ে যেতে মন চায় না। নিঃসঙ্গ ছলিম মুন্সী এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন।

নানা, ভাত খাইবা না? পানুর কথায় সম্বিৎ ফেরে। হ্যাঁ রে। খাওনের সময় অইছে। আয়। নদীর পানি থেইকা হাতটা ধুইয়া আয়।
গামছার গাট থেকে ভাতের ডিস বের করেন ছলিম। তার মধ্যে ছোট বাটিতে মাছের তরকারি। এখন আর মাছের স্বাদ পাওয়া যায় না। চাষের মাছে কোনো মজাই নাই। যমুনা নদী সব কাইরা নিলেও মাছের অভাব বুঝতে দেয় নাই। তিন যুগ আগেও মাছের কোনো আকাল ছিল না। যেই নদীর পানিতে ভেসে গেছে পূর্ব পুরুষদের বসতভিটা, গোরের চিহ্ন, সেই উত্তাল যমুনা আইজ আবারও মরার পথে। বর্ষায় পানি বাড়লেও মাছের দেখা আর পাওয়া যায় না।

বুঝলে নানা ভাই। এই নদীর বুকে আমাগোর পূর্ব পুরুষদের…। নানা, তোমার এই গপ্প আর ভাল্লাগে না। কতবার কইছ, মনে আছে? পানুর কথায় ধম্কে যান ছলিম মুন্সী। আহারে। আমি তাইলে আর কার কাছে কমু? কার কাছে কইলে লেইখা রাইখবো পূর্ব পুরুষদের কেচ্ছা? এই নদীর কেচ্ছা। চরের কেচ্ছা। কামারের হাফরের মতো গরম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ছলিম মুন্সীর শুকনো পাঁজর থেকে। ঝুনা নারিকেলের ঘোলা পানির মতো চোখ বেয়ে নেমে আসে স্বচ্ছ শিশিরের মতো অশ্রুফোটা।

আরো পড়ুন : রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে উধাও হয়ে গেল

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

যমুনা নদী ও পাঁচ পুরুষের কেচ্ছা

আপডেট সময় ১০:১৫:১৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
আশ্বিন মাস। ভাদ্রের ভ্যাপসা গরম এখনো আছে। তির তির করে বেলা বাড়ার সাথে তর তরিয়ে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। বোগল ছেঁড়া হাফ হাতা গেঞ্জি পড়ে দোচালা টিনের ঘর থেকে বের হন সত্তরোর্ধ্ব ছলিম মুন্সী। ঘাড়ে গামছা। তার এক মাথায় বড় গেদির রান্না করে দেয়া দুপুরের খাবার। অন্য মাথায় পুটলি করে বাঁধা পানের ডিব্বা। ঘরের কোনায় রাখায় বাঁশের লগি নিয়ে ডাক দেন নাতী পানুকে। পানু প্রতিদিনের মতো চারটি ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁঠাল গাছের নিচে। আওয়াজ দেয়, নানা, আমি এহানে।

ছাগল আর নাতীকে নিয়ে শতবর্ষী নৌকা ছাড়েন ছলিম। ভাঁজ পড়া চামড়ার হাতে বৈঠা ধরেন। কব্জিতে আর আগের মতো জোর পান না। বাজানের মামু যখন নৌকাটি পাঠান, তখন বড় ছই ছিল। মাঝখানে ছিল মস্তবড় মাস্তুল। লাল টকটকে রঙের ট্রেটন কাপড়ের পাল তুলে বাজান ব্যবসায়ীদের নিয়ে শাহজাদপুর কাপড়ের মোকামে যেতেন। বলরামপুরের পাটের হাটে যেতেন শনি ও মঙ্গলবার। গুণ টানার লোক ছিল তিনজন। দুইদিকে চারটি বৈঠা একসাথে টানা হতো। বাজান ছইয়ের উপর বসে শক্ত হাতে দাড় ধরতেন। কখনো কখনো কালুগাজীর গান গাইতেন তিনি। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে তৈরি হতো মোহময় সুর তরঙ্গ।

এখন আর বৈঠা দিয়ে কেউ নৌকা চালায় না। সবাই শ্যালো মেশিন লাগিয়েছে। কিন্তু ছলিম বাবার স্মৃতি এখনো আগলে রেখেছেন। যদিও এখন আর সেই ছই নেই, মাস্তুল নেই। শুকনো মৌসুমে নিজের হাতে নৌকা মেরামত করেন। আলকাতরার সাথে গাবের রস মাখেন। এতে নাকি নৌকা টেকসই হয়। তার এসব কাণ্ড দেখে অনেকেই হাসাহাসি করে। অবশ্য ছলিমের সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই।

যমুনা নদীর পানিতে টান পড়েছে। জাগতে শুরু করেছে বানের পানিতে তলিয়ে থাকা বিস্তৃর্ণ চর। দখিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে কাশফুল। আকাশে উড়ছে গাঙ শালিকের দল। শিকার পেলেই ছোঁ মারছে পানিতে। ঠোটে করে ছোট মাছ ধরে উড়ে যাচ্ছে। আবারও আসছে। বালি হাঁসগুলো সাঁতার কাঁটছে আয়েশী ভঙ্গিতে। একটি হাঁস চেষ্টা করছে মাছ গিলতে। পারছে না। মাছটি ঠোট থেকে পানিতে পড়ছে। শিকারী হাঁস আবারো ডুব দিয়ে ধরে আনছে। বার কয়েক চেষ্টার পর মাছটি গিলে পানিতে ঠোট ভেজায়। তারপর তৃপ্ত মনে ভাসতে থাকে। আগে এই নদীতে শুশুক ছিল। এখন আর দেখা যায় না। বৃদ্ধ ছলিমের কাছে এ সবই চিরচেনা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেন না। ভালো বা মন্দ লাগার অনুভূতি স্পর্শ করে না তাকে। তার কাছে জীবন ধূ ধূ বালুচরের মতো। যেখানে উত্তাপ আছে। কিন্তু কোনো আনন্দ নেই।

মড় মড় শব্দে নৌকার সামনের গোলুই তীর ঘেঁষে জন্মানো কাশঝাড়ের মাঝে ঢুকিয়ে দেন ছলিম। বৈঠা তুলে লগি নিয়ে নেমে পড়েন হাঁটু পানিতে। লাল কাঁকড়ার দল শব্দ পেয়ে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে গর্তে। কানি বক দুটি উড়ে গিয়ে বসে সামান্য দূরে। ছলিম লগিটিকে শক্ত করে পুঁতে তার সাথে রশি দিয়ে নৌকাটিকে বেঁধে রাখেন। পানু ছাগলগুলোকে ছেড়ে দেয় সদ্য গজিয়ে উঠা ঘাসের মাঝে।

কয়েকটি কাশফুলের ডগা একসাথে বেঁধে তার নিচে বসেন ছলিম মুন্সী। গামছার পুটলি থেকে পাটায় ছেচা সুপারি দিয়ে পান মুখে দেন। এই চর তার কাছে জীবনের শিকর। পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব। দাদার দাদা আলী মামুদ মুন্সীর বাস ছিল এখানে। তখন গ্রামের নাম ছিল ঘাটাইল। সবুজে ঘেরা গ্রামটির পূর্ব পাশে ছিল একটি খাল। নামটা ঠিক মনে করতে পারেন না। গ্রামের উত্তরে ছিল হাট। প্রতি রবিবার সেখানে হাট বসতো। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো হাটে। দুপুরের পর শুরু হওয়া হাটের বেচাকেনা চলতো রাত পর্যন্ত। কূপির আলোয় দোকানিরা হিসেব কষতো। হাটের পশ্চিম পাশে ছিল বিশাল ছাতিয়ান গাছ। তার নিচে ছনের ঘরের মক্তবে আরবি পড়াতেন আলী মামুদ। সেই থেকে এলাকার মানুষ তাকে মুন্সী নামে ডাকতেন। তারা ছিলেন চার ভাই। একান্নবর্তী পরিবারের অন্যরা ছিলেন কৃষক। চারপাশে ছনের ঘর। মাঝে বড় উঠান। উঠানের দক্ষিণ-পূবে কূয়া। পাড়ার লোকেরা খাবার পানি এ কূয়া থেকেই সংগ্রহ করতেন। বড় ভাইয়েরা বিয়ে করলেও আলী মামুদ তখনো কুমার। বিয়ের কথা চলছিল। পাশের গাঁয়ের মণ্ডল বাড়ির মেয়ে। গায়ের রং কালো হলেও নেকজাত ও পরহেজগার হওয়ায় আলী মামুদের পছন্দ হয়েছিল। বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল অগ্রায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার।

সেদিন গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙে পানির ভয়াল গর্জনে। ঘোলা পানিতে পশ্চিমের খাল ভরে তীব্র গতিকে চলে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে। দেখতে দেখতে খালের দুইপাড়ে শুরু হয় ভাঙন। পানির তোড়ে ভেসে যেতে থাকে ফসলি জমি ঘরবাড়ি গবাদি পশু সহ সবকিছু। কিয়ামতের আলামত ভেবে আলী মামুদ দৌড়ে যান মক্তবে। কোরান শরীফ খুলে দেখেন। না, অক্ষর সব ঠিক আছে। তার মানে কিয়ামত শুরু হয়নি। মক্তব থেকে বের হতেই আচমকা ঢেউ আছড়ে পড়ে তার উপর। সাঁতার না জানা মুন্সী কোনো মতে হালটের পাড়ে একটি কলাগাছকে জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরেন। ভেসে যেতে থাকেন দক্ষিণে। কয়েকবার জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়েছিল। দশ মাইল দূরে সমেশপুরের কাছে কলাগাছটি একটি কটিখড়ায় আটকায়। একজন সৌখিন মৎস্যশিকারীর সহায়তা প্রাণে বেঁচে যান আলী মামুদ। উদ্ধার পাওয়ার পর তার কাচারী ঘরে থাকেন সপ্তাহ খানেকের মতো। এ সময় পরিবার পরিজনের কথা কিছুই জানতে পারেন না। আচমকা পানির ভয়াল গর্জনে ভীত সন্ত্রস্ত স্থানীয়রা। অজানা আশঙ্কায় নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। অনেকেই সহায় সম্বল হারিয়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। দু’দিন আগেও যার সব ছিল, আজ সে নিঃস্ব।

সপ্তাহ খানেক পর পায়ে হেঁটে সিরাজগঞ্জ থানা শহরে যান আলী মামুদ। ছল্ ছল্ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শহরের পূবে সদ্য তৈরি বিশাল নদীর দিকে। ক’দিন আগেও যেখানে সবুজ শস্যের বুকে বাতাস ঢেউ খেলতো, সেখানে আজ পানির ক্রমাগত ঢেউ চলে যাচ্ছে ভাটিতে। শুধু পানি আর পানি। ওপাড়ে কি আছে দেখা যায় না। বসতভিটা কোথায় ছিল তাও ঠাহর করতে পারেন না।
দিনের আলো যেমন করে মøান হয় রাতের গভীরে, তেমনিভাবে আলী মামুদের সুখস্মৃতি হারিয়ে যায় সময়ের দুর্বিপাকে। জীবিকার তাগিদে পা বাড়ায় সে। যেটুকু বিদ্যা আছে তাই দিয়ে চেষ্টা করে অন্ন আর বাসস্থানের।

নদীর পাড়ে ছোট মুদির দোকান। তার সামনে বাঁশের বেঞ্চিতে বসে আছেন আলী মামুদ। শুকনো মুখ দেখে মায়া হয় দোকানি মাতাম শেখের। জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন বানের তোড়ে সবকিছু হারিয়ে যাওয়া অসহায় যুবকের করুণ কাহিনি। মাতাম শেখ দোকানের সামনে ঝোলানো ভিমা আইটা কলার ছড়ি থেকে দুইটা কলা আর বিস্কুট হাতে দিয়ে বলেন, খায়া নাও বাবা। চিন্তা কইরা আর কী কইরবা? যা অওয়ার অইয়া গ্যাছে। এহন নিজে বাঁচনের চিন্তা করো। ক্ষুধার্ত পেটে গোগ্রাসে কলা গিলতে দেখে অবাক হন দোকানি। কথায় কথায় একটা কাজের কথা বলেন আলী মামুদ। আশ্বাস দিয়ে মাতাম শেখ বসতে বলেন। রাতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান তাকে। দুই ছেলেকে কোরান শিক্ষার জন্য বলেন। বিনিময়ে থাকা খাওয়া। রাজী হয়ে যান আলী মামুদ। এর কিছুদিন পর আশে পাশের কয়েক কিশোর-কিশোরীও তার কাছে পড়তে আসে। বছর খানেক পর মাতাম শেখ তার বিধবা কন্যার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বলেন, তার নামে সাত পাখি ক্ষেতি জমি আছে। সংসার ভালোই চলবে। স্বজনহারা আলী মামুদের রাজী না হয়ে উপায় ছিল না। বিয়ের পর শহরের পূবে নদীর বেশ পশ্চিমে ঘর নির্মাণ করেন। পাশে ছোট জায়গায় ছনের মসজিদ নির্মাণ করে নিজেই ইমামতি শুরু করে। চার সন্তানকে আরবী শিক্ষা দেন তিনি।

চার ছেলের মধ্যে বড়জন হলেন জাবেদ আলী মুন্সী। আরবি শিক্ষা করেও সে সড়কের পাশে মুদি দোকানের ব্যবসা শরু করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। মেঝ ছেলে বাপের মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব নেন। মা-বাবা মারা যাওয়ার পরও সুখেই কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু হঠাৎ করে এক বছর আষাঢ় মাসের প্রবল বন্যায় শুরু হয় ভাঙ্গন। সাত দিনের মধ্যেই চোখের সামনে সবকিছু হারিয়ে যায় যমুনার বুকে। নিঃস্ব মানুষগুলোর ঠাঁই হয় সরকারি সড়কের নিচে। কোনো রকমে কলাপাতার ঘরে শুরু হয় বসবাস। জায়েদ আলীর কাছে যে কয়েকটা টাকা ছিল তা দিয়ে সামান্য কিছু মাল কিনে তা শহরের অলিতে গলিতে ফেরি করতে থাকেন। খরচের পর জমতে থাকে কিছু টাকা। এক সময় ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে আবারও দোকান শুরু করেন। বড় দোকানদারও হন এক সময়।

জাবেদ আলী বিয়ে করেন খালাতো বোন রিনাকে। সে ঘরে জন্ম নেন একমাত্র ছেলে কোবাদ আলী মুন্সী। দেখতে বেশ সুন্দর হয়েছিল। মক্তবের পড়া শেষ করে একটি মিশনারী স্কুলে পড়েছিল কয়েক বছর। বাবার ব্যবসায় মনোযোগী হয়ে পিতার সুনাম বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। বেশ বড় হয়েছিল দোকান। দূরের পাইকাররা আসতো তার দোকান থেকে মাল কিনতে। বাবা জায়েদ আলী ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন উজানের এক নামকরা সওদাগরের মেয়ের সাথে। মেয়ে যেমন ছিল রূপসী তেমনি গুণবতী। চৌদ্দ গায়ের লোক জেনেছিল সে বিয়ের খবর। চার বেহারার পাল্কী করে যেদিন বউ নিয়ে আসেন, সেদিন আশে পাশের কয়েক’শ লোক ভিড় জমিয়েছিল।

বিয়ের পর কোবাদ আলী মুন্সী বাড়িতে টিনের ঘর দেন। সওদাগার শ্বশুর আসাম থেকে কাঠের পালঙ্ক আর সিন্ধুক বানিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে সাতনরী হার, কোমরবিছা, নদ, নোলক, বালা আরও অনেক গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের জন্য দিয়েছিলেন কাঁসার থালা বাটি জগ। আনন্দের সংসারে জন্ম নেয় দুই মেয়ে আর তিন ছেলে। বড় ছেলে দশ বছর বয়য়ে গুটি বসন্তে মারা যায়। ছোট ছেলেটা মানসিক প্রতিবন্ধি। মেয়ে দুজনকে বড় ঘরে বিয়ে দেন কোবাদ আলী। মেজ ছেলে ইবাদ আলী মুন্সী বাবার ব্যবসার হাল ধরেন। তিনি বিয়ে করেন মাতুলকূলের এক আত্মীয়াকে। পরের বছর তাদের ঘরে জন্ম নেয় ছলিম মুন্সী। তারপর দুই বোন। ছলিমের বয়স তখন ছয় কি সাত। মক্তবে ভর্তি হয় সে। যাওয়ার সময় দাদা-দাদির পা ছুঁয়ে কদমবুছি করেন। সে বছর ভাদ্র মাসে এলাকায় দেখা দেয় কলেরা রোগ। গাঁয়ের পর গাঁয়ের মানুষ মারা যায়। একদিন সকালে কলেরা রোগে মারা যান কোবাদ আলী। জানাযা আর লাশ দাফন নিয়ে বিপাকে পড়েন পুত্র ইবাদ আলী। প্রায় সকল লোক গ্রামছাড়া। ইবাদ আলী বোনদের সাথে জানাযা ছাড়াই বাবাকে কবরে শুইয়ে দোয়া করেন। বাড়ি আসার পর দেখেন মায়ের অবস্থা ভালো না। সন্ধ্যার পর মা-ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। একদিনে পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনেকটা নির্বাক হয়ে যান ইবাদ আলী। কি ভয়াবহ দিন গেছে তখন! চারিদিকে শুধু কান্নার রোল। অনেক মুর্দাকে দেখা গেছে মহিলারা কোন রকমে টেনে নিয়ে কবর নামক গর্তে মাটি চাপা দিতে।

বাপ-মা মারা যাওয়ার পর বাজান অনেকটা নির্বাক হয়ে পড়েন। কারো সাথে তেমন কোনো কথা বলতেন না। ব্যবসায়ও অমনোযোগী। এভাবেই কেটে যায় প্রায় দুই বছর। ব্যবসায় ধ্বস নামে। এক মামা তখন এই নৌকাটি দিয়ে বলেছিলেন, মোকাম করতে। পরিবারের কথা ভেবে নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে। ইবাদ আলী তখন দূরের মোকাম থেকে ধান গম কিনে এলাকায় বিক্রি করতেন। তখন দুই টাকায় এক ঘোড়া ধান পাওয়া যেত। এক ঘোড়া সমান কত মন তা জানা ছিল না ছলিমের। ব্যবসা ভালোই চলছিল। এরই মাঝে নদীর আবারও ভয়াল রূপ। উজান থেকে প্রবল বন্যার পানি নেমে আসে। তিনদিনের মধ্যে নদীতে বিলীন হয় ইবাদ মুন্সীর বসতভিটা, দোকান। ঘর হারিয়ে গ্রামের মানুষ আশ্রয় নেয় সরকারি রাস্তার পশ্চিম পাশে। ইবাদ মুন্সীর সম্বল শুধু নৌকাটি। কোনো পূঁজি নেই। নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। নিরুপায় হয়ে মায়ের স্মৃতি অলংকার বিক্রি করে চার কুড়ি বার টাকা দিয়ে বাঁধের পূবে খানিকটা দূরে এক খণ্ড জমি কেনেন। বাকি টাকা দিয়ে দেন ছোট মুদি দোকান। বাজানের শরীরটা দিনে দিনে কেমন যেন হলদে হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছিলেন না। একদিন সবাই বুঝলো, বাজানের কামালের ব্যারাম হইছে। কত বৈদ্য, কবিরাজকে দেখানো হলো। কিন্তু বাজান আর ভালো হলো না। একদিন সবাইকে ছেড়ে গোরস্তানের বাসিন্দা হলেন। সেই গোরস্তানও আজ নদীর স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে।

নদী তার জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। পূর্ব পুরুষদের কবরের চিহ্নটুকুও আর অবশিষ্ঠ নেই। এ সবই তার বাজান বলেছেন। বাজান শুনেছেন দাদার কাছে। দাদা শুনেছেন বাজানের দাদার কাছে। তিনি শুনেছেন আলী মামুদ মুন্সীর কাছে। অলিখিত সেই কেচ্ছা বুকের ওপর ভারী পাথরের মতো মনে হয় ছলিম মুন্সীর। এখন আর কেউ এ সব শুনতে চায় না। বিরক্ত হয়। গ্যাদা ম্যাট্রিক পাস করার পর সংসারের হাল ধরতে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে গার্মেন্টেসে কাম নিলো। বউ মারা যাওয়ার পর অনেক করে বলেছিল, তার কাছে থাকতে। ছলিম মুন্সী রাজি হন নি। বাপ-দাদার স্মৃতি ছেড়ে যেতে মন চায় না। নিঃসঙ্গ ছলিম মুন্সী এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন।

নানা, ভাত খাইবা না? পানুর কথায় সম্বিৎ ফেরে। হ্যাঁ রে। খাওনের সময় অইছে। আয়। নদীর পানি থেইকা হাতটা ধুইয়া আয়।
গামছার গাট থেকে ভাতের ডিস বের করেন ছলিম। তার মধ্যে ছোট বাটিতে মাছের তরকারি। এখন আর মাছের স্বাদ পাওয়া যায় না। চাষের মাছে কোনো মজাই নাই। যমুনা নদী সব কাইরা নিলেও মাছের অভাব বুঝতে দেয় নাই। তিন যুগ আগেও মাছের কোনো আকাল ছিল না। যেই নদীর পানিতে ভেসে গেছে পূর্ব পুরুষদের বসতভিটা, গোরের চিহ্ন, সেই উত্তাল যমুনা আইজ আবারও মরার পথে। বর্ষায় পানি বাড়লেও মাছের দেখা আর পাওয়া যায় না।

বুঝলে নানা ভাই। এই নদীর বুকে আমাগোর পূর্ব পুরুষদের…। নানা, তোমার এই গপ্প আর ভাল্লাগে না। কতবার কইছ, মনে আছে? পানুর কথায় ধম্কে যান ছলিম মুন্সী। আহারে। আমি তাইলে আর কার কাছে কমু? কার কাছে কইলে লেইখা রাইখবো পূর্ব পুরুষদের কেচ্ছা? এই নদীর কেচ্ছা। চরের কেচ্ছা। কামারের হাফরের মতো গরম দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ছলিম মুন্সীর শুকনো পাঁজর থেকে। ঝুনা নারিকেলের ঘোলা পানির মতো চোখ বেয়ে নেমে আসে স্বচ্ছ শিশিরের মতো অশ্রুফোটা।

আরো পড়ুন : রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে উধাও হয়ে গেল