ঢাকা ১০:০৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে উধাও হয়ে গেল

জামিউর রহমান লেমন
আমরা ঢাকার শাহজাহারপুর গভঃ অফিসার্স কলোনীর ৫ নম্বরই টাইপ বিল্ডিং এ থাকি। বেশ ক’বছর আগে টেলিভিশনের জন্য একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য খাগড়াছড়ি গেলে সেখান থেকে একটা বাঁশের চারা আমি নিয়ে আসি। আমাদের ফ্ল্যাটের পিছন দিকে গাছ লাগানোর জন্য একটু জায়গা ছিল। সেখানে বেশ কিছু তরকারির গাছ আমি লাগিয়েছিলাম। কোন কিছু চিন্তা না করেই সেই জায়গাটায় আমি বাঁশের চারাটি লাগিয়ে দেই। দেখতে দেখতে সেই চারাটি তরতর করে দু’বছরের মাথায় বেড়ে উঠলো। আমাদের শোবার ঘরের ঠিক জানালার পিছনেই এই গাছটি ক্রমেই ঝোপে পরিণত হলো। আমরা খুবই অবাক হলাম।

গণযোগাযোগ অধিদপ্তরে চাকুরির সুবাদে আমাকে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণ করতে হতো। ভ্রমণ শেষে বাড়িতে ফিরলেই আমার স্ত্রী আমাকে গাছটি নিয়ে এটা সেটা বলতো। আমি গায়ে মাখিনি। বিশ্বাসও করিনি। একরাতে আমি বেড রুম থেকে বাথরুমের দিকে যাওয়ার পথেই প্রথম বুঝতে পারলাম বাঁশ ঝাড়ে কিছু আলো জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হলো কে যেন জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে আমাদের ডাইনিং স্পেসের দিকে গেল। আমি লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম কিছুই না। আবার বেড রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে ডাইনিং স্পেসে পানি খাওয়ার জন্য যেতে গিয়েই মনে হলো কে যেন আমাকে অতিক্রম করছে। ঠিক এধরনের আরো কিছু কথাই ইতোপূর্বে আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল। একটু বাতাস হলেই কঞ্চি বাঁশের শব্দ রাতে মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করতো। আর তাই একদিন পুরো বাঁশ ঝাড়টি স্বমূলে কেটে ফেললাম। এবারে তৈরি হলো আরেক ধরনের সমস্যা। আমি যেদিন বাসায় থাকতাম না বা ভ্রমণে থাকতাম, সেইদিনই বিভিন্ন ভাবে আমার স্ত্রী ভয় পেতে শুরু করলো। একদিনতো ঘুমের মাঝেই কে যেন তার গলা চেপে ধরে। রাতে ঘরের দরজা জানালায় বিভিন্ন ধরনের শব্দ হয়, তবে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। বিষয়টি রামপুরার আমার এক বড়ভাইকে জানাই। তিনি একেবারেই আল্লাহ্ওয়ালা, ধার্মিক। তিনি সব শুনে বললেন, শোবার ঘরের পাশে বাঁশ ঝাড় লাগানো ঠিক হয়নি। আর হঠাৎ করে তিনাদের আবাস ভেঙ্গে ফেলাও ঠিক হয়নি। পৃথিবীতে জ্বিন ইনশান তো আছেই, এটা মুসলমানদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকে আমি বললাম সমাধান কোথায়। তিনি বললেন, তারাতো আপনাদের কোন ক্ষতি করেনি। আমি বললাম, না। তিনি আমাদের ফ্লাটে আসলেন, দেখলেন, তারপর সব ঠিকঠাক।

বড়ভাই একদিন আমাকে বললেন, ভাইজান আপনার আব্বাতো চলে গেছেন, একবার সম্ভব হলে যান না মক্কা শরিফ যিয়ারত করে আসেন। যে কথা সেই কাজ। মাত্র একদিনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যাবো। তখন রমজান মাস। আম্মা বেঁচে আছেন। ভাবলাম মক্কা যাওয়ার আগে আম্মাকে একটু দেখে আসি, তার অনুমতি নিয়ে আসি। সে সময় খুলনার ট্রেন ছাড়তো জয়দেবপুর থেকে। ঢাকা থেকে সাটেল ট্রেন খুব ভোরে নিয়ে যেতো জয়দেবপুরে। আমার বন্ধু কাওছারকে বললাম তুমি ভোরে আমাকে কমলাপুরে পৌঁছে দিয়ে আসবে। যথারীতি কাওছার রাতে আমাদের বাসায় থাকলো। ভোরে উঠে আমরা সেহরী করলাম। তখনো ভোরের আজান পড়েনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কি আর করা। আমাদের সাটেল ট্রেন ধরার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি কাওছারকে বললাম, ‘কি এখনি যাবে! যে অন্ধকার’! কাওছার বললো, তাতে কি, রমজানে কোন ভয় নেই ভাই। আমি সামনে, কাওছার লাগেজটা নিয়ে পিছনে। কলোনীর গেটে আসতেই ভেতরের দারোয়ান বললো, স্যার রিকশা তো এখন পাবেন না, হেঁটেই মনে হয় যেতে হবে। আমি পকেট গেট খুলে বের হতেই দেখি, এক বৃদ্ধ সাদা দাঁড়িওয়ালা রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে বসে আছে। কিছু না বলেই আমরা দু’জন তাতে উঠে পড়ি। রিকশাওয়ালা আমাদের কোন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। যেহেতু কমলাপুরের দিকেই যাচ্ছে সেহেতু তাকে আর গন্তব্যের কথা বলার প্রয়োজন মনে করিনি। পীরজঙ্গির মাজারের কাছে যেতেই রিক্সাওয়ালা পিছন ফিরে দেখে বললো, আপনিতো খুলনায় যাবেন তাই না বাবা? আমি কোন কিছু না ভেবেই বললাম ‘হ্যাঁ’। কাওছার বললো, তোমার বাড়ি কী খুলনায়? রিকশাওয়ালা কোন উত্তর দেয় না। আমার কাছে পাঁচশ টাকার নোট থাকায় আমি কাওছার কে বললাম, ‘ষ্টেশন থেকে কিছু পত্রিকা কিনে নিলে ভাংতি পাবে। রাস্তায় পড়াও যাবে, ওর ভাড়াটাও দেয়া যাবে।’

ষ্টেশনে নেমেই কাওছার পত্রিকা কিনতে যায় আর আমি ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে ষ্টেশনের সিঁড়িতে ঘুরে দাঁড়াই। রিকশাওয়ালাকে বলি, ‘ভাই এক মিনিট দাঁড়ান।’ কাওছার তড়িঘড়ি করে দুইটা দৈনিক আর একটা ইসলামি জার্নাল কিনে নিয়ে আসে। আমি বলি, ‘ঐ যে ঐখানে রিকশাওয়ালা ভাড়াটা দিয়ে আসো। পঞ্চাশ টাকা দিও।’ এরপর অনেক খুঁজাখুজি, রিক্সাওয়ালাকে আর পাওয়া গেল না। এমনিতেই শীতের রাত, লোকজন গাড়ি, রিকশা একেবারেই কম। আমরা দু’জন হেঁটে সামনে পিছনে গিয়ে অনেক খুঁজতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ভাড়া দিতে না পারায় নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছিল, তার উপরে রমজান মাস।

সন্ধ্যার আজানের আগেই ট্রেন পৌঁছে গেল খুলনা ষ্টেশনে। বাসায় যখন পৌঁছালাম তখন ইফতারির সাইরেন বাজছে। আব্বা মারা যাবার পর থেকে এমনিতেই আমার প্র্যাকটিস ছিল, খুলনা পৌঁছেই লাগেজ রেখে আব্বার কবর জিয়ারত করা। আজ তার ব্যত্যয় ঘটলো। আম্মা বললেন, বাবু ইফতারি করে নামাজ পড়ে তবে যাও। যথারীতি তাই হলো।

বাসার গেটে পা দিতেই দেখি সকালের মত এক সাদা দাঁড়িয়ালা রিকশাওয়ালা, আসছে, আমি ডাকতেই সে বললো, কোথায় যাবেন, বসুপাড়া কবরস্থানে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। সকালের ঘটনা আর এখনকার ঘটনা সব মিলিয়ে আমার মনে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধলো। রিকশা চলছে বসুপাড়ার দিকে। কবরস্থানের গেটে পৌঁছাতেই আমি বললাম, ‘বাবা, আপনি কী আমার সাথে কবর যিয়ারত করবেন?’ সে বললো, অবশ্যই। আমি বললাম, ‘রিকশাটা বাইরে না রেখে ভিতরে রাখেন।’ সে বললো, এই রিকশা কেউ নেবেনা বাবা। মানেটা ঠিক বুঝলাম না। আব্বার কবরের কাছে গিয়ে দোয়া কালাম পড়ার পর তাকে বললাম, ‘বাবা, আপনি মুনাজাত করেন।’ সে বললো, আপনি তার ছেলে না, ছেলের দোয়া বেশি কবুল হয়। সব শেষে আবার রিকশায় করে বাসার গেটে ফেরত আসতেই দেখি রোজী আপা হাসতে হাসতে গেটের দিকে আসছেন। আমার হাত প্যান্টের পিছনের পকেটের মানিব্যাগে, আর চোখ রোজী আপার দিকে। পিছন ফিরে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি উধাও। সব শুনে রোজী আপা বললেন, কই, কাউকে দেখিনিতো। দেখলাম তুমি দাঁড়িয়ে আছো, তাই দৌড়ে আসলাম। সব শুনে আম্মা বললেন, সাবধানে থেকো বাবা। কিছু সদ্কা দিয়ে দিও, তোমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হয়।

ঢাকা এসে বড় ভাইকে সব বিষয় খুলে বললাম। উনি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলেন। কেবল আমার দিব্যদৃষ্টি দুই রিক্সাওয়ালার দাড়ি আর বড় ভাইয়ের দাড়ির মধ্যে একটা সদৃশ্য দেখতে পেলো। বড় ভাই আজ নাই, তাই এই অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা বা উত্তর আমি আজো পাইনি। সমাপ্ত।

আরো পড়ুন : অলৌকিক: আব্বা আমাকে সাথে নিয়ে শাহজাহানপুর মোড় পর্যন্ত গেলেন; তারপর উধাও!

 

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে উধাও হয়ে গেল

আপডেট সময় ১০:০৯:১২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

জামিউর রহমান লেমন
আমরা ঢাকার শাহজাহারপুর গভঃ অফিসার্স কলোনীর ৫ নম্বরই টাইপ বিল্ডিং এ থাকি। বেশ ক’বছর আগে টেলিভিশনের জন্য একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য খাগড়াছড়ি গেলে সেখান থেকে একটা বাঁশের চারা আমি নিয়ে আসি। আমাদের ফ্ল্যাটের পিছন দিকে গাছ লাগানোর জন্য একটু জায়গা ছিল। সেখানে বেশ কিছু তরকারির গাছ আমি লাগিয়েছিলাম। কোন কিছু চিন্তা না করেই সেই জায়গাটায় আমি বাঁশের চারাটি লাগিয়ে দেই। দেখতে দেখতে সেই চারাটি তরতর করে দু’বছরের মাথায় বেড়ে উঠলো। আমাদের শোবার ঘরের ঠিক জানালার পিছনেই এই গাছটি ক্রমেই ঝোপে পরিণত হলো। আমরা খুবই অবাক হলাম।

গণযোগাযোগ অধিদপ্তরে চাকুরির সুবাদে আমাকে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণ করতে হতো। ভ্রমণ শেষে বাড়িতে ফিরলেই আমার স্ত্রী আমাকে গাছটি নিয়ে এটা সেটা বলতো। আমি গায়ে মাখিনি। বিশ্বাসও করিনি। একরাতে আমি বেড রুম থেকে বাথরুমের দিকে যাওয়ার পথেই প্রথম বুঝতে পারলাম বাঁশ ঝাড়ে কিছু আলো জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার মনে হলো কে যেন জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে আমাদের ডাইনিং স্পেসের দিকে গেল। আমি লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম কিছুই না। আবার বেড রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে ডাইনিং স্পেসে পানি খাওয়ার জন্য যেতে গিয়েই মনে হলো কে যেন আমাকে অতিক্রম করছে। ঠিক এধরনের আরো কিছু কথাই ইতোপূর্বে আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিল। একটু বাতাস হলেই কঞ্চি বাঁশের শব্দ রাতে মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করতো। আর তাই একদিন পুরো বাঁশ ঝাড়টি স্বমূলে কেটে ফেললাম। এবারে তৈরি হলো আরেক ধরনের সমস্যা। আমি যেদিন বাসায় থাকতাম না বা ভ্রমণে থাকতাম, সেইদিনই বিভিন্ন ভাবে আমার স্ত্রী ভয় পেতে শুরু করলো। একদিনতো ঘুমের মাঝেই কে যেন তার গলা চেপে ধরে। রাতে ঘরের দরজা জানালায় বিভিন্ন ধরনের শব্দ হয়, তবে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। বিষয়টি রামপুরার আমার এক বড়ভাইকে জানাই। তিনি একেবারেই আল্লাহ্ওয়ালা, ধার্মিক। তিনি সব শুনে বললেন, শোবার ঘরের পাশে বাঁশ ঝাড় লাগানো ঠিক হয়নি। আর হঠাৎ করে তিনাদের আবাস ভেঙ্গে ফেলাও ঠিক হয়নি। পৃথিবীতে জ্বিন ইনশান তো আছেই, এটা মুসলমানদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকে আমি বললাম সমাধান কোথায়। তিনি বললেন, তারাতো আপনাদের কোন ক্ষতি করেনি। আমি বললাম, না। তিনি আমাদের ফ্লাটে আসলেন, দেখলেন, তারপর সব ঠিকঠাক।

বড়ভাই একদিন আমাকে বললেন, ভাইজান আপনার আব্বাতো চলে গেছেন, একবার সম্ভব হলে যান না মক্কা শরিফ যিয়ারত করে আসেন। যে কথা সেই কাজ। মাত্র একদিনেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি যাবো। তখন রমজান মাস। আম্মা বেঁচে আছেন। ভাবলাম মক্কা যাওয়ার আগে আম্মাকে একটু দেখে আসি, তার অনুমতি নিয়ে আসি। সে সময় খুলনার ট্রেন ছাড়তো জয়দেবপুর থেকে। ঢাকা থেকে সাটেল ট্রেন খুব ভোরে নিয়ে যেতো জয়দেবপুরে। আমার বন্ধু কাওছারকে বললাম তুমি ভোরে আমাকে কমলাপুরে পৌঁছে দিয়ে আসবে। যথারীতি কাওছার রাতে আমাদের বাসায় থাকলো। ভোরে উঠে আমরা সেহরী করলাম। তখনো ভোরের আজান পড়েনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কি আর করা। আমাদের সাটেল ট্রেন ধরার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি কাওছারকে বললাম, ‘কি এখনি যাবে! যে অন্ধকার’! কাওছার বললো, তাতে কি, রমজানে কোন ভয় নেই ভাই। আমি সামনে, কাওছার লাগেজটা নিয়ে পিছনে। কলোনীর গেটে আসতেই ভেতরের দারোয়ান বললো, স্যার রিকশা তো এখন পাবেন না, হেঁটেই মনে হয় যেতে হবে। আমি পকেট গেট খুলে বের হতেই দেখি, এক বৃদ্ধ সাদা দাঁড়িওয়ালা রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে বসে আছে। কিছু না বলেই আমরা দু’জন তাতে উঠে পড়ি। রিকশাওয়ালা আমাদের কোন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। যেহেতু কমলাপুরের দিকেই যাচ্ছে সেহেতু তাকে আর গন্তব্যের কথা বলার প্রয়োজন মনে করিনি। পীরজঙ্গির মাজারের কাছে যেতেই রিক্সাওয়ালা পিছন ফিরে দেখে বললো, আপনিতো খুলনায় যাবেন তাই না বাবা? আমি কোন কিছু না ভেবেই বললাম ‘হ্যাঁ’। কাওছার বললো, তোমার বাড়ি কী খুলনায়? রিকশাওয়ালা কোন উত্তর দেয় না। আমার কাছে পাঁচশ টাকার নোট থাকায় আমি কাওছার কে বললাম, ‘ষ্টেশন থেকে কিছু পত্রিকা কিনে নিলে ভাংতি পাবে। রাস্তায় পড়াও যাবে, ওর ভাড়াটাও দেয়া যাবে।’

ষ্টেশনে নেমেই কাওছার পত্রিকা কিনতে যায় আর আমি ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে ষ্টেশনের সিঁড়িতে ঘুরে দাঁড়াই। রিকশাওয়ালাকে বলি, ‘ভাই এক মিনিট দাঁড়ান।’ কাওছার তড়িঘড়ি করে দুইটা দৈনিক আর একটা ইসলামি জার্নাল কিনে নিয়ে আসে। আমি বলি, ‘ঐ যে ঐখানে রিকশাওয়ালা ভাড়াটা দিয়ে আসো। পঞ্চাশ টাকা দিও।’ এরপর অনেক খুঁজাখুজি, রিক্সাওয়ালাকে আর পাওয়া গেল না। এমনিতেই শীতের রাত, লোকজন গাড়ি, রিকশা একেবারেই কম। আমরা দু’জন হেঁটে সামনে পিছনে গিয়ে অনেক খুঁজতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। ভাড়া দিতে না পারায় নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছিল, তার উপরে রমজান মাস।

সন্ধ্যার আজানের আগেই ট্রেন পৌঁছে গেল খুলনা ষ্টেশনে। বাসায় যখন পৌঁছালাম তখন ইফতারির সাইরেন বাজছে। আব্বা মারা যাবার পর থেকে এমনিতেই আমার প্র্যাকটিস ছিল, খুলনা পৌঁছেই লাগেজ রেখে আব্বার কবর জিয়ারত করা। আজ তার ব্যত্যয় ঘটলো। আম্মা বললেন, বাবু ইফতারি করে নামাজ পড়ে তবে যাও। যথারীতি তাই হলো।

বাসার গেটে পা দিতেই দেখি সকালের মত এক সাদা দাঁড়িয়ালা রিকশাওয়ালা, আসছে, আমি ডাকতেই সে বললো, কোথায় যাবেন, বসুপাড়া কবরস্থানে? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’। সকালের ঘটনা আর এখনকার ঘটনা সব মিলিয়ে আমার মনে কিছু প্রশ্ন দানা বাঁধলো। রিকশা চলছে বসুপাড়ার দিকে। কবরস্থানের গেটে পৌঁছাতেই আমি বললাম, ‘বাবা, আপনি কী আমার সাথে কবর যিয়ারত করবেন?’ সে বললো, অবশ্যই। আমি বললাম, ‘রিকশাটা বাইরে না রেখে ভিতরে রাখেন।’ সে বললো, এই রিকশা কেউ নেবেনা বাবা। মানেটা ঠিক বুঝলাম না। আব্বার কবরের কাছে গিয়ে দোয়া কালাম পড়ার পর তাকে বললাম, ‘বাবা, আপনি মুনাজাত করেন।’ সে বললো, আপনি তার ছেলে না, ছেলের দোয়া বেশি কবুল হয়। সব শেষে আবার রিকশায় করে বাসার গেটে ফেরত আসতেই দেখি রোজী আপা হাসতে হাসতে গেটের দিকে আসছেন। আমার হাত প্যান্টের পিছনের পকেটের মানিব্যাগে, আর চোখ রোজী আপার দিকে। পিছন ফিরে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি উধাও। সব শুনে রোজী আপা বললেন, কই, কাউকে দেখিনিতো। দেখলাম তুমি দাঁড়িয়ে আছো, তাই দৌড়ে আসলাম। সব শুনে আম্মা বললেন, সাবধানে থেকো বাবা। কিছু সদ্কা দিয়ে দিও, তোমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা হয়।

ঢাকা এসে বড় ভাইকে সব বিষয় খুলে বললাম। উনি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু হাসলেন। কেবল আমার দিব্যদৃষ্টি দুই রিক্সাওয়ালার দাড়ি আর বড় ভাইয়ের দাড়ির মধ্যে একটা সদৃশ্য দেখতে পেলো। বড় ভাই আজ নাই, তাই এই অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা বা উত্তর আমি আজো পাইনি। সমাপ্ত।

আরো পড়ুন : অলৌকিক: আব্বা আমাকে সাথে নিয়ে শাহজাহানপুর মোড় পর্যন্ত গেলেন; তারপর উধাও!