ঢাকা ০৮:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আহমদ ছফা; সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ

আহমদ ছফা
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ
(৩০ জুন ১৯৪৩-২৮ জুলাই ২০০১)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
আহমদ ছফা ছিলেন একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
জন্ম :
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শিক্ষা ও জীবন :
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’।
১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।
সাহিত্যকর্ম
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় একটি লেখা হলো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা “যদ্যপি আমার গুরু”।
মননশীল সাহিত্য
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। প্রকাশকাল- শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ সাল। ১৯৭২-এ প্রকাশ পায় ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। ১৯৭৯ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস’ এবং ১৯৮১ এ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থ প্রকাশ পায়।
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২)
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা প্রকাশ করেন। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে। আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। ছফার ভাষায়: “আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- সেও ঠেলায় পড়ে।”
আহমদ ছফা, ১৯৯৪
বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মাসিক সমকালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন।’ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন। ছফার মতে, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিতম উৎস। তাঁর মতে, বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতার শিকড়ও বর্ণাশ্রম প্রথাতে প্রোথিত আছে। আর শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতির কারণে বাঙালি মুসলমান আজ পর্যন্ত তাদের জাতিগত হীনম্মন্যতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে নি। আর তাই ‘বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে।’
১৯৯২ সালে রচিত ‘বাংলাদেশের উঁচুবিত্ত শ্রেণি এবং সমাজবিপ্লব প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে ছফা বলেছেন, দরিদ্র ও সংগ্রামরত বিশাল আম জনতার সাথে দেশের শহুরে সুশীল সমাজ ও শাসক শ্রেণির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের অভিজাতরা বিদেশিদের চেয়ে বেশি বিদেশি সেজে থাকে। তারা কাল্পনিক বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা বোধ করে, যার কোনো শিকড় বাংলাদেশের কোটি জনতার রূঢ় বাস্তবতায় নেই। ছফা আরো বলেন, বাঙালি সাধারণ মুসলমানরা আদৌ গোঁড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল না, কিন্তু শাসকশ্রেণির সাথে তাদের সতত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দূরত্ব ও নিরবচ্ছিন্ন শোষণ ও আর্থরাজনৈতিক বঞ্চনা তাদের মাঝে ক্রোধ ও ক্ষোভে পূর্ণ পলকা অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যে অবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলো বাংলাদেশে জনমত গঠন করতে পারছে।
কথাসাহিত্য
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭) আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ। ওঙ্কার (১৯৭৫) ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস। একজন আলী কেনানের উত্থান-পতনে (১৯৮৮) ছফা বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে আলী কেনান নামের মূল চরিত্রের উত্থান ও পতন উপস্থাপন করেছেন। মরণবিলাসে (১৯৮৯) চিত্রায়িত হয়েছে মৃত্যুশয্যায় এক মন্ত্রী যে তার রাজনৈতিক অনুসারী মাওলা বক্সের কাছে তার সারা জীবনে কৃত অপকর্মের বর্ণনা দেয়। অলাতচক্র (১৯৯৩) প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত। গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) উপন্যাসের মূল কেন্দ্র একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা লোক বিশ্ববিদ্যালয়, উপন্যাসের ভাষায়, ‘দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মূল চরিত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত উপাচার্য মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আবু জুনায়েদের আরোহণ এবং এর আগে ও পরে শিক্ষক রাজনীতিকে ঘিরে ঘটনাচক্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার এই উপন্যাসে। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) উপন্যাসটি ছফার ব্যক্তিগত প্রেমকে উপজীব্য করে রচিত।
কাব্য সাহিত্য ও অন্যান্য
আহমদ ছফা চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তিনি জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত স্মৃতিচারণ গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক বলে বিবেচিত আহমদ ছফা ছিলেন ‘সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী।’ ছফার লেখালেখিতে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বর্তমানময়তা আছে, আছে ইতিহাসের পরিচ্ছন্নতা। তৃতীয় উপাদান গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার এবং তা রাজনৈতিক অর্থে। ছফার আরও ছিল সাহস। তার ক্ষেত্রে এ সাহস এসেছে ইতিহাসবোধ থেকে, অঙ্গীকার থেকে।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যেকোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।
হুমায়ূন আহমদ আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, আহমদ ছফা ‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত’ ‘একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক।’ ইকবাল আরো লিখেছেন, ‘আমাদের বড় সৌভাগ্য তার মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।’
আহমদ ছফা সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘সে (ছফা) গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথালপাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।’
আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “সুবিধাবাদীর ‘লাইফ ইজ এ কম্প্রোমাইজ’ তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।”
সলিমুল্লাহ খান তাকে একজন দ্রষ্টা, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, বিশ্বের সেরা কাহিনী-কথকদের একজন ও বাংলা ভাষার মহান কথাসাহিত্যিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন ছফা কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী।
সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়।
“আহমদ ছফা : প্রথার বাইরের মানুষ” নামের এক নিবন্ধে রাশেদ খান মেনন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য, বাংলাদেশের মননজগৎ ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল ছফাকে হারিয়ে অনেকখানি রিক্ত হয়ে পড়েছে।’
রশীদ করীম লিখেছেন, ‘আহমদ ছফার এক একটি শব্দ শিলাখণ্ডের মতন কঠিন, আপাত-উদাসীন নির্মম অথচ তারই অন্তরে গভীর বেদনা ভালোবাসা কী পরিমাণ তার কোন সীমা নেই।’
ছফার উপন্যাস নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন ‘ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাসকে ও ইতিহাসে বর্তমান ব্যক্তিটিকে নিবিড় করে অনুভব করার তাগিদে পাঠক আহমদ ছফার অনুসন্ধানী অভিযানে শরিক হবেন।’
আহমদ ছফার অনেক গল্প, উপন্যাস মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। গাজী তানজিয়া প্রণীত কালের নায়ক (২০১৪) আহমদ ছফার জীবনভিত্তিক একটি উপন্যাস।
পুরস্কার
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাকে ২০০২ সালে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
ব্যক্তিগত জীবন
আহমদ ছফা সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন। তবে কয়েকজন নারীর সাথে তার প্রণয়সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন শামীম শিকদার ও সুরাইয়া খানম। এদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে ছফা অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
মৃত্যু
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের পাশে বিশ হাজার টাকা চাদা তুলে জায়গায় কিনে তাকে দাফন করা হয়।

আরো পড়ুন : বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃত ও বহুধা গুণাধিকারী মোহাম্মদ আকরম খাঁ

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

আহমদ ছফা; সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ

আপডেট সময় ১১:০৬:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

আহমদ ছফা
সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যার দীপ্তিময় বিচরণ
(৩০ জুন ১৯৪৩-২৮ জুলাই ২০০১)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
আহমদ ছফা ছিলেন একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খান সহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। তার লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে।
জন্ম :
আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
শিক্ষা ও জীবন :
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৫৭ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’।
১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল।
সাহিত্যকর্ম
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় একটি লেখা হলো অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখা “যদ্যপি আমার গুরু”।
মননশীল সাহিত্য
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। প্রকাশকাল- শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ সাল। ১৯৭২-এ প্রকাশ পায় ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। ১৯৭৯ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস’ এবং ১৯৮১ এ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ গ্রন্থ প্রকাশ পায়।
বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২)
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনা প্রকাশ করেন। ‘বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী’ এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে। আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। ছফার ভাষায়: “আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়- প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন- সেও ঠেলায় পড়ে।”
আহমদ ছফা, ১৯৯৪
বাংলা একাডেমি থেকে বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। গ্রন্থের নাম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মাসিক সমকালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন।’ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে ছফা বাঙালি মুসলমানদের হীনম্মন্যতার ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং পাশাপাশি এর বাস্তব ও যৌক্তিক কারণগুলো তুলে ধরেছেন। ছফার মতে, হিন্দু বর্ণাশ্রম প্রথাই এদেশের সাম্প্রদায়িকতার আদিতম উৎস। তাঁর মতে, বাঙালি মুসলমানের হীনম্মন্যতার শিকড়ও বর্ণাশ্রম প্রথাতে প্রোথিত আছে। আর শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতির কারণে বাঙালি মুসলমান আজ পর্যন্ত তাদের জাতিগত হীনম্মন্যতা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে নি। আর তাই ‘বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে।’
১৯৯২ সালে রচিত ‘বাংলাদেশের উঁচুবিত্ত শ্রেণি এবং সমাজবিপ্লব প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে ছফা বলেছেন, দরিদ্র ও সংগ্রামরত বিশাল আম জনতার সাথে দেশের শহুরে সুশীল সমাজ ও শাসক শ্রেণির কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের অভিজাতরা বিদেশিদের চেয়ে বেশি বিদেশি সেজে থাকে। তারা কাল্পনিক বৈশ্বিক সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা বোধ করে, যার কোনো শিকড় বাংলাদেশের কোটি জনতার রূঢ় বাস্তবতায় নেই। ছফা আরো বলেন, বাঙালি সাধারণ মুসলমানরা আদৌ গোঁড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল না, কিন্তু শাসকশ্রেণির সাথে তাদের সতত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দূরত্ব ও নিরবচ্ছিন্ন শোষণ ও আর্থরাজনৈতিক বঞ্চনা তাদের মাঝে ক্রোধ ও ক্ষোভে পূর্ণ পলকা অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যে অবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলো বাংলাদেশে জনমত গঠন করতে পারছে।
কথাসাহিত্য
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭) আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ও গ্রন্থ। ওঙ্কার (১৯৭৫) ছফার দ্বিতীয় উপন্যাস। একজন আলী কেনানের উত্থান-পতনে (১৯৮৮) ছফা বাংলাদেশের মাজার সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে আলী কেনান নামের মূল চরিত্রের উত্থান ও পতন উপস্থাপন করেছেন। মরণবিলাসে (১৯৮৯) চিত্রায়িত হয়েছে মৃত্যুশয্যায় এক মন্ত্রী যে তার রাজনৈতিক অনুসারী মাওলা বক্সের কাছে তার সারা জীবনে কৃত অপকর্মের বর্ণনা দেয়। অলাতচক্র (১৯৯৩) প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত। গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫) উপন্যাসের মূল কেন্দ্র একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা লোক বিশ্ববিদ্যালয়, উপন্যাসের ভাষায়, ‘দেশের সবচাইতে প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মূল চরিত্র সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্বাচিত উপাচার্য মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে আবু জুনায়েদের আরোহণ এবং এর আগে ও পরে শিক্ষক রাজনীতিকে ঘিরে ঘটনাচক্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ সালে। পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার এই উপন্যাসে। অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) উপন্যাসটি ছফার ব্যক্তিগত প্রেমকে উপজীব্য করে রচিত।
কাব্য সাহিত্য ও অন্যান্য
আহমদ ছফা চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তিনি জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের ফাউস্ট অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হয় ১৯৮৬ সালে। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সমসাময়িক কালের বিশিষ্ট পণ্ডিত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত স্মৃতিচারণ গ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরু প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে।
প্রভাব ও উত্তরাধিকার
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক বলে বিবেচিত আহমদ ছফা ছিলেন ‘সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী।’ ছফার লেখালেখিতে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বর্তমানময়তা আছে, আছে ইতিহাসের পরিচ্ছন্নতা। তৃতীয় উপাদান গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার এবং তা রাজনৈতিক অর্থে। ছফার আরও ছিল সাহস। তার ক্ষেত্রে এ সাহস এসেছে ইতিহাসবোধ থেকে, অঙ্গীকার থেকে।
জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যেকোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।
হুমায়ূন আহমদ আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন।
মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, আহমদ ছফা ‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত’ ‘একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক।’ ইকবাল আরো লিখেছেন, ‘আমাদের বড় সৌভাগ্য তার মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।’
আহমদ ছফা সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘সে (ছফা) গাছবাড়িয়া গ্রাম থেকে আসা অতি সাধারণ একটি গ্রামের ছেলে। কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির জগতে সে যে উথালপাথাল ধাক্কা দিয়ে গেল তার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য বলি, সংস্কৃতি বলি, রাজনীতি বলি, বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড বলি তার সঙ্গে খোদ একটা বোঝাপড়া না করে কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রসর হওয়া যাবে না।’
আহমদ শরীফ বলেছিলেন, “সুবিধাবাদীর ‘লাইফ ইজ এ কম্প্রোমাইজ’ তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।”
সলিমুল্লাহ খান তাকে একজন দ্রষ্টা, রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, বিশ্বের সেরা কাহিনী-কথকদের একজন ও বাংলা ভাষার মহান কথাসাহিত্যিক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মনে করেন ছফা কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী।
সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ছফা কেবল পাঠ করার বিষয় নয়, চর্চা করার বিষয়।
“আহমদ ছফা : প্রথার বাইরের মানুষ” নামের এক নিবন্ধে রাশেদ খান মেনন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য, বাংলাদেশের মননজগৎ ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল ছফাকে হারিয়ে অনেকখানি রিক্ত হয়ে পড়েছে।’
রশীদ করীম লিখেছেন, ‘আহমদ ছফার এক একটি শব্দ শিলাখণ্ডের মতন কঠিন, আপাত-উদাসীন নির্মম অথচ তারই অন্তরে গভীর বেদনা ভালোবাসা কী পরিমাণ তার কোন সীমা নেই।’
ছফার উপন্যাস নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন ‘ব্যক্তির মধ্যে ইতিহাসকে ও ইতিহাসে বর্তমান ব্যক্তিটিকে নিবিড় করে অনুভব করার তাগিদে পাঠক আহমদ ছফার অনুসন্ধানী অভিযানে শরিক হবেন।’
আহমদ ছফার অনেক গল্প, উপন্যাস মঞ্চনাটক, টেলিভিশন নাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। গাজী তানজিয়া প্রণীত কালের নায়ক (২০১৪) আহমদ ছফার জীবনভিত্তিক একটি উপন্যাস।
পুরস্কার
তিনি লেখক শিবির পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি কর্তৃক সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১৯৮০ সালে ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার গ্রহণ করেছেন বলে জানা যায়। তাকে ২০০২ সালে সাহিত্যে (মরণোত্তর) একুশে পদক প্রদান করা হয় ।
ব্যক্তিগত জীবন
আহমদ ছফা সারাজীবন অকৃতদার ছিলেন। তবে কয়েকজন নারীর সাথে তার প্রণয়সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন শামীম শিকদার ও সুরাইয়া খানম। এদের সাথে সম্পর্কের ভিত্তিতে ছফা অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬) আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনা করেছিলেন।
মৃত্যু
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের পাশে বিশ হাজার টাকা চাদা তুলে জায়গায় কিনে তাকে দাফন করা হয়।

আরো পড়ুন : বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃত ও বহুধা গুণাধিকারী মোহাম্মদ আকরম খাঁ