ঢাকা ১০:০৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গেরুয়া মাটির পথে ৩ : জুলি রহমান, গ্রন্থ পর্যালোচনা : ইদ্রিস আলী মেহেদী

গেরুয়া মাটির পথে ৩ : জুলি রহমান
গ্রন্থ পর্যালোচনা : ইদ্রিস আলী মেহেদী

’’গেরুয়া মাটির পথে ৩’’ – এটা মূলত একট গানের বই। বইটি শুরু থেকে শেষাবধি পাঠান্তে আমার ফার্স্ট ইমপ্রেশন হচ্ছে, কবি-গীতিকার জুলি রহমানের এটি এক অনুপম ও মৃন্ময়ী চিন্তার ফসল, যা বইটির অভ্যন্তরে সুবিন্যস্ত। হৃদয়ের অলিগলি বেয়ে, কবি শেষান্তে অন্বেষণ করেছেন তার অতলান্তে। কুড়িয়ে এনেছেন সুর-ছন্দ, রুপ-রস, রামধনু রঙ ও মা-মাটির আঁচলমাখা হৃদয়হরণ গন্ধ। আহা কী তার ঐশ্বর্য! – স্বর্গীয় সুধার আধার যা বর্ণিল – বর্ণনাতীত।

মূলত আলোচ্য গ্রন্থটির রচনাগুলো ২০২০-এর প্রারম্ভ থেকেই। এর ফলশ্রুতিতেই এ বিশাল সঙ্গীত সম্ভার। কবির স্বগতোক্তি এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বিষয়টি এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যথা ‘’সুখ-দুঃখের বেসাতি নিয়েই তার এই গ্রন্থের মাল-মশলা তথা উপজীব্য। অন্যের সুখ-সমৃদ্ধি কিংবা দুঃখময়তা, অণু-পরমাণুগুলো ধারণ বা বহন করে তিনি স্বীয় অনুধ্যানকেই চিত্রায়িত করেছেন সঙ্গীতের সুরধারায়, সুরমহিমায়। আহা সুর! হৃদয়গ্রাহী সুরের ঝংকার। মর্মমূলে সবুজাঙ্গণ বিস্তারের এক শৈল্পিকাচরণ।

সঙ্গীত বিষয়ক ঋদ্ধিমান পণ্ডিতগণ সঙ্গীতকে নিম্নরুপ ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেনঃ ‘’A song is a musical composition performed by the human voice.’’ কোন কোন সঙ্গীতজ্ঞের মতানুসারে সঙ্গীত হচ্ছেঃ ‘’An art of sound in time that expresses ideas and emotions in significant forms through the elements of rhythm, melody, harmony and color.’’

যা-ই হোক, কবি-গীতিকার জুলি রহমান এ গ্রন্থে বিরহের বৈরাগ্যকে, মিলনের মধুরত্বকে অক্ষরে, ছন্দে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার দারুণ বিন্যাসের ছত্রচ্ছায়ায় যে স্বার্থক বুনন ঘটিয়েছেন, প্রদর্শন করেছেন মুন্সিয়ানার. সেখানে যেন ফুটেছে বসরাই গোলাপ। এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। সাধারণ গান থেকে শ্যাম গীতিকাব্য, কাব্যনাটক যক্ষকান্তা ও ভরানদীর বাঁকে।

প্রেম-পর্বের গানগুলোর মধ্যে মানব-মানবীর চিরায়ত প্রেমানুভূতির এক অমোঘ বার্তা বিশদভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াসে মগ্ন কবি। গানের কলিতে তাই তার এমন অকপট স্বীকারোক্তিঃ তুমিই জীবনের রং আমার/সঙ্গীত সারা বেলার;/তুমিই দিলে স্বপ্ন সাজাবার/সেই তুমি দিলে বেদনা অপার।

গান শুধু প্রেমাসক্তিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন ও সুরলহরীতে মন্ত্রমুগ্ধতাই নয়, বিরহানলে পুড়ে পুড়ে প্রেমাস্বাদনলাভে পারঙ্গমতার কঠিন পথের দুর্গম বাঁকগুলোকেও আলিঙ্গণ করতে শেখায় অতি দক্ষতায়, সূক্ষতায়। গীতিকারের চরণগুলো যেন তারই স্পষ্টাভাসে মুখর – দুঃখকে ভালোবেসেই আমার পথচলা/তবে কেন বা সুখের গল্প বলা?/ফুলে নয় কণ্টকে গড়েছি মালা/জলহীন চোখে আগুনের জ্বালা।

আলোচ্য গ্রন্থটির ধারাবাহিকতায় পরবর্তী পর্বটি – ‘’শ্যাম গীতিকাব্য’’। শ্রবণেই মনোজগতে কেমন যেন একটা ’শ্যাম শ্যাম’ ভাবের ব্যঞ্জণায় মাদকতা সৃষ্টি করে, অবতারণা করে এক মোহাচ্ছন্নতার। কিংবদন্তীর কথা বিলক্ষন স্মরণ করিয়ে দেয় অবলীলায়।

প্রেম নিছক প্রেমই নয়। প্রেম স্বর্গ-মর্ত্যের এক সোনালী-বর্ণালী সূতিকাগার। প্রেম উচ্চমার্গীয় সাধনার এক দ্যুতিময় চিত্ররূপ। প্রেম শিল্পের মুগ্ধতা। প্রেম সঙ্গীতের মূ্র্চ্ছনা। প্রেম পবিত্রতার বন্দনা। প্রেম স্বর্গের মসৃণ সোপান। সঙ্গতই এটা সহজলভ্য কোন মামূলী ধাঁচের উপাদান নয়। ক্রয়-বিক্রয়ের ঊর্দ্ধে যার মাকাম। সাধনালব্ধ যা, তা-ই প্রেমের সওগাত। লাগাতার সাধনালব্ধ অপূর্ব নির্যাসই প্রেম। নিরলস সাধনার ফলশ্রুতিতেই আসে চরম-পরম প্রাপ্তি। তাই তো কবির শাণিত কলমের কালি নির্দ্ধিধায় এঁকে দিলোঃ ‘’ওহে শ্যাম আমার তুমি কই?/ কত যে আশায় পথ চেয়ে রই! কী সাধনায় পাবো তোমাকে/বলে যাও শুধু আমাকে।

এই পর্বের কোন কোন চরণে প্রেম কখনো ধরা দেয় নিঃসীম নিষ্কামে, প্রগাঢ় স্বকীয়তায়। শরীরবৃ্ত্তীয়তার ঊর্দ্ধে অবস্থান করে প্রেমাবহ সাবলীল, স্বচ্ছ, গতিময় হতে পারে কবির ঋদ্ধিমান ভাষায় চমৎকারভাবে তা বর্ণিত। কবি যখন বলেন – ‍মুছে দিয়ে ক্রুঢ় স্বার্থসিদ্ধি এষণা/ঘুচে যাক শৃঙ্গার কামনা/তবুও তুমি থাকো আমার/জন্ম-জন্মান্তর ঘুচিয়ে আঁধার।

গ্রন্থটির ‘’কাব্যনাটক যক্ষকান্তা’’ পর্বে কবি-গীতিকার, হৃদয়োৎসারিত মর্মবাণী এমন শৈল্পিকাবহে উত্থাপন করেছেন যে, পাঠককুল যক্ষকান্তার মতোই আবেগাতুর, প্রেমাতুরতায় উদ্বেলিত হওয়ার উৎসমূল খুঁজে পাবে সহজিয়ায়। কবি যেমনটি অতলাশ্রয়ী অনুভবে ব্যক্ত করেছেনঃ পাথর চোখ তার মণি হয়ে জ্বলে/আমার নয়ন বন্দি হলো সেই বিহঙ্গ তলে।/রূপ তার যক্ষকান্তার গভীর হোমানলে/এমন মধুর ক্ষণে তারেই মনে পড়ে।

বৈষয়িকতার বিষবাষ্পে এ গ্রহ আজ বিপুলভাবে ন্যুব্জ, প্রবলভাবে আক্রান্ত। তথাকথিত বায়বীয় ও মেকি প্রেমে এর অশুভ প্রভাব যেন ‘’করোনা’’ মহামারী অধিক ভয়ংকর। কবি এখানে মানবীয়, হৃদয়বৃত্তীয়, স্বর্গীয় তথা প্রেমের খাটীত্বকেই মৌলিকত্ব প্রদান করতে কাব্যিকতায় রূপদান করার প্রয়াস নিয়েছেন। মনের শুদ্ধতা ও পবিত্রতাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছেন ঐকান্তিকতায়। প্রেমের পরিশুদ্ধতায়ই এর মূল চাবিকাঠি তথা পরিমাপদণ্ড । কবির কাব্যনাটক যক্ষকান্তে সেটাই ধ্বনিত হয়েছে এমন সুচারুভাবে – বাঁধন নয় শরীরে কোনো/দিয়ে মন মনকে চেনো/যক্ষকান্তা চিরচেনা প্রেম/সূক্ষ সুতোয় না এনো হেম’’।

প্রেম শাশ্বতিক – চিরন্তনিক। প্রেমাবহের এই ফল্গুধারায় কবি মন সিঞ্চিত, কূলাতিক্রান্ত। কবি প্রাসঙ্গিকভাবে তা অত্যুজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করতে পারঙ্গম হয়েছেন শাব্দিক দ্যোতনায়।

গ্রন্থটির শেষাংশে দীপ্তিময়তায় স্থান পেয়েছে ‘’ভরা নদীর বাঁকে’’। এই পর্বটির বহুলাংশে আবহমান গ্রামীণ পটভূমির জীবন্ত ছোঁয়ায় উজ্জীবিত। মা-মাটি, প্রকৃতির সুনিবিড় স্পর্শে, মায়াবী বন্ধনে প্রাণোচ্ছ্বল। মনের বাঁকে বাঁকে, বিল-ঝিল, ডহরের নিস্তরঙ্গতা কখনো বা হৃদয়ের অসীম চত্বরে চৈত্রের তাতানো খরা, আবার অকস্মাৎ বোশেখের নিষ্ঠুর তাণ্ডবতা। মনোবৃত্তির সকল উপাদানে টইটম্বুর ছন্দ, ভাষার এমন অনুপম উচ্চারণ এভাবেই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় কাব্যাঙ্গণের পুষ্পসজ্জিত নান্দনিক সোপানসমূহ। কবির ভাষায় বিধৃত হয়েছে যেভাবে – আসমানে ভাসে ধলামেঘ মনে বন্ধুর মায়া/দিও আমার প্রাণের ছোঁয়া দিও তারে ছায়া। জলের পানা যাও ভেসে যাও দূরের গাঁও/বলো তারে চোখের জলে বুক ভেসে যায়।

মিলনাকাঙ্খায় প্রেমের যে সজীব বীজ রোপিত হয়, তা কখনো অংকুরোদগম অবধি পৌঁছেনা। দুর্বারতায় মিলনোন্মুখ থেকেও দুরূহ চড়াই-উৎরাইয়ের কবলে তা ব্যর্থতার পাকদণ্ডীতে বিলীন হয়ে যায় দুঃখের সরোবরে। কিন্তু গীতিকার-কবি জুলি রহমান অতি সচেতন ও সূক্ষতার সাথে তার প্রিয় পাঠককূলকে সেই বিয়োগান্তক দুঃখময়তাকে সযত্নে মুক্তি দিয়ে উপহার দিয়েছেন মিলন-মধুর স্বর্গীয় অমিয়তাকে এভাবেইঃ ‘’দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধু সুজন …… হাসে/সুখে থকো কাজল রেখা প্রেম পিয়াসে/কাজল রেখার অঞ্জণ আঁকা দু’চোখে/দুঃখের শেষে ভাসে দুজন স্বর্গালোকে।’’

উপসংহারে বলা যায়, কবি-গীতিকার জুলি রহমানের ‘’গেরুয়া মাটির পথে ৩’’ গ্রন্থটি সার্বিক বিচারে পাঠক মহলে সমাদৃত হবে। বইটির বাঁধাই ও মুদ্রণ মানসম্মত। অনিচ্ছাকৃত বানান বিভ্রাট হয়তো প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু সীমাবদ্ধতা হেতু হয়ে থাকে। আমি ঐকান্তিকভাবে বইটির বহুল প্রচার-প্রসার প্রত্যাশা করছি।

আরো পড়ুন : ঈদের প্রত্যাশা

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

গেরুয়া মাটির পথে ৩ : জুলি রহমান, গ্রন্থ পর্যালোচনা : ইদ্রিস আলী মেহেদী

আপডেট সময় ০৮:১৯:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

গেরুয়া মাটির পথে ৩ : জুলি রহমান
গ্রন্থ পর্যালোচনা : ইদ্রিস আলী মেহেদী

’’গেরুয়া মাটির পথে ৩’’ – এটা মূলত একট গানের বই। বইটি শুরু থেকে শেষাবধি পাঠান্তে আমার ফার্স্ট ইমপ্রেশন হচ্ছে, কবি-গীতিকার জুলি রহমানের এটি এক অনুপম ও মৃন্ময়ী চিন্তার ফসল, যা বইটির অভ্যন্তরে সুবিন্যস্ত। হৃদয়ের অলিগলি বেয়ে, কবি শেষান্তে অন্বেষণ করেছেন তার অতলান্তে। কুড়িয়ে এনেছেন সুর-ছন্দ, রুপ-রস, রামধনু রঙ ও মা-মাটির আঁচলমাখা হৃদয়হরণ গন্ধ। আহা কী তার ঐশ্বর্য! – স্বর্গীয় সুধার আধার যা বর্ণিল – বর্ণনাতীত।

মূলত আলোচ্য গ্রন্থটির রচনাগুলো ২০২০-এর প্রারম্ভ থেকেই। এর ফলশ্রুতিতেই এ বিশাল সঙ্গীত সম্ভার। কবির স্বগতোক্তি এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি বিষয়টি এমনভাবে প্রকাশ করেছেন যথা ‘’সুখ-দুঃখের বেসাতি নিয়েই তার এই গ্রন্থের মাল-মশলা তথা উপজীব্য। অন্যের সুখ-সমৃদ্ধি কিংবা দুঃখময়তা, অণু-পরমাণুগুলো ধারণ বা বহন করে তিনি স্বীয় অনুধ্যানকেই চিত্রায়িত করেছেন সঙ্গীতের সুরধারায়, সুরমহিমায়। আহা সুর! হৃদয়গ্রাহী সুরের ঝংকার। মর্মমূলে সবুজাঙ্গণ বিস্তারের এক শৈল্পিকাচরণ।

সঙ্গীত বিষয়ক ঋদ্ধিমান পণ্ডিতগণ সঙ্গীতকে নিম্নরুপ ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেনঃ ‘’A song is a musical composition performed by the human voice.’’ কোন কোন সঙ্গীতজ্ঞের মতানুসারে সঙ্গীত হচ্ছেঃ ‘’An art of sound in time that expresses ideas and emotions in significant forms through the elements of rhythm, melody, harmony and color.’’

যা-ই হোক, কবি-গীতিকার জুলি রহমান এ গ্রন্থে বিরহের বৈরাগ্যকে, মিলনের মধুরত্বকে অক্ষরে, ছন্দে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার দারুণ বিন্যাসের ছত্রচ্ছায়ায় যে স্বার্থক বুনন ঘটিয়েছেন, প্রদর্শন করেছেন মুন্সিয়ানার. সেখানে যেন ফুটেছে বসরাই গোলাপ। এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। সাধারণ গান থেকে শ্যাম গীতিকাব্য, কাব্যনাটক যক্ষকান্তা ও ভরানদীর বাঁকে।

প্রেম-পর্বের গানগুলোর মধ্যে মানব-মানবীর চিরায়ত প্রেমানুভূতির এক অমোঘ বার্তা বিশদভাবে উপস্থাপন করার প্রয়াসে মগ্ন কবি। গানের কলিতে তাই তার এমন অকপট স্বীকারোক্তিঃ তুমিই জীবনের রং আমার/সঙ্গীত সারা বেলার;/তুমিই দিলে স্বপ্ন সাজাবার/সেই তুমি দিলে বেদনা অপার।

গান শুধু প্রেমাসক্তিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন ও সুরলহরীতে মন্ত্রমুগ্ধতাই নয়, বিরহানলে পুড়ে পুড়ে প্রেমাস্বাদনলাভে পারঙ্গমতার কঠিন পথের দুর্গম বাঁকগুলোকেও আলিঙ্গণ করতে শেখায় অতি দক্ষতায়, সূক্ষতায়। গীতিকারের চরণগুলো যেন তারই স্পষ্টাভাসে মুখর – দুঃখকে ভালোবেসেই আমার পথচলা/তবে কেন বা সুখের গল্প বলা?/ফুলে নয় কণ্টকে গড়েছি মালা/জলহীন চোখে আগুনের জ্বালা।

আলোচ্য গ্রন্থটির ধারাবাহিকতায় পরবর্তী পর্বটি – ‘’শ্যাম গীতিকাব্য’’। শ্রবণেই মনোজগতে কেমন যেন একটা ’শ্যাম শ্যাম’ ভাবের ব্যঞ্জণায় মাদকতা সৃষ্টি করে, অবতারণা করে এক মোহাচ্ছন্নতার। কিংবদন্তীর কথা বিলক্ষন স্মরণ করিয়ে দেয় অবলীলায়।

প্রেম নিছক প্রেমই নয়। প্রেম স্বর্গ-মর্ত্যের এক সোনালী-বর্ণালী সূতিকাগার। প্রেম উচ্চমার্গীয় সাধনার এক দ্যুতিময় চিত্ররূপ। প্রেম শিল্পের মুগ্ধতা। প্রেম সঙ্গীতের মূ্র্চ্ছনা। প্রেম পবিত্রতার বন্দনা। প্রেম স্বর্গের মসৃণ সোপান। সঙ্গতই এটা সহজলভ্য কোন মামূলী ধাঁচের উপাদান নয়। ক্রয়-বিক্রয়ের ঊর্দ্ধে যার মাকাম। সাধনালব্ধ যা, তা-ই প্রেমের সওগাত। লাগাতার সাধনালব্ধ অপূর্ব নির্যাসই প্রেম। নিরলস সাধনার ফলশ্রুতিতেই আসে চরম-পরম প্রাপ্তি। তাই তো কবির শাণিত কলমের কালি নির্দ্ধিধায় এঁকে দিলোঃ ‘’ওহে শ্যাম আমার তুমি কই?/ কত যে আশায় পথ চেয়ে রই! কী সাধনায় পাবো তোমাকে/বলে যাও শুধু আমাকে।

এই পর্বের কোন কোন চরণে প্রেম কখনো ধরা দেয় নিঃসীম নিষ্কামে, প্রগাঢ় স্বকীয়তায়। শরীরবৃ্ত্তীয়তার ঊর্দ্ধে অবস্থান করে প্রেমাবহ সাবলীল, স্বচ্ছ, গতিময় হতে পারে কবির ঋদ্ধিমান ভাষায় চমৎকারভাবে তা বর্ণিত। কবি যখন বলেন – ‍মুছে দিয়ে ক্রুঢ় স্বার্থসিদ্ধি এষণা/ঘুচে যাক শৃঙ্গার কামনা/তবুও তুমি থাকো আমার/জন্ম-জন্মান্তর ঘুচিয়ে আঁধার।

গ্রন্থটির ‘’কাব্যনাটক যক্ষকান্তা’’ পর্বে কবি-গীতিকার, হৃদয়োৎসারিত মর্মবাণী এমন শৈল্পিকাবহে উত্থাপন করেছেন যে, পাঠককুল যক্ষকান্তার মতোই আবেগাতুর, প্রেমাতুরতায় উদ্বেলিত হওয়ার উৎসমূল খুঁজে পাবে সহজিয়ায়। কবি যেমনটি অতলাশ্রয়ী অনুভবে ব্যক্ত করেছেনঃ পাথর চোখ তার মণি হয়ে জ্বলে/আমার নয়ন বন্দি হলো সেই বিহঙ্গ তলে।/রূপ তার যক্ষকান্তার গভীর হোমানলে/এমন মধুর ক্ষণে তারেই মনে পড়ে।

বৈষয়িকতার বিষবাষ্পে এ গ্রহ আজ বিপুলভাবে ন্যুব্জ, প্রবলভাবে আক্রান্ত। তথাকথিত বায়বীয় ও মেকি প্রেমে এর অশুভ প্রভাব যেন ‘’করোনা’’ মহামারী অধিক ভয়ংকর। কবি এখানে মানবীয়, হৃদয়বৃত্তীয়, স্বর্গীয় তথা প্রেমের খাটীত্বকেই মৌলিকত্ব প্রদান করতে কাব্যিকতায় রূপদান করার প্রয়াস নিয়েছেন। মনের শুদ্ধতা ও পবিত্রতাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছেন ঐকান্তিকতায়। প্রেমের পরিশুদ্ধতায়ই এর মূল চাবিকাঠি তথা পরিমাপদণ্ড । কবির কাব্যনাটক যক্ষকান্তে সেটাই ধ্বনিত হয়েছে এমন সুচারুভাবে – বাঁধন নয় শরীরে কোনো/দিয়ে মন মনকে চেনো/যক্ষকান্তা চিরচেনা প্রেম/সূক্ষ সুতোয় না এনো হেম’’।

প্রেম শাশ্বতিক – চিরন্তনিক। প্রেমাবহের এই ফল্গুধারায় কবি মন সিঞ্চিত, কূলাতিক্রান্ত। কবি প্রাসঙ্গিকভাবে তা অত্যুজ্জ্বলভাবে চিত্রায়িত করতে পারঙ্গম হয়েছেন শাব্দিক দ্যোতনায়।

গ্রন্থটির শেষাংশে দীপ্তিময়তায় স্থান পেয়েছে ‘’ভরা নদীর বাঁকে’’। এই পর্বটির বহুলাংশে আবহমান গ্রামীণ পটভূমির জীবন্ত ছোঁয়ায় উজ্জীবিত। মা-মাটি, প্রকৃতির সুনিবিড় স্পর্শে, মায়াবী বন্ধনে প্রাণোচ্ছ্বল। মনের বাঁকে বাঁকে, বিল-ঝিল, ডহরের নিস্তরঙ্গতা কখনো বা হৃদয়ের অসীম চত্বরে চৈত্রের তাতানো খরা, আবার অকস্মাৎ বোশেখের নিষ্ঠুর তাণ্ডবতা। মনোবৃত্তির সকল উপাদানে টইটম্বুর ছন্দ, ভাষার এমন অনুপম উচ্চারণ এভাবেই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় কাব্যাঙ্গণের পুষ্পসজ্জিত নান্দনিক সোপানসমূহ। কবির ভাষায় বিধৃত হয়েছে যেভাবে – আসমানে ভাসে ধলামেঘ মনে বন্ধুর মায়া/দিও আমার প্রাণের ছোঁয়া দিও তারে ছায়া। জলের পানা যাও ভেসে যাও দূরের গাঁও/বলো তারে চোখের জলে বুক ভেসে যায়।

মিলনাকাঙ্খায় প্রেমের যে সজীব বীজ রোপিত হয়, তা কখনো অংকুরোদগম অবধি পৌঁছেনা। দুর্বারতায় মিলনোন্মুখ থেকেও দুরূহ চড়াই-উৎরাইয়ের কবলে তা ব্যর্থতার পাকদণ্ডীতে বিলীন হয়ে যায় দুঃখের সরোবরে। কিন্তু গীতিকার-কবি জুলি রহমান অতি সচেতন ও সূক্ষতার সাথে তার প্রিয় পাঠককূলকে সেই বিয়োগান্তক দুঃখময়তাকে সযত্নে মুক্তি দিয়ে উপহার দিয়েছেন মিলন-মধুর স্বর্গীয় অমিয়তাকে এভাবেইঃ ‘’দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধু সুজন …… হাসে/সুখে থকো কাজল রেখা প্রেম পিয়াসে/কাজল রেখার অঞ্জণ আঁকা দু’চোখে/দুঃখের শেষে ভাসে দুজন স্বর্গালোকে।’’

উপসংহারে বলা যায়, কবি-গীতিকার জুলি রহমানের ‘’গেরুয়া মাটির পথে ৩’’ গ্রন্থটি সার্বিক বিচারে পাঠক মহলে সমাদৃত হবে। বইটির বাঁধাই ও মুদ্রণ মানসম্মত। অনিচ্ছাকৃত বানান বিভ্রাট হয়তো প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু সীমাবদ্ধতা হেতু হয়ে থাকে। আমি ঐকান্তিকভাবে বইটির বহুল প্রচার-প্রসার প্রত্যাশা করছি।

আরো পড়ুন : ঈদের প্রত্যাশা