ঢাকা ০৯:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
প্রখ্যাত কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ ছিলেন ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’। এছাড়া ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে একজন প্রখ্যাত কবি, শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ব্যঙ্গ্যকবিতা ও সনেট রচনায় তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তিনি বাংলা কাব্যজগতের সর্বাধিক সনেট রচয়িতা। তার কবিতায় বাংলার অধপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে-কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন তা স্বতন্ত্র এবং এ-গ্রন্থ তার এক অমর সৃষ্টি।
জন্ম ও পরিবার

সৈয়দ ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামের সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মাতার রওশন আখতার।

১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি) এর সঙ্গে ফররুখ আহমদ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা সওগাত পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।

ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে এগারো জন। তারা হলেন: সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান (আহমদ আখতার), সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
শিক্ষাজীবন

ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশের দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি তখন ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও তাঁর অনুরূপ সমর্থন ছিল।
কর্মজীবন

ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্য চর্চা

কিশোর বয়সে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে ফররুখ আহমদ সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে ‘লাশ’ কবিতা লিখে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী কবি। তাঁর কাব্যের মৌলিক প্রবণতা মুসলিম সংস্কৃতির গৌরবকীর্তন ও জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ। পাকিস্তানবাদ, ইসলামিক আদর্শ ও আরব-ইরানের ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।

বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগনৈপুণ্য এবং বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে তাঁর কবিতা এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। ব্যঙ্গ্যকবিতা ও সনেট রচনায় তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেমতায়ী (১৯৬৬), হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১) ইত্যাদি। তাঁর শিশুতোষ রচনার মধ্যে রয়েছে পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি।

ফররখ আহমদ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় ‘কবি’। তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা। তবে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ মাসিক সওগাতের আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যায় পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন, “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি ”।

পুরস্কার
সাহিত্যে বিশেষ অবদানে জন্য তিনি ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স, ১৯৬৬ সালে আদমজী পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৭৭ একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

মৃত্যু
ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যাবেলায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ফররুখ আহমদের কবিতাগুচ্ছ:
পাঞ্জেরি

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
পাঞ্জেরি!

জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!

 

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিল বিকল-
সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,
– অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল
গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বারবার।
জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এইসব যন্ত্র জানোয়ার
দিন রাত্রি ঘোরেফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে
সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথে পার হয়ে আর
অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিঙে আসামে জঙ্গলে।

আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়াপাড়াতে।
দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;
উজ্জ্বীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;
কাঁচড়াপাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।
(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে
কাঁচড়াপাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।।

 

বর্ষার বিষণ্ন চাঁদ

বর্ষার বিষণ্ন চাঁদ এ রাতেও উঠেছে তেমনি
যেমন সে উঠেছিল হাজার বছর আগেকার
বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে। সে রাত্রির অস্ফুটে ব্যথার
মৃদু স্বর আছে এ আকাশে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি
আমার মনের তারে বেজে ওঠে আপনা আপনি,
শ্রাবণ মেঘের মাঝে ডুবে যায় চাঁদ যতবার;
যতবার ভেসে ওঠে। দূরে এক অস্পষ্ট মাজার
শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে জাগায় ব্যথার আবেষ্টনী।

হাজার বছর পরে এই চাঁদ বিষণ্ণ বর্ষার
ব’য়ে নিয়ে যাবে স্মৃতি জনপদে বেদনা-মন্থর;
অস্পষ্ট ছায়ার মত, যেখানে এ রাত্রির দুয়ারে,
খুলে দেবে অন্ধকারে জীবনের বিস্মৃত প্রহর;
বৃষ্টি ধোয়া আসমানে জাগাবে সে এই ক্লান্ত স্বর;
হাজার বছর পরে একবার শুধু একবার।।

 

সিলেট ষ্টেশনে একটি শীতের প্রভাত

অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণী ও প্রাণের
সাড়া নেই। এখানে জালালাবাদে দেখি এসে
হিম-সিক্ত কম্বলের মত রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে
সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের।
ইরানী ছুরির মত তীক্ষ্মধার হাওয়া উত্তরের
বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে
তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে
সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের।

বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ঝিল্লিও নীরব, পাখীদের
বাসায় নিঃসাড় ঘুম (মৃত্যু নেমে আসে ছদ্মবেশে
পৌত্তলিক অন্ধকারে), সাড়া নাই মুক্ত জীবনের;
মৌন প্রতীক্ষায় ধরা মর্মরিয়া ওঠে তবু ক্লেশে।
তারপর কি আশ্চর্য দেখি চেয়ে প্রতীক্ষার শেষে
প্রশান্ত প্রভাত নামে স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাসি দরবেশের।।

আরো পড়ুন : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি `আল মাহমুদ’

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ

আপডেট সময় ১২:০৭:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ এপ্রিল ২০২৪

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
প্রখ্যাত কবি সৈয়দ ফররুখ আহমদ ছিলেন ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’। এছাড়া ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মৌলিক প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে একজন প্রখ্যাত কবি, শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ব্যঙ্গ্যকবিতা ও সনেট রচনায় তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তিনি বাংলা কাব্যজগতের সর্বাধিক সনেট রচয়িতা। তার কবিতায় বাংলার অধপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাক্প্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে-কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন তা স্বতন্ত্র এবং এ-গ্রন্থ তার এক অমর সৃষ্টি।
জন্ম ও পরিবার

সৈয়দ ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন তৎকালীন যশোর জেলার অন্তর্গত মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামের সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর। মাতার রওশন আখতার।

১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুন (লিলি) এর সঙ্গে ফররুখ আহমদ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার নিজের বিয়ে উপলক্ষে ফররুখ ‘উপহার’ নামে একটি কবিতা লেখেন যা সওগাত পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।

ফররুখ আহমদের ছেলে-মেয়ে এগারো জন। তারা হলেন: সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহল মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান (আহমদ আখতার), সৈয়দ মুহম্মদ ওয়হিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।
শিক্ষাজীবন

ফররুখ আহমদ খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আই.এ. পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন এবং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশের দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তিনি তখন ধর্মীয় কুসংস্কার ও পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর হাতে লেখনী পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও তাঁর অনুরূপ সমর্থন ছিল।
কর্মজীবন

ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। তিনি ১৯৪৩ সালে আই.জি.প্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্য চর্চা

কিশোর বয়সে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে ফররুখ আহমদ সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে ‘লাশ’ কবিতা লিখে তিনি প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণবাদী কবি। তাঁর কাব্যের মৌলিক প্রবণতা মুসলিম সংস্কৃতির গৌরবকীর্তন ও জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ। পাকিস্তানবাদ, ইসলামিক আদর্শ ও আরব-ইরানের ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে।

বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগনৈপুণ্য এবং বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে তাঁর কবিতা এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। ব্যঙ্গ্যকবিতা ও সনেট রচনায় তাঁর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেমতায়ী (১৯৬৬), হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১) ইত্যাদি। তাঁর শিশুতোষ রচনার মধ্যে রয়েছে পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি।

ফররখ আহমদ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় ‘কবি’। তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা। তবে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ মাসিক সওগাতের আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যায় পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন, “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি ”।

পুরস্কার
সাহিত্যে বিশেষ অবদানে জন্য তিনি ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬১ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স, ১৯৬৬ সালে আদমজী পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৭৭ একুশে পদক (মরণোত্তর) এবং ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।

মৃত্যু
ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যাবেলায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ফররুখ আহমদের কবিতাগুচ্ছ:
পাঞ্জেরি

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?
এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব
তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব
অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,
বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।
আহা, পেরেশান মুসাফির দল।
দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরে
নিরাশায় ছবি এঁকে!
পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে
চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?
তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরি!
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?

শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,
দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,
আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।
মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।
কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।
সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,
ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।
ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি
রোনাজারি ক্ষুধিতের!
ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!
ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।
পাঞ্জেরি!

জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!

 

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি

কাঁচড়াপাড়ায় রাত্রি। ডিপোতলে এঞ্জিল বিকল-
সুদীর্ঘ বিশ্রান্ত শ্বাস ফেলে জাগে ফাটা বয়লার,
– অবরুদ্ধ গতিবেগ। তারপর আসে মিস্ত্রিদল
গলানো ইস্পাত আনে, দৃঢ় অস্ত্র হানে বারবার।
জ্বলন্ত অগ্নির তাপে এইসব যন্ত্র জানোয়ার
দিন রাত্রি ঘোরেফেরে সুদুর্গম দেশে, সমতলে
সমান্তর, রেলে রেলে, সেতুপথে পার হয়ে আর
অভীষ্ট লক্ষ্যের পানে দার্জিলিঙে আসামে জঙ্গলে।

আহত সন্ধ্যায় তারা অবশেষে কাঁচড়াপাড়াতে।
দূরে নাগরিক আশা জ্বলে বালবে লাল-নীল-পীত;
উজ্জ্বীবিত কামনার অগ্নিমোহ-অশান্ত ক্ষুধাতে;
কাঁচড়াপাড়ার কলে মিস্ত্রিদের নারীর সঙ্গীত।
(হাতুড়িও লক্ষ্যভ্রষ্ট) ম্লান চাঁদ কৃষ্ণপক্ষ রাতে
কাঁচড়াপাড়ায় জাগে নারী আর স্বপ্নের ইঙ্গিত।।

 

বর্ষার বিষণ্ন চাঁদ

বর্ষার বিষণ্ন চাঁদ এ রাতেও উঠেছে তেমনি
যেমন সে উঠেছিল হাজার বছর আগেকার
বৃষ্টি-ধোয়া আসমানে। সে রাত্রির অস্ফুটে ব্যথার
মৃদু স্বর আছে এ আকাশে। সেই ক্ষীণ কণ্ঠধ্বনি
আমার মনের তারে বেজে ওঠে আপনা আপনি,
শ্রাবণ মেঘের মাঝে ডুবে যায় চাঁদ যতবার;
যতবার ভেসে ওঠে। দূরে এক অস্পষ্ট মাজার
শতাব্দীর স্মৃতি নিয়ে জাগায় ব্যথার আবেষ্টনী।

হাজার বছর পরে এই চাঁদ বিষণ্ণ বর্ষার
ব’য়ে নিয়ে যাবে স্মৃতি জনপদে বেদনা-মন্থর;
অস্পষ্ট ছায়ার মত, যেখানে এ রাত্রির দুয়ারে,
খুলে দেবে অন্ধকারে জীবনের বিস্মৃত প্রহর;
বৃষ্টি ধোয়া আসমানে জাগাবে সে এই ক্লান্ত স্বর;
হাজার বছর পরে একবার শুধু একবার।।

 

সিলেট ষ্টেশনে একটি শীতের প্রভাত

অন্ধকার আজদাহার বেষ্টনীতে প্রাণী ও প্রাণের
সাড়া নেই। এখানে জালালাবাদে দেখি এসে
হিম-সিক্ত কম্বলের মত রাত্রি ঢেকেছে নিঃশেষে
সমস্ত আলোকরশ্মি পৃথিবীর সকল পথের।
ইরানী ছুরির মত তীক্ষ্মধার হাওয়া উত্তরের
বিদ্ধ হয় অনাবৃত তরু শীর্ষে, নিমেষে নিমেষে
তারি স্পর্শ পাই শূন্য প্লাটফর্মে; মাঘ রাত্রি শেষে
সুপ্তিমগ্ন জনপ্রাণী এখন সিলেট শহরের।

বাতাসের দীর্ঘশ্বাস ঝিল্লিও নীরব, পাখীদের
বাসায় নিঃসাড় ঘুম (মৃত্যু নেমে আসে ছদ্মবেশে
পৌত্তলিক অন্ধকারে), সাড়া নাই মুক্ত জীবনের;
মৌন প্রতীক্ষায় ধরা মর্মরিয়া ওঠে তবু ক্লেশে।
তারপর কি আশ্চর্য দেখি চেয়ে প্রতীক্ষার শেষে
প্রশান্ত প্রভাত নামে স্নিগ্ধোজ্জ্বল হাসি দরবেশের।।

আরো পড়ুন : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি `আল মাহমুদ’