ঢাকা ১০:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বরই ফুল

বরই ফুল
ধ্রুব এষ
তার বেডসাইড টেবিল তিনটা। টেবিল না টুল আসলে। তেপায়া। দেখা যায় না। বইপত্রের ঢিবি হয়ে আছে। আরো নানা কিছু কোনা-কানচিতে। সিগারেটের প্যাকেট, স্টেপলার, চুলের গার্ডার, শুকনা ফুলের মালা, দেশলাইয়ের বাক্স, চিরুনি, মোবাইল ফোনের বিকল চার্জার ইত্যাদি। কাঠের বানানো ছোট বুদ্ধ আছেন একজন। আর আছে একটা নাকফুল। রুপার নাকফুল। বহুদিন ধরে আছে। কার নাকফুল? তার ঘরে কেন? কী করে এল? রহস্য সে উদ্ধার করতে পারে নাই।
একা থাকে সে। আট বছর ধরে। দাম্পত্যজীবনের তিতা এখনো মন থেকে যায় নাই। জটিল একজন মানুষ হিসাবে সে থাকতে পারে নাই আরেকজন আধা জটিল মানুষের সঙ্গে। আধা জটিল নাকফুল পরত না। এখন কি পরে? এই খবরে কোনোই দরকার নাই তার। বাবা রে!
তিন বোনের এক ভাই সে। বিগব্রাদার। তিন বোনই ছোট। আভা, মায়া ও গাজী কালু। আভা মায়া পিঠোপিঠি। আভার দুই মেয়ে। বৃন্তা, ইনকা। মায়ার এক মেয়ে সভ্যতা। বৃন্তা জাপানে থাকে, পড়াশোনা করে। ইনকা পড়ে গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে। সভ্যতা স্কলাসটিকায়। গাজী কালুর ছেলেমেয়ে নাই। বিয়েই করে নাই। বয়সই হয় নাই। বাপ মায়ের শেষ বয়সের জাদু, ভাইয়ের সঙ্গে গাজী কালুর বয়সের ফারাক ছাব্বিশ বছর। গাজী কালু জগন্নাথে পড়ে। চারুকলায়। পুরান ঢাকায় থাকে। সাবলেট। আভা মায়া বলেছিল তাদের সঙ্গে থাকতে কিন্তু গাজী কালু বোনদের বাসায় থাকবে না।
‘দাদার বাসায় থাক তবে।’
‘তোদের কি মাথা খারাপ রে আপ্পান? দাদার সাথে মানুষ থাকে? দেখে শুনে বিয়ে করা বউই থাকে নাই!’
‘তুই তার বোন।’
‘বোন তো কী? এই লোকের সাথে থাকলে তিন দিনে সে আমার হাড় মাস কালা করে ছাড়বে।’
‘তুই এমনিতেই কালা রে মনা।’
‘হ্যাঁ। তোরা সব তো টেলকম পাউডারের ডিব্বা। কালা জগতের ভালা কি না বল?’
‘তা তো অবশ্যই। তা তো অবশ্যই। তোর মতো ভালা কেউ এই পৃথিবীতে নাই। সৌরজগতে নাই।’
‘হ্যাঁ। আমি ভালা, তোরাও ভালা। তবে দাদা একটা… একটা… পুতিনের শালা! হি হি হি!’
সারমর্ম কী?
ভাইয়ের সঙ্গে সব থেকে বেশি ভাব গাজী কালুর। চব্বিশ ঘন্টায় সশরীরে একবার ভাইকে দেখে যাবেই কষ্ট-মষ্ট করে। বিড়ি-সিগারেট টানবে ভাইয়ের সঙ্গে বসে। টাকা নিয়ে যাবে।
‘রিকশা ভাড়া দে দাদা।’
‘কত?’
‘কত তুই জানিস না? ঢং! পাঁচশ টাকা দে।’
‘পাঁচশ টাকা রিকশা ভাড়া?’
‘না, আমার ফি। সেটা কি কোনোদিনই পাঁচ হাজার টাকার কম হয় বল?’
‘পাঁচ হাজার? দুর! দশ হাজার টাকার কম কী করে হয়?’
‘হয় তো। নয় হাজার পাঁচশ টাকা কম হয়। কী করব? তুই হলি একটা গ্রেট ম্যাড ক্যাপ। মহান ফকির। টাকা দে যাই।’
রুপার নাকফুল তিন বোনই দেখেছে। তারা কেউ নাকফুল পরে না। ইনকাকে নিয়ে গাজী কালু তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তদন্ত কমিটির প্রধান ইনকা যাচাই বাছাই করে রিপোর্ট দিয়েছে। মামা এত পুরোনো বই কিনে, কোনো বইতে হয়ত ছিল নাকফুলটা। মোটা কোনো বইয়ের ভেতরে। পড়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্য সমাধান? মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে ইনকা। কিছু মানুষকে বইয়ের পেজমার্কার হিসাবে চুলের কাঁটা, নেইল কাটার, টিপের পাতা, আই লাইনার ব্যবহার করতে দেখা যায়। সেরকম কেউ পেজমার্কার হিসাবে নাকফুল ব্যবহার করতেই পারে। মুশকিল হলো নাকফুলটা ঠিক কোন বইটা থেকে পড়েছে সেটা বের করা মুশকিল। বইয়ের ঢিবি না উইয়ের ঢিবি। হাত দিলে মামা বা দাদা খুন করে ফেলবে।
জুনিয়র মিস পার্পল ইনকা। তার অনুমানই ঠিক হয়ত। কোনো বই থেকে পড়েছে নাকফুলটা।
‘মৌমিতা আন্টি কি নাকফুল পরে মামা?’
‘মৌমিতা? না রে মামা।’
‘নাকফুল পরে তেমন কেউ তবে তোমার বাসায় আসে না বলছো?’
‘চিন্তা করে দেখি একটু।… না।’
কথা হলো নাকফুলটা কেন সরায় না সে? এমনি সরায় না। আছে, থাকুক। তার ঘরের এমন অনেক পদার্থ নিয়েই এ ধরনের একটা ভাব তার আছে। চিরুনিটা যেমন, আছে থাকুক। গার্ডারটা যেমন, আছে থাকুক। সে যেমন, আছে থাকুক। হা হা হা! কী, না, রুপার নাকফুল। সব সময় এটা মাথায় থাকে তার? না। রবিবার দুপুর দুইটায়ও ছিল না। দুইটা আট, নয়-এও ছিল না। আনবিক শক্তি কমিশনে কিছু শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়েছিল সে। কমিশনের জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা ইব্রাহিম আসাদ (শোয়েব) তার বন্ধু। কবি শোয়েব। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রকোষ্ঠে বসে তারা রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিল। দুইটা দশ মিনিটে দুটা মেয়ে আর একটা ছেলে ঢুকল প্রকোষ্ঠে। মেয়েদের একজন চাপা রঙের। গাঢ় সবুজ শাড়ি পরে আছে। মস্ত লাল টিপ। হার্টবিট মিস হলো তার? রুপার নাকফুল পরে আছে মেয়েটা। হুবহু তার ঘরের নাকফুলটার মতো নাকফুল। বিহ্বল হলো সে। শোয়েব অভ্যাগত তিনজনের পরিচয় দিল। কবি তারা। সে কেবল বলতে পারল, ‘অ।’
আনবিক শক্তি কমিশন থেকে সে ঘরে ফিরল দুর্বল, ঘোরগ্রস্থ হয়ে। যদিও এর মানে হয় না। রুপার নাকফুল এক ডিজাইনের কি একটাই বানায়? এত চমকানোর কী আছে তার? চাপা রঙের কবি মেয়েটা কি তার ঘরের নাকফুল নিয়ে গেছে নাকি? দুর!
কিন্তু তার ঘরের নাকফুলটা তো নাই।
সে দেখল যে।

আরো পড়ুন : মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

বরই ফুল

আপডেট সময় ০৬:০৫:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৪

বরই ফুল
ধ্রুব এষ
তার বেডসাইড টেবিল তিনটা। টেবিল না টুল আসলে। তেপায়া। দেখা যায় না। বইপত্রের ঢিবি হয়ে আছে। আরো নানা কিছু কোনা-কানচিতে। সিগারেটের প্যাকেট, স্টেপলার, চুলের গার্ডার, শুকনা ফুলের মালা, দেশলাইয়ের বাক্স, চিরুনি, মোবাইল ফোনের বিকল চার্জার ইত্যাদি। কাঠের বানানো ছোট বুদ্ধ আছেন একজন। আর আছে একটা নাকফুল। রুপার নাকফুল। বহুদিন ধরে আছে। কার নাকফুল? তার ঘরে কেন? কী করে এল? রহস্য সে উদ্ধার করতে পারে নাই।
একা থাকে সে। আট বছর ধরে। দাম্পত্যজীবনের তিতা এখনো মন থেকে যায় নাই। জটিল একজন মানুষ হিসাবে সে থাকতে পারে নাই আরেকজন আধা জটিল মানুষের সঙ্গে। আধা জটিল নাকফুল পরত না। এখন কি পরে? এই খবরে কোনোই দরকার নাই তার। বাবা রে!
তিন বোনের এক ভাই সে। বিগব্রাদার। তিন বোনই ছোট। আভা, মায়া ও গাজী কালু। আভা মায়া পিঠোপিঠি। আভার দুই মেয়ে। বৃন্তা, ইনকা। মায়ার এক মেয়ে সভ্যতা। বৃন্তা জাপানে থাকে, পড়াশোনা করে। ইনকা পড়ে গ্রীন হেরাল্ড স্কুলে। সভ্যতা স্কলাসটিকায়। গাজী কালুর ছেলেমেয়ে নাই। বিয়েই করে নাই। বয়সই হয় নাই। বাপ মায়ের শেষ বয়সের জাদু, ভাইয়ের সঙ্গে গাজী কালুর বয়সের ফারাক ছাব্বিশ বছর। গাজী কালু জগন্নাথে পড়ে। চারুকলায়। পুরান ঢাকায় থাকে। সাবলেট। আভা মায়া বলেছিল তাদের সঙ্গে থাকতে কিন্তু গাজী কালু বোনদের বাসায় থাকবে না।
‘দাদার বাসায় থাক তবে।’
‘তোদের কি মাথা খারাপ রে আপ্পান? দাদার সাথে মানুষ থাকে? দেখে শুনে বিয়ে করা বউই থাকে নাই!’
‘তুই তার বোন।’
‘বোন তো কী? এই লোকের সাথে থাকলে তিন দিনে সে আমার হাড় মাস কালা করে ছাড়বে।’
‘তুই এমনিতেই কালা রে মনা।’
‘হ্যাঁ। তোরা সব তো টেলকম পাউডারের ডিব্বা। কালা জগতের ভালা কি না বল?’
‘তা তো অবশ্যই। তা তো অবশ্যই। তোর মতো ভালা কেউ এই পৃথিবীতে নাই। সৌরজগতে নাই।’
‘হ্যাঁ। আমি ভালা, তোরাও ভালা। তবে দাদা একটা… একটা… পুতিনের শালা! হি হি হি!’
সারমর্ম কী?
ভাইয়ের সঙ্গে সব থেকে বেশি ভাব গাজী কালুর। চব্বিশ ঘন্টায় সশরীরে একবার ভাইকে দেখে যাবেই কষ্ট-মষ্ট করে। বিড়ি-সিগারেট টানবে ভাইয়ের সঙ্গে বসে। টাকা নিয়ে যাবে।
‘রিকশা ভাড়া দে দাদা।’
‘কত?’
‘কত তুই জানিস না? ঢং! পাঁচশ টাকা দে।’
‘পাঁচশ টাকা রিকশা ভাড়া?’
‘না, আমার ফি। সেটা কি কোনোদিনই পাঁচ হাজার টাকার কম হয় বল?’
‘পাঁচ হাজার? দুর! দশ হাজার টাকার কম কী করে হয়?’
‘হয় তো। নয় হাজার পাঁচশ টাকা কম হয়। কী করব? তুই হলি একটা গ্রেট ম্যাড ক্যাপ। মহান ফকির। টাকা দে যাই।’
রুপার নাকফুল তিন বোনই দেখেছে। তারা কেউ নাকফুল পরে না। ইনকাকে নিয়ে গাজী কালু তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তদন্ত কমিটির প্রধান ইনকা যাচাই বাছাই করে রিপোর্ট দিয়েছে। মামা এত পুরোনো বই কিনে, কোনো বইতে হয়ত ছিল নাকফুলটা। মোটা কোনো বইয়ের ভেতরে। পড়ে গেছে। বিশ্বাসযোগ্য সমাধান? মানুষের বিচিত্র স্বভাব নিয়ে গবেষণা করে দেখেছে ইনকা। কিছু মানুষকে বইয়ের পেজমার্কার হিসাবে চুলের কাঁটা, নেইল কাটার, টিপের পাতা, আই লাইনার ব্যবহার করতে দেখা যায়। সেরকম কেউ পেজমার্কার হিসাবে নাকফুল ব্যবহার করতেই পারে। মুশকিল হলো নাকফুলটা ঠিক কোন বইটা থেকে পড়েছে সেটা বের করা মুশকিল। বইয়ের ঢিবি না উইয়ের ঢিবি। হাত দিলে মামা বা দাদা খুন করে ফেলবে।
জুনিয়র মিস পার্পল ইনকা। তার অনুমানই ঠিক হয়ত। কোনো বই থেকে পড়েছে নাকফুলটা।
‘মৌমিতা আন্টি কি নাকফুল পরে মামা?’
‘মৌমিতা? না রে মামা।’
‘নাকফুল পরে তেমন কেউ তবে তোমার বাসায় আসে না বলছো?’
‘চিন্তা করে দেখি একটু।… না।’
কথা হলো নাকফুলটা কেন সরায় না সে? এমনি সরায় না। আছে, থাকুক। তার ঘরের এমন অনেক পদার্থ নিয়েই এ ধরনের একটা ভাব তার আছে। চিরুনিটা যেমন, আছে থাকুক। গার্ডারটা যেমন, আছে থাকুক। সে যেমন, আছে থাকুক। হা হা হা! কী, না, রুপার নাকফুল। সব সময় এটা মাথায় থাকে তার? না। রবিবার দুপুর দুইটায়ও ছিল না। দুইটা আট, নয়-এও ছিল না। আনবিক শক্তি কমিশনে কিছু শক্তি সঞ্চয় করতে গিয়েছিল সে। কমিশনের জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা ইব্রাহিম আসাদ (শোয়েব) তার বন্ধু। কবি শোয়েব। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রকোষ্ঠে বসে তারা রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিল। দুইটা দশ মিনিটে দুটা মেয়ে আর একটা ছেলে ঢুকল প্রকোষ্ঠে। মেয়েদের একজন চাপা রঙের। গাঢ় সবুজ শাড়ি পরে আছে। মস্ত লাল টিপ। হার্টবিট মিস হলো তার? রুপার নাকফুল পরে আছে মেয়েটা। হুবহু তার ঘরের নাকফুলটার মতো নাকফুল। বিহ্বল হলো সে। শোয়েব অভ্যাগত তিনজনের পরিচয় দিল। কবি তারা। সে কেবল বলতে পারল, ‘অ।’
আনবিক শক্তি কমিশন থেকে সে ঘরে ফিরল দুর্বল, ঘোরগ্রস্থ হয়ে। যদিও এর মানে হয় না। রুপার নাকফুল এক ডিজাইনের কি একটাই বানায়? এত চমকানোর কী আছে তার? চাপা রঙের কবি মেয়েটা কি তার ঘরের নাকফুল নিয়ে গেছে নাকি? দুর!
কিন্তু তার ঘরের নাকফুলটা তো নাই।
সে দেখল যে।

আরো পড়ুন : মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ