ঢাকা ০৯:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!

শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!
জামিউর রহমান লেমন:
আমি তখন শহীদুল্লাহ্ হলের মেইন বিল্ডিং এ থাকি। ৩০১১ তে বজলু ভাইয়ের রুমে ডাবলিং করি। পাশের রুমেই ডাবলিং করে অসিম ভাইয়ের সাথে থাকে কবি কাসেদুজ্জামান সেলিম। আমি খুলনার সে যশোরের। দুজনেই গান বাজনা লেখালেখি করি। তাই সহজেই সখ্যতা গড়ে ওঠে।
অবসরে সেলিম টেবিল বাজায় আমি গান করি। কিশোর কুমার মান্না দে থেকে শুরু করে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত সব গানগুলি। তখনো সেভাবে প্রেম আমার জীবনে আসেনি। দু’একজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হলেও সেটা ছিল নিছক বন্ধুত্বের। আর তাছাড়া তখন আমার হ্যাংলা পাতলা শরীর চেহারা কাউকেই তেমন আকৃষ্ট করতো না। আমার সেই যুবক বেলা থেকেই ছিল একটু নেওটা স্বভাব। সবকিছুতেই সবার সঙ্গে আদিক্ষেতা বেশি দেখানো। একটু গায় পড়া স্বভাবের। এতে করে কাছের ও পাশের অনেকেই আমাকে ভুল বুঝতো। না জানি কি হচ্ছে। এমনি এখনো ভাবে নিকটজন আপনজন সবাই।
সেলিম ও আমি প্রায় সুযোগ পেলেই শহীদুল্লাহ হলের মেইন বিল্ডিং এর ছাদে লোহার ভয়ংঙ্কর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম। ছাদে বসে গল্প করতে করতে রাত কেটে যেতো। গল্পের অধিকাংশ বিষয় ছিল স্বপ্ন। কি করবো কি হবো, হাতি ঘোড়া মারবো ইত্যাদি। অনেক দিন এভাবে গল্প গান কবিতা করতে করতে ছাদেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরে ঘুম ভাঙতো হল মসজিদের ইমামের আজান শুনে। তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেও গা ছম ছম করতো। মনে হতো আমরা নবাব আমলের কোন দূর্গের বন্দি।
আশির দশকে ঢাকা শহরে তেমন একটা কোলাহল ছিল না। গাড়ি ঘোড়ার শব্দ খুব একটা নেই বললেই চলে। তার উপরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভোরের নির্জনতা।
এখানে বলে নেয়া ভাল যে, দিনাজপুরের কসবায় হাবিব নামে আমার এক বন্ধু ছিল। বয়সে আমার দু’এক বছরের ছোট হবে। ছোট বয়স থেকে হাবিব সাহিত্য ও সামাজিক কাজে খুবই দক্ষ ও উৎসাহী ছিল। ভাল একটা সামাজিক সংগঠন করার স্বপ্ন ছিল তার। দিনাজপুর শেরেবাংলা ক্লাবের বহু অনুষ্ঠানে আমি হাবিব দুলাল একসাথে অংশ নিয়েছি। মনে পড়ে জীবনে বাড়ির বাইরে কোন পিকনিকে প্রথম অংশ নেয়াটাও ছিল দুলাল হাবিবের সাথে। হাবিবের খুব সখ ছিল র‌্যালী সাইকেল চালানোর। আমারও ছিল। সেই ইচ্ছায় বন্ধু সুজা’র সাইকেলে আমার সাইকেল চালানোয় হাতেখড়ি। রাস্তার পাশের ড্রেনে আছাড় খেয়ে, হাত পা ছিলে মায়ের ধমক উপেক্ষা করে শিখেছিলাম দুচাকার সখের ঐ বাহনটি। আমি দুলাল ও হাবিব মাঝে মধ্যে দিনাজপুর বড় মাঠের হেলিপ্যাডে পালা করে সাইকেল চালাতাম। ভালই লাগতো। সখের বসে জুনিয়ার বক্সিং এ প্রায় বছর খানেক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম বডি বিল্ডার আজিজ ভাইয়ের কাছ থেকে। এক শোতে পরাজিত হয়ে প্রায় অসুস্থ যখন, তখন এই হাবিবই আমায় বলেছিল, ভাই এটা আপনার জন্য নয়। মাথাটার যত্ন করেন। বক্সিং এ মাথা যন্ত্রটার বিপত্তি ঘটতে পারে। সেই থেকে বক্সিং এর ইতি। নতুন নেশা টেবিল টেনিস। হাবিব শাহীন এরা ছিল আমার খেলার পার্টনার। মনে পড়ে জেলা পর্যায়ের চুড়ান্ত খেলায়ও আমি অংশ নিয়েছিলাম।
হলের ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ করে মেইন গেইটের দিকে আমার নজর যায়। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, বন্ধু সুজার সেই লাল সাইকেলটি নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হাবিব। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে এটি বন্ধু আহমেদের সাইকেল। যে সাইকেলটি নিয়ে আমি বহুবার হল থেকে আজিমপুর সুইপার কলোনীর প্রায় কাছে আহমেদের বাসায় যাতায়াত করেছি। আমি সেলিমকে বললাম, দোস্ত দেখতো এই সকালে গেটে কে দাঁড়িয়ে আছে? ভাল করে দেখে সেলিম বললো, কই কেউ নারে বাবা। চলো হাতমুখ ধুয়ে চানখারপুলে চা বিস্কুট খেয়ে আসি। পরের দিন আমার ক্লাস ছিল ড. শাহজাহানের, সম্ভবত প্যাথোলজি। বিষয়টা দুর্বোধ্য। কিছুই বুঝিনা। মাঝে মধ্যে রোজী আপার উপর রাগ হতো। কেন যে এখানে ভর্তি হতে বাধ্য করলো আমাকে। দুর্বোধ্য বিষয় এই কারণে বলছি যে, তখন আমার পড়াশোনায় খুব একটা মন বসতো না। ক্যাম্পাসের পলিটিক্স, কাদের-চুনু প্যানেল, গান-বাজনা লেখালেখির পোকা মাথায় গিজ গিজ করতো। সিরিয়াসলি পড়বো সে সময়টা কোথায়। তবে সব সময় মনে পড়তো, আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে, ভাইস চ্যান্সলার ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীর একটি কথা, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটি ভর্তি হতে পারে তাকে একটা গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট দেয়া যায়।” স্যারের কথাটা বাস্তবে রুপ নিয়েছে আমার জীবনে। আমি চেয়েছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে, পড়াশুনা একটি বিষয় তবে জীবনের জন্য সেটি এক্কেবারেই মূখ্য নয়। একরকম হেসে খেলেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেছি আমি।
আমরা ছাদ থেকে নামতে যাবো, হঠাৎ সেলিম বললো, দাঁড়া! দাঁড়া! তুইতো ঠিকই বলেছিস! কে যেন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমার কানে বাজছে সাইকেলের বেলের শব্দ। আমি দেখলাম হাবিব দাঁড়িয়ে স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে। কিন্তু কি করে সম্ভব! ঢাকা আসতে তো নগরবাড়ি, আরিচা দুটো ফেরী পেরুতে হয়। সাইকেল নিয়ে ও কিভাবে আসবে। চোখটা ঘষে নিয়ে বার বার দেখতে চেষ্টা করলাম।
ঐদিন সকালে প্যাথোলজি ক্লাস শেষে হলে ফিরে দেখি আব্বার চিঠি। আমি পেনশনের কাজে ঢাকা আসছি। তোমার ওখানে আসবো। আব্বাকে বাংলামোটর থেকে রিসিভ করে সোজা আমার হলের রুমে। বজলু ভাই তখন কি একটা কাজে দেশে গেছেন। আব্বাকে বললাম, হোটেলে থেকে কি করবেন? আমার হলেই থাকেন। দুইটা দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে, রাতেতো খালি ঘুমানো।
কিছুটা ফ্রেশ হয়ে হলের মসজিদে নামাজ সেরে আব্বা ও আমি হাঁটতে হাঁটতে চানখার পুলে গিয়ে পরাটা ও মাংস খেতে খেতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। আব্বা বললেন, কাল সকালে রোজীর হলে যাবো। আমি বললাম, সকালেতো তার ক্লাস বিকেলে যাবো, টিএসসিতে খাবো আমার টাকায়। আব্বা বললেন, মানে। আমি বললাম, বেতারের বর্হিঃবিশ্ব কার্যক্রমে অনুষ্ঠান করছি। পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি। আব্বা বললেন, কি বলিস! হলে ফিরে আমার ছোট বেডে আব্বা শুয়েই সারাদিন জার্নির ধকলে ঘুমিয়ে পড়লেন। বহুদিন পর তাকে কাছে পেয়ে তার বুকের সান্নিধ্য পেতে খুব ইচ্ছে হলো। পারলাম না, যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সকালে উঠে হলের ক্যান্টিনে নাস্তা সেরে দুজন মিলে বাসাবোতে মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসারের বাসায় গেলাম। সেখান থেকে সচিবালয়ে। তারপর বিকেলে শামসুন্নাহার হলের সামনে। আমরা শামসুন্নাহার হলের গেটে সিøপ পাঠিয়ে রোজী আপার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আব্বা বললেন, জানিস বাবু, দিনাজপুর গিয়েছিলাম, আমার ঐ মিথ্যে কেসটার রায় হয়েছে। আমি জিতেছি। সোজা পথে থাকলে কিছু কষ্ট আসতে পারে তবে তার বিচার আছে, সত্যের জয় হয়ই। আব্বার মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর কষ্টের দিনগুলির কথা এক নিমিষে আমি ভুলে গেলাম। আব্বা বললেন, আর একটা খারাপ খবর আছে। ঐ যে কসবার মুজিবরের ভাই হাবিব না হবিবর, সে নাকি ফাঁসি দিয়ে মারা গেছে, তুই কিছু জানিস। তোর সাথে তো সখ্যতা ছিল।
আমি তো অবাক, কি শুনলাম আমি। হাবিবের সাথে যোগাযোগ নেই সেই দীর্ঘদিন দিনাজপুর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসার পর। তাহলে! গত সকালের ঘটনাটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো আবার। হলের ছাদ থেকে হাবিবকেইতো আমি দেখেছি! রোজী আপা এসেই স্বভাব সুলভ হেসে বললেন, তোমাদের জন্য রুম থেকে হালুয়া রান্না করে এনেছি।

আরও পড়ুন : অলৌকিক! সাদা ছায়ামূর্তিটা পানির মধ্যে ডুব দিলো!

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!

আপডেট সময় ০৯:৫৪:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ মার্চ ২০২৪

শহীদুল্লাহ্ হলের ছাদ থেকে দেখতে পেলাম হাবিবকে!
জামিউর রহমান লেমন:
আমি তখন শহীদুল্লাহ্ হলের মেইন বিল্ডিং এ থাকি। ৩০১১ তে বজলু ভাইয়ের রুমে ডাবলিং করি। পাশের রুমেই ডাবলিং করে অসিম ভাইয়ের সাথে থাকে কবি কাসেদুজ্জামান সেলিম। আমি খুলনার সে যশোরের। দুজনেই গান বাজনা লেখালেখি করি। তাই সহজেই সখ্যতা গড়ে ওঠে।
অবসরে সেলিম টেবিল বাজায় আমি গান করি। কিশোর কুমার মান্না দে থেকে শুরু করে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বিখ্যাত সব গানগুলি। তখনো সেভাবে প্রেম আমার জীবনে আসেনি। দু’একজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হলেও সেটা ছিল নিছক বন্ধুত্বের। আর তাছাড়া তখন আমার হ্যাংলা পাতলা শরীর চেহারা কাউকেই তেমন আকৃষ্ট করতো না। আমার সেই যুবক বেলা থেকেই ছিল একটু নেওটা স্বভাব। সবকিছুতেই সবার সঙ্গে আদিক্ষেতা বেশি দেখানো। একটু গায় পড়া স্বভাবের। এতে করে কাছের ও পাশের অনেকেই আমাকে ভুল বুঝতো। না জানি কি হচ্ছে। এমনি এখনো ভাবে নিকটজন আপনজন সবাই।
সেলিম ও আমি প্রায় সুযোগ পেলেই শহীদুল্লাহ হলের মেইন বিল্ডিং এর ছাদে লোহার ভয়ংঙ্কর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতাম। ছাদে বসে গল্প করতে করতে রাত কেটে যেতো। গল্পের অধিকাংশ বিষয় ছিল স্বপ্ন। কি করবো কি হবো, হাতি ঘোড়া মারবো ইত্যাদি। অনেক দিন এভাবে গল্প গান কবিতা করতে করতে ছাদেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরে ঘুম ভাঙতো হল মসজিদের ইমামের আজান শুনে। তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেও গা ছম ছম করতো। মনে হতো আমরা নবাব আমলের কোন দূর্গের বন্দি।
আশির দশকে ঢাকা শহরে তেমন একটা কোলাহল ছিল না। গাড়ি ঘোড়ার শব্দ খুব একটা নেই বললেই চলে। তার উপরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভোরের নির্জনতা।
এখানে বলে নেয়া ভাল যে, দিনাজপুরের কসবায় হাবিব নামে আমার এক বন্ধু ছিল। বয়সে আমার দু’এক বছরের ছোট হবে। ছোট বয়স থেকে হাবিব সাহিত্য ও সামাজিক কাজে খুবই দক্ষ ও উৎসাহী ছিল। ভাল একটা সামাজিক সংগঠন করার স্বপ্ন ছিল তার। দিনাজপুর শেরেবাংলা ক্লাবের বহু অনুষ্ঠানে আমি হাবিব দুলাল একসাথে অংশ নিয়েছি। মনে পড়ে জীবনে বাড়ির বাইরে কোন পিকনিকে প্রথম অংশ নেয়াটাও ছিল দুলাল হাবিবের সাথে। হাবিবের খুব সখ ছিল র‌্যালী সাইকেল চালানোর। আমারও ছিল। সেই ইচ্ছায় বন্ধু সুজা’র সাইকেলে আমার সাইকেল চালানোয় হাতেখড়ি। রাস্তার পাশের ড্রেনে আছাড় খেয়ে, হাত পা ছিলে মায়ের ধমক উপেক্ষা করে শিখেছিলাম দুচাকার সখের ঐ বাহনটি। আমি দুলাল ও হাবিব মাঝে মধ্যে দিনাজপুর বড় মাঠের হেলিপ্যাডে পালা করে সাইকেল চালাতাম। ভালই লাগতো। সখের বসে জুনিয়ার বক্সিং এ প্রায় বছর খানেক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম বডি বিল্ডার আজিজ ভাইয়ের কাছ থেকে। এক শোতে পরাজিত হয়ে প্রায় অসুস্থ যখন, তখন এই হাবিবই আমায় বলেছিল, ভাই এটা আপনার জন্য নয়। মাথাটার যত্ন করেন। বক্সিং এ মাথা যন্ত্রটার বিপত্তি ঘটতে পারে। সেই থেকে বক্সিং এর ইতি। নতুন নেশা টেবিল টেনিস। হাবিব শাহীন এরা ছিল আমার খেলার পার্টনার। মনে পড়ে জেলা পর্যায়ের চুড়ান্ত খেলায়ও আমি অংশ নিয়েছিলাম।
হলের ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ করে মেইন গেইটের দিকে আমার নজর যায়। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে, বন্ধু সুজার সেই লাল সাইকেলটি নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হাবিব। মাঝে মধ্যে মনে হয়েছে এটি বন্ধু আহমেদের সাইকেল। যে সাইকেলটি নিয়ে আমি বহুবার হল থেকে আজিমপুর সুইপার কলোনীর প্রায় কাছে আহমেদের বাসায় যাতায়াত করেছি। আমি সেলিমকে বললাম, দোস্ত দেখতো এই সকালে গেটে কে দাঁড়িয়ে আছে? ভাল করে দেখে সেলিম বললো, কই কেউ নারে বাবা। চলো হাতমুখ ধুয়ে চানখারপুলে চা বিস্কুট খেয়ে আসি। পরের দিন আমার ক্লাস ছিল ড. শাহজাহানের, সম্ভবত প্যাথোলজি। বিষয়টা দুর্বোধ্য। কিছুই বুঝিনা। মাঝে মধ্যে রোজী আপার উপর রাগ হতো। কেন যে এখানে ভর্তি হতে বাধ্য করলো আমাকে। দুর্বোধ্য বিষয় এই কারণে বলছি যে, তখন আমার পড়াশোনায় খুব একটা মন বসতো না। ক্যাম্পাসের পলিটিক্স, কাদের-চুনু প্যানেল, গান-বাজনা লেখালেখির পোকা মাথায় গিজ গিজ করতো। সিরিয়াসলি পড়বো সে সময়টা কোথায়। তবে সব সময় মনে পড়তো, আমাদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে, ভাইস চ্যান্সলার ড. ফজলুল হালিম চৌধুরীর একটি কথা, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছেলেটি ভর্তি হতে পারে তাকে একটা গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট দেয়া যায়।” স্যারের কথাটা বাস্তবে রুপ নিয়েছে আমার জীবনে। আমি চেয়েছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে, পড়াশুনা একটি বিষয় তবে জীবনের জন্য সেটি এক্কেবারেই মূখ্য নয়। একরকম হেসে খেলেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেছি আমি।
আমরা ছাদ থেকে নামতে যাবো, হঠাৎ সেলিম বললো, দাঁড়া! দাঁড়া! তুইতো ঠিকই বলেছিস! কে যেন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমার কানে বাজছে সাইকেলের বেলের শব্দ। আমি দেখলাম হাবিব দাঁড়িয়ে স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে। কিন্তু কি করে সম্ভব! ঢাকা আসতে তো নগরবাড়ি, আরিচা দুটো ফেরী পেরুতে হয়। সাইকেল নিয়ে ও কিভাবে আসবে। চোখটা ঘষে নিয়ে বার বার দেখতে চেষ্টা করলাম।
ঐদিন সকালে প্যাথোলজি ক্লাস শেষে হলে ফিরে দেখি আব্বার চিঠি। আমি পেনশনের কাজে ঢাকা আসছি। তোমার ওখানে আসবো। আব্বাকে বাংলামোটর থেকে রিসিভ করে সোজা আমার হলের রুমে। বজলু ভাই তখন কি একটা কাজে দেশে গেছেন। আব্বাকে বললাম, হোটেলে থেকে কি করবেন? আমার হলেই থাকেন। দুইটা দিন দেখতে দেখতে চলে যাবে, রাতেতো খালি ঘুমানো।
কিছুটা ফ্রেশ হয়ে হলের মসজিদে নামাজ সেরে আব্বা ও আমি হাঁটতে হাঁটতে চানখার পুলে গিয়ে পরাটা ও মাংস খেতে খেতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। আব্বা বললেন, কাল সকালে রোজীর হলে যাবো। আমি বললাম, সকালেতো তার ক্লাস বিকেলে যাবো, টিএসসিতে খাবো আমার টাকায়। আব্বা বললেন, মানে। আমি বললাম, বেতারের বর্হিঃবিশ্ব কার্যক্রমে অনুষ্ঠান করছি। পঞ্চাশ টাকা পেয়েছি। আব্বা বললেন, কি বলিস! হলে ফিরে আমার ছোট বেডে আব্বা শুয়েই সারাদিন জার্নির ধকলে ঘুমিয়ে পড়লেন। বহুদিন পর তাকে কাছে পেয়ে তার বুকের সান্নিধ্য পেতে খুব ইচ্ছে হলো। পারলাম না, যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সকালে উঠে হলের ক্যান্টিনে নাস্তা সেরে দুজন মিলে বাসাবোতে মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসারের বাসায় গেলাম। সেখান থেকে সচিবালয়ে। তারপর বিকেলে শামসুন্নাহার হলের সামনে। আমরা শামসুন্নাহার হলের গেটে সিøপ পাঠিয়ে রোজী আপার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ আব্বা বললেন, জানিস বাবু, দিনাজপুর গিয়েছিলাম, আমার ঐ মিথ্যে কেসটার রায় হয়েছে। আমি জিতেছি। সোজা পথে থাকলে কিছু কষ্ট আসতে পারে তবে তার বিচার আছে, সত্যের জয় হয়ই। আব্বার মুখ থেকে এই কথাটা শোনার পর কষ্টের দিনগুলির কথা এক নিমিষে আমি ভুলে গেলাম। আব্বা বললেন, আর একটা খারাপ খবর আছে। ঐ যে কসবার মুজিবরের ভাই হাবিব না হবিবর, সে নাকি ফাঁসি দিয়ে মারা গেছে, তুই কিছু জানিস। তোর সাথে তো সখ্যতা ছিল।
আমি তো অবাক, কি শুনলাম আমি। হাবিবের সাথে যোগাযোগ নেই সেই দীর্ঘদিন দিনাজপুর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসার পর। তাহলে! গত সকালের ঘটনাটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো আবার। হলের ছাদ থেকে হাবিবকেইতো আমি দেখেছি! রোজী আপা এসেই স্বভাব সুলভ হেসে বললেন, তোমাদের জন্য রুম থেকে হালুয়া রান্না করে এনেছি।

আরও পড়ুন : অলৌকিক! সাদা ছায়ামূর্তিটা পানির মধ্যে ডুব দিলো!