ঢাকা ১০:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (৭ই মার্চ ১৯৫০-২৩শে মে ২০১৬)

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের জন্ম ৭ই মার্চ। ১৯৫০ সালের এদিনে দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নিশ্শা পলাশবাড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস একই জেলার বিরামপুর উপজেলার শিমুলতলী গ্রাম। তাঁর পিতা মফিজউদ্দিন মন্ডল এবং মাতা শামসুজ্জোহরা। তিনি ছিলেন জন্মজাত যুগশ্রেষ্ঠ অলি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সূফিবাদী কবি, সুসাহিত্যিক, দার্শনিক, অনুবাদক ও সম্পাদক।
শিক্ষাজীবনে তিনি ১৯৬৫ বিরামপুর পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে রাজধানী ঢাকার কায়েদ আজম কলেজ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের অধীন আর্টিলারি বাহিনির হয়ে সশস্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি দিনাজপুর সীমান্ত সংলগ্ন বড়াহার ক্যাম্পে থাকতেন। তিনি অনেক সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে পর পেশাদারিত্বের সাথে সংযুক্ত হন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তাঁর লেখা অনেক নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটক লেখার পাশাপাশি তিনি নাটকের নির্দেশনাও দিতেন। এ সময় তাঁর লেখা বেশ কিছু গান বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়।
১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ সাতক্ষীরার তৎকালীন প্রখ্যাত পীর হজরত হাকিম আবদুল হাকিম (র.) কাছে খাস মোজাদ্দেদিয়া তরিকার বায়াত গ্রহণ করেন। এর পর তিনি ভুলে যান দুনিয়ার মোহ-মায়া-মমতা। প্রিয় মোর্শেদের দেখানো পথে খোঁজেন মহান আল্লাহ্র নৈকট্য। কঠিন রিয়াজতের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে যান আধ্যাত্মিক জগতের অনন্য উচ্চতায়। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অডিট ডিপার্টমেন্টের পদস্থ কর্মকর্তা।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ তরিকার প্রচার প্রসারে মহফিলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন সাহিত্যের প্রতি। দেশ বিদেশের কবি সাহিত্যিকদের কাছে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়ে ওঠে একজন অনন্য সাধারণ সূফি কবি হিসেবে। যাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে আল্লাহ্ প্রেম, রসুলের প্রেম, ইসলামের প্রেম এবং আধ্যাতিকতা। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। গ্রন্থগুলো হলো- (১) সোনার শিকল, (২) ভেঙে পড়ে বাতাসের সিঁড়ি, (৩) বিশ্বাসের বৃষ্টি চিহ্ন, (৪) নীড়ে তার নীল ঢেউ, (৫) সীমান্ত প্রহরী সব সরে যাও, (৬) ধীর সুর বিলম্বিত ব্যথা এবং (৭) তৃষিত তিথির অতিথি।
তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে, ‘তুমি তো মোর্শেদ মহান’, ‘নকশায়ে নকশবন্দ’, ‘চেরাগে চিশতি’, ‘জীলান সূর্যের হাতছানি’, ‘বায়ানুল বাকী’, ‘কালিয়ারের কুতুব’, ‘প্রথম পরিবার’, ‘মহাপ্রেমিক মুসা’, ‘জননীদের জীবনকথা’, ‘সিদ্দীকশ্রেষ্ঠ’, ‘আল্লাহ্র জিকির’, ‘ইসলামী বিশ্বাস’, ‘অগ্নি ও উদ্যানের সংবাদ’, ‘নামাজ শিক্ষা’, ‘রমজান মাস’, ‘আমন্ত্রণ পরিশুদ্ধতার প্রতি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাজ হলো তাফসীরে মাযহারীর অনুবাদ। তিনি মুরিদদের দিয়ে বার খণ্ডের গ্রন্থগুলো অনুবাদ করিয়ে নিজে পুর্নলিখন ও সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে এই মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বের সাথে চর্চা ও অধ্যায়ন করা হয়। এছাড়া তিনি বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ প্রিয় মুরিদদের দিয়ে বাংলায় অনুবাদ করান এবং নিজে সম্পাদনা করেন। এগুলোর মধ্যে ‘মাদারেজুন্ নবুওয়াত (আট খণ্ড)’, ‘মালাবুদ্দা মিনহু’, ‘মাক্বামাতে মাযহারী’, ‘মুকাশিফাতে আয়নিয়া’, ‘মাব্দা ওয়া মা’আদ’, মাআরিফে লাদুন্নিয়া’, ‘মকতুবাতে মাসুমীয়া’, ‘হাজ্রাতুল কুদুস’ উল্লেখযোগ্য।
মামুনুর রশীদের জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে অধ্যায়নের মাধ্যমে। তিনি জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানে বিজ্ঞ ছিলেন। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি বুৎপত্তি অর্জন করেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি, ফারসি ও খেমার ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিলো অসাধারণ।
হজরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ২০০২ সালে ইসলামের শাশ্বত দাওয়াতের পবিত্রতম ব্রত নিয়ে সস্ত্রীক কম্বোডিয়া হিজরত করেন। তরিকার প্রচার প্রসারে তিনি সফর করেন ভারত, ভূটান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন, হংকং, লাওস, সুইডেন, ইংল্যান্ড, স্পেন, সৌদি আরব, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, উজবেকিস্থান ও ইতালি।
মহান এই সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ২০১৬ সালের ২৩শে মে, ১৪ই শাবান, ১৪৩৭ হিজরী, সোমবার কলিকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। (্ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁকে জন্মস্থান দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলায় নিজ গ্রামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের একগুচ্ছ কবিতা
অন্য গোলাপ

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
অনেক কাঁটার কৃষ্ণ প্রাতে অন্ধ রাতে
ঝড় তুফানে বৈরী বাগান বিরান হ’লে
আমার তবে কোন্ ভাবনা কোন্ ভাবনা?

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
জীবন থেকে জীবন পেলে মৃত্যু কোথায়?
জীবন থেকে জবান পেলে জমিন জুড়ে
হাজার কুসুম দল মেলে দ্যায় ঝড় তুফানে।

দূর সফরের সামান আছে আশাও আছে
সওয়াল জবাব জানাই আছে হিসেব মতো
অনেক আঁধার চিরে চিরে এই হৃদয়
জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ।

আমার গোলাপ অন্য গোলাপ, বিশ^াসী বুক
কালের কালোয় আঁধার আলোয় হয় না বিলীন
মৃত্যু জীবন কাল মহাকাল সব আঁধারে
সফল সুখের গন্ধ ছড়ায় অন্য গোলাপ।

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
অনেক রাতের গভীর যামের অনেক রোদন
তুফান তিমির দুঃখ বিপদ আসেই যদি
আমার তবে কোন্ ভাবনা কোন ভাব্না।

জন্ম

অনলিত অন্তরের তলে
কথালতা চলে, দোলে, জ¦লে
ব’য়ে চলে য্যানো এক অলৌকিক নদীর ধারায়
জলজাত ঢেউ জাগে, জেগে উঠে আবার হারায়
স্রোতাঘাতে ভেঙে যায় বার বার হৃদয়ে পাড়
ঋতুবদলের পথে আসে যায় শুধুই আষাঢ়
দু’পালে দেয়াল দেয়া সংসারিক সুখের স্বকাল
বিরুদ্ধ জোয়ারে ঝড়ে ওড়ে লাল জীবনের পাল
উজান ভাটার মতো নিয়মিত রজনী প্রভাত
অবিবেকী অন্তর একই সাথে করে আত্মসাৎ
গতি যতির মতো ব্যতিক্রমী সৃজনের ক্ষণ
প্রকৃত সঞ্চয় জেনে সযতনে জমা রাখে মন
রোদনের মতো কিছু শব্দমালা পড়ে ধীরে ঝ’রে
অতলান্ত মনাধারে ক্রমে ক্রমে কিছু কিছু ক’রে
তবু মন তৃপ্তিহীন সারাক্ষণ যাবজ্জীবন
এভাড়েই ভ’রে ওঠে চেতনার গৃহাঙ্গন, বন…

অনলিত অন্তরের তলে
কথা ব্যথা জ¦লে, নেভে, জ¦লে
সে ব্যথার দাবদাহে জন্ম নেয় যখন জীবন
কাগজের পৃষ্ঠা জুড়ে জেগে ওঠে কবির স্বজন।

 

রোদনের প্রতিচিত্র

কোথায় জীবন য্যানো দৃশ্যমান নয় তার মূল
বেনামি উজান থেকে নেমে আসে তপ্ত স্রোতধারা
বৃন্ত-আধারের আগে কোথায় প্রথম ফোটে ফুল
আকারবিহীন মনে শব্দহীন শব্দ আনে সাড়া?

কোন সূচনায় সুখ অসুখর মতোন সমান
মৌনমুখী মগ্নতার অবিনাশী মুখবন্ধ হয়
চৈতন্যের পাড় ভেঙে নিয়ে আসে অন্ধ অভিমান
কালের কপোলে করে শব্দীর অশ্রু অপচয়?

নয়নের নদীতটে নিসর্গের নিরন্তর স্রোত
রোদনের মতো আঁকে জীবনের বিচিত্রিত রূপ
বিদগ্ধ রীতিতে ঋদ্ধ যে রাখে নেতৃত্ব কোনোমতে
সে জ¦লে কথার মূলে মর্মগন্ধী চেতনার ধূপ।

সীমানাবিহীন পথে শুরু হয় রোদন রোদন
দিকের দেয়াল দিয়ে সে ছবি কী ঢেকে রাখা যায়?
অচিন অয়নে তার চিহ্নহীন অবাক বদন
জ¦লে নিত্য নিরন্তর অন্তরের আলৌকিকতায়।

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ (৭ই মার্চ ১৯৫০-২৩শে মে ২০১৬)

আপডেট সময় ০১:০১:৫৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ ২০২৪

মাহমুদুন্নবী জ্যোতি
সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের জন্ম ৭ই মার্চ। ১৯৫০ সালের এদিনে দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার নিশ্শা পলাশবাড়ি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতৃনিবাস একই জেলার বিরামপুর উপজেলার শিমুলতলী গ্রাম। তাঁর পিতা মফিজউদ্দিন মন্ডল এবং মাতা শামসুজ্জোহরা। তিনি ছিলেন জন্মজাত যুগশ্রেষ্ঠ অলি, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সূফিবাদী কবি, সুসাহিত্যিক, দার্শনিক, অনুবাদক ও সম্পাদক।
শিক্ষাজীবনে তিনি ১৯৬৫ বিরামপুর পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে রাজধানী ঢাকার কায়েদ আজম কলেজ (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) থেকে বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করেন।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাত নম্বর সেক্টরের অধীন আর্টিলারি বাহিনির হয়ে সশস্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি দিনাজপুর সীমান্ত সংলগ্ন বড়াহার ক্যাম্পে থাকতেন। তিনি অনেক সম্মুখযুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনে পর পেশাদারিত্বের সাথে সংযুক্ত হন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। তাঁর লেখা অনেক নাটক বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। নাটক লেখার পাশাপাশি তিনি নাটকের নির্দেশনাও দিতেন। এ সময় তাঁর লেখা বেশ কিছু গান বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়।
১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ সাতক্ষীরার তৎকালীন প্রখ্যাত পীর হজরত হাকিম আবদুল হাকিম (র.) কাছে খাস মোজাদ্দেদিয়া তরিকার বায়াত গ্রহণ করেন। এর পর তিনি ভুলে যান দুনিয়ার মোহ-মায়া-মমতা। প্রিয় মোর্শেদের দেখানো পথে খোঁজেন মহান আল্লাহ্র নৈকট্য। কঠিন রিয়াজতের মাধ্যমে নিজেকে নিয়ে যান আধ্যাত্মিক জগতের অনন্য উচ্চতায়। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অডিট ডিপার্টমেন্টের পদস্থ কর্মকর্তা।
মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ তরিকার প্রচার প্রসারে মহফিলের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন সাহিত্যের প্রতি। দেশ বিদেশের কবি সাহিত্যিকদের কাছে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়ে ওঠে একজন অনন্য সাধারণ সূফি কবি হিসেবে। যাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে আল্লাহ্ প্রেম, রসুলের প্রেম, ইসলামের প্রেম এবং আধ্যাতিকতা। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা সাতটি। গ্রন্থগুলো হলো- (১) সোনার শিকল, (২) ভেঙে পড়ে বাতাসের সিঁড়ি, (৩) বিশ্বাসের বৃষ্টি চিহ্ন, (৪) নীড়ে তার নীল ঢেউ, (৫) সীমান্ত প্রহরী সব সরে যাও, (৬) ধীর সুর বিলম্বিত ব্যথা এবং (৭) তৃষিত তিথির অতিথি।
তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে, ‘তুমি তো মোর্শেদ মহান’, ‘নকশায়ে নকশবন্দ’, ‘চেরাগে চিশতি’, ‘জীলান সূর্যের হাতছানি’, ‘বায়ানুল বাকী’, ‘কালিয়ারের কুতুব’, ‘প্রথম পরিবার’, ‘মহাপ্রেমিক মুসা’, ‘জননীদের জীবনকথা’, ‘সিদ্দীকশ্রেষ্ঠ’, ‘আল্লাহ্র জিকির’, ‘ইসলামী বিশ্বাস’, ‘অগ্নি ও উদ্যানের সংবাদ’, ‘নামাজ শিক্ষা’, ‘রমজান মাস’, ‘আমন্ত্রণ পরিশুদ্ধতার প্রতি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তাঁর সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাজ হলো তাফসীরে মাযহারীর অনুবাদ। তিনি মুরিদদের দিয়ে বার খণ্ডের গ্রন্থগুলো অনুবাদ করিয়ে নিজে পুর্নলিখন ও সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে এই মহামূল্যবান গ্রন্থগুলো দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বের সাথে চর্চা ও অধ্যায়ন করা হয়। এছাড়া তিনি বেশকিছু মূল্যবান গ্রন্থ প্রিয় মুরিদদের দিয়ে বাংলায় অনুবাদ করান এবং নিজে সম্পাদনা করেন। এগুলোর মধ্যে ‘মাদারেজুন্ নবুওয়াত (আট খণ্ড)’, ‘মালাবুদ্দা মিনহু’, ‘মাক্বামাতে মাযহারী’, ‘মুকাশিফাতে আয়নিয়া’, ‘মাব্দা ওয়া মা’আদ’, মাআরিফে লাদুন্নিয়া’, ‘মকতুবাতে মাসুমীয়া’, ‘হাজ্রাতুল কুদুস’ উল্লেখযোগ্য।
মামুনুর রশীদের জীবনের বড় একটা সময় কেটেছে অধ্যায়নের মাধ্যমে। তিনি জাহেরী ও বাতেনী জ্ঞানে বিজ্ঞ ছিলেন। ভাষার ক্ষেত্রে তিনি বুৎপত্তি অর্জন করেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি, ফারসি ও খেমার ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিলো অসাধারণ।
হজরত মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ২০০২ সালে ইসলামের শাশ্বত দাওয়াতের পবিত্রতম ব্রত নিয়ে সস্ত্রীক কম্বোডিয়া হিজরত করেন। তরিকার প্রচার প্রসারে তিনি সফর করেন ভারত, ভূটান, নেপাল, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চীন, হংকং, লাওস, সুইডেন, ইংল্যান্ড, স্পেন, সৌদি আরব, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, উজবেকিস্থান ও ইতালি।
মহান এই সূফি ও সাধক কবি মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ ২০১৬ সালের ২৩শে মে, ১৪ই শাবান, ১৪৩৭ হিজরী, সোমবার কলিকাতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। (্ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁকে জন্মস্থান দিনাজপুর জেলার বিরামপুর উপজেলায় নিজ গ্রামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

মোহাম্মদ মামুনুর রশীদের একগুচ্ছ কবিতা
অন্য গোলাপ

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
অনেক কাঁটার কৃষ্ণ প্রাতে অন্ধ রাতে
ঝড় তুফানে বৈরী বাগান বিরান হ’লে
আমার তবে কোন্ ভাবনা কোন্ ভাবনা?

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
জীবন থেকে জীবন পেলে মৃত্যু কোথায়?
জীবন থেকে জবান পেলে জমিন জুড়ে
হাজার কুসুম দল মেলে দ্যায় ঝড় তুফানে।

দূর সফরের সামান আছে আশাও আছে
সওয়াল জবাব জানাই আছে হিসেব মতো
অনেক আঁধার চিরে চিরে এই হৃদয়
জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ।

আমার গোলাপ অন্য গোলাপ, বিশ^াসী বুক
কালের কালোয় আঁধার আলোয় হয় না বিলীন
মৃত্যু জীবন কাল মহাকাল সব আঁধারে
সফল সুখের গন্ধ ছড়ায় অন্য গোলাপ।

জীবন থেকে তুলেছি এক অন্য গোলাপ
অনেক রাতের গভীর যামের অনেক রোদন
তুফান তিমির দুঃখ বিপদ আসেই যদি
আমার তবে কোন্ ভাবনা কোন ভাব্না।

জন্ম

অনলিত অন্তরের তলে
কথালতা চলে, দোলে, জ¦লে
ব’য়ে চলে য্যানো এক অলৌকিক নদীর ধারায়
জলজাত ঢেউ জাগে, জেগে উঠে আবার হারায়
স্রোতাঘাতে ভেঙে যায় বার বার হৃদয়ে পাড়
ঋতুবদলের পথে আসে যায় শুধুই আষাঢ়
দু’পালে দেয়াল দেয়া সংসারিক সুখের স্বকাল
বিরুদ্ধ জোয়ারে ঝড়ে ওড়ে লাল জীবনের পাল
উজান ভাটার মতো নিয়মিত রজনী প্রভাত
অবিবেকী অন্তর একই সাথে করে আত্মসাৎ
গতি যতির মতো ব্যতিক্রমী সৃজনের ক্ষণ
প্রকৃত সঞ্চয় জেনে সযতনে জমা রাখে মন
রোদনের মতো কিছু শব্দমালা পড়ে ধীরে ঝ’রে
অতলান্ত মনাধারে ক্রমে ক্রমে কিছু কিছু ক’রে
তবু মন তৃপ্তিহীন সারাক্ষণ যাবজ্জীবন
এভাড়েই ভ’রে ওঠে চেতনার গৃহাঙ্গন, বন…

অনলিত অন্তরের তলে
কথা ব্যথা জ¦লে, নেভে, জ¦লে
সে ব্যথার দাবদাহে জন্ম নেয় যখন জীবন
কাগজের পৃষ্ঠা জুড়ে জেগে ওঠে কবির স্বজন।

 

রোদনের প্রতিচিত্র

কোথায় জীবন য্যানো দৃশ্যমান নয় তার মূল
বেনামি উজান থেকে নেমে আসে তপ্ত স্রোতধারা
বৃন্ত-আধারের আগে কোথায় প্রথম ফোটে ফুল
আকারবিহীন মনে শব্দহীন শব্দ আনে সাড়া?

কোন সূচনায় সুখ অসুখর মতোন সমান
মৌনমুখী মগ্নতার অবিনাশী মুখবন্ধ হয়
চৈতন্যের পাড় ভেঙে নিয়ে আসে অন্ধ অভিমান
কালের কপোলে করে শব্দীর অশ্রু অপচয়?

নয়নের নদীতটে নিসর্গের নিরন্তর স্রোত
রোদনের মতো আঁকে জীবনের বিচিত্রিত রূপ
বিদগ্ধ রীতিতে ঋদ্ধ যে রাখে নেতৃত্ব কোনোমতে
সে জ¦লে কথার মূলে মর্মগন্ধী চেতনার ধূপ।

সীমানাবিহীন পথে শুরু হয় রোদন রোদন
দিকের দেয়াল দিয়ে সে ছবি কী ঢেকে রাখা যায়?
অচিন অয়নে তার চিহ্নহীন অবাক বদন
জ¦লে নিত্য নিরন্তর অন্তরের আলৌকিকতায়।