দেশের অন্যতম বড় সবজির মোকাম বগুড়ার মহাস্থান বাজারে ফুলকপিসহ কয়েকটি সবজির দাম পড়ে গেছে। অথচ কৃষকদের কাছ থেকে কেনা এসব সবজির দাম হাত বদলে ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে।
বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটে ফুলকপি বিক্রি করতে এসে হতাশ সে এলাকার মোকামতলার কৃষক কাসেম মণ্ডল।
তিনি বলছিলেন, “বাড়িতে গরু-ছাগল থাকলে তাদেরই খাওয়াতাম। উৎপাদন খরচ বাদ দিলাম, মাঠ থেকে হাট পর্যন্ত নিয়ে আসতে কেজি প্রতি যে খরচ হচ্ছে, সেই টাকাও আমরা পাচ্ছি না।”
দেশে সবজির অন্যতম বড় মোকাম মহাস্থান হাটে শুধু ফুলকপি নয়, শীতকালীন সবজির মধ্যে বাঁধাকপি, মুলা, শিমসহ আরো কয়েকটি সবজির দাম কৃষক পর্যায়ে পুরোপুরি ‘পড়ে’ গেছে।
দেশের যেসব অঞ্চলে শীতকালীন এই সবজিগুলোর চাষ বেশি হয়, তার মধ্যে অন্যতম উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা বগুড়া, গাইবান্ধা আর দিনাজপুর।
উত্তরের এই জেলাগুলোতে কৃষক পর্যায়ে ফুলকপি আর বাঁধাকপির দাম কেজি প্রতি দুই থেকে থেকে আড়াই টাকায় নেমেছে। কিন্তু, হাত বদলে ঢাকার বাজারগুলোতে সেই সবজি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে।
মাঝখান থেকে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্যে কৃষকের মাথায় হাত পড়েছে। চাষের খরচ উঠে না আসায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে। আর ঢাকায় ক্রেতার ‘পকেট কাটার’ দায় ফড়িয়া সিন্ডিকেটের ওপর চাপাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
ক্ষমতার পালাবদলের পর বাজারে সবজিসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের দাম ছিল উর্ধ্বমুখী। বাজারে পর্যাপ্ত শীতকালীন সবজি আসতে থাকায় সম্প্রতি ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
দুই টাকার ফুলকপি যেভাবে ২০ টাকা
কৃষক পর্যায়ে যে ফুলকপি দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, সেটি হাত বদলে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে গড়ে ২০ টাকা করে।
কৃষক পর্যায়ে বাঁধাকপি আর মুলাও দুই থেকে আড়াই টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ, ঢাকায় এসব সবজিও ২০ থেকে ২৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে।
বগুড়ায় কৃষক পর্যায়ে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ ২৫ টাকা, শিম ২০ টাকা আর বেগুন ১৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ, রাজধানীর বাজারগুলোতে কাঁচামরিচ ৫০ টাকা, শিম ৪০ থেকে ৫০ টাকা, বেগুন ৫০ থেকে ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালী ও কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে আকৃতিভেদে প্রতিটি ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম পড়ছে গড়ে ২০ টাকা। তবে, আড়ত থেকে পাইকারি কিনলে দাম পড়ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা প্রতিটি।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি সবজি বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, “আমরা দুই তিন টাকায় কিনতে পারি না। আমরা কিনেছি স্থানীয় আড়তদারের কাছ থেকে। তারা কৃষকদের থেকে হয়ত আরও কমে কিনেছে।
“এর সঙ্গে আমাদের পরিবহন খরচ, গুদামসহ দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলের হিসেব রয়েছে। বগুড়া থেকে আসার পর, সবজি আনলোড যারা করে, তাদেরও পয়সা দিতে হয়। সব মিলিয়ে আমরা ১২ থেকে ১৫ টাকা কেজি করে বিক্রি করছি।”
এই বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা সবুজ হোসেন বলেন, “আমরা বগুড়া থেকে পাইকারি কিনে এনে ফুলকপি খুচরা বিক্রি করি। এখন তো আগের তুলনায় সব শীতকালীন সবজির দাম কম।”
কীভাবে হাত বদলে এই সবজির দাম বেড়ে যায়? সবুজ হোসেন বলছেন, “প্রথমে কৃষকরা স্থানীয় বাজারে নিয়ে আসে। পরে সেখানকার পাইকার বা আড়তদাররা সেগুলো মণ হিসেবে কিনে নেয়। এরপর, ট্রাক বা পিকআপে করে আসে রাজধানীতে। এভাবে কয়েকটি হাত বদল হয়েই মূলত সবজির দাম বাড়ে।
“আমরা যারা শেষ ধাপে আছি, তারা তো আর সরাসরি কৃষকদের থেকে কিনতে পারি না। স্থানীয় বাজারগুলোতে ফড়িয়াদের সিন্ডিকেট থাকে। তারা সবাই মিলে একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়। এরপর, সেই দামে কৃষকদের থেকে কিনে নেয়।”
এই বাজারের আরেক বিক্রেতা আরিফ হোসেনও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, “খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের সরাসরি সংযোগ থাকলে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমত। তাতে মানুষও কম দামে শাক-সবজি পেত। আবার কৃষকরাও লাভবান হত।”
বগুড়ার দুই টাকার মুলা ঢাকায় ২০ টাকা
বগুড়ার মহাস্থান হাটে পাইকারি সবজির দাম একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সোমবার দেশের অন্যতম বড় শাক-সবজির বাজার মহাস্থান হাটে গিয়ে সবজির দাম পতনের এমন তথ্য দিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বগুড়া প্রতিনিধি জিয়া শাহীন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মুলা বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি দুই টাকা, ফুলকপির কেজিও দুই টাকা থেকে আড়াই টাকা করে। আর, বাঁধাকপি দুই টাকা থেকে তিন টাকা।
পৌষের মাঝামাঝিতে এসব সবজির দামে ধ্বস নামায় মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। ভালো লাভের আশায় শীতকালীন সবজির চাষ করে বিপাকে পড়েছেন তারা। অবশ্য পৌষ মাসের আগে শীত যখন নামতে শুরু করেছে, তখন কিছুদিন তারা ভালো দাম পেয়েছেন। এখন বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম কমে যাচ্ছে।
মৌসুমের এই সময়ে ফসল আবাদের খরচ না উঠলেও বাধ্য হয়ে কম দামেই সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের৷ বেপারীদের দাবি, দাম কমে যাওয়ায় ‘লোকসানে’ পড়তে হচ্ছে তাদেরও।
কৃষক ও পাইকারি বাজারে দাম পড়তি হলেও হাতবদল হয়ে ১০০ গজ দূরে খুচরা বাজারেই এসব সবজি ৫ থেকে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে৷
মহাস্থান হাটে ফুলকপি বিক্রি করতে আসা বগুড়ার মোকামতলার কৃষক কাসেম মণ্ডলের জিজ্ঞাসা, “ফুলকপির মত সবজি মাত্র এক থেকে চার টাকা কেজিতে কখনও বিক্রি হতে পারে? মুলার কেজি দুই টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না।”
শীতের সবজির মধ্যে ফুলকপি বেশ জনপ্রিয়, মাছ দিয়ে রান্না করে খেতেও সুস্বাদু। ফুলকপি দিয়ে তৈরি হয় পাকোড়ার মতো মুখরোচক খাবারও।
বগুড়ার মহাস্থানগড় এলাকার আরেক কৃষক হযরত আলী বলেন, “প্রতি বিঘায় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে ফুলকপি চাষ করে। কৃষদের জ্বালা কেউ বোঝে না। কাউকে বলতেও পারছি না, সহ্যও করতে পারছি না৷”
তিনি বলেন, “কাঁচা সবজি রাখার জন্য হিমাগারও নেই যে সেখানে রাখব। সবজি জমি থেকে না ওঠালে নষ্ট হয়ে যাবে। আবার বাজারে এনে লাভ হচ্ছে না। পরিবহন খরচও উঠছে না।”
এই বাজারের আড়তদার তাহেরুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন মহাস্থান হাট থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৮০ থেকে ৯০ ট্রাক সবজি যায়। শীতের প্রথমে চাষিরা ভালো দাম পেলেও সরবরাহ বাড়ায় বাজার তলানিতে পৌঁছেছে।
শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বলেন, “এই উপজেলায় এবার অন্যান্য সবজির তুলনায় ফুলকপি ও বাঁধাকপি দুটিরই চাষ বেশি হয়েছে।
“ফলে বাজারে সরবরাহের তুলনায় কপির ক্রেতা কম। আর ক্রেতা কম থাকায় বাজারে দাম পড়ে গেছে। বগুড়ায় এবার ১২ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির চাষ হয়েছে।”
গাইবান্ধায় একই চিত্র
আমদানি ও ফলন বেশি হওয়ায় বগুড়ার পাশের জেলা গাইবান্ধাতেও শীতের সবজির দাম কমে গেছে।
বুধবার জেলার কয়েকটি হাট-বাজার ঘুরে দেখেছেন গাইবান্ধা প্রতিনিধি।
তিনি জানান, গাইবান্ধার পাইকারি বাজারগুলোতে প্রতিকেজি ফুলকপি ৫ থেকে ৬ টাকা, বাঁধাকপি ৪ থেকে ৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া, বেগুন ৫ থেকে ৬ টাকা ও শিম ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি দরে কৃষকরা পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন।
হাত বদলের পর স্থানীয় খুচরা বিক্রেতারা প্রতিকেজি ফুলকপি ১০ টাকা, বাঁধাকপি ৭ থেকে ৮ টাকা, বেগুন ১০ টাকা ও শিম ১০ থেকে ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর খুচরা বাজারের ক্রেতা বিক্রেতারা জানান, গত এক সপ্তাহে সবজিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
সাদুল্লাপুর উপজেলার ধাপরেহাট ইউনিয়নের নিজপাড়া গ্রামের সবজি চাষি আতোয়ার মিয়া ৩০ শতক জমিতে বাঁধাকপি আবাদ করেছেন। সর্বমোট খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “আজকে বাজারে কপি নিয়ে এসে দেখি ৫ টাকা কেজি দরেও পাইকাররা কিনছেন না। হঠাৎ করে দাম কমে যাওয়ায় এবছর তার খরচের টাকাই উঠবে না। মূলধন খোয়া যাবে।”
একই উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের কাঠাল লক্ষ্মীপুর গ্রামের কৃষক সাদা মিয়া একই বাজারে ফুলকপি বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা দরে।
তিনি বলেন, “প্রতি কেজি ফুলকপি উৎপাদনে ২০ থেকে ৩০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু বাজারে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় প্রতি কেজি ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।”
গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ বলেন, “সবজির দাম অনেক কমেছে। দুই সপ্তাহ আগে ফুলকপি ছিল ৮০ টাকা কেজি। আজ ৬ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ফুলকপি। তবে বাজার এত কমে যাওয়া ভালো না। এতে করে কৃষকরা আগামীতে সবজি চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তখন বাজারে অতি উচ্চ মূল্যেও সবজি পাওয়া যাবে না।”
দর মন্দা দিনাজপুরেও
বগুড়া আর গাইবান্ধার মতো দিনাজপুরেও বাজার পড়ে গেছে ফুলকপির। অনেক জায়গায় মাঠেই পড়ে থাকছে এই শীতকালীন সবজিটি।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “মাঠেই পড়ে থাকছে ফুলকপি। ক্রেতা নেই। কৃষকের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে প্রতি মণ ৪০ টাকা দরে। প্রতিটা এক থেকে দেড় টাকা। যেটা খুচরা বাজারে ক্রেতা কিনছে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে।”