ইসরায়েলের যে নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে সেটা কারোরই অজানা নয়। যদিও দেশটিকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিষয়টি স্বীকার করতে দেখা যায়নি। বরং ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি রয়েছে এমন দাবি করে সপ্তাহখানেক আগে দেশটির ওপর হামলা শুরু করে ইসরায়েল।
জবাবে ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ অবস্থায় দেশ দুটির মধ্যে সংঘাত ক্রমেই আরো বাড়তে দেখা যাচ্ছে। শান্তি ও নিরাপত্তা বিষষক স্পেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী হাভিয়ের বোহিগাস বিবিসিকে বলছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র দেশ যার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গত মার্চে জানিয়েছিল যে, ইরান এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে হলে এটি ৯০ শতাংশের ওপরে অর্জন করতে হবে বলে জানিয়েছেন বোহিগাস।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ইরানসহ অন্যান্য দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করলেও ইসরায়েল এখন পর্যন্ত সই করেনি। ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মতো একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর আইএইএকে তাদের সম্ভাব্য পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে দিতে তারা বাধ্য নয়। যদিও ইসরায়েল নিজে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার একজন সদস্য। যেহেতু দেশটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয় না সেকারণে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে খুব একটা তথ্যও পাওয়া যায় না।
যতটুকু তথ্য জানা যায়, সেগুলো মূলত ফাঁস হওয়া তথ্য, মার্কিন প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি বিভাগের প্রতিবেদন এবং পারমাণবিক কর্মসূচি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। এছাড়াও ইসরায়েলের সাবেক পরমাণু প্রকৌশলী মোর্দেচাই ভানুনুর সাক্ষাৎকার থেকেও দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
এক সময় ইসরায়েলি পারমাণবিক কেন্দ্রে কর্মরত ভানুনুকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য সানডে টাইমসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। ওই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই ভানুনু তখন বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন যে, ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করার জন্য তাকে অনেক বছর জেলও খাটতে হয়েছে।
পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে তথ্য প্রকাশিত হলেও ইসরায়েলের নেতারা নিজ মুখে কখনও সেটি স্বীকার করেননি, আবার অস্বীকারও করতে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে তারা বরং অস্পষ্টতা রাখার নীতি মেনে চলেন।
পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে ইসরায়েলের সরকারের এই নীতিকে বলা হয় ‘আমিমুত’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা’। ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেন যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, ইসরায়েলের পারমাণবিক যুগে এই নীতিটি সম্ভবত তাদের সবচেয়ে স্বতন্ত্র ব্যাপার।
যদিও ইসরায়েলের ইতিহাসে এই নীতি মোটেও নতুন কিছু নয়। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ তার আত্মজীবনীতেও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন, অস্পষ্টতার শক্তি যে কত প্রচণ্ড, সেটি আমরা শিখেছি…যারা দ্বিতীয়বার হলোকস্ট করতে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য এই অস্পষ্টতা বা সন্দেহ একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে।
অধ্যাপক কোহেনও তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, পারমাণবিক অস্ত্রের বিষয়ে অস্বচ্ছতার এই নীতি ইসরায়েলের সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলগত এবং কূটনৈতিক অর্জন।
ইসরায়েল তার নিজের পছন্দেই অস্পষ্টতার নীতি গ্রহণ করেছে এবং সেটা হয়েছে। যেহেতু দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করেনি, সে কারণে তাদের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন করতে দেওয়ারও প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেছেন ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক জেভিয়ার বোহিগাস।
তিনি আরও বলেন, সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ দেশই সবকিছু স্পষ্ট করতে চায় না। তবে পারমাণবিক ইস্যুতে ইসরায়েল ‘আরও বেশি অস্পষ্টতা’ বজায় রাখে।
এর মাধ্যমেই তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে এতটুকুই জানা যাচ্ছে যে, দেশটির একটি পারমাণবিক কর্মসূচি রয়েছে এবং তাদের কাছে একাধিক পারমাণবিক বোমা আছে, যা তারা প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারে।
ইসরায়েলি নেতারা এ বিষয়টি কখনও স্বীকার বা অস্বীকার করেননি। এই অস্পষ্টতাই ইসরায়েলকে অস্তিত্বগত হুমকির বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন ইসরায়েলের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাভনার কোহেন। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিপরীতে দেশটিকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক কিংবা নৈতিক কোনো ধরনের মূল্যই দিতে হয়নি।
ঠিক কতগুলো পারমাণবিক বোমা আছে ইসরায়েলের?
১৯৮৬ সালে ভানুনু জানিয়েছিলেন যে, সে সময় ইসরায়েলের কাছে আনুমানিক ১০০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ‘ওয়ারহেড’ ছিল। বোমার সামনের যে অংশে মূলত বিস্ফোরক রাখা থাকে, সেটি ওয়ারহেড নামে পরিচিত। ভানুনু কয়েকশ ওয়ারহেড থাকার দাবি করলেও পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো অবশ্য তা বলছে না।
সুইডেনভিত্তিক পরমাণু অস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে ৯০টির মতো ওয়ারহেড থাকতে পারে।
এসব ওয়ারহেড তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্লুটোনিয়াম দক্ষিণ ইসরায়েলের ডিমোনা শহরের কাছে অবস্থিত নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের চুল্লিতে উৎপাদিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যদিও ইসরায়েলের সরকার দাবি করে আসছে যে, পরমাণু চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা মাত্র ২৬ মেগাওয়াট। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন যে, চুল্লিটির উৎপাদন সক্ষমতা আরও অনেক বেশি।
ইসরায়েলের অন্যান্য পারমাণবিক স্থাপনার মতো এই চুল্লিটিও আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নজরদারির বাইরে রয়েছে। ফলে সেটার অপব্যবহার হচ্ছে কি না এবং পারমাণবিক কর্মসূচি কতটা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটি স্বাধীনভাবে যাচাই করার সুযোগ নেই।
সেক্ষেত্রে ইসরায়েল যদি তথ্য না দেয়, তাহলে কীভাবে জানা যাবে যে, দেশটির কাছে কতগুলো পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে?
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরমাণু কেন্দ্রগুলো পর্যবেক্ষণ রাখে এবং সেটার ভিত্তিতে প্রতিবছর ধারণা করে থাকে বলে উল্লেখ করেছেন গবেষক ও পদার্থবিজ্ঞানী বোহিগাস।
তিনি বলেন, যেসব দেশের ব্যাপারে কম তথ্য রয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম উৎপাদনের আনুমানিক পরিমাণ গণনা করার মাধ্যমে ধারণা পাওয়া যায়। ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও সেটি করা হয়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
যদিও পদ্ধতিটি আগেও বিভিন্ন সময় ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরায়েলের মতো উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে দেশটির ‘পারমাণবিক ওয়ারহেড’ সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। উত্তর কোরিয়ার কাছে প্রায় ৫০টি ওয়ারহেড রয়েছে বলে অনুমান করেন তারা।
বোহিগাস জানান, ২০১১ সালে নিউ স্টার্ট ট্রিটি স্বাক্ষরের আগে যখন পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে থাকা পারমাণিক বোমার সংখ্যার বিষয়ে আনুমানিক একটা ধারণা পেয়েছিল পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো। পরে তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর দেখা গেছে, সেগুলো বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সুতরাং সেখান থেকে বলা যায় যে, ইসরায়েলের পরমাণু অস্ত্রের বিষয়ে যে ধারণা করা হচ্ছে, সেটি বাস্তবসম্মত বা বাস্তবতার বেশ কাছাকাছিই হবে। এমনটাই মনে করেন শান্তি ও নিরাপত্তা বিষষক স্পেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডেলাস সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের এই গবেষক।