ঢাকা ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ২৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
জুলাই আন্দোলন নিয়ে ৮ সিনেমা; নির্মাতা চূড়ান্ত বেশি সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন : প্রেস সচিব পুলিশে চাকরি পাচ্ছেন আন্দোলনে আহত ১০০ জন: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ১৪৪ ধারা ভেঙে সচিবালয় ঘেরাওয়ের চেষ্টা, পুলিশের ধাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার কাজের তালিকা দিলেন উপদেষ্টা মাহফুজ সরকার গঠনের পর অভিযুক্ত কাউকে দেশত্যাগ করতে দেয়া হয়নি: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ট্রুডো কেন হঠাৎ পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন? কে হতে যাচ্ছে তার উত্তরসূরি? গঠিত হচ্ছে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’,  ইরানে হিজাব খুলে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের প্রতিবাদ শক্তিশালী ভূমিকম্পে তিব্বতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫৩

মেট্রোয় প্রকাশ্যে চুম্বনের ভিডিও ঘিরে যত প্রশ্ন আর বিতর্ক

মেট্রো স্টেশনে যুগলের চুম্বনের দৃশ্য গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুম্বনরত ওই যুগলের ভিডিও, যা কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে (এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি বিবিসি), আপাতত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।

ভিডিও নিয়ে ইতোমধ্যে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। তাদের বক্তব্য, কেন জনসমক্ষে অন্তরঙ্গতা?

আবার অন্যদিকে, সমাজমাধ্যমে অনেকেই ওই যুগলের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাদের পাল্টা যুক্তি, ভালবাসা বা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে সমস্যা কোথায়?

একই সঙ্গে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কেনই বা দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল?

যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিতে একদিকে যেমন সরগরম হয়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তেমনই এই ঘটনা উসকে দিয়েছে ২০১৮-র মেট্রোর একটা ঘটনার স্মৃতি যেখানে মেট্রোয় সফররত এক যুগলকে আলিঙ্গন করতে দেখে শুধুমাত্র কটাক্ষের শিকার হতে হয়নি, মারধরও খেতে হয়েছিল সহযাত্রীদের কাছ থেকে।

দিল্লি মেট্রোতে একাধিকবার প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের অন্তরঙ্গতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরু মেট্রোতেও এক যুগলকে কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছিল অনুরূপ ঘটনায়।

এই জাতীয় ঘটনায় প্রতিবার একই প্রশ্নর জন্ম দেয়। সেটা হলো সমাজে পিডিএ (পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন) এবং ‘নৈতিকতার সংজ্ঞা’ নিয়ে।

কলকাতা মেট্রোর সাম্প্রতিকতম ঘটনাও একই প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

আলোচনার কেন্দ্রে থাকা ভিডিও
যে ভিডিওকে ঘিরে এই আলোচনা সেখানে দু’জন তরুণ-তরুণী দৃশ্যমান। ভিডিওতে একে অপরের ওষ্ঠে চুম্বন করতে দেখা গিয়েছে তাদের। প্ল্যাটফর্মের অন্যান্য যাত্রীদের বিষয়ে তাদের বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

আশপাশে থাকা যাত্রীদের মধ্যেই কেউ ওই ভিডিও রেকর্ড করেছেন। তারপর তা আপলোড করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রকাশ্যে আসার পরই তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় আলোচনা, তর্ক।

ওই যুগলের পক্ষে এবং বিপক্ষে সওয়াল জোরালো হতে থাকে। একদিকে যেমন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে থাকেন যে ‘জনসমক্ষে অন্তরঙ্গতা কী খুব প্রয়োজন?’

অন্যদিকে অপর পক্ষ যুক্তি, ‘হলেই বা সমস্যা কী?’

সাধারণ মানুষ কী বলছেন?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও চোখে পড়েছে কলকাতার বাসিন্দা উপাসনা চৌধুরীর। পেশায় লেখিকা তিনি।

তার কথায় বলেন, “ভাবতে অবাক লাগে এক যুগলের চুম্বন দেখে আমরা এত দ্রুত রিয়্যাক্ট করছি, অথচ সেই আমরাই ছয় মাসের এক শিশুকে ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনাতে চুপ করে থাকি!”

“অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, ভালবাসার উদযাপন নিয়ে কেন আমদের এত সমস্যা? আরও পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিতে হবে আমাদের।”

দক্ষিণ কলকাতার একটা কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পাঠরত এক ছাত্রী তার এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী বলেছেন, “আমাদের জেনারেশনের কাছে জড়িয়ে ধরা বা চুম্বন কোনও বিষয় নয়। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে আমরা বন্ধুদের জড়িয়ে ধরি। বিষয়টা একেবারে নর্মাল (স্বাভাবিক)।”

কলকাতা মেট্রো স্টেশনে তোলা ওই ভিডিও সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তিনি। বছর ২০-র এই ছাত্রী বলেন, “কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে তোলা ওই ভিডিও নিয়ে সমালোচনায় আমি অবাক হইনি।”

“একবার আমার এক বন্ধু অটো স্ট্যান্ডে পর্যন্ত ছাড়তে এসেছিল। বিদায় জানানোর সময় আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। সেই সময় আশপাশের অনেকের খারাপ কথা বলতে থাকেন। খুব অপমানজনক ছিল ঘটনাটা। তারপর থেকে আর কখনও কোনও ছেলে বন্ধুকে রাস্তায় জড়িয়ে ধরিনি বা বলতে পারেন সাহস পাইনি।”

কলেজ পড়ুয়া তৃণাঙ্কুর দাস কলকাতা মেট্রোর ওই ঘটনাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে পিডিএ-তে স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধুদের কেউ করলে বা অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখলে আমি মোটেই তাদের টার্গেট (নিশানা) করব না বা ক্যামেরায় রেকর্ডও করব না।”

এই বিষয়ে তার পরামর্শ, “যাদের পছন্দ হচ্ছে না, তারা এড়িয়ে গেলেই পারেন। এই নিয়ে অযথা আলোচনা করার কোনও মানে হয় না বলেই আমার মনে হয়।”

একইভাবে, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন জনসমক্ষে এই অন্তরঙ্গতার যৌক্তিকতা নিয়ে। তাদেরই একজন গৃহবধূ তৃণা বসু। তার মেয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটা প্লে স্কুলে পড়ে। যাতায়াতের জন্য মেট্রোই ভরসা তাদের।

তিনি বলেছেন, “সত্যি কথা বলতে কী, মেট্রোতে বা পথে ঘাটে এমন দৃশ্য দেখলে অস্বস্তি হয় বৈকি, বিশেষত যদি সঙ্গে আমার ছোট্ট মেয়ে থাকে।”

বছর ২৮-এর এই গৃহবধূ বলেছেন, “আমার মতে সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট স্থান এবং সময় রয়েছে। জনসমক্ষে অন্তরঙ্গ না হলেই বা ক্ষতি কী? এইটুকু আমরা জনসমক্ষের আড়ালে তুলে রাখতে পারি, না কি? কারণ মুহূর্তটা তো শুধুমাত্র দু’জনেরই।”

“তবে এটা নিয়ে রে রে করে তেড়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না।”

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের একাধিক শহরে এমন ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। দিল্লি মেট্রোতেও একাধিক ঘটনায় অন্তরঙ্গ হওয়া যুগলকে জনসাধারণের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরু মেট্রোতেও তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাকে একই কারণে জনরোষের শিকার হতে হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে দিল্লির বাসিন্দা পুলকিত গর্গ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “অফিসে যাতায়াতের সময় অনেক যুগলকেই দেখি সমালোচনার শিকার হতে। এটা কোনও অন্যায় বলে তো আমার মনে হয় না, তাও তাদের দু-চার কথা শুনতে হয়।”

“কিন্তু এক্ষেত্রে যারা ওই প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে আঙুল তোলেন, তাদের অনেককেই অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে দেখি বা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি।”

পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন কি আইনত অপরাধ?
প্রকাশ্যে যুগলদের আলিঙ্গন এবং চুম্বন নিয়ে এর আগেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক ঘটনায় তথাকথিত নীতি-পুলিশদের বিরুদ্ধে যুগলদের হেনস্থার অভিযোগও সামনে এসেছে।

২০১৪ সালে কেরালার এক ক্যাফেতে যুগলদের অন্তরঙ্গ হওয়ার কারণে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। তার প্রতিবাদ জানিয়ে কেরালাতে ‘কিস অফ লাভ’ কর্মসূচিও শুরু হয়েছিল যা পরে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৮ সালে কলকাতা মেট্রোতে ওই যুগলকে মারধরের ঘটনারও প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো জনসমক্ষে অন্তরঙ্গ হওয়া কী আইনত অপরাধ?

আইনজীবী বিভাস চ্যাটার্জী বলছেন, “না, ভারতীয় আইনে চুম্বন অপরাধ নয়। ভারতের আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, অবসিনিটি (অশ্লীলতা) হলে সেটা অপরাধ।”

এখন কোনটা অশ্লীল আর কোনটা নয়, তা আলোচনা এবং যুক্তি সাপেক্ষ।

এই বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রসঙ্গ আনেন। তিনি বলেছেন, “বর্তমানে এই সমস্ত ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একটা জাজমেন্ট আমরা মেনে চলি। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বিষয় অশ্লীল কি না তা সমসাময়িক সমাজের নিরিখে বিচার করতে হবে। দেখতে হবে বিষয়টার শিল্পগত বা অন্য কোনও গুরুত্ব রয়েছে কি না, বিষয়টা আইন বিরুদ্ধ কি না ইত্যাদি।”

কলকাতা মেট্রোয় সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে নীতিপুলিশরা অনেকরকম কথা বলছেন বটে কিন্তু আইনের চোখে এটা অপরাধ বা নিষিদ্ধ তা সরাসরি বলাটা কঠিন। কারণ আমরা আস্তে আস্তে অনেক লিবারাল হচ্ছি এবং আইনের ইন্টারপ্রিটেশন (ব্যাখ্যাও) সেই দিকেই যাচ্ছে।”

অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে ওই যুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে শেয়ার করা আদৌ ঠিক কি না।

সাইবার বিশেষজ্ঞ মি. চ্যাটার্জী বলেন, “এমন কোনও আইন নেই যে এটাকে (ভিডিও করা) আটকাবে কিন্তু কারও যদি প্রাইভেসি বিঘ্নিত হয় তাহলে তার (যার ভিডিও করা হচ্ছে) সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে অভিযোগ জানানোর। এই ঘটনা যেহেতু পাবলিক ফোরামে হচ্ছে তাই প্রাইভেসি বিঘ্নিত হচ্ছেও বলা যায় না।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় আবার মনে করেন, পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে কে কীভাবে সেটা দেখছেন। এই ঘটনাকে মনোসামাজিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।

তার কথায়, “স্বভাবতই সব মানুষ সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টাকে দেখেন না। আমি থাকলে হয়ত তাদের না দেখার মতো করে চলে যেতাম। কিন্তু যিনি বিষয়টাকে ক্যামেরাবন্দি করে সমাজ মাধ্যমে আপলোড করেছেন, তিনি বিষয়টাকে দেখেছেন এবং সেটাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও চেয়েছেন।”

“এখানে বড় প্রশ্ন হলো তিনি কেন এই ভিডিও করলেন এবং কেনই বা তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন।” এক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাবনার কথা বলেছেন মি. রায়।

তার কথায়, “হতে পারে ওই ব্যক্তির মধ্যে মুক্তমনস্কদের দেখে কিছুটা ঈর্ষা কাজ করেছে। কিংবা নিছকই সামাজিক মাধ্যমে এই ভিডিও ভাইরাল করার উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করেছেন। তিনি জানেন এটা আরও প্রচার পাবে এবং এই নিয়ে কথা হবে। সেক্ষেত্রে দুষ্টুমিই তার মোটিভ।”

এই প্রসঙ্গে নীতিপুলিশদের ভূমিকার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে মি. রায় জানিয়েছেন, নীতিপুলিশ কোনও বিষয় জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বিশেষ লাভ হয় না।

তিনি বলেছেন, “সমাজ পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয় এবং কেউ কেউ বলেন সেটা হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তার বড় উদাহরণ হলো সোভিয়েত এক্সপেরিমেন্ট, নাৎসি বা চাইনিজ এক্সপেরিমেন্ট যারা নীতিবোধকে রাতারাতি বদলাতে চেয়েছিল।”

২০১৮ সালে কলকাতা মেট্রোয় এক যুগল একে অপরকে আলিঙ্গনের পর তাদের উপস্থিত যাত্রীদের একাংশের রোষানলে পড়তে হয়। মারধর এবং হেনস্থা হতে হয়েছিল তাদের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্কও দানা বেঁধেছিল। প্রতিবাদে ‘ফ্রি হাগ’ এবং অন্যান্য কর্মসূচি পালন হয়েছিল।

বলেছেন, “এই ক্ষেত্রেও বাধা দিয়ে লাভ নেই। এক্ষেত্রে যেমন তাদের যুক্তি হবে যে তোমরা আমাদের প্রকাশ্যে চুম্বন করতে দিলে না, কিন্তু আমরা জায়গা খুঁজে নেব।”

“সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই কমপ্লেক্স রিয়েলিটিটাই কাজ করে। তারা যতই বাঁধন কষবেন, উল্টোদিকে ততই প্রভোকেটেড হয়ে পড়বে।”

সাম্প্রতিক ঘটনায় অবশ্য যুগলকে হেনস্থা হতে হয়নি। তাহলে কী ‘সাবালক’ হচ্ছে কলকাতা? ‘সহনশীলতা’ বাড়ছে?

অধ্যাপক ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “মানুষের মধ্যে কতটা সহনশীলতা বেড়েছে তা বলা মুশকিল। হয়ত সেটা বেড়েছে কিংবা দেখা যাবে ২০১৮ সালে মেট্রোর ঘটনায় যারা সহযাত্রী ছিলেন এবং সাম্প্রতিক ঘটনায় মেট্রো স্টেশনে যারা ছিলেন তারা ভিন্ন ধরনের মানুষ।”

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের মতোই তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন ওই ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করা ব্যক্তিকে নিয়ে। তার কথায়, “এক্ষেত্রে যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেটা হলো কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল।”

“এক্ষেত্রে দু’টো কারণ হতে পারে। এক, ডেপ্রাইভেশনের জায়গা অর্থাৎ আমি পাইনি তাই আমি ভিডিও করে মজা পাচ্ছি। কিম্বা নীতিপুলিশ হয়ে বিষয়টাকে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।”

ভিডিওর সমালোচকদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন এই আচরণ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী।

এই প্রসঙ্গে শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “কোনটা আমাদের সংস্কৃতি আর কোনটা নয় সেটা কে নির্ধারণ করবে। অনেকেই বলবে খাজুরাহো আমাদের সংস্কৃতি নয়। অথচ যুগলের চুম্বন বা মিলনের দৃশ্য অনেক মন্দিরের গাত্রে খোদাই করা আছে। সেটা তো পুজো করার জায়গা।”

“আসলে কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা নয় তা সমসাময়িক যুগের উপর ভিত্তি করে ঠিক হয়।”

তবে বেশ কিছু বিষয়ে যে চিন্তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বদলাচ্ছে তাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

তার কথায়, “বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা বদলাচ্ছে। আগে অন্তরঙ্গ দৃশ্য সিনেমাতে বোঝাতে দুটো ফুল বা একজোড়া প্রজাপতি দেখানো হতো। সেখান থেকে তো আমরা অনেকটা সরে এসেছি। এখন পিডিএ নিয়ে অনেক বেশি কথা হয়।”

ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট শতাব্দী দাশ আবার বলেছেন, “এই বিষয়ে জনসাধারণের তো কিছু বলার থাকতে পারে না। আসলে চুম্বন সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই অদ্ভুত। মানুষ মানুষকে চুম্বন করবে এটা তো স্বাভাবিক। একজন মা যেমন তার শিশুকে চুম্বন করতে পারেন প্রেমিক-প্রেমিকাও তা করতে পারেন।”

“মূলত ভালবাসা দেখাতেই চুম্বন করা হয়। এটা একেবারেই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করার একটা মাধ্যম। এখানে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”

পেশায় শিক্ষিকা শতাব্দী দাশ। তিনি বলেছেন, “আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলব ভালবাসাকে তারা যেভাবে খুশি জাহির করতে পারে এবং যেকোনও লিঙ্গের মানুষের প্রতি করতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এতে কোনও অপরাধ নেই।”

“আমি তাদের বলব রাস্তায় কাউকে ইভটিজ করা, হেনস্থা করা অপরাধ কিন্তু কারও প্রতি ভালোবাসা দেখানোটা মোটেই খারাপ কিছু নয়।”

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ।

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

মেট্রোয় প্রকাশ্যে চুম্বনের ভিডিও ঘিরে যত প্রশ্ন আর বিতর্ক

আপডেট সময় ১১:৫৯:৪৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪

মেট্রো স্টেশনে যুগলের চুম্বনের দৃশ্য গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুম্বনরত ওই যুগলের ভিডিও, যা কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে (এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেনি বিবিসি), আপাতত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।

ভিডিও নিয়ে ইতোমধ্যে সোচ্চার হয়েছেন অনেকে। তাদের বক্তব্য, কেন জনসমক্ষে অন্তরঙ্গতা?

আবার অন্যদিকে, সমাজমাধ্যমে অনেকেই ওই যুগলের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাদের পাল্টা যুক্তি, ভালবাসা বা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে সমস্যা কোথায়?

একই সঙ্গে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, কেনই বা দু’জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল?

যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিতে একদিকে যেমন সরগরম হয়ে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তেমনই এই ঘটনা উসকে দিয়েছে ২০১৮-র মেট্রোর একটা ঘটনার স্মৃতি যেখানে মেট্রোয় সফররত এক যুগলকে আলিঙ্গন করতে দেখে শুধুমাত্র কটাক্ষের শিকার হতে হয়নি, মারধরও খেতে হয়েছিল সহযাত্রীদের কাছ থেকে।

দিল্লি মেট্রোতে একাধিকবার প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের অন্তরঙ্গতার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরু মেট্রোতেও এক যুগলকে কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছিল অনুরূপ ঘটনায়।

এই জাতীয় ঘটনায় প্রতিবার একই প্রশ্নর জন্ম দেয়। সেটা হলো সমাজে পিডিএ (পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন) এবং ‘নৈতিকতার সংজ্ঞা’ নিয়ে।

কলকাতা মেট্রোর সাম্প্রতিকতম ঘটনাও একই প্রশ্ন তুলে ধরেছে।

আলোচনার কেন্দ্রে থাকা ভিডিও
যে ভিডিওকে ঘিরে এই আলোচনা সেখানে দু’জন তরুণ-তরুণী দৃশ্যমান। ভিডিওতে একে অপরের ওষ্ঠে চুম্বন করতে দেখা গিয়েছে তাদের। প্ল্যাটফর্মের অন্যান্য যাত্রীদের বিষয়ে তাদের বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।

আশপাশে থাকা যাত্রীদের মধ্যেই কেউ ওই ভিডিও রেকর্ড করেছেন। তারপর তা আপলোড করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রকাশ্যে আসার পরই তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। শুরু হয় আলোচনা, তর্ক।

ওই যুগলের পক্ষে এবং বিপক্ষে সওয়াল জোরালো হতে থাকে। একদিকে যেমন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে থাকেন যে ‘জনসমক্ষে অন্তরঙ্গতা কী খুব প্রয়োজন?’

অন্যদিকে অপর পক্ষ যুক্তি, ‘হলেই বা সমস্যা কী?’

সাধারণ মানুষ কী বলছেন?

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও চোখে পড়েছে কলকাতার বাসিন্দা উপাসনা চৌধুরীর। পেশায় লেখিকা তিনি।

তার কথায় বলেন, “ভাবতে অবাক লাগে এক যুগলের চুম্বন দেখে আমরা এত দ্রুত রিয়্যাক্ট করছি, অথচ সেই আমরাই ছয় মাসের এক শিশুকে ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনাতে চুপ করে থাকি!”

“অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ, ভালবাসার উদযাপন নিয়ে কেন আমদের এত সমস্যা? আরও পরিণতমনস্কতার পরিচয় দিতে হবে আমাদের।”

দক্ষিণ কলকাতার একটা কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পাঠরত এক ছাত্রী তার এক অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী বলেছেন, “আমাদের জেনারেশনের কাছে জড়িয়ে ধরা বা চুম্বন কোনও বিষয় নয়। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে আমরা বন্ধুদের জড়িয়ে ধরি। বিষয়টা একেবারে নর্মাল (স্বাভাবিক)।”

কলকাতা মেট্রো স্টেশনে তোলা ওই ভিডিও সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তিনি। বছর ২০-র এই ছাত্রী বলেন, “কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে তোলা ওই ভিডিও নিয়ে সমালোচনায় আমি অবাক হইনি।”

“একবার আমার এক বন্ধু অটো স্ট্যান্ডে পর্যন্ত ছাড়তে এসেছিল। বিদায় জানানোর সময় আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। সেই সময় আশপাশের অনেকের খারাপ কথা বলতে থাকেন। খুব অপমানজনক ছিল ঘটনাটা। তারপর থেকে আর কখনও কোনও ছেলে বন্ধুকে রাস্তায় জড়িয়ে ধরিনি বা বলতে পারেন সাহস পাইনি।”

কলেজ পড়ুয়া তৃণাঙ্কুর দাস কলকাতা মেট্রোর ওই ঘটনাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে পিডিএ-তে স্বচ্ছন্দ বোধ করি না। কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধুদের কেউ করলে বা অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখলে আমি মোটেই তাদের টার্গেট (নিশানা) করব না বা ক্যামেরায় রেকর্ডও করব না।”

এই বিষয়ে তার পরামর্শ, “যাদের পছন্দ হচ্ছে না, তারা এড়িয়ে গেলেই পারেন। এই নিয়ে অযথা আলোচনা করার কোনও মানে হয় না বলেই আমার মনে হয়।”

একইভাবে, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন জনসমক্ষে এই অন্তরঙ্গতার যৌক্তিকতা নিয়ে। তাদেরই একজন গৃহবধূ তৃণা বসু। তার মেয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটা প্লে স্কুলে পড়ে। যাতায়াতের জন্য মেট্রোই ভরসা তাদের।

তিনি বলেছেন, “সত্যি কথা বলতে কী, মেট্রোতে বা পথে ঘাটে এমন দৃশ্য দেখলে অস্বস্তি হয় বৈকি, বিশেষত যদি সঙ্গে আমার ছোট্ট মেয়ে থাকে।”

বছর ২৮-এর এই গৃহবধূ বলেছেন, “আমার মতে সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট স্থান এবং সময় রয়েছে। জনসমক্ষে অন্তরঙ্গ না হলেই বা ক্ষতি কী? এইটুকু আমরা জনসমক্ষের আড়ালে তুলে রাখতে পারি, না কি? কারণ মুহূর্তটা তো শুধুমাত্র দু’জনেরই।”

“তবে এটা নিয়ে রে রে করে তেড়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলেও আমার মনে হয় না।”

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের একাধিক শহরে এমন ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। দিল্লি মেট্রোতেও একাধিক ঘটনায় অন্তরঙ্গ হওয়া যুগলকে জনসাধারণের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে। সম্প্রতি বেঙ্গালুরু মেট্রোতেও তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাকে একই কারণে জনরোষের শিকার হতে হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে দিল্লির বাসিন্দা পুলকিত গর্গ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “অফিসে যাতায়াতের সময় অনেক যুগলকেই দেখি সমালোচনার শিকার হতে। এটা কোনও অন্যায় বলে তো আমার মনে হয় না, তাও তাদের দু-চার কথা শুনতে হয়।”

“কিন্তু এক্ষেত্রে যারা ওই প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে আঙুল তোলেন, তাদের অনেককেই অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে দেখি বা অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি।”

পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন কি আইনত অপরাধ?
প্রকাশ্যে যুগলদের আলিঙ্গন এবং চুম্বন নিয়ে এর আগেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একাধিক ঘটনায় তথাকথিত নীতি-পুলিশদের বিরুদ্ধে যুগলদের হেনস্থার অভিযোগও সামনে এসেছে।

২০১৪ সালে কেরালার এক ক্যাফেতে যুগলদের অন্তরঙ্গ হওয়ার কারণে হেনস্থা করা হয় বলে অভিযোগ। তার প্রতিবাদ জানিয়ে কেরালাতে ‘কিস অফ লাভ’ কর্মসূচিও শুরু হয়েছিল যা পরে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

২০১৮ সালে কলকাতা মেট্রোতে ওই যুগলকে মারধরের ঘটনারও প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো জনসমক্ষে অন্তরঙ্গ হওয়া কী আইনত অপরাধ?

আইনজীবী বিভাস চ্যাটার্জী বলছেন, “না, ভারতীয় আইনে চুম্বন অপরাধ নয়। ভারতের আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, অবসিনিটি (অশ্লীলতা) হলে সেটা অপরাধ।”

এখন কোনটা অশ্লীল আর কোনটা নয়, তা আলোচনা এবং যুক্তি সাপেক্ষ।

এই বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রসঙ্গ আনেন। তিনি বলেছেন, “বর্তমানে এই সমস্ত ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের একটা জাজমেন্ট আমরা মেনে চলি। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বিষয় অশ্লীল কি না তা সমসাময়িক সমাজের নিরিখে বিচার করতে হবে। দেখতে হবে বিষয়টার শিল্পগত বা অন্য কোনও গুরুত্ব রয়েছে কি না, বিষয়টা আইন বিরুদ্ধ কি না ইত্যাদি।”

কলকাতা মেট্রোয় সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে নীতিপুলিশরা অনেকরকম কথা বলছেন বটে কিন্তু আইনের চোখে এটা অপরাধ বা নিষিদ্ধ তা সরাসরি বলাটা কঠিন। কারণ আমরা আস্তে আস্তে অনেক লিবারাল হচ্ছি এবং আইনের ইন্টারপ্রিটেশন (ব্যাখ্যাও) সেই দিকেই যাচ্ছে।”

অন্যদিকে, সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই পাল্টা অভিযোগ করেছেন যে ওই যুগলের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ভিডিও করে তা ইন্টারনেটে শেয়ার করা আদৌ ঠিক কি না।

সাইবার বিশেষজ্ঞ মি. চ্যাটার্জী বলেন, “এমন কোনও আইন নেই যে এটাকে (ভিডিও করা) আটকাবে কিন্তু কারও যদি প্রাইভেসি বিঘ্নিত হয় তাহলে তার (যার ভিডিও করা হচ্ছে) সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে অভিযোগ জানানোর। এই ঘটনা যেহেতু পাবলিক ফোরামে হচ্ছে তাই প্রাইভেসি বিঘ্নিত হচ্ছেও বলা যায় না।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায় আবার মনে করেন, পুরো বিষয়টা নির্ভর করছে কে কীভাবে সেটা দেখছেন। এই ঘটনাকে মনোসামাজিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।

তার কথায়, “স্বভাবতই সব মানুষ সমান দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টাকে দেখেন না। আমি থাকলে হয়ত তাদের না দেখার মতো করে চলে যেতাম। কিন্তু যিনি বিষয়টাকে ক্যামেরাবন্দি করে সমাজ মাধ্যমে আপলোড করেছেন, তিনি বিষয়টাকে দেখেছেন এবং সেটাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও চেয়েছেন।”

“এখানে বড় প্রশ্ন হলো তিনি কেন এই ভিডিও করলেন এবং কেনই বা তা সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন।” এক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাবনার কথা বলেছেন মি. রায়।

তার কথায়, “হতে পারে ওই ব্যক্তির মধ্যে মুক্তমনস্কদের দেখে কিছুটা ঈর্ষা কাজ করেছে। কিংবা নিছকই সামাজিক মাধ্যমে এই ভিডিও ভাইরাল করার উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করেছেন। তিনি জানেন এটা আরও প্রচার পাবে এবং এই নিয়ে কথা হবে। সেক্ষেত্রে দুষ্টুমিই তার মোটিভ।”

এই প্রসঙ্গে নীতিপুলিশদের ভূমিকার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে মি. রায় জানিয়েছেন, নীতিপুলিশ কোনও বিষয় জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত বিশেষ লাভ হয় না।

তিনি বলেছেন, “সমাজ পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয় এবং কেউ কেউ বলেন সেটা হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তার বড় উদাহরণ হলো সোভিয়েত এক্সপেরিমেন্ট, নাৎসি বা চাইনিজ এক্সপেরিমেন্ট যারা নীতিবোধকে রাতারাতি বদলাতে চেয়েছিল।”

২০১৮ সালে কলকাতা মেট্রোয় এক যুগল একে অপরকে আলিঙ্গনের পর তাদের উপস্থিত যাত্রীদের একাংশের রোষানলে পড়তে হয়। মারধর এবং হেনস্থা হতে হয়েছিল তাদের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্কও দানা বেঁধেছিল। প্রতিবাদে ‘ফ্রি হাগ’ এবং অন্যান্য কর্মসূচি পালন হয়েছিল।

বলেছেন, “এই ক্ষেত্রেও বাধা দিয়ে লাভ নেই। এক্ষেত্রে যেমন তাদের যুক্তি হবে যে তোমরা আমাদের প্রকাশ্যে চুম্বন করতে দিলে না, কিন্তু আমরা জায়গা খুঁজে নেব।”

“সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই কমপ্লেক্স রিয়েলিটিটাই কাজ করে। তারা যতই বাঁধন কষবেন, উল্টোদিকে ততই প্রভোকেটেড হয়ে পড়বে।”

সাম্প্রতিক ঘটনায় অবশ্য যুগলকে হেনস্থা হতে হয়নি। তাহলে কী ‘সাবালক’ হচ্ছে কলকাতা? ‘সহনশীলতা’ বাড়ছে?

অধ্যাপক ও সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “মানুষের মধ্যে কতটা সহনশীলতা বেড়েছে তা বলা মুশকিল। হয়ত সেটা বেড়েছে কিংবা দেখা যাবে ২০১৮ সালে মেট্রোর ঘটনায় যারা সহযাত্রী ছিলেন এবং সাম্প্রতিক ঘটনায় মেট্রো স্টেশনে যারা ছিলেন তারা ভিন্ন ধরনের মানুষ।”

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের মতোই তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন ওই ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করা ব্যক্তিকে নিয়ে। তার কথায়, “এক্ষেত্রে যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, সেটা হলো কী উদ্দেশ্য নিয়ে এই ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল।”

“এক্ষেত্রে দু’টো কারণ হতে পারে। এক, ডেপ্রাইভেশনের জায়গা অর্থাৎ আমি পাইনি তাই আমি ভিডিও করে মজা পাচ্ছি। কিম্বা নীতিপুলিশ হয়ে বিষয়টাকে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া।”

ভিডিওর সমালোচকদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন এই আচরণ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী।

এই প্রসঙ্গে শাশ্বতী ঘোষ বলেছেন, “কোনটা আমাদের সংস্কৃতি আর কোনটা নয় সেটা কে নির্ধারণ করবে। অনেকেই বলবে খাজুরাহো আমাদের সংস্কৃতি নয়। অথচ যুগলের চুম্বন বা মিলনের দৃশ্য অনেক মন্দিরের গাত্রে খোদাই করা আছে। সেটা তো পুজো করার জায়গা।”

“আসলে কোনটা সংস্কৃতি আর কোনটা নয় তা সমসাময়িক যুগের উপর ভিত্তি করে ঠিক হয়।”

তবে বেশ কিছু বিষয়ে যে চিন্তা এবং গ্রহণযোগ্যতা বদলাচ্ছে তাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

তার কথায়, “বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের চিন্তা ভাবনা বদলাচ্ছে। আগে অন্তরঙ্গ দৃশ্য সিনেমাতে বোঝাতে দুটো ফুল বা একজোড়া প্রজাপতি দেখানো হতো। সেখান থেকে তো আমরা অনেকটা সরে এসেছি। এখন পিডিএ নিয়ে অনেক বেশি কথা হয়।”

ফেমিনিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট শতাব্দী দাশ আবার বলেছেন, “এই বিষয়ে জনসাধারণের তো কিছু বলার থাকতে পারে না। আসলে চুম্বন সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই অদ্ভুত। মানুষ মানুষকে চুম্বন করবে এটা তো স্বাভাবিক। একজন মা যেমন তার শিশুকে চুম্বন করতে পারেন প্রেমিক-প্রেমিকাও তা করতে পারেন।”

“মূলত ভালবাসা দেখাতেই চুম্বন করা হয়। এটা একেবারেই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ করার একটা মাধ্যম। এখানে বাধা দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।”

পেশায় শিক্ষিকা শতাব্দী দাশ। তিনি বলেছেন, “আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বলব ভালবাসাকে তারা যেভাবে খুশি জাহির করতে পারে এবং যেকোনও লিঙ্গের মানুষের প্রতি করতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এতে কোনও অপরাধ নেই।”

“আমি তাদের বলব রাস্তায় কাউকে ইভটিজ করা, হেনস্থা করা অপরাধ কিন্তু কারও প্রতি ভালোবাসা দেখানোটা মোটেই খারাপ কিছু নয়।”

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ।