চাকরি আছে। বেতন ভাতাসহ সকল সুযোগ সুবিধা আছে। কিন্তু কোনো পোস্টিং নেই। প্রতিদিন সচিবালয়ের লাইব্রেরীতে গিয়ে হাজিরা খাতায় সই করার মধ্যে সীমাবদ্ধ এদের দায়িত্ব। এরা হলেন, ‘ওএসডি’। যার পূর্ণরূপ ‘অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি’ বা ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’। যা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। তৎকালীন ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ওএসডি’র বিধান চালু করা হয়, যার চর্চা পাকিস্তান আমলেও বলবৎ ছিল। অতীতের রীতি মেনে স্বাধীন বাংলাদেশেও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার নিয়ম রাখা হয়। বর্তমানে সংস্থাপন বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার বিধান রয়েছে। এর বাইরে, অন্য বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে সংযুক্ত করার নিয়ম চালু আছে। প্রশাসনিক প্রয়োজনেই দেশ স্বাধীনের পর জনপ্রশাসনে ওএসডি বিধান রাখা হয়েছিল।
বিশেষ দায়িত্বের বাইরেও আরো বেশ কিছু প্রশাসনিক প্রয়োজনে ওএসডি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষণ বা ছুটিতে যাওয়া। চাকরিরত অবস্থায় কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ টানা তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন, অসুস্থতা বা চিকিৎসাজনিত কারণে ছুটি নিতে চাইলে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে রাখা হয়। প্রশিক্ষণ বা ছুটিতে থাকাকালে তাদের বেতন-ভাতা যেন বন্ধ না হয়, সেজন্যই এটি করার প্রয়োজন পড়ে। একই কারণে পদোন্নতি পাওয়ার পর একজন কর্মকর্তাকে তার নতুন পদে পদায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে ওএসডি করে রাখা হয়ে থাকে।
এছাড়া কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ প্রেষণে অন্য কোনো বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানে গেলে কিংবা অন্য কোনো বিভাগে সংযুক্ত থাকা কর্মকর্তাকে সেখান থেকে অবসর দেওয়ার সময় ওএসডি করার প্রয়োজন হয়। এর বাইরে, কর্মকর্তাদের কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি বা শৃঙ্খলাভঙ্গের মতো কোনো অভিযোগ উঠলে সেটির তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে ওএসডি করে রাখার বিধান রয়েছে। এছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে অভিযুক্ত কর্মকর্তা যেন কোনোভাবে তদন্তকাজে বাধা সৃষ্টি করতে না পারেন, সেজন্য তাকে ওএসডি করা হয়ে থাকে। তবে সরকার চাইলে এসবের বাইরেও যেকোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করতে পারে।
আমাদের দেশে প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তার বাইরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদেরকে ওএসডি করার নজির রয়েছে। বিশেষ করে গত তিন দশকে যেহারে রাজনৈতিক বিবেচনায় অযৌক্তিতভাবে ওএসডির ঘটনা ঘটেছে, সেটি বেশ উদ্বেগজনক। মূলত ১৯৯৬ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসার পর তাদের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করা হয়, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরাও অংশ নেন। ওই ঘটনার পর কর্মকর্তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে চলে আসে এবং তাদের অনেকে পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের সময় ওএসডি হন।
একইভাবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বিএনপি শাসনামলে পদোন্নতি পাওয়া অনেক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। এমনকি সম্প্রতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বেঅন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরেও একইভাবে শেখ হাসিনার শাসনামলে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের অনেকে ওএসডি হয়েছেন।
ওএসডি হওয়া খাতা-কলমে হাজিরা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও উচ্চপদের কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই সেটি অনুসরণ করেন না। যেহেতু কাজ নেই, সেজন্য তারাও অফিসে আসার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। তবে হাজিরা যেন ঠিক থাকে, সেজন্য সপ্তাহে একদিন এসে বাকি দিনগুলোর জায়গাতেও সই করে চলে যান। অনেকে গল্প-গুজব করে সময় কাটান। কেউ হয়তো বইপত্র নেড়ে-চেড়ে দেখেন।
এদিকে, সরকারি কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (জিইএমএস) ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে ওএসডি থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১৬ জন সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিবের নাম রয়েছে। ওই তালিকায় আরও প্রায় অর্ধশত জন অতিরিক্ত সচিবের নাম দেখা গেছে। শীর্ষ এসব কর্মকর্তাদের অনেকেই ওএসডি হয়েছেন শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর।
মজার বিষয় হলো, ওএসডি হওয়ার পর কর্মকর্তারা কোনো কাজ না করলেও তাতে বেতন-ভাতা আটকে থাকে না। পদ অনুযায়ী আগের মতোই বেতন-বোনাস, গাড়ি-বাড়িসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। সরকারের কর্মকর্তাদের এভাবে বসিয়ে বসিয়ে বেতন-বোনাস দেওয়াটা জনগণের করের টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
ওএসডি করার মাধ্যমে কর্মকর্তাদেরকে বেকার বসিয়ে রাখার ফলে যে মেধার পাশাপাশি যে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হচ্ছে। ওএসডি হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত শেষ করা। সেখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে ওএসডি করে না রেখে বরং তাকে বরখাস্ত বা অন্য কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
আরো পড়ুন : পোশাক কারখানায় স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনুন