মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ী হওয়ার পর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এখন আলোচনার বিষয় সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেমন হবে। মানবাধিকার সংক্রান্ত কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে শীতলতা চলছিলো। এসময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বক্তব্যেও তা প্রকাশ পাচ্ছিলো। তবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে অনেকটাই উষ্ণতা দেখা গেছে।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট নেতাদের সম্পর্ক বরাবরই বেশ ভালো। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে তার উচ্ছ্বসিত ছবিতেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন যে, শুধু ডেমোক্র্যাট না, রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুসম্পর্ক রয়েছে। তার মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান সর্ম্পক আরও উচ্চ শিখরে পৌঁছাবে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে অবধারিতভাবেই এই প্রশ্ন আসছে যে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ যেভাবে গলতে শুরু করেছিলো, এখনও তা অব্যাহত থাকবে কি না।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের ওপর রাতারাতি কোনও প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে গিয়ে পরতে পারে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক নয়।
এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২০১৬ সালে ফিরে গেলে। তখন রিপাবলিকান পার্টি থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই বছরই ফ্রান্সের এইচইসি প্যারিস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখার সময় মুহাম্মদ ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়কে ‘সূর্যগ্রহণ’ বা অন্ধকার সময় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার এক চিঠিতে তিনি বলেন যে “দুই দেশের অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে ও টেকসই উন্নয়নের জন্য একসঙ্গে কাজ করতে উন্মুখ রয়েছি।”
তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরাসরি ফোন-ই করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর আগে তিনি ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের দু’জনের কিছু ছবিসহ আরও একটি টুইট করেছিলেন। এই দু’টো টুইটেই নরেন্দ্র মোদী ট্রাম্পকে “বন্ধু” হিসাবে সম্বোধন করেছেন।
এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদী’র মধ্যকার সম্পর্ক সবসময়ই ভালো। সেইসাথে, রিপাবলিকান পার্টির সাথেও ভারতের সম্পর্ক সবসময়ই খুব ভালো থাকে। তবে তাদের দু’জনের এই বন্ধুত্ব বাংলাদেশের জন্য কিছুটা চিন্তার কারণ।
কারণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ভালো বন্ধু ভারত এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতের লক্ষ্য হবে, আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় আনতে সবরকম সহযোগিতা করা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনকে নিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা করার আরও একটি কারণ, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক্সে (পূর্বের টুইটার) ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া একটি টুইট। তিনি সেই টুইটে দাবি করেছেন যে বাংলাদেশে হিন্দুসহ সংখ্যালঘুদের ওপর ‘বর্বর নির্যাতন’ চলছে। তার ওই বিবৃতি তখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিলো।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে হঠাৎ “নাটকীয় পরিবর্তন” ঘটে যাবে বলে তিনি মনে করছেন না। কারণ এটিকে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে যে মার্কিন নীতিতে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কি না। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বেই, এতটা ঘনিষ্ঠতা থাকবে না। উষ্ণতা থাকবে না।
বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি কী, সেখানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা প্রয়োজন মনে করে, তার জন্য ভারতকে কী কী দিতে হবে এবং ভারত কী কী চাইবে, এখানে এই সমস্ত সমীকরণ আছে।
এশীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে কূটনীতি আছে, বাংলাদেশকে তার-ই একটি উপাদান হিসাবে দেখে তারা। সেই উপাদানের প্রেক্ষাপট হলো, এখন সে চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত। ট্রাম্পের আমলে সেটি আরও ধারালো হবে। তা বজায় রাখতে হলে ভারতের সাথে তার কৌশলগত সম্পর্ক বজায় থাকবে।
অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র এখানে বাংলাদেশকে নিয়ে খুব বেশ মাথা ঘামাতে চাইবে না। কারণ “তারা এটি খুব ভালো করে জানে যে এখানে যদি স্থিতিশীল অবস্থা থাকে এবং অর্থনীতি ক্রমাগত উন্নতির দিকে যায়, তাহলে আমরা তাদের সাথে অংশীদারিত্ব ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারবো।
আরো পড়ুন : নির্বাচন নিয়ে জনমনে ধোঁয়াশা