বাংলাদেশে নিয়োগ, ভর্তি পরীক্ষা, অ্যাকাডেমিক পরীক্ষা সবখানেই আছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা। প্রশ্ন ফাঁস করে কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে, অন্যদিকে নানা সাফল্যের পালক উঠছে অযোগ্যদের মাথায়।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এর প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ১৭ জনের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে আছেন পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলী। তিনি বছরের পর বছর সরকারি এই গুরুত্বপূর্ণ চাকরির প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ। প্রশ্ন ফাঁস-কাণ্ডে তার সাথে পিএসপির কয়েকজন কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর, উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারি পরিচালক আলমগীর কবির। আরো রয়েছেন অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম।
পিএসসির বাইরে নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান, নোমান সিদ্দিকী, আবু সোলায়মান মো: সোহেল, জাহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদ, সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন, লিটন সরকার ও সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকেও আটক করা হয়েছে। সোহানুর রহমান সিয়াম পিএসসির ড্রাইভার আবেদ আলীর ছেলে ও ছাত্রলীগ নেতা।
আটকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, তারা ৩৩তম বিসিএস থেকে সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষাসহ নন-ক্যাডার নিয়োগের একাধিক পরীক্ষায়র প্রশ্ন ফাঁস করেছে। পিএসসির মাধ্যমে এখন শুধু বিসিএস ক্যাডার নয়, সরকারের বিভিন্ন দফতরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদেরও নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মো: মনিরুজ্জামান মনির অভিযোগ করেন, ‘২০২০ সাল থেকে রেলওয়ের নিয়োগ শুরু হয় পিএসসির মাধ্যমে। আর তখন থেকেই পিএসসির কিছু কর্মকর্তা প্রশ্ন ফাঁস করে রেলওয়েতে নিয়োগ-বাণিজ্য শুরু করে। তারা এর জন্য ধাপে ধাপে অর্থ নেয়। প্রতিটি নিয়োগে ২৫-৩০ লাখ টাকা আয় করে তারা। আমরা অভিযোগও করেছি। কিন্তু পিএসসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তখন কেউ কথা বলার সাহস করেনি। এখন তো বাস্তব পরিস্থিতি প্রকাশ হলো।’
শুধু বিসিএস নিয়োগ পরীক্ষা নয়, অন্য নিয়োগেরও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এর আগে ব্যাংকে কর্মকর্তা নিয়োগের পরীক্ষা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও আছে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস অনেকবার হয়েছে। আর সর্বশেষ নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
কিন্তু এইসব ঘটনায় মামলা ও গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় সবাই ছাড়া পেয়ে যান। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন ছাত্রসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তাদের অনেককে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু আদালতের বিচারে তারা সবাই ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি খালাস পান। এটি ছিল প্রশ্ন ফাঁসের সবচেয়ে বড় চক্র।
২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নিয়োগসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ২০০ মামলা হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। তার মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র একটি মামলায়। ৪৪টি মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়েছেন।
এখন প্রশ্ন ফাঁস সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিসিএসের প্রশ্নও যখন ফাঁস হয়, তখন তো আর আস্থার জায়গা থাকে না। প্রশ্ন ফাঁনের অভিযোগে শুধু ড্রাইভারকে ধরলেই চলবে না। এর মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে হবে।
বিচারহীনতায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ দাবি করি, অথচ প্রশ্ন ফাঁস আটকাতে পারি না। সদিচ্ছা থাকলে এটা বন্ধ করা সম্ভব। ডিজিটালি পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ছাপানো যায়। সেটা করা হলে আর প্রশ্ন ফাঁস হবে না।
এছাড়া আটকৃতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এমন অন্যায় করার দু:সাহস আর কেউ না দেখায়।