ঢাকা ০৪:০৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৫ জানুয়ারী ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :

সুফিয়া কামাল; নারী আন্দোলনের পুরোধা

সুফিয়া কামাল
নারী আন্দোলনের পুরোধা
(২০শে জুন ১৯১১ – ২০শে নভেম্বর ১৯৯৯)
বেগম সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

জন্ম ও বংশ:
সৈয়দা সুফিয়া বেগম ২০শে জুন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়ি রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান জমিদার খান্দানের মেয়ে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত শিলাউরের সৈয়দ বংশ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ১৯১৮ সালে সুফিয়ার বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী ওকালতি চাকরি এবং ঘরবাড়ি ছেড়ে সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। তাই সুফিয়া তার মা সৈয়দা সাবেরা বেগমের সাথে মামার বাড়িতেই বড় হন। সুফিয়ার নানা খান বাহাদুর নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন একজন জমিদার এবং বিখ্যাত ম্যাজিস্টেট।

প্রাথমিক জীবন:
বাবার নিরুদ্দেশ যাত্রার পর তার মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। এই কারণে তার শৈশব কেটেছিল নানার বাড়িতে।

যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। তার মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এই কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তার।

১৯২২ সনে ১১ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।

সাহিত্যচর্চার সূচনা এবং কলকাতার জীবন:
সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

নিজের সাহিত্য প্রয়াসের সূচনা প্রসঙ্গে তিনি এ ভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন, “এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দহেনাদ পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।”

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায় যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৩২ সালে তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় নিপতিত করে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিন আহমেদের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। দেশবিভাগের পূর্বে কিছু কাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন।

ঢাকার জীবন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড:
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতোপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ঐ সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন ।

স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

সাহিত্যকর্ম:
কাব্যগ্রন্থ: সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২), Mother of Pearls and Other Poems (English poem) ।
গল্প: কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭), মুক্তিযুদ্ধ মুক্তির জয় (মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ)।
ভ্রমণকাহিনি: সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮)।
স্মৃতিকথা: একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)।
আত্মজীবনী: একালে আমাদের কাল (১৯৮৮)।
শিশুতোষ: ইতল বিতল (১৯৬৫), নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮১)।
অনুবাদ: সাঁঝের মায়া- বলশেভনী সুমের্কী (রুশ) (১৯৮৪)।

পুরস্কার:
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১) (প্রত্যাখান করেন ১৯৬৯), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), সংগ্রামী নারী পুরস্কার, চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৮১), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭)।

মৃত্যু:
সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করা হয়।

সুফিয়া কামালের একগুচ্ছ কবিতা

প্রার্থনা

তুলি দুই হাত করি মোনাজাত
হে রহিম রহমান
কত সুন্দর করিয়া ধরণী
মোদের করেছ দান।

গাছে ফুল ফল
নদী ভরা জল
পাখির কন্ঠে গান
সকলি তোমার দান।

মাতা, পিতা, ভাই, বোন ও স্বজন
সব মানুষেরা সবাই আপন
কত মমতায় মধুর করিয়া
ভরিয়া দিয়াছ প্রাণ।

তাই যেন মোরা তোমারে না ভলি
সরল সহজ সৎ পথে চলি
কত ভাল তুমি, কত ভালোবাস
গেয়ে যাই এই গান।

হেমন্ত

সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?

আনল ডেকে মটরশুঁটি
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।

হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।

জন্মেছি এই দেশে

অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।
আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।

আরো পড়ুন :

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক; রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

কামিনী রায়; প্রথিতযশা বাঙালি মহিলা কবি

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

সুফিয়া কামাল; নারী আন্দোলনের পুরোধা

আপডেট সময় ১১:৩০:০১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

সুফিয়া কামাল
নারী আন্দোলনের পুরোধা
(২০শে জুন ১৯১১ – ২০শে নভেম্বর ১৯৯৯)
বেগম সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

জন্ম ও বংশ:
সৈয়দা সুফিয়া বেগম ২০শে জুন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়ি রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান জমিদার খান্দানের মেয়ে। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত শিলাউরের সৈয়দ বংশ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ১৯১৮ সালে সুফিয়ার বয়স যখন সাত বছর তখন তাঁর বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী ওকালতি চাকরি এবং ঘরবাড়ি ছেড়ে সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। তাই সুফিয়া তার মা সৈয়দা সাবেরা বেগমের সাথে মামার বাড়িতেই বড় হন। সুফিয়ার নানা খান বাহাদুর নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন একজন জমিদার এবং বিখ্যাত ম্যাজিস্টেট।

প্রাথমিক জীবন:
বাবার নিরুদ্দেশ যাত্রার পর তার মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। এই কারণে তার শৈশব কেটেছিল নানার বাড়িতে।

যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। তার মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এই কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তার।

১৯২২ সনে ১১ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।

সাহিত্যচর্চার সূচনা এবং কলকাতার জীবন:
সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

নিজের সাহিত্য প্রয়াসের সূচনা প্রসঙ্গে তিনি এ ভাবে স্মৃতিচারণ করেছেন, “এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দহেনাদ পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর আছে? গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে হলো ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে, কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প। কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।”

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায় যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৩২ সালে তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে আর্থিক সমস্যায় নিপতিত করে। তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিন আহমেদের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। দেশবিভাগের পূর্বে কিছু কাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন।

ঢাকার জীবন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড:
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতোপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ঐ সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন ।

স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

সাহিত্যকর্ম:
কাব্যগ্রন্থ: সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২), Mother of Pearls and Other Poems (English poem) ।
গল্প: কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭), মুক্তিযুদ্ধ মুক্তির জয় (মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ)।
ভ্রমণকাহিনি: সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮)।
স্মৃতিকথা: একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)।
আত্মজীবনী: একালে আমাদের কাল (১৯৮৮)।
শিশুতোষ: ইতল বিতল (১৯৬৫), নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮১)।
অনুবাদ: সাঁঝের মায়া- বলশেভনী সুমের্কী (রুশ) (১৯৮৪)।

পুরস্কার:
সুফিয়া কামাল ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: পাকিস্তান সরকারের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬১) (প্রত্যাখান করেন ১৯৬৯), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), সংগ্রামী নারী পুরস্কার, চেকোশ্লোভাকিয়া (১৯৮১), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭)।

মৃত্যু:
সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করা হয়।

সুফিয়া কামালের একগুচ্ছ কবিতা

প্রার্থনা

তুলি দুই হাত করি মোনাজাত
হে রহিম রহমান
কত সুন্দর করিয়া ধরণী
মোদের করেছ দান।

গাছে ফুল ফল
নদী ভরা জল
পাখির কন্ঠে গান
সকলি তোমার দান।

মাতা, পিতা, ভাই, বোন ও স্বজন
সব মানুষেরা সবাই আপন
কত মমতায় মধুর করিয়া
ভরিয়া দিয়াছ প্রাণ।

তাই যেন মোরা তোমারে না ভলি
সরল সহজ সৎ পথে চলি
কত ভাল তুমি, কত ভালোবাস
গেয়ে যাই এই গান।

হেমন্ত

সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?

আনল ডেকে মটরশুঁটি
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।

আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।

হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।

জন্মেছি এই দেশে

অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
অনেক গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।
আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।

আরো পড়ুন :

তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক; রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ

কামিনী রায়; প্রথিতযশা বাঙালি মহিলা কবি