টেস্ট ম্যাচের তৃতীয় দিনকে বলা হয় ‘মুভিং ডে।’ ম্যাচের সম্ভাব্য পরিণতির ইঙ্গিত সাধারণত মেলে এ দিনই। জ্যামাইকা টেস্টেও তা ফুটে উঠল অনেকটাই। ব্যাটে-বলে চমকপ্রদ পারফরম্যান্সে দিনটি রাঙাল বাংলাদেশ। গতি আর বাউন্সের মিশেলে অগ্নিঝরা বোলিংয়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং ছারখার করলেন নাহিদ রানা। নাটকীয় লিড পাওয়ার পর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে চমকে দিলেন ব্যাটসম্যানরা। স্বপ্নের আবির চোখে মেখে দিন শেষ করল বাংলাদেশ।
জ্যামাইকায় বাংলাদেশের সামনে এখন দারুণ এক জয়ের হাতছানি। তৃতীয় দিন শেষে সফরকারীরা এগিয়ে ২১১ রানে, উইকেট আছে এখনও ৫টি।
স্যাবাইনা পার্কে ১ উইকেটে ৭০ রান নিয়ে তৃতীয় দিন শুরু করা ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৪৬ রানেই। এক পর্যায়ে ১ উইকেটে ৮৫ রান করা দল ভয়াবহ ব্যাটিং ধসে ৯১ রানের মধ্যে হারায় ৯ উইকেট।
১৬৪ রানের পুঁজি নিয়েও ১৮ রানের মহামূল্য লিড পায় বাংলাদেশ।
একসময় পেস বোলারদের স্বর্গ ছিল যে অঞ্চল, সেই ক্যারিবিয়ায় টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেটের স্বাদ পান নাহিদ রানা। গতির ঝড়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং কাঁপিয়ে দিয়ে ৬১ রানে ৫ উইকেট নেন ২২ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে পাল্টা আক্রমণে ক্যারিবিয়ানদের চমকে দেয় বাংলাদেশ। শেষ পর্যন্ত সোমবার দিন শেষ করে তারা ৫ উইকেটে ১৯৩ রান নিয়ে।
জিততে হলে এই মাঠে রান তাড়ার রেকর্ড নতুন করে লিখতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। অসুস্থতার কারণে এ দিন ব্যাটিং করতে পারেননি মুমিনুল হক। চতুর্থ দিনে তাকে নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আশার জায়গাও অনেক বেশি। লক্ষ্যটাকে তারা নিয়ে যেতে চাইবে ক্যারিবিয়ানদের নাগালের বাইরে।
আগের দিন দারুণ বোলিং করেও ৩৭ ওভারে কেবল একটি উইকেট নিতে পারে বাংলাদেশ। তৃতীয় দিন সকালে প্রথম পাঁচ ওভার নির্বিঘ্নে কাটিয়ে দেন ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ও কেসি কার্টি। এরপর দৃশ্যপটে আবির্ভাব নাহিদের।
তার গতি ও বাড়তি বাউন্সে টালমাটাল হয়ে গালিতে ধরা পড়েন ব্র্যাথওয়েট। ১৩৯ বল খেলে ২৯ রানে আউট হন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক।
কার্টির সঙ্গে তার জুটি থামে ৬০ রানে। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের আর কোনো জুটিতে ১৫ রানও আসেনি।
নাহিদ পরের ওভারে ফেরান নতুন ব্যাটসম্যান কাভেম হজকে। তাসকিন আহমেদের কাছে জীবন পাওয়ার এক বল পরই কিপার লিটন দাসের দারুণ রিফ্লেক্স ক্যাচের শিকার হন তিনি।
এরপর উইকেট ধরা দিতে থাকে একের পর এক। তাসকিনের নিচু হওয়া বলে বোল্ড হন আলিক আথানেজ, আগের টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান জাস্টিন গ্রেভস ২ রানে বোল্ড তাইজুল ইসলামের দুর্দান্ত ডেলিভারিতে।
উইকেট শিকার উৎসবে যোগ দেন হাসান মাহমুদও। জশুয়া দা সিলভা টিকতে দেননি তিনি। লম্বা সময় এক প্রান্ত আগলে রাখা কেসি কার্টিকেও বিদায় করেন তিনি। ১৯৯ মিনিট ক্রিজ আঁকড়ে এই ব্যাটসম্যান উইকেট হারান লেগ স্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে (৪০ রান)।
নাহিদ পরে লোয়ার অর্ডারে ছোবল দিয়ে পূর্ণ করেন ছয় টেস্টের ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট। মাস তিনেক আগে রাওয়ালপিন্ডিতে চার উইকেট ছিল তার আগের সেরা বোলিং।
১৭ ওভার বোলিং করে মাত্র ২৪ রান দেন তাইজুল ইসলাম। টেস্টে অন্তত ১৫ ওভার বোলিং করা বোলারদের মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলিংয়ের কীর্তি এটি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের পর আর কেউ দুঅঙ্ক ছুঁতে পারেননি।
রোচের উইকেট নেওয়ার আগে তার গায়ে বার দুয়েক বল লাগান নাহিদ। তাতে বড় ক্ষতি হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের। চোটের কারণে বোলিং ইনিংসের শুরুতে অভিজ্ঞ এই পেসারকে পায়নি দল।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে জেডেন সিলসের প্রথম ওভারেই হারায় মাহমুদুল হাসান জয়কে। ১৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে সপ্তমবার শূন্য রানে আউট হলেন তিনি। তার ব্যাটে ফিফটি নেই টানা ১৫ ইনিংস।
মুমিনুলের জায়গায় তিনে নেমে শাহাদাত হোসেন আগ্রাসী ব্যাটিং শুরু করেন তৃতীয় ওভারের পর থেকে। আরেকপ্রান্তে সাদমান ইসলামও শট খেলতে থাকেন। দলের পরিকল্পনা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
শাহাদাত বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারেননি। আলজারি জোসেফের বলে একবার জীবন পাওয়ার পর তার বলেই উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান তিনি ২৬ বলে ২৮ রান করে।
তবে বাংলাদেশের পথ বদলায়নি। টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবার চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে বাউন্ডারির ফোয়ারা ছুটিয়ে দলকে এগিয়ে নেন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ।
এক পর্যায়ে মিরাজ ও সাদমান মিলে ৯ বলের মধ্যে বাউন্ডারি মারেন ৭টি!
প্রথম ১৫ ওভারে ১৬ বাউন্ডারিতে বাংলাদেশের রান দাঁড়ায় ৯৯।
এরপর রানের গতিতে একটু লাগাম দেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চা-বিরতির পরপরই এই জুটি থামে ৭০ রানে। শামার জোসেফের বলে আলগা শটে উইকেট হারান ৭ চারে ৪৬ রান করা সাদমান।
একটু পর শামারের লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে আউট হয়ে যান মিরাজ (৩৯ বলে ৪২)।
৩০ ওভারের পর মাঠে ফিরে বল হাতে নেন কিমার রোচ। তবে চেনা ধার দেখা যায়নি তার বোলিংয়ে। জাকের আলিকে নিয়ে আরেকটি কার্যকর জুটি গড়েন লিটন কুমার দাস।
এই জুটি ৪১ রানে থামান জাস্টিন গ্রেভস। তার চোখধাঁধানো একটি অফ কাটার অনেকটা ভেতরে ঢুকে লিটনকে চমকে দিয়ে ছোবল দেয় স্টাম্পে (২৫)। এরপর জাকের ও তাইজুল আরও বাড়িয়ে নেন দলের লিড।
চতুর্থ দিনে এই রান যত বাড়বে, বাংলাদেশ ততই গিয়ে যাবে জয়ের দিকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৬৪
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১ম ইনিংস: ৬৫ ওভারে ১৪৬ (আগের দিন ৭০/১) (ব্র্যাথওয়েট ৩৯, লুই ১২, কার্টি ৪০, হজ ৩, আথানেজ ২, গ্রেভস ২, দা সিলভা ৫, আলজারি জোসেফ ৭, রোচ ৮, শামার জোসেফ ৬, সিলস ৮*; হাসান ১১-৪-১৯-২, তাসকিন ১৪-৭-২০-১, নাহিদ ১৮-১-৬১-৫, তাইজুল ১৭-৭-২৪-১, মিরাজ ৫-১-১৫-১)।
বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৪১.৪ ওভারে ১৯৩/৫ (জয় ০, সাদমান ৪৬, শাহাদাত ২৮, মিরাজ ৪২, লিটন ২৫, জাকের ২৯*, তাইজুল ৯*; সিলস ৯-২-৪৩-১, আলজারি জোসেফ ৮.৪-০-৩৯-১, শামার জোসেফ ১০-০-৭০-২, গ্রেভস ৮-১-২০-১, হজ ১-০-৪-০, রোচ ৫-০-১২-০)।