পোপ হচ্ছেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু। পোপ হিসেবে যিনি নির্বাচিত হন, তিনি ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা সব চার্চের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১২ বছর ধরে বিশ্বের প্রায় ১৪০ কোটি ক্যাথলিককে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন পোপ ফ্রান্সিস।
সোমবার পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। এক বিবৃতিতে ভ্যাটিকান জানিয়েছে, ২১ এপ্রিল ইস্টার সোমবার ৮৮ বছর বয়সে ভ্যাটিকানের কাসা সান্তা মার্টায় নিজ বাসভবনে মারা যান তিনি।
একজন পোপের মৃত্যু এবং তার উত্তরসূরি নির্বাচনে নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। পোপের মৃত্যুর খবর ভ্যাটিকানের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়। একজন চিকিৎসক পোপের পালস পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সমর্থকরা যেন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন সেজন্য তার মরদেহ জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। এরপরেই শেষকৃত্য এবং দাফন সম্পন্ন হয়।
মৃত ঘোষণার পর পোপের হাতে থাকা রিং অব ফিশারম্যান খুলে নেওয়া হয় এবং অন্যান্য নথির সঙ্গে তা নষ্ট করে দেওয়া হয়। এই আংটি হলো কোনো পোপের আইডেন্টিফিকেশন। এর মানে হচ্ছে, তার ক্ষমতাকালের সমাপ্তি। এটা পোপের ক্ষমতা শেষের একটি প্রতীকী প্রথা। প্রত্যেক পোপের জন্য আলাদা করে আংটি তৈরি করা হয়।
পোপের মৃত্যুর পর তার বাসস্থানে সিল করে দেওয়া হয়। পোপের মৃত্যুর পর ক্যাথলিক চার্চে শোক ঘোষণা করা হয়। সাধারণত মৃত্যুর চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ দিনের মধ্যে পোপকে সমাহিত করা হয়। অধিকাংশ পোপকেই ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হয়। তবে পোপ ফ্রান্সিস ২০২৩ সালে একটি সাক্ষাৎকারে রোমের সান্তা মারিয়া ম্যাগিওর ব্যাসিলিকায় তার দেহ রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
গত বছরই পোপ ফ্রান্সিস বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান সংশোধন করেছিলেন। একজন সাধারণ বিশপ হিসেবে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতিনীতি যেন সহজ হয় সে বিষয়টিকেই জোর দিয়েছেন তিনি। তার ইচ্ছানুযায়ী, ভ্যাটিকানের বাইরে তার দাফনের অনুমতি রয়েছে। তবে মূল কিছু বিষয় অপরিবর্তিত থাকবে।
শেষকৃত্যের রীতিনীতিতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল কেন?
যদিও উত্তরসূরি নির্বাচনের প্রক্রিয়া বা কনক্লেভের নিয়ম নিয়ে পোপদের মধ্যে কিছুটা দ্বিমত ছিল। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে পোপের শেষকৃত্যের রীতিনীতিতে কোনো সংশোধন আনা হয়নি।
তবে এ বিষয়ে পরিবর্তন আনার বিষয়ে পোপ ফ্রান্সিস নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করার পর এবং ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইমেরিটাস পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের মৃত্যুর পর কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়ে। বেনেডিক্টের জন্য ভ্যাটিকানকে ৬০০ বছরের মধ্যে প্রথম অবসরপ্রাপ্ত পোপের শেষকৃত্যে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
এর কয়েক মাস পরেই পোপ ফ্রান্সিস জানান যে, তিনি ভ্যাটিকানের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান আর্চবিশপ দিয়েগো রাভেলির সঙ্গে কাজ করছেন যেন পুরো আচার-অনুষ্ঠানের বিষয়টি সহজ করা যায়।
পোপকে সমাহিত করার আগে তার মরদেহ রাষ্ট্রীয়ভাবে শায়িত রাখা হয়, যাতে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে পারে। ঐতিহ্য অনুযায়ী, পোপের মরদেহ প্রথমে সাইপ্রাস কাঠের একটি কফিনে রাখা হয়। এরপর সেটি সিসার তৈরি দ্বিতীয় কফিনে সিলমোহর করা হয়, যেখানে পোপের নাম ও তার কার্যকালের তারিখ খোদাই করা থাকে। সবশেষ এলম কাঠের একটি তৃতীয় বাইরের কফিনের মধ্যে সেটি স্থাপন করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, পোপের মৃত্যুর ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কার্ডিনালদের অবশ্যই ভ্যাটিকানে পৌঁছাতে হয়। তারা বিশেষভাবে নির্ধারিত বাসস্থানে অবস্থান করেন। নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য সম্মেলন পরিচালনা করেন এবং তারাই ভোট দিয়ে পরবর্তী পোপ নির্বাচিত করেন।
পোপ নির্বাচনের জন্য ভ্যাটিকানে গোপন সম্মেলন বা কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ১২০ জন কার্ডিনাল ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশ নেন। যদিও বিশ্বব্যাপী কার্ডিনালের সংখ্যা প্রায় ১৯৫; তবে ৮০ বছরের বেশি বয়সী কার্ডিনালদের ভোট দেওয়ার অনুমতি নেই।
দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেলে নির্বাচিত কার্ডিনালকে পোপ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তিনি জয় স্বীকার করলে পরবর্তী পোপ হন। যদি কোনো কার্ডিনাল দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না পান তখন সব ভোটের স্লিপ নির্দিষ্ট চুল্লিতে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
সেই চুল্লির চিমনি দিয়ে কালো ধোঁয়া দেখেই সবাই বুঝতে পারেন পোপ নির্বাচন হয়নি। তখন আবার একই প্রক্রিয়া শুরু হয়। পোপ নির্বাচনের জন্য এই ভোটাভুটি এবং আলোচনা সবই হয় একটি বন্ধ কক্ষে।
পোপ নির্বাচন হলে শুরু হয় নাম ঘোষণার প্রক্রিয়া। ভ্যাটিক্যানে সেই সময়ের মধ্যেই জড়ো হন প্রচুর মানুষ। ঊর্ধ্বতন কোনো কার্ডিনাল তখন পোপের নতুন নাম ঘোষণা করেন। নতুন পোপ নতুন পোশাক পরে জনসম্মুখে আসেন। এরপর পরেন ফিশারম্যান রিং। ঈশ্বরের নামে শপথ নেওয়ার পর ভ্যাটিক্যানের ব্যালকনি থেকে ভাষণ দেন তিনি।
দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে আসা প্রথম পোপ ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। ক্যাথলিক চার্চের পোপ হওয়ার পর অনেক কিছুই প্রথমবার করলেও ফ্রান্সিস কখনো চার্চের সংস্কার কার্যক্রম বন্ধ করেননি। এরপরও পুরোনোকে আঁকড়ে ধরা ঐহিত্যবাদীদের মধ্যেও তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় ছিলেন।
সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া তৃতীয় গ্রেগরি ৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার পর থেকে রোমে ইউরোপের বাইরে আর কোনো বিশপ ছিল না। সেন্ট পিটারের সিংহাসনে নির্বাচিত প্রথম জেসুইটও ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিকভাবেই জেসুইটদের রোম সন্দেহের চোখে দেখতো। জেসুইট বলতে এখানে যিশু খ্রিষ্টের সোসাইটির সদস্যকে বোঝায় যারা অন্যদের সাহায্য করার জন্য, ন্যায়বিচার ও সবকিছুতে বিধাতাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নিবেদিত।
ফ্রান্সিসের পূর্বসূরি ষোড়শ বেনেডিক্ট ছিলেন ১৬০০ বছরের মধ্যে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকারী প্রথম পোপ। ফলে প্রায় এক দশক সময়ের মধ্যে ভ্যাটিকান সিটি দুজন পোপের দেখা পেয়েছে।
যিনি একইসাথে যৌন বিষয়ে কট্টর দৃষ্টিভঙ্গিসহ রক্ষণশীলদের এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়ে উদার অবস্থানের কারণে সংস্কারপন্থিদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন।