ঢাকা ০৭:০০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও নারীর অগ্রযাত্রা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী অধিকার রক্ষায় বিশদ সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে যা যা সুপারিশ করেছে, তা নিঃসন্দেহে নারীর অগ্রযাত্রার পথে সহায়ক।

অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া আছে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা। শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা। সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি দেওয়ার সুপারিশ।

নারীর স্বার্থরক্ষায় ও নারী উন্নয়নে যতোটাই ইতিবাচক সুপারিশ করা হোক না কেন, ইতোমধ্যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল চেয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। অবিলম্বে নারীবিষয়ক সুপারিশমালা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সুপারিশমালা তুলে ধরা হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো অনেকক্ষেত্রে নির্ধারণ করবে যে আমরা কতটা নিবো, আর কতটুকু নিবো না।

যদিও ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরা বোনকে বঞ্চিত করে। প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইসলামি চিন্তাবিদদের সাথেও কথা বলা যেতে পারে। যারা “ধর্ম গেল” বলে শঙ্কিত থাকেন, তাদের বুঝতে হবে সময়ের আবর্তে অনেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় মতবাদ ও আইনি নিয়ম কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে।

যারা এই কমিশনে আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, এদেশের নারী আন্দোলনের সাথে অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাঁরা জানেন এদেশে নারীর পক্ষে একটি কথা বলা মাত্র পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ে এর বিরোধিতা করার জন্য। সেই হিসাব অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক দলগুলো যে কমিশনের বিলোপ চাইবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এরপরেও দাবি জানিয়ে যেতে হবে। বহুবছর ধরে নারী আন্দোলন কর্মীরা বিভিন্ন পর্যায়ে নারী অধিকারের কথা বলে যাচ্ছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিভিন্ন তরফ থেকে দাবিদাওয়া উত্থাপিত হচ্ছে। কাজেই নারী সমাজও মনে করেছেন সংস্কারটা হয়তো এখনই হবে। কিন্তু আদতে কী তাই হবে?

মনে রাখা দরকার এই সরকারের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো, যারা মুহূর্তেই সব সুপারিশ ‘ইসলাম বিরোধী’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সংস্কার কমিশনকেই বাতিল করতে বলছেন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ইউনূস সরকার কতটা কী করতে পারবেন, তা সহজেই অনুমেয়।

নারী কমিশনের দেয়া প্রতিটি দাবিই সমর্থনযোগ্য। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেশে একটি সিভিল ল’ এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছি। অনেক মুসলিম দেশেই তা আছে। যারা ইচ্ছা করবেন, তারা সিভিল ল’ অনুযায়ী কাজ করবেন। সেই কারণেই অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশের পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক যোগ করে বলেন, ‘অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে একটা সিভিল অপশন থাকা দরকার। আমরা রাতারাতি প্রচলিত পারিবারিক আইন বাদ দিতে পারব না।’ তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করতে চায় না। এই সরকারের স্বার্থ নেই। এই সরকারই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কিন্তু এখানেই মূল প্রশ্ন, এই সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে আমলে না নিয়ে আদৌ এই সংস্কার করতে পারবে কিনা?

২০১৯ এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে ’পুত্র’ বা ‘কন্যা’র পরিবর্তে আইনে শুধু ’সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার প্রধান। তাতে করে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি। এই প্রসঙ্গে মনে হল আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর কথা।

আবদুল মতিন খসরুর সাথে নিউজের প্রয়োজনেই দু’একবার কথা হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে ভোরের কাগজে কাজ করার সময়। সেসময়ে ওনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে। ঐ সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে কেন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার বিধান কায়েম করেন না? সরকার তো পারিবারিক আইনে অনেক ধরনের প্রগতিশীল পরিবর্তন এনেছেন।

উনি উত্তরে বলেছিলেন, “নানা কারণে আমাদের হাত পা বাঁধা। তাই চাইলেও সরকার এরকম ইতিবাচক একটি পরিবর্তন আনতে পারবে না। আমার নিজের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মনেপ্রাণে চাই দু’জনকে সমানভাগে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যেতে। বাবা হিসেবে দু’জনকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু আমারও হাত পা বাঁধা। পারছি কই উত্তরাধিকার আইনে কোনো পরিবর্তন আনতে বা সিভিল ল’ এর অপশন চালু করতে।” – উনি এই কথাগুলো বলেছিলেন সাক্ষাৎকারের বাইরে।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, তখন নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ এর ৭.২ অনুচ্ছেদে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। ইচ্ছে করলেই হয়তো সরকার একটি আইন পাস করতে পারতো বা নীতি গ্রহণ করতে পারতো। তারা তখন সেটা করতে করেনি বা করতে পারেনি। বোঝাই যায় সরকার এত বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি।

শুধু যে ইসলামিক দলগুলো সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তা নয়। হিন্দু ধর্মীয় নেতারাও সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার ও তালাকের অধিকার নিয়ে কথা বলতে নারাজ। ২০০৮/৯ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত এমন বিরোধিতাই দেখেছি। এমনকি সুশীল সমাজের হিন্দু সদস্যের একটা অংশ এই দাবির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে কাজ করার সময় একটা গ্রুপ এই দুটি ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মহাজোটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকির মুখে পড়েছিল। কাজেই সংস্কার কমিশন যে আশা নিয়ে সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন, সেই আশা কতটা পূরণ হবে কে জানে।

অতীতের দিকে যদি দেখি তাহলেও দেখবো ইতিবাচক ফলাফল হতে হতে হয়নি। “২০০৪ আমাদের পেতে হলো বিএনপি-জামাত সরকারের সময়কার নারী উন্নয়ন নীতির দ্বিতীয় খসড়া। তৎকালীন সরকার উত্তরাধিকার আইনে ও ভূমির উপর নারীর অধিকারের অংশটি কেটে দিয়েছিল। আমরা তৃতীয় খসড়াটি পেয়েছিলাম ২০০৮ সালে। সে যাক, অনেক জল ঘোলা হয়েছে এই নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে। এমনকী কেয়ারটেকার সরকার পর্যন্ত আলেমদের নিয়ে কমিটি করেছিলেন নীতিটি যাচাই-বাছাই করার জন্য। ফলে একদিন নীতিটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবসময়ই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নারী উন্নয়ন নীতিতে সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিয়ে নীরবতা প্রদর্শন করেছে।” (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, নিবন্ধ: প্রফেসার ড. কাবেরি গায়েন)

মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে আসছে। তারা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, আমরা সবসময় বলছি, দুই সন্তানই যথেষ্ট। সেখানে কারো যদি দুটিই কন্যা সন্তান হয়, তখন সেই পরিবার কী করবেন? কাজেই সবকিছুই বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে।

সেজন্যই বারবার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে পিতার অর্জিত সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন শরীয়া আইনের অপব্যবহার করা না হয়। আমরা শরীয়া আইন মেনে চলবো, সেই সাথে এমন কোন উপায় বের করতে হবে, যেন ইসলামি আইনের নাম ব্যবহার করে নারীকে কেউ স্বামী ও পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে না পারে।

যদিও ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরা বোনকে বঞ্চিত করে। প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইসলামি চিন্তাবিদদের সাথেও কথা বলা যেতে পারে। যারা “ধর্ম গেল” বলে শঙ্কিত থাকেন, তাদের বুঝতে হবে সময়ের আবর্তে অনেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় মতবাদ ও আইনি নিয়ম কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে।

আমরা জানি “ইসলাম মানে ইনসাফ”। এই সত্যটি মানতেই হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য না, একটি ইউনিফর্ম আইন হওয়া দরকার, সব ধর্মের মানুষের জন্য। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই সিভিল ল’ আছে, আবার শরীয়া আইনও আছে। যে পরিবার, যেভাবে সুবিধা পাবেন, তারা সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ করবেন।

সংবিধান ও আইনগত কাঠামো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুপারিশের মধ্যে আরও কয়েকটি ইতিবাচক প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০ ভাগ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করাসহ আরো কিছু সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে।

এছাড়া গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই দুটি ইস্যু নিয়ে বলতে হয়, নারী প্রায় সবার কাছেই ভোগ্যপণ্য। বিভিন্ন দ্বিতীয় শ্রেণির গণমাধ্যম নিউজ নয়, ভিউজ দিয়ে চলে। আর ভিউজ বাড়াতে ব্যবহার করা হয় নারীকে। অনেক নারী নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য, আয় করার বা কাজ পাওয়ার জন্য ভোগ্যপণ্য হতে রাজি থাকেন।

অন্যদিকে নারী বিদ্বেষী বয়ানই তো বয়ানের মূল উপজীব্য। ‘নারীর পেট পাঙাস মাছের পেটির মতো’, ‘পর্দা ছাড়া নারী ছেলা কলার মতো’, নারী বিদ্বেষী এ ধরনের কথা না বললে জলসা জমে না। এইসব আসরে ধর্মের প্রকৃত ও যুক্তিযুক্ত বয়ান যতোটা না মানুষ শোনে, এর চাইতেও বেশি আগ্রহ থাকে নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে। এখন পরিস্থিতি বয়ান ব্যবসায়ীদের আরো অনুকূলে চলে গেছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করার যে দাবি সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে, তা মঞ্জুর হওয়া অসম্ভব। দেশে ২০২০ সাল থেকে বাল্যবিবাহ বাড়ছেই। গত নয় মাসে প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে বাল্যবিবাহ বহু বেড়ে গেছে। গ্রামেগঞ্জে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ে ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি। সরকার ভোটদানের বয়স ১৬ করার কথা ভাবছেন, সেখানে বাল্যবিয়ের বয়স ১৮ থাকে কীভাবে?

আর বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিটিও কতটা কার্যকর হবে, তা বুঝতে পারছি না। ৩/৪ বছর আগে টাঙ্গাইলে ১৩ বছরের একজন কিশোরী মধ্যবয়স্ক স্বামীর সহবাসের বলি হয়ে নিহত হয়েছিল। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, যেখানে মেয়েরা স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ পরিবার, সমাজ একথা মানতেই চায় না। তারা মনে করেন, স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীকে যখন, যেমন ইচ্ছা ভোগ করার। স্বামী আবার ধর্ষণ করে কীভাবে? এ অপরাধ হতেই পারে না। এই ভুল ধারণা থেকে পরিবার ও সমাজকে সরিয়ে এনে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়টি খুব কঠিন।

ধর্মভিত্তিক দলগুলো মনে করছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোয় ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পারিবারিক বিধানকে চরমভাবে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করা হয়েছে। সুপারিশে থাকা ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ এর মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নামে ইসলামের বিধানকে বাতিল করে পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা বলেও মনে করছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরির প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। অন্যদিকে এই সরকারের উপর ভরসা রেখে নারী সংস্কার কমিশন সুপারিশ পেশ করেছে, দেখি সরকার কার কথা শোনে?

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও নারীর অগ্রযাত্রা

আপডেট সময় ১১:০১:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী অধিকার রক্ষায় বিশদ সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। ‘সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ’ শিরোনামের প্রতিবেদনে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনে যা যা সুপারিশ করেছে, তা নিঃসন্দেহে নারীর অগ্রযাত্রার পথে সহায়ক।

অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশ করেছে কমিশন। এছাড়া আছে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা। নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা। শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা। সব প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ৬ মাস ছুটি দেওয়ার সুপারিশ।

নারীর স্বার্থরক্ষায় ও নারী উন্নয়নে যতোটাই ইতিবাচক সুপারিশ করা হোক না কেন, ইতোমধ্যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল চেয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ। অবিলম্বে নারীবিষয়ক সুপারিশমালা বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সুপারিশমালা তুলে ধরা হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো অনেকক্ষেত্রে নির্ধারণ করবে যে আমরা কতটা নিবো, আর কতটুকু নিবো না।

যদিও ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরা বোনকে বঞ্চিত করে। প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইসলামি চিন্তাবিদদের সাথেও কথা বলা যেতে পারে। যারা “ধর্ম গেল” বলে শঙ্কিত থাকেন, তাদের বুঝতে হবে সময়ের আবর্তে অনেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় মতবাদ ও আইনি নিয়ম কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে।

যারা এই কমিশনে আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, এদেশের নারী আন্দোলনের সাথে অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাঁরা জানেন এদেশে নারীর পক্ষে একটি কথা বলা মাত্র পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ে এর বিরোধিতা করার জন্য। সেই হিসাব অনুযায়ী ধর্মভিত্তিক দলগুলো যে কমিশনের বিলোপ চাইবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এরপরেও দাবি জানিয়ে যেতে হবে। বহুবছর ধরে নারী আন্দোলন কর্মীরা বিভিন্ন পর্যায়ে নারী অধিকারের কথা বলে যাচ্ছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিভিন্ন তরফ থেকে দাবিদাওয়া উত্থাপিত হচ্ছে। কাজেই নারী সমাজও মনে করেছেন সংস্কারটা হয়তো এখনই হবে। কিন্তু আদতে কী তাই হবে?

মনে রাখা দরকার এই সরকারের সাথে জড়িয়ে আছে ধর্মভিত্তিক দলগুলো, যারা মুহূর্তেই সব সুপারিশ ‘ইসলাম বিরোধী’ বলে নাকচ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সংস্কার কমিশনকেই বাতিল করতে বলছেন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ইউনূস সরকার কতটা কী করতে পারবেন, তা সহজেই অনুমেয়।

নারী কমিশনের দেয়া প্রতিটি দাবিই সমর্থনযোগ্য। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেশে একটি সিভিল ল’ এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছি। অনেক মুসলিম দেশেই তা আছে। যারা ইচ্ছা করবেন, তারা সিভিল ল’ অনুযায়ী কাজ করবেন। সেই কারণেই অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশের পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক যোগ করে বলেন, ‘অভিন্ন পারিবারিক আইনের বিষয়ে একটা সিভিল অপশন থাকা দরকার। আমরা রাতারাতি প্রচলিত পারিবারিক আইন বাদ দিতে পারব না।’ তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য অনেক কিছু করতে চায় না। এই সরকারের স্বার্থ নেই। এই সরকারই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন। কিন্তু এখানেই মূল প্রশ্ন, এই সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে আমলে না নিয়ে আদৌ এই সংস্কার করতে পারবে কিনা?

২০১৯ এর আইনগত সহায়তা দিবসের অনুষ্ঠানে ’পুত্র’ বা ‘কন্যা’র পরিবর্তে আইনে শুধু ’সন্তান’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকার প্রধান। তাতে করে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে ভাবার দরকার হবে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি। এই প্রসঙ্গে মনে হল আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুর কথা।

আবদুল মতিন খসরুর সাথে নিউজের প্রয়োজনেই দু’একবার কথা হয়েছিল, ১৯৯৬ সালে ভোরের কাগজে কাজ করার সময়। সেসময়ে ওনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম উত্তরাধিকার আইন নিয়ে। ঐ সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে কেন ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমানভাবে সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার বিধান কায়েম করেন না? সরকার তো পারিবারিক আইনে অনেক ধরনের প্রগতিশীল পরিবর্তন এনেছেন।

উনি উত্তরে বলেছিলেন, “নানা কারণে আমাদের হাত পা বাঁধা। তাই চাইলেও সরকার এরকম ইতিবাচক একটি পরিবর্তন আনতে পারবে না। আমার নিজের এক ছেলে ও এক মেয়ে। মনেপ্রাণে চাই দু’জনকে সমানভাগে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে যেতে। বাবা হিসেবে দু’জনকে সমান ভালোবাসি। কিন্তু আমারও হাত পা বাঁধা। পারছি কই উত্তরাধিকার আইনে কোনো পরিবর্তন আনতে বা সিভিল ল’ এর অপশন চালু করতে।” – উনি এই কথাগুলো বলেছিলেন সাক্ষাৎকারের বাইরে।

আওয়ামী লীগ সরকার যখন ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল, তখন নারী উন্নয়ন নীতি ১৯৯৭ এর ৭.২ অনুচ্ছেদে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। ইচ্ছে করলেই হয়তো সরকার একটি আইন পাস করতে পারতো বা নীতি গ্রহণ করতে পারতো। তারা তখন সেটা করতে করেনি বা করতে পারেনি। বোঝাই যায় সরকার এত বড় ঝুঁকি নিতে চায়নি।

শুধু যে ইসলামিক দলগুলো সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তা নয়। হিন্দু ধর্মীয় নেতারাও সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার ও তালাকের অধিকার নিয়ে কথা বলতে নারাজ। ২০০৮/৯ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত এমন বিরোধিতাই দেখেছি। এমনকি সুশীল সমাজের হিন্দু সদস্যের একটা অংশ এই দাবির প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনে কাজ করার সময় একটা গ্রুপ এই দুটি ইস্যু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মহাজোটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে হুমকির মুখে পড়েছিল। কাজেই সংস্কার কমিশন যে আশা নিয়ে সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন, সেই আশা কতটা পূরণ হবে কে জানে।

অতীতের দিকে যদি দেখি তাহলেও দেখবো ইতিবাচক ফলাফল হতে হতে হয়নি। “২০০৪ আমাদের পেতে হলো বিএনপি-জামাত সরকারের সময়কার নারী উন্নয়ন নীতির দ্বিতীয় খসড়া। তৎকালীন সরকার উত্তরাধিকার আইনে ও ভূমির উপর নারীর অধিকারের অংশটি কেটে দিয়েছিল। আমরা তৃতীয় খসড়াটি পেয়েছিলাম ২০০৮ সালে। সে যাক, অনেক জল ঘোলা হয়েছে এই নারী উন্নয়ন নীতি নিয়ে। এমনকী কেয়ারটেকার সরকার পর্যন্ত আলেমদের নিয়ে কমিটি করেছিলেন নীতিটি যাচাই-বাছাই করার জন্য। ফলে একদিন নীতিটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সবসময়ই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নারী উন্নয়ন নীতিতে সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার নিয়ে নীরবতা প্রদর্শন করেছে।” (সূত্র: দি ডেইলি স্টার, নিবন্ধ: প্রফেসার ড. কাবেরি গায়েন)

মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলে আসছে। তারা এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, আমরা সবসময় বলছি, দুই সন্তানই যথেষ্ট। সেখানে কারো যদি দুটিই কন্যা সন্তান হয়, তখন সেই পরিবার কী করবেন? কাজেই সবকিছুই বাস্তবতার নিরিখে ভাবতে হবে।

সেজন্যই বারবার সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে পিতার অর্জিত সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে যেন শরীয়া আইনের অপব্যবহার করা না হয়। আমরা শরীয়া আইন মেনে চলবো, সেই সাথে এমন কোন উপায় বের করতে হবে, যেন ইসলামি আইনের নাম ব্যবহার করে নারীকে কেউ স্বামী ও পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে না পারে।

যদিও ইসলাম নারীকে সম্পত্তিতে অধিকার দিয়েছে কিন্তু সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরা বোনকে বঞ্চিত করে। প্রয়োজনে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইসলামি চিন্তাবিদদের সাথেও কথা বলা যেতে পারে। যারা “ধর্ম গেল” বলে শঙ্কিত থাকেন, তাদের বুঝতে হবে সময়ের আবর্তে অনেক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় মতবাদ ও আইনি নিয়ম কানুন পরিবর্তন করা হয়েছে।

আমরা জানি “ইসলাম মানে ইনসাফ”। এই সত্যটি মানতেই হবে। শুধু মুসলমানদের জন্য না, একটি ইউনিফর্ম আইন হওয়া দরকার, সব ধর্মের মানুষের জন্য। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশেই সিভিল ল’ আছে, আবার শরীয়া আইনও আছে। যে পরিবার, যেভাবে সুবিধা পাবেন, তারা সেভাবেই সম্পত্তি ভাগ করবেন।

সংবিধান ও আইনগত কাঠামো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সুপারিশের মধ্যে আরও কয়েকটি ইতিবাচক প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০ ভাগ নিশ্চিত করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করা, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করাসহ আরো কিছু সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে।

এছাড়া গণমাধ্যমে অংশগ্রহণের জন্য নারীকে যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার না করা, অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই দুটি ইস্যু নিয়ে বলতে হয়, নারী প্রায় সবার কাছেই ভোগ্যপণ্য। বিভিন্ন দ্বিতীয় শ্রেণির গণমাধ্যম নিউজ নয়, ভিউজ দিয়ে চলে। আর ভিউজ বাড়াতে ব্যবহার করা হয় নারীকে। অনেক নারী নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্য, আয় করার বা কাজ পাওয়ার জন্য ভোগ্যপণ্য হতে রাজি থাকেন।

অন্যদিকে নারী বিদ্বেষী বয়ানই তো বয়ানের মূল উপজীব্য। ‘নারীর পেট পাঙাস মাছের পেটির মতো’, ‘পর্দা ছাড়া নারী ছেলা কলার মতো’, নারী বিদ্বেষী এ ধরনের কথা না বললে জলসা জমে না। এইসব আসরে ধর্মের প্রকৃত ও যুক্তিযুক্ত বয়ান যতোটা না মানুষ শোনে, এর চাইতেও বেশি আগ্রহ থাকে নারী বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে। এখন পরিস্থিতি বয়ান ব্যবসায়ীদের আরো অনুকূলে চলে গেছে।

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ধারা ১৭ (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ের বিয়ের সুযোগ রাখা) বাতিল করার যে দাবি সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে, তা মঞ্জুর হওয়া অসম্ভব। দেশে ২০২০ সাল থেকে বাল্যবিবাহ বাড়ছেই। গত নয় মাসে প্রশাসনিক নজরদারির অভাবে বাল্যবিবাহ বহু বেড়ে গেছে। গ্রামেগঞ্জে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিয়ে ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি। সরকার ভোটদানের বয়স ১৬ করার কথা ভাবছেন, সেখানে বাল্যবিয়ের বয়স ১৮ থাকে কীভাবে?

আর বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিটিও কতটা কার্যকর হবে, তা বুঝতে পারছি না। ৩/৪ বছর আগে টাঙ্গাইলে ১৩ বছরের একজন কিশোরী মধ্যবয়স্ক স্বামীর সহবাসের বলি হয়ে নিহত হয়েছিল। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, যেখানে মেয়েরা স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অথচ পরিবার, সমাজ একথা মানতেই চায় না। তারা মনে করেন, স্বামীর অধিকার আছে স্ত্রীকে যখন, যেমন ইচ্ছা ভোগ করার। স্বামী আবার ধর্ষণ করে কীভাবে? এ অপরাধ হতেই পারে না। এই ভুল ধারণা থেকে পরিবার ও সমাজকে সরিয়ে এনে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা বিষয়টি খুব কঠিন।

ধর্মভিত্তিক দলগুলো মনে করছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোয় ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক পারিবারিক বিধানকে চরমভাবে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করা হয়েছে। সুপারিশে থাকা ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ এর মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার নামে ইসলামের বিধানকে বাতিল করে পশ্চিমা সমাজব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা বলেও মনে করছে। অভিন্ন পারিবারিক আইন তৈরির প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি। অন্যদিকে এই সরকারের উপর ভরসা রেখে নারী সংস্কার কমিশন সুপারিশ পেশ করেছে, দেখি সরকার কার কথা শোনে?