ঢাকা ০৬:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫, ১০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জিয়া দর্শন

একটি আশাহীন দিশেহারা নৈরাস্য সাগরে ডুবন্ত জাতীর সঠিক পথ নির্দেশক ও মুক্তির অগ্রদূত মুক্তি সেনানীর নাম শহীদ জিয়াউর রহমান। মহাকালের স্বাক্ষী এই ক্ষণজন্মা কালপুরুষ বীজয়ী বীর ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন।বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান ছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের রুপকার এবং “নব ধারার স্রষ্টা” হিসাবে খ্যাত ও স্মরণীয়। তিনি জাতীকে একটি রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেন। সেই দর্শনের ভিত্তিতে একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করেন এবং সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য গড়ে তোলেন একটি রাজনৈতিক দল। যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল।
জিয়াউর রহমানের মূলনীতিগুলো হলো: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন এবং এই নীতিগুলো গ্রহণ করেন।
জিয়াউর রহমানের মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে নিচে দেওয়া হলো:-
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: এটি ছিল জিয়াউর রহমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠবে।
বহুদলীয় গণতন্ত্র:জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন।
ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন:জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করেন এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন জানান। তিনি মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নেও গুরুত্ব দেন।
অর্থনৈতিক মুক্তি:জিয়াউর রহমান “একটি গ্রাম, একটি শহর” এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করেন। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতের উন্নয়নে জোর দেন।
মুক্ত বাজার অর্থনীতি:জিয়াউর রহমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দেন এবং বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করেন।
জিয়াউর রহমানের এই নীতিগুলো সে সময়কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আজও এগুলোর প্রভাব দেখা যায়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তার রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনের পটভূমি, যুগোপযোগী এবং লক্ষ্য সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি নিজে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরুক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশপ্রেমিকদের হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্বোৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মসূচি যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উপযোগী, বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্ব জাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য শনাক্ত করছেন তিনি এভাবে; বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি কি? সঙ্গতকারণেই সে প্রশ্ন ওঠে। কি কি বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে এ দর্শন গড়ে উঠেছে, সেটিও তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, “আমরা বলতে পারি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে,যা হচ্ছে :
১. বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা;
২. ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে জনগণ;
৩. আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা;
৪. আমাদের সাংস্কৃতিক, জনগণের আশা-আকাঙ্খা,উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি;
৫. দু’শ বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক;
৬. আমাদের ধর্মে প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা;
৭. সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।
কেন এই সাত বিবেচ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বাস্তবায়ন অপরিহার্যতার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি বিভিন্ন সময় দিয়েছেন। তার লেখায় সংক্ষেপে এসেছে এভাবে; “উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিক তাকালে এটা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ একটা গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, মরক্কো ও স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থানের একটা সাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশ এ উপমহাদেশের ও এ অঞ্চলের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর দক্ষিণে সুগভীর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখন্ডের বৈচিত্র্য দিয়ে। তাই বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটিতে অতীতেও অনেক উত্থান-পতন ঘটে গেছে। হাজার হাজার বছরের পট পরিবর্তনকে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ।
এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ইংরেজ জাতি উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ কায়েমের প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল কেন? উপমহাদেশের অন্য যে কোনো স্থান তারা প্রথমে দখল করতে চাইলে নিশ্চয়ই পারতো। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা এজন্য বেছে নিয়েছিল যে, এখান থেকে আন্তর্জাতিক চলাচলে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান ও আকার তাতে এখান থেকে পশ্চিমে ও পূর্বদিকে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করাও সুবিধাজনক বলে ইংরেজগণ এ স্থানকে প্রথমে বেছে নিয়েছিল।
সুচতুর ইংরেজদের এ পরিকল্পনা এতটা নির্ভুল ছিল যে, পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা গোটা ভারতবর্ষ এবং ব্রহ্মদেশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এ থেকে তাই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের ছিল এক বিরাট ‘স্ট্রাটেজিক অবস্থান এবং বলাবাহুল্য যে, সেই অবস্থান আজও গুরুত্বপূর্ণই রয়ে গেছে।
এ কারণেই বাংলাদেশের ভূখন্ড এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশির ওপর এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এবং পরাশক্তিগুলোর অশুভ দৃষ্টি রয়েছে। যা আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ। কাজেই বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এবং এই আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি হলো জাতীয়তাবাদী চেতনা। কারণ, জাতীয়তাবাদী চেতনাই দেশ ও জাতিকে বহিঃশক্তির হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদের ধরন, স্বরূপ চারিত্রিক লক্ষণ পর্যালোচনা সাপেক্ষে জিয়াউর রহমানের বক্তব্য হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এদের থেকে আলাদা। তাঁর অভিমত; ‘অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে কার্যকরী রয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ,জার্মান জাতীয়তাবাদ, এরিয়ান জাতীয়তাবাদ হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
কেউ ভাষাভিত্তিক আবার কেউ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সমর্থক। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন আঞ্চলিক মতবাদ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। আসিয়ান- এর ভিত্তিতে তাদের এ আঞ্চলিক মতাদর্শ চলছে। অন্যদিকে রয়েছে অর্থনীতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হিসাবে ইইসি। একে আমরা যুদ্ধভিত্তিক জাতীয়তাবাদও বলতে পারি। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ এদের চেয়ে পৃথক। আমরা খন্ডিত চেতনায় বিশ্বাসী নই। তাই আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিকভিত্তিক। এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা।’
‘সার্বিকভিত্তিক জাতীয়তাবাদ’ বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের দর্শন উপস্থাপন বা পেশই যথেষ্ট হতে পারে না। তা জনগণকে অবহিত করা, তাতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের পন্থা কি? অবশ্যই সুগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রশিক্ষিত নেতা-কর্মীদের একটি দল। যেহেতু সমাজে বহু মতের মানুষ আছে এবং তাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারও আছে, সুতরাং এমন একটি পরিবেশ দেশে থাকা জরুরি যাতে বহু মত ও বহু দলের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে তিনি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে দেশকে পরিচালনা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক পদক্ষেপসমূহে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বর্তমানে লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো দেশ ও জাতি গঠন। দু’শত বছর পরাধীন থাকার ফলে দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি হয়েছে, সময়ও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রয়োজন অনতিবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে কথা থেকে যায়, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে কিভাবে? একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে? নিশ্চয়ই নয়। ‘ওয়ান পার্টি সিস্টেম’ এবং ‘রেজিমেন্টেশন ইনফোর্স› করে যে সাফল্য অর্জন করা যায় না, নিকট অতীত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা পথে পরিচালিত করাই সর্বোত্তম পথ বলে আমি মনে করি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাল খনন কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রেজিমেন্টেশনের মাধ্যমে যে কাজ করা হতো সে কাজ আমরা জনগণের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করিয়ে নিচ্ছি। এখানেই আমাদের দর্শকের সাফল্য।’
১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়াউর রহমান সেই পদে অধিষ্ঠিত হন। কার্যত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় এখান থেকেই। ঘোষণা করা হয়, যা জনকল্যাণ ও দেশ উন্নয়নে দিকনির্দেশক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জিয়াউর রহমানের রাজনীতি অনুধাবন করতে হলে এই ১৯ দফা উল্লেখ করা আবশ্যক। যথা :
১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করা।
২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গড়ে তোলা।
৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।
৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যাতে ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা।
৭. দেশের কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৮. কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।
৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
১১. সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।
১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।
১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা।
১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।
১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।
বর ১৮. দুর্নীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা।
১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য সংহতি সুদঢ় করা।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গণভোটে এই ১৯ দফা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে এবং প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোট পড়ে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে।
এই ১৯ দফা কর্মসূচি ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পায় এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জিয়াউর রহমান প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হিসাবে রূপান্তরিত হয়।
১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে এবং একই কর্মসূচির ভিত্তিতে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। জাতীয়তাবাদী দল নবধারার রাজনীতির ধারক-বাহক। এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার উপসংহারে এসে আমরা পুনরায় শুরুর কথাগুলো উল্লেখ করতে চাই। বলতে চাই, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান “নবধারার স্রষ্টা” হিসাবে খ্যাত ও স্মরণীয়। তিনি একটি রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান করেন এবং ঐ দর্শন ও কর্মসূচির বাস্তবায়নে একটি দল গঠন করেন, যার নাম জাতীয়তাবাদী দল।
আমরা আরও বলতে চাই, জিয়াউর রহমান সূচিত রাজনৈতিক ধারাটি দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক ধারা। এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান দায়িত্ব দলের নেতাকর্মীদের। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, তার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেকটাই দূরে সরে গেছে। নবপ্রজন্মের নেতানেত্রীদের এটা আমলে নিতে হবে এবং তার রাজনীতি যথাস্থানে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে নিরলস ব্রতচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
পরিশেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচির লক্ষ্য; দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা। শোষণমুক্ত, ন্যায় ও সুবিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচার ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ।

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

জিয়া দর্শন

আপডেট সময় ১০:৫৮:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
একটি আশাহীন দিশেহারা নৈরাস্য সাগরে ডুবন্ত জাতীর সঠিক পথ নির্দেশক ও মুক্তির অগ্রদূত মুক্তি সেনানীর নাম শহীদ জিয়াউর রহমান। মহাকালের স্বাক্ষী এই ক্ষণজন্মা কালপুরুষ বীজয়ী বীর ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার বাগবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন।বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান ছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্রের রুপকার এবং “নব ধারার স্রষ্টা” হিসাবে খ্যাত ও স্মরণীয়। তিনি জাতীকে একটি রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেন। সেই দর্শনের ভিত্তিতে একটি কর্মসূচি প্রণয়ন করেন এবং সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য গড়ে তোলেন একটি রাজনৈতিক দল। যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল।
জিয়াউর রহমানের মূলনীতিগুলো হলো: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্র, এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আকুন্ঠ সমর্থন। তিনি ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন এবং এই নীতিগুলো গ্রহণ করেন।
জিয়াউর রহমানের মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে নিচে দেওয়া হলো:-
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: এটি ছিল জিয়াউর রহমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠবে।
বহুদলীয় গণতন্ত্র:জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সকল রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন।
ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন:জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করেন এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন জানান। তিনি মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নেও গুরুত্ব দেন।
অর্থনৈতিক মুক্তি:জিয়াউর রহমান “একটি গ্রাম, একটি শহর” এই স্লোগানকে সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করেন। তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কৃষি খাতের উন্নয়নে জোর দেন।
মুক্ত বাজার অর্থনীতি:জিয়াউর রহমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দেন এবং বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করেন।
জিয়াউর রহমানের এই নীতিগুলো সে সময়কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং আজও এগুলোর প্রভাব দেখা যায়।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তার রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনের পটভূমি, যুগোপযোগী এবং লক্ষ্য সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি নিজে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এদেশের আপামর জনগণের অন্তরে চির জাগরুক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশপ্রেমিকদের হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্বোৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। এই দর্শনে নিহিত রয়েছে বাস্তব আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মসূচি যা দেশের ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে উপযোগী, বাস্তবমুখী ও সময়োচিত শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংবদ্ধ করবে, জাতিকে সুনিশ্চিতভাবে অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে এবং বিশ্ব জাতির দরবারে বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য শনাক্ত করছেন তিনি এভাবে; বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, একটি শোষণমুক্ত সমাজ, যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি কি? সঙ্গতকারণেই সে প্রশ্ন ওঠে। কি কি বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে এ দর্শন গড়ে উঠেছে, সেটিও তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, “আমরা বলতে পারি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে,যা হচ্ছে :
১. বাংলাদেশের ভূমি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা;
২. ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে জনগণ;
৩. আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা;
৪. আমাদের সাংস্কৃতিক, জনগণের আশা-আকাঙ্খা,উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি;
৫. দু’শ বছর উপনিবেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক;
৬. আমাদের ধর্মে প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা;
৭. সর্বোপরি আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তার দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।
কেন এই সাত বিবেচ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই বাস্তবায়ন অপরিহার্যতার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি বিভিন্ন সময় দিয়েছেন। তার লেখায় সংক্ষেপে এসেছে এভাবে; “উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিক তাকালে এটা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ একটা গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, মরক্কো ও স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থানের একটা সাদৃশ্য আছে। বাংলাদেশ এ উপমহাদেশের ও এ অঞ্চলের সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর দক্ষিণে সুগভীর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখন্ডের বৈচিত্র্য দিয়ে। তাই বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডটিতে অতীতেও অনেক উত্থান-পতন ঘটে গেছে। হাজার হাজার বছরের পট পরিবর্তনকে ধারণ করে আছে বাংলাদেশ।
এখানে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ইংরেজ জাতি উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশ কায়েমের প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছিল কেন? উপমহাদেশের অন্য যে কোনো স্থান তারা প্রথমে দখল করতে চাইলে নিশ্চয়ই পারতো। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা এজন্য বেছে নিয়েছিল যে, এখান থেকে আন্তর্জাতিক চলাচলে সুবিধা হবে। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান ও আকার তাতে এখান থেকে পশ্চিমে ও পূর্বদিকে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করাও সুবিধাজনক বলে ইংরেজগণ এ স্থানকে প্রথমে বেছে নিয়েছিল।
সুচতুর ইংরেজদের এ পরিকল্পনা এতটা নির্ভুল ছিল যে, পর্যায়ক্রমিকভাবে তারা গোটা ভারতবর্ষ এবং ব্রহ্মদেশ দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। এ থেকে তাই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের ছিল এক বিরাট ‘স্ট্রাটেজিক অবস্থান এবং বলাবাহুল্য যে, সেই অবস্থান আজও গুরুত্বপূর্ণই রয়ে গেছে।
এ কারণেই বাংলাদেশের ভূখন্ড এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশির ওপর এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ এবং পরাশক্তিগুলোর অশুভ দৃষ্টি রয়েছে। যা আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ। কাজেই বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে এবং এই আধিপত্যবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। আমাদের কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি হলো জাতীয়তাবাদী চেতনা। কারণ, জাতীয়তাবাদী চেতনাই দেশ ও জাতিকে বহিঃশক্তির হুমকি থেকে রক্ষা করতে পারে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদের ধরন, স্বরূপ চারিত্রিক লক্ষণ পর্যালোচনা সাপেক্ষে জিয়াউর রহমানের বক্তব্য হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এদের থেকে আলাদা। তাঁর অভিমত; ‘অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে কার্যকরী রয়েছে। আরব জাতীয়তাবাদ,জার্মান জাতীয়তাবাদ, এরিয়ান জাতীয়তাবাদ হলো ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
কেউ ভাষাভিত্তিক আবার কেউ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সমর্থক। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন আঞ্চলিক মতবাদ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। আসিয়ান- এর ভিত্তিতে তাদের এ আঞ্চলিক মতাদর্শ চলছে। অন্যদিকে রয়েছে অর্থনীতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হিসাবে ইইসি। একে আমরা যুদ্ধভিত্তিক জাতীয়তাবাদও বলতে পারি। কিন্তু আমাদের জাতীয়তাবাদ এদের চেয়ে পৃথক। আমরা খন্ডিত চেতনায় বিশ্বাসী নই। তাই আমাদের জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিকভিত্তিক। এ জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিক বোধ, অর্থনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের উন্মাদনা।’
‘সার্বিকভিত্তিক জাতীয়তাবাদ’ বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের দর্শন উপস্থাপন বা পেশই যথেষ্ট হতে পারে না। তা জনগণকে অবহিত করা, তাতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং উদ্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের পন্থা কি? অবশ্যই সুগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রশিক্ষিত নেতা-কর্মীদের একটি দল। যেহেতু সমাজে বহু মতের মানুষ আছে এবং তাদের সংঘবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারও আছে, সুতরাং এমন একটি পরিবেশ দেশে থাকা জরুরি যাতে বহু মত ও বহু দলের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়।
এক্ষেত্রে তিনি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই গ্রহণ করেন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে দেশকে পরিচালনা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
প্রাথমিক পদক্ষেপসমূহে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বর্তমানে লক্ষ্য একটাই, আর তা হলো দেশ ও জাতি গঠন। দু’শত বছর পরাধীন থাকার ফলে দেশ ও জাতির অনেক ক্ষতি হয়েছে, সময়ও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আমাদের প্রয়োজন অনতিবিলম্বে জনশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা। তবে কথা থেকে যায়, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা হবে কিভাবে? একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে? নিশ্চয়ই নয়। ‘ওয়ান পার্টি সিস্টেম’ এবং ‘রেজিমেন্টেশন ইনফোর্স› করে যে সাফল্য অর্জন করা যায় না, নিকট অতীত তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশের জনগোষ্ঠীকে একটা পথে পরিচালিত করাই সর্বোত্তম পথ বলে আমি মনে করি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে খাল খনন কর্মসূচিতে সাড়া দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে রেজিমেন্টেশনের মাধ্যমে যে কাজ করা হতো সে কাজ আমরা জনগণের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে করিয়ে নিচ্ছি। এখানেই আমাদের দর্শকের সাফল্য।’
১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল স্বাস্থ্যগত কারণে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ালে জিয়াউর রহমান সেই পদে অধিষ্ঠিত হন। কার্যত তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় এখান থেকেই। ঘোষণা করা হয়, যা জনকল্যাণ ও দেশ উন্নয়নে দিকনির্দেশক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। জিয়াউর রহমানের রাজনীতি অনুধাবন করতে হলে এই ১৯ দফা উল্লেখ করা আবশ্যক। যথা :
১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করা।
২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
৩. সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গড়ে তোলা।
৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।
৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যাতে ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা।
৭. দেশের কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড়ের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৮. কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।
৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
১১. সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুব সমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।
১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।
১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা।
১৬. সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।
১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বেসরকারিকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।
বর ১৮. দুর্নীতি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা।
১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য সংহতি সুদঢ় করা।
উল্লেখ করা যেতে পারে, গণভোটে এই ১৯ দফা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে এবং প্রায় ৯৮ শতাংশ ভোট পড়ে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে।
এই ১৯ দফা কর্মসূচি ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও নির্বাচনী ইশতেহারে স্থান পায় এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে জিয়াউর রহমান প্রায় ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হিসাবে রূপান্তরিত হয়।
১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদে নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করে এবং একই কর্মসূচির ভিত্তিতে ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৭ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। জাতীয়তাবাদী দল নবধারার রাজনীতির ধারক-বাহক। এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার উপসংহারে এসে আমরা পুনরায় শুরুর কথাগুলো উল্লেখ করতে চাই। বলতে চাই, আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান “নবধারার স্রষ্টা” হিসাবে খ্যাত ও স্মরণীয়। তিনি একটি রাজনৈতিক দর্শন উপহার দেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদান করেন এবং ঐ দর্শন ও কর্মসূচির বাস্তবায়নে একটি দল গঠন করেন, যার নাম জাতীয়তাবাদী দল।
আমরা আরও বলতে চাই, জিয়াউর রহমান সূচিত রাজনৈতিক ধারাটি দেশের সবচেয়ে বৃহত্তম রাজনৈতিক ধারা। এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান দায়িত্ব দলের নেতাকর্মীদের। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, তার রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অনেকটাই দূরে সরে গেছে। নবপ্রজন্মের নেতানেত্রীদের এটা আমলে নিতে হবে এবং তার রাজনীতি যথাস্থানে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে নিরলস ব্রতচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
পরিশেষে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচির লক্ষ্য; দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা। শোষণমুক্ত, ন্যায় ও সুবিচারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে এর ব্যাপক প্রচার ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ।