ঢাকা ০৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোটা সংস্কার: বেকারত্বের সমস্যা সমাধান কী আদৌ হবে?

মঞ্জুরে খোদা
প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ লাখ শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে হিমশিম খাচ্ছে।কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল চাকরির ক্ষেত্রে কোন ধরণের বৈষম্য ব্যতিরেকে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা। এক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নাগরিকদের জন্য কি ধরণের চাকরির সুযোগ আছে সেই বিষয়টা জানা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের জন্য সরকারি চাকরি বলতে বোঝায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশন বা বিসিএস ক্যাডার হওয়া। কিন্তু সেই চাকরির পরিমাণ আসলে কত?

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে বিগত ৩৫-৩৯তম বিসিএসের ৫টি নিয়োগ পরীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, মোট নিয়োগ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮১৩ জন। মেধা কোটায় ৯,৮১৮ জন (৬৬.২%), জেলা কোটায় ২,১২৪ জন, মহিলা কোটায় ১,৪২৬ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১,২৯৮ জন (৮.৭%), ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় ১৩১ জন ও প্রতিবন্ধী কোটায় ১৬ জন। যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে এত কথা সেই কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৮.৭ শতাংশ। এই কোটা না থাকলে মেধা কোটায় চাকরি পেতেন হয়তো আরো ১,২৮৯ জন।

কিন্তু এখানে একটি তথ্য অনুপস্থিত সেটা হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতির মাধ্যমে কতজন বা কত শতাংশ চাকরি পেয়েছেন? তাহলে কোটা তুলে দিলে কত জন তরুণের ভাগ্যে চাকরি নামের সোনার হরিণটা জুটবে? কিছু মানুষের মেধার ভিত্তিতে চাকরি হলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? না মোটেই না। তবে একটা পথ হয়তো পরিষ্কার হবে যে, কোটা নয় মেধার ভিত্তিতে সবার চাকরি হওয়া। তাহলে কোটা তুলে দেয়ার মাধ্যমে চাকরির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, দুর্নীতি আছে, সেগুলোরও কি ইতি ঘটল? সে নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশে বেকার সমস্যার চিত্রটা কেমন? বাংলাদেশে চাকরি বলতে মূলত সরকারি চাকরিই বোঝায়। পোশাকখাত এখনও এখনো বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের জায়গা এবং সেখানে ভালো বা উঁচু বেতনের চাকরির সুযোগ তেমন একটা তৈরি হয়নি বললেই চলে। যৎসামান্য উঁচু বেতনের যে চাকরিগুলো আছে, সেগুলো ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিকরা দখল করে আছেন। সে কারণে তরুণদের প্রধান ঝোঁক সরকারি চাকরির দিকেই। সেখানে কঠিন প্রতিযোগিতার সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগটাকে যতটা সম্ভব কম প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে চান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণ মূলত এটাই। কিন্তু সরকার তাদের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে ও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে এত বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কোটা সংস্কার দেশের বেকার সমস্যার কতটা সমাধান করবে? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে দেশে বেকারত্বের সমস্যা কেমন সে বিষয়টা জানা দরকার। সেটা সরকারি তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরিমাপ করলে ভুল হবে। তারা বলছে যে, বাংলাদেশের যে বেকার সমস্যা রয়েছে, তেমন সমস্যা উন্নত দেশগুলোতেও বিদ্যমান।

বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস থেকে বেকারত্বের যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তা দেখলে মনে হবে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর কাতারে পৌঁছে গেছে। অনেক আগেই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিবিএসের পক্ষ থেকে আজ থেকে ৫ বছর আগে মানে ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার দেখানো হয়েছিলে ৪ দশমিক ২২ ভাগ। ২০২০ সালে করোনাকালের লকডাউনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও দেখানো হয়েছিল ৫ দশমিক ৩ ভাগ। কানাডায়ও তখন বেকারত্বের হার ছিল ৫ ভাগ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে বেকারত্বের যে হার প্রকাশ করা হয় তা কোনোভাবেই সঠিক নয়? কেন নয়?

বিবিএস যে পদ্ধতিতে বেকারত্ব পরিমাপ করে, তা প্রকৃত বেকারত্বের পরিমাণকে লুকিয়ে রাখে এবং ভুল তথ্য প্রকাশ করে। জনসাধারণকে জানানো হয় যে বাংলাদেশে কোনো বেকার নেই বললেই চলে। বিবিএসের প্রকাশিত এই তথ্যই বিশ্বব্যাংক হুবহু প্রকাশ করে। এই তথ্য দেখে যে কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মনে করবে বাংলাদেশ অনেক আগেই ইউরোপ-আমেরিকাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে।

পত্রিকা লিখছে, প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ লাখ শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক তরুণের কি কর্মের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে বা হচ্ছে? না হচ্ছে না। বছর ঘুরতেই আবার নতুন করে শ্রমবাজারে এই সংখ্যা যুক্ত হচ্ছে। বিরূপাক্ষ পাল বিবিএসের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে তার এক প্রবন্ধে নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারত্ব ২৫ ভাগের উপরে এবং এর মধ্যে শিক্ষিত বেকার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। তাহলে কীভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বেকারত্বের হার ৪ থেকে ৫ ভাগ বলে?”

বেকারত্ব নির্ধারণের মানদণ্ড কি? যুক্তরাষ্ট্রে তাকেই বেকার বলা হয়, যে চার সপ্তাহ ধরে কাজের সন্ধান করছে। উন্নত সব দেশই বেকারত্ব নির্ধারণের এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমেরিকার ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের (বিএলএস) এই পদ্ধতি প্রায় সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে বেকারত্ব নির্ধারণ করা হয় সেটা হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশনের (আইএলও) পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রকৃত বেকারত্বের কোনো চিত্র পাওয়া যাবে না। আইএলও পদ্ধতি হচ্ছে, গত এক মাসে যিনি দুই-এক ঘণ্টা কাজ করেছেন বা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন তিনিও বেকার নন। এই ফর্মুলায় চললে বলতে হয় বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিগুলো ছাড়া কেউ বেকার নয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০২৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করার তিন বছর পরও ২৮ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকছেন। পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি চারজনে একজন বেকার থাকছেন।

বেকার থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই বিএ (পাস) ডিগ্রিধারী। এছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, বাংলা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেকারের হার তুলনামূলক বেশি। বিপুলসংখ্যক নারীও এই বেকার তালিকায় আছেন।

এত মেধার কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় কি আসলেই সেই পরিমাণ মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল কিন্তু সে কথা বলে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিট’ এবং ‘চারুকলা ইউনিট’-এর ১ম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, গড়ে ৪টি ইউনিটে মোট ৮৮.৯৯ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পাসই করতে পারেননি। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তিচ্ছুদের। এই ইউনিটটিতে মাত্র ৮.৮৯ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পাস করেছেন। কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে পাস করেছেন ১০.০৭ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে পাস করেছেন ১৩.৩৩ শতাংশ আর চারুকলায় পাস করেছেন ১১.৭৫ শতাংশ ভর্তিচ্ছু। এই অবস্থা কোনভাবেই স্বস্তিকর নয়। শিক্ষার্থীদেরও চাকরির বাজারে নিজেদের অধিক দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

দেশের কর্মক্ষম মানুষের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেকার, তাদের কোনো কাজ নেই। এটা যে কোনো দেশের জন্য মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতি। সেই তথ্য গোপন করা আরো বিপজ্জনক। জনসংখ্য যেমন সমস্যা আবার জনসংখ্যা একটি সম্পদও। তাকে ব্যবহার করে চীন-জাপান আজ বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের জন্য প্রকৃতিক সম্পদ, জনসম্পদ, পুঁজি, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দরকার। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটিই আছে। এ দেশে ১৫-৬৪ বছর বয়সী নাগরিকের সংখ্যা ৬৬.৩%, সেটা একটা আশীর্বাদ। সেই সম্পদকে কাজে না লাগাতে পারার ব্যর্থতা কাদের? কেন স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীতেও সেটা হয়ে ওঠেনি? স্বাধীনতার অন্যতম অর্থ হচ্ছে অথনৈতিক স্বাধীনতা। পাকিস্তান আমলে অর্থনৈতিক শোষণ এবং কর্মসহ নানা দিক থেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এই দেশ। কিন্তু এখন কেন স্বাধীন দেশে কোটি যুবক বেকার থাকবে? একজন মানুষের যদি কাজ না থাকে তাকে কিভাবে স্বাধীন বলা যায়? অন্য সব স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পরে যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে, মানে মানুষের কর্ম না থাকে। আমরা যতই স্বাধীনতার কথা বলি না কেন কর্মহীন মানুষের কাছে এই স্বাধীনতা মূল্যহীন। বছরের পর বছর কোনো কাজ-চাকরি না থাকা মানে পরাধীন থাকা।

বেকার সমস্যার সমাধানে করণীয় কি? কোনো সমস্যা-সংকট যদি থাকে, প্রথমে তাকে সামনে আনতে হবে, স্বীকার করতে হবে। তারপর সমস্যার অগ্রাধিকারকে বুঝে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বেকারত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুতর ও বিপজ্জনক সমস্যা। আরো অনেক সমস্যা থাকলেও বেকারত্বের মতো এতটা অভিশপ্ত ও গ্লানিকর নয়। সমাজে অন্যান্য যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো বেকারত্বের উপজাত। বেকারত্বের কারণেই অন্যান্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে।

বেকারত্বের গ্লানি ও হতাশায় তরুণরা মাদকাসক্তি, অপরাধ ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। স্বীকার হয় অপরাজনীতির। এতে শুধু বেকাররাই নয় পুরো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে উন্নয়নের সুফল কিছু মানুষ ভোগ করতে পারলেও অধিকাংশ বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাধীনতাকে সবার জন্য অর্থপূর্ণ করতে গ্রাম-শহরে বেকার সমস্যার সমাধানে কার্যকর জাতীয় পরিকল্পনা দরকার। দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের জন্য কি ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ-বাস্তবতা আছে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। প্রয়োজনে এজন্য জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে।

আরো পড়ুন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কী হবে?

 

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

কোটা সংস্কার: বেকারত্বের সমস্যা সমাধান কী আদৌ হবে?

আপডেট সময় ০৮:৩১:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪

মঞ্জুরে খোদা
প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ লাখ শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে হিমশিম খাচ্ছে।কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল চাকরির ক্ষেত্রে কোন ধরণের বৈষম্য ব্যতিরেকে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা। এক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নাগরিকদের জন্য কি ধরণের চাকরির সুযোগ আছে সেই বিষয়টা জানা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা উচ্চশিক্ষিত নাগরিকদের জন্য সরকারি চাকরি বলতে বোঝায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কমিশন বা বিসিএস ক্যাডার হওয়া। কিন্তু সেই চাকরির পরিমাণ আসলে কত?

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে বিগত ৩৫-৩৯তম বিসিএসের ৫টি নিয়োগ পরীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, মোট নিয়োগ পেয়েছেন ১৪ হাজার ৮১৩ জন। মেধা কোটায় ৯,৮১৮ জন (৬৬.২%), জেলা কোটায় ২,১২৪ জন, মহিলা কোটায় ১,৪২৬ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১,২৯৮ জন (৮.৭%), ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় ১৩১ জন ও প্রতিবন্ধী কোটায় ১৬ জন। যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে এত কথা সেই কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৮.৭ শতাংশ। এই কোটা না থাকলে মেধা কোটায় চাকরি পেতেন হয়তো আরো ১,২৮৯ জন।

কিন্তু এখানে একটি তথ্য অনুপস্থিত সেটা হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও দুর্নীতির মাধ্যমে কতজন বা কত শতাংশ চাকরি পেয়েছেন? তাহলে কোটা তুলে দিলে কত জন তরুণের ভাগ্যে চাকরি নামের সোনার হরিণটা জুটবে? কিছু মানুষের মেধার ভিত্তিতে চাকরি হলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে? না মোটেই না। তবে একটা পথ হয়তো পরিষ্কার হবে যে, কোটা নয় মেধার ভিত্তিতে সবার চাকরি হওয়া। তাহলে কোটা তুলে দেয়ার মাধ্যমে চাকরির ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, দুর্নীতি আছে, সেগুলোরও কি ইতি ঘটল? সে নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশে বেকার সমস্যার চিত্রটা কেমন? বাংলাদেশে চাকরি বলতে মূলত সরকারি চাকরিই বোঝায়। পোশাকখাত এখনও এখনো বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় কর্মসংস্থানের জায়গা এবং সেখানে ভালো বা উঁচু বেতনের চাকরির সুযোগ তেমন একটা তৈরি হয়নি বললেই চলে। যৎসামান্য উঁচু বেতনের যে চাকরিগুলো আছে, সেগুলো ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিকরা দখল করে আছেন। সে কারণে তরুণদের প্রধান ঝোঁক সরকারি চাকরির দিকেই। সেখানে কঠিন প্রতিযোগিতার সঙ্গে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করবে এটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগটাকে যতটা সম্ভব কম প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে চান। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণ মূলত এটাই। কিন্তু সরকার তাদের এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে ও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে এত বিপুল প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কোটা সংস্কার দেশের বেকার সমস্যার কতটা সমাধান করবে? সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে দেশে বেকারত্বের সমস্যা কেমন সে বিষয়টা জানা দরকার। সেটা সরকারি তথ্যের উপর ভিত্তি করে পরিমাপ করলে ভুল হবে। তারা বলছে যে, বাংলাদেশের যে বেকার সমস্যা রয়েছে, তেমন সমস্যা উন্নত দেশগুলোতেও বিদ্যমান।

বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস থেকে বেকারত্বের যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তা দেখলে মনে হবে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর কাতারে পৌঁছে গেছে। অনেক আগেই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিবিএসের পক্ষ থেকে আজ থেকে ৫ বছর আগে মানে ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার দেখানো হয়েছিলে ৪ দশমিক ২২ ভাগ। ২০২০ সালে করোনাকালের লকডাউনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও দেখানো হয়েছিল ৫ দশমিক ৩ ভাগ। কানাডায়ও তখন বেকারত্বের হার ছিল ৫ ভাগ। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে বেকারত্বের যে হার প্রকাশ করা হয় তা কোনোভাবেই সঠিক নয়? কেন নয়?

বিবিএস যে পদ্ধতিতে বেকারত্ব পরিমাপ করে, তা প্রকৃত বেকারত্বের পরিমাণকে লুকিয়ে রাখে এবং ভুল তথ্য প্রকাশ করে। জনসাধারণকে জানানো হয় যে বাংলাদেশে কোনো বেকার নেই বললেই চলে। বিবিএসের প্রকাশিত এই তথ্যই বিশ্বব্যাংক হুবহু প্রকাশ করে। এই তথ্য দেখে যে কোনো ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান মনে করবে বাংলাদেশ অনেক আগেই ইউরোপ-আমেরিকাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে।

পত্রিকা লিখছে, প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ লাখ শিক্ষিত, আধা-শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করে হিমশিম খাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক তরুণের কি কর্মের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে বা হচ্ছে? না হচ্ছে না। বছর ঘুরতেই আবার নতুন করে শ্রমবাজারে এই সংখ্যা যুক্ত হচ্ছে। বিরূপাক্ষ পাল বিবিএসের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে তার এক প্রবন্ধে নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশে বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারত্ব ২৫ ভাগের উপরে এবং এর মধ্যে শিক্ষিত বেকার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। তাহলে কীভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান বেকারত্বের হার ৪ থেকে ৫ ভাগ বলে?”

বেকারত্ব নির্ধারণের মানদণ্ড কি? যুক্তরাষ্ট্রে তাকেই বেকার বলা হয়, যে চার সপ্তাহ ধরে কাজের সন্ধান করছে। উন্নত সব দেশই বেকারত্ব নির্ধারণের এই পদ্ধতি অনুসরণ করে। আমেরিকার ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকসের (বিএলএস) এই পদ্ধতি প্রায় সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে বেকারত্ব নির্ধারণ করা হয় সেটা হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশনের (আইএলও) পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করলে প্রকৃত বেকারত্বের কোনো চিত্র পাওয়া যাবে না। আইএলও পদ্ধতি হচ্ছে, গত এক মাসে যিনি দুই-এক ঘণ্টা কাজ করেছেন বা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন তিনিও বেকার নন। এই ফর্মুলায় চললে বলতে হয় বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিগুলো ছাড়া কেউ বেকার নয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ২০২৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করার তিন বছর পরও ২৮ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট বেকার থাকছেন। পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের প্রতি চারজনে একজন বেকার থাকছেন।

বেকার থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশির ভাগই বিএ (পাস) ডিগ্রিধারী। এছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, বাংলা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেকারের হার তুলনামূলক বেশি। বিপুলসংখ্যক নারীও এই বেকার তালিকায় আছেন।

এত মেধার কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় কি আসলেই সেই পরিমাণ মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল কিন্তু সে কথা বলে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘বিজ্ঞান ইউনিট’, ‘ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিট’ এবং ‘চারুকলা ইউনিট’-এর ১ম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, গড়ে ৪টি ইউনিটে মোট ৮৮.৯৯ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পাসই করতে পারেননি। প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা বিজ্ঞান ইউনিটে ভর্তিচ্ছুদের। এই ইউনিটটিতে মাত্র ৮.৮৯ শতাংশ ভর্তিচ্ছু পাস করেছেন। কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে পাস করেছেন ১০.০৭ শতাংশ, ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে পাস করেছেন ১৩.৩৩ শতাংশ আর চারুকলায় পাস করেছেন ১১.৭৫ শতাংশ ভর্তিচ্ছু। এই অবস্থা কোনভাবেই স্বস্তিকর নয়। শিক্ষার্থীদেরও চাকরির বাজারে নিজেদের অধিক দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।

দেশের কর্মক্ষম মানুষের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বেকার, তাদের কোনো কাজ নেই। এটা যে কোনো দেশের জন্য মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতি। সেই তথ্য গোপন করা আরো বিপজ্জনক। জনসংখ্য যেমন সমস্যা আবার জনসংখ্যা একটি সম্পদও। তাকে ব্যবহার করে চীন-জাপান আজ বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের জন্য প্রকৃতিক সম্পদ, জনসম্পদ, পুঁজি, জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দরকার। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটিই আছে। এ দেশে ১৫-৬৪ বছর বয়সী নাগরিকের সংখ্যা ৬৬.৩%, সেটা একটা আশীর্বাদ। সেই সম্পদকে কাজে না লাগাতে পারার ব্যর্থতা কাদের? কেন স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীতেও সেটা হয়ে ওঠেনি? স্বাধীনতার অন্যতম অর্থ হচ্ছে অথনৈতিক স্বাধীনতা। পাকিস্তান আমলে অর্থনৈতিক শোষণ এবং কর্মসহ নানা দিক থেকে বৈষম্যের শিকার হয়েছে এই দেশ। কিন্তু এখন কেন স্বাধীন দেশে কোটি যুবক বেকার থাকবে? একজন মানুষের যদি কাজ না থাকে তাকে কিভাবে স্বাধীন বলা যায়? অন্য সব স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পরে যদি আর্থিক স্বাধীনতা না থাকে, মানে মানুষের কর্ম না থাকে। আমরা যতই স্বাধীনতার কথা বলি না কেন কর্মহীন মানুষের কাছে এই স্বাধীনতা মূল্যহীন। বছরের পর বছর কোনো কাজ-চাকরি না থাকা মানে পরাধীন থাকা।

বেকার সমস্যার সমাধানে করণীয় কি? কোনো সমস্যা-সংকট যদি থাকে, প্রথমে তাকে সামনে আনতে হবে, স্বীকার করতে হবে। তারপর সমস্যার অগ্রাধিকারকে বুঝে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। বেকারত্ব হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুতর ও বিপজ্জনক সমস্যা। আরো অনেক সমস্যা থাকলেও বেকারত্বের মতো এতটা অভিশপ্ত ও গ্লানিকর নয়। সমাজে অন্যান্য যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো বেকারত্বের উপজাত। বেকারত্বের কারণেই অন্যান্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে ও হচ্ছে।

বেকারত্বের গ্লানি ও হতাশায় তরুণরা মাদকাসক্তি, অপরাধ ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। স্বীকার হয় অপরাজনীতির। এতে শুধু বেকাররাই নয় পুরো সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে উন্নয়নের সুফল কিছু মানুষ ভোগ করতে পারলেও অধিকাংশ বঞ্চিত হচ্ছে। স্বাধীনতাকে সবার জন্য অর্থপূর্ণ করতে গ্রাম-শহরে বেকার সমস্যার সমাধানে কার্যকর জাতীয় পরিকল্পনা দরকার। দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের জন্য কি ধরণের কর্মসংস্থানের সুযোগ-বাস্তবতা আছে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। প্রয়োজনে এজন্য জাতীয় কমিশন গঠন করতে হবে।

আরো পড়ুন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কী হবে?