ঢাকা ০৪:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম :
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদসহ ৫ জনের নামে মামলা সাড়ে ৯ লাখ টাকার জুতা পরেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান মেগা প্রজেক্টের নামে দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার : বিএনপি মহাসচিব জার্মানিতে ব্যাটারিচালিত ট্রেনের যুগে টেসলার অভিষেক সেনাবাহিনীকে সবখানে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না: ফখরুল অর্পিত দায়িত্ব পালনে সবার সহযোগিতা চাইলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি হবে না : উপদেষ্টা ফাওজুল কবির যুক্তরাষ্ট্রে ইউনূস-মোদি বৈঠক হচ্ছে না চয়নিকার সিনেমায় দেবকে নায়ক হিসেবে চান , নায়িকা কে হবেন? ঢাবিতে যুবক ও জাবিতে ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে হত্যা: আইন হাতে তুলে না নিতে আহ্বান

যে কারণে পতন হয় স্বৈরশাসকের

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন


এরিস্টটল প্রণীত শাসনব্যবস্থার ছয়টি রূপের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ স্বৈরতন্ত্র। নগর রাষ্ট্রের যুগে স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বিদ্রোহ করে কিংবা নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে। এই ধারা বজায় ছিল সাম্রাজ্যবাদের যুগেও। জাতিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের যুগে এসে বদলেছে স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় আসার ধরন। অনেকে স্বৈরশাসক হয়েছেন গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসে। ক্ষমতার নেশায় বিপ্লবীরা স্বৈরশাসক হয়েছেন, স্বৈরশাসক হয়েছেন একসময়ের অনেক গণতন্ত্রপন্থী নেতারাও। জনগণকে নিপীড়ন করে, মত প্রকাশের সুযোগকে সংকুচিত করে, বিরোধীদের নির্মূল করে, কখনো জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে টিকে থেকেছে স্বৈরশাসকেরা। তবুও একটা সময় এসে পতন হয়েছে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা স্বৈরশাসকদের। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার আর সামাজিক ন্যায্যতার দাবিতে জনগণ মুক্তি খুঁজেছে স্বৈরশাসকদের কবল থেকে।

স্বৈরতন্ত্রে শাসক বা শাসকের আশেপাশের মানুষের লক্ষ্য জনগণের উন্নয়ন থাকে না, লক্ষ্য থাকে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ অর্থ সংগ্রহ করা, মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা আর বিপুল অর্থের সঞ্চয় নিজেদের কাছে রাখা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই , এই লক্ষ্য পূরণের জন্য জনগণের শোষক হয়ে উঠে স্বৈরশাসকেরা, জনগণের জানমালের রক্ষকের জায়গায় হয়ে উঠে ভক্ষক। ফলে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্বৈরশাসকেরা, তৈরি হয় পতনের ক্ষেত্র।

স্বৈরশাসকেরা টিকে থাকার জন্য জনগণের সামনে বিভিন্নভাবে নিজেকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করেন, আবার প্রয়োজনে জনগণের মনে তৈরি করেন ভয়। এই ভয় স্বৈরশাসকেরা যেমন নিচুস্তরে তৈরি করেন, তৈরি করেন শাসন কাঠামোর বাকি সকল স্তরেও। চূড়ান্ত পর্যায়ে এই ভয়ই ক্ষমতার ভিত্তি হয় স্বৈরশাসকের, রক্ষা করে জন অসন্তোষ আর জনরোষের প্রকাশ থেকে।


স্বৈরশাসনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক জবাবদিহিতা থাকে না, আমলাতন্ত্রের মোরালিটি ভেঙে যায়, কমে যায় রাষ্ট্রের সামর্থ্য। ফলে সর্বস্তরের দুর্নীতি সর্বদা আষ্টেপৃষ্টে থাকে স্বৈরশাসনের সময়টা। স্বৈরশাসক চাইলেও এই দুর্নীতি দূর করতে পারে না, মেনে নিতে হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। অনেক সময় আবার স্বৈরশাসকেরাই জড়িয়ে পড়েন এই বিশাল লুটপাটের মধ্যে। ফলে একটা সময় দারিদ্রতার ফাঁদে আটকে পড়ে দেশের সিংহভাহ জনগণ, অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে শাসক আর শাসকের আশেপাশে থাকা লোকজনের মধ্যে। এই তীব্র বঞ্চনা আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা জনগণকে পরিবর্তনের প্রত্যাশী করে তোলে, উদ্বুদ্ব করে স্বৈরশাসকের পতনে।

স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসে জনগণকে কখনোই বিশ্বাস করেন না, ক্ষমতায়ন ঘটান না অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর। ফলে, সবসময় আস্থার একটা সংকট শাসকশ্রেণির সাথে শোষিতের চলতেই থাকে। তবুও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাঝে মাঝে কিছু জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নিতে হয় স্বৈরশাসকদের, জনগণকে দিতে হয় কিছু সুযোগ সুবিধা। আবার অনেক সময় আদর্শগত জায়গা থেকেও স্বৈরশাসকেরা জনগণকে তৈরি করে দেন সুযোগ সুবিধা। মাঝে মাঝেই এই বিনামূল্যে খাদ্য, স্বাস্থ্য বা ভূমি সংস্কারের উদ্যোগগুলোকে সফলতা হিসেবে জাহির করেন।

জিম্বাবুয়েতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন রবার্ট মুগাবে, প্রতিশ্রুতি ছিল ভূমি সংস্কারের। আস্তে আস্তে তিনি স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করেছিলেন ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শ্বেতদের ভূমিচ্যুত করায় পড়েন পশ্চিমা রোষানলে, মিডিয়ার প্রচারে আবির্ভূত হন খলনায়ক হিসেবে, ধ্বস নামে জনপ্রিয়তায়। একইভাবে পতন হয়েছে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের, জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর।

বিশ্বায়নের এই যুগে শক্তিশালী হয়েছে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক ক্ষমতা, বেড়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। ফলে তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশেই স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের মেনে নিতে হয় পরাশক্তিগুলোর প্রভাব, দেশকে বানিয়ে ফেলেন স্যাটেলাইট স্টেইট বা তাবেদার রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, একটা সময় জনগণ বুঝতে পারে, রাষ্ট্র আসলে তাদের কল্যাণে কাজ করছে না, কাঠামোর কারণে তারা শুধু শোষিতই হচ্ছেন। ফলে একটা সময় জনগণ বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মাধ্যমে ইতি টানে স্বৈরশাসনের।


আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার বৈধতা আসে নির্বাচনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন একদলীয় স্বৈরশাসনে থাকা উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনে একজনই প্রার্থী থাকে নির্বাচনে, জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দিতে হয় সেই প্রার্থীকেই। এভাবেই তিন পুরুষ ধরে উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় রয়েছে উন পরিবার, চরম দারিদ্রতা আর তীব্র খাদ্যসঙ্কটের মধ্যেও মেনে নিচ্ছে স্বৈরশাসন।
কিন্তু সকল স্বৈরশাসকের জন্য পরিস্থিতি সবসময় এতোটা সুখকর হয় না। ২০০৬ সালে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে গিয়ে জনগণের কাছে বৈধতা হারিয়েছিলেন রবার্ট মুগাবে, গত বছর ক্ষমতা হারিয়েছেন সুদানের ওমর আল বশির।

স্বৈরশাসকের শাসন টিকিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে থাকে তার চারপাশে থাকা কতিপয় অভিজাতেরা। শাসকের আশেপাশে জড়ো হয় নিজের স্বার্থের তাগিদে। একটা সময় এই অনুসারীদের মধ্যে স্বার্থ আর সুবিধার জন্য বিভাজন তৈরি হয়, জন্ম নেয় সংঘাতের। ফলে শাসকের অনুসারী হিসেবে থাকা এই স্বার্থগোষ্ঠীগুলো স্বৈরশাসকের কাছে আবির্ভূত হয় চাপ হিসেবে, ধীরে ধীরে নিয়ে যায় পতনের দিকে।

স্বৈরশাসকেরা সাধারণত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা ছাড়ে না, আকঁড়ে ধরে থাকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে শাসকের দক্ষতা। আবেদন হারায় বয়সের কারণে। একটা সময় স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর কাছেও বন্দি হয়ে যান স্বৈরশাসক, নিজের অনুসারীদের যোগান দিতে হয় সীমাহীন সম্পদের যোগান। ফলে জনগণের বিশাল অংশ বঞ্চিত হয় সামাজিক ন্যায্যতা থেকে, বাধাগ্রস্ত হয় তাদের অর্থনৈতিক অধিকার। তৈরি হয় পতনের স্ফুলিঙ্গ।


দীর্ঘ শাসনের ফলে একটা সময় স্বৈরশাসকের কবল থেকে জনগণ মুক্তি খুঁজে, শাসকের দক্ষতার হ্রাস একটা সময় পতন ঘটায় স্বৈরশাসকের। কিন্তু যে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণ স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়, অধিকাংশ সময়ই তা থেকে যায় অপূর্ণ। অন্তহীন শোষণের চক্রে ঘুরপাক খায় শোষিতের জীবন।

বাংলাদেশ ছিল স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত ছিল না বলে মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে।

রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘ ষোল বছরের দু:শাসনের অবসান হয়েছে গত ৫ অগাষ্ট। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। সাথে ছিলেন ছোটবোন শেখ রেহানা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানী ঢাকা ত্যাগ করেছেন তারা। এদিন বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা ভাতর চলে যান। যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগ পাননি।

আরো পড়ুন : যেভাবে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও পরিবর্তন হয়

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদসহ ৫ জনের নামে মামলা

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

যে কারণে পতন হয় স্বৈরশাসকের

আপডেট সময় ০৭:২৯:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৪

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন


এরিস্টটল প্রণীত শাসনব্যবস্থার ছয়টি রূপের সবচেয়ে নিকৃষ্ট রূপ স্বৈরতন্ত্র। নগর রাষ্ট্রের যুগে স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসেছেন সামরিক বিদ্রোহ করে কিংবা নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে। এই ধারা বজায় ছিল সাম্রাজ্যবাদের যুগেও। জাতিকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের যুগে এসে বদলেছে স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় আসার ধরন। অনেকে স্বৈরশাসক হয়েছেন গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এসে। ক্ষমতার নেশায় বিপ্লবীরা স্বৈরশাসক হয়েছেন, স্বৈরশাসক হয়েছেন একসময়ের অনেক গণতন্ত্রপন্থী নেতারাও। জনগণকে নিপীড়ন করে, মত প্রকাশের সুযোগকে সংকুচিত করে, বিরোধীদের নির্মূল করে, কখনো জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে টিকে থেকেছে স্বৈরশাসকেরা। তবুও একটা সময় এসে পতন হয়েছে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা স্বৈরশাসকদের। গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার আর সামাজিক ন্যায্যতার দাবিতে জনগণ মুক্তি খুঁজেছে স্বৈরশাসকদের কবল থেকে।

স্বৈরতন্ত্রে শাসক বা শাসকের আশেপাশের মানুষের লক্ষ্য জনগণের উন্নয়ন থাকে না, লক্ষ্য থাকে ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ অর্থ সংগ্রহ করা, মুনাফাকে সর্বোচ্চ করা আর বিপুল অর্থের সঞ্চয় নিজেদের কাছে রাখা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই , এই লক্ষ্য পূরণের জন্য জনগণের শোষক হয়ে উঠে স্বৈরশাসকেরা, জনগণের জানমালের রক্ষকের জায়গায় হয়ে উঠে ভক্ষক। ফলে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্বৈরশাসকেরা, তৈরি হয় পতনের ক্ষেত্র।

স্বৈরশাসকেরা টিকে থাকার জন্য জনগণের সামনে বিভিন্নভাবে নিজেকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপন করেন, আবার প্রয়োজনে জনগণের মনে তৈরি করেন ভয়। এই ভয় স্বৈরশাসকেরা যেমন নিচুস্তরে তৈরি করেন, তৈরি করেন শাসন কাঠামোর বাকি সকল স্তরেও। চূড়ান্ত পর্যায়ে এই ভয়ই ক্ষমতার ভিত্তি হয় স্বৈরশাসকের, রক্ষা করে জন অসন্তোষ আর জনরোষের প্রকাশ থেকে।


স্বৈরশাসনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক জবাবদিহিতা থাকে না, আমলাতন্ত্রের মোরালিটি ভেঙে যায়, কমে যায় রাষ্ট্রের সামর্থ্য। ফলে সর্বস্তরের দুর্নীতি সর্বদা আষ্টেপৃষ্টে থাকে স্বৈরশাসনের সময়টা। স্বৈরশাসক চাইলেও এই দুর্নীতি দূর করতে পারে না, মেনে নিতে হয় ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে। অনেক সময় আবার স্বৈরশাসকেরাই জড়িয়ে পড়েন এই বিশাল লুটপাটের মধ্যে। ফলে একটা সময় দারিদ্রতার ফাঁদে আটকে পড়ে দেশের সিংহভাহ জনগণ, অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে শাসক আর শাসকের আশেপাশে থাকা লোকজনের মধ্যে। এই তীব্র বঞ্চনা আর অর্থনৈতিক দুরাবস্থা জনগণকে পরিবর্তনের প্রত্যাশী করে তোলে, উদ্বুদ্ব করে স্বৈরশাসকের পতনে।

স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় এসে জনগণকে কখনোই বিশ্বাস করেন না, ক্ষমতায়ন ঘটান না অভ্যন্তরীণ প্রভাবকগুলোর। ফলে, সবসময় আস্থার একটা সংকট শাসকশ্রেণির সাথে শোষিতের চলতেই থাকে। তবুও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মাঝে মাঝে কিছু জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ নিতে হয় স্বৈরশাসকদের, জনগণকে দিতে হয় কিছু সুযোগ সুবিধা। আবার অনেক সময় আদর্শগত জায়গা থেকেও স্বৈরশাসকেরা জনগণকে তৈরি করে দেন সুযোগ সুবিধা। মাঝে মাঝেই এই বিনামূল্যে খাদ্য, স্বাস্থ্য বা ভূমি সংস্কারের উদ্যোগগুলোকে সফলতা হিসেবে জাহির করেন।

জিম্বাবুয়েতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করে গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় এসেছিলেন রবার্ট মুগাবে, প্রতিশ্রুতি ছিল ভূমি সংস্কারের। আস্তে আস্তে তিনি স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তবায়ন করেছিলেন ভূমি সংস্কারের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শ্বেতদের ভূমিচ্যুত করায় পড়েন পশ্চিমা রোষানলে, মিডিয়ার প্রচারে আবির্ভূত হন খলনায়ক হিসেবে, ধ্বস নামে জনপ্রিয়তায়। একইভাবে পতন হয়েছে ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের, জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর।

বিশ্বায়নের এই যুগে শক্তিশালী হয়েছে পরাশক্তিগুলোর কূটনৈতিক ক্ষমতা, বেড়েছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। ফলে তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশেই স্বৈরশাসকের আবির্ভাব ঘটে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের মেনে নিতে হয় পরাশক্তিগুলোর প্রভাব, দেশকে বানিয়ে ফেলেন স্যাটেলাইট স্টেইট বা তাবেদার রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই, একটা সময় জনগণ বুঝতে পারে, রাষ্ট্র আসলে তাদের কল্যাণে কাজ করছে না, কাঠামোর কারণে তারা শুধু শোষিতই হচ্ছেন। ফলে একটা সময় জনগণ বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মাধ্যমে ইতি টানে স্বৈরশাসনের।


আধুনিক যুগে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার বৈধতা আসে নির্বাচনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিন একদলীয় স্বৈরশাসনে থাকা উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনে একজনই প্রার্থী থাকে নির্বাচনে, জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে ভোট দিতে হয় সেই প্রার্থীকেই। এভাবেই তিন পুরুষ ধরে উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় রয়েছে উন পরিবার, চরম দারিদ্রতা আর তীব্র খাদ্যসঙ্কটের মধ্যেও মেনে নিচ্ছে স্বৈরশাসন।
কিন্তু সকল স্বৈরশাসকের জন্য পরিস্থিতি সবসময় এতোটা সুখকর হয় না। ২০০৬ সালে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে গিয়ে জনগণের কাছে বৈধতা হারিয়েছিলেন রবার্ট মুগাবে, গত বছর ক্ষমতা হারিয়েছেন সুদানের ওমর আল বশির।

স্বৈরশাসকের শাসন টিকিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে থাকে তার চারপাশে থাকা কতিপয় অভিজাতেরা। শাসকের আশেপাশে জড়ো হয় নিজের স্বার্থের তাগিদে। একটা সময় এই অনুসারীদের মধ্যে স্বার্থ আর সুবিধার জন্য বিভাজন তৈরি হয়, জন্ম নেয় সংঘাতের। ফলে শাসকের অনুসারী হিসেবে থাকা এই স্বার্থগোষ্ঠীগুলো স্বৈরশাসকের কাছে আবির্ভূত হয় চাপ হিসেবে, ধীরে ধীরে নিয়ে যায় পতনের দিকে।

স্বৈরশাসকেরা সাধারণত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা ছাড়ে না, আকঁড়ে ধরে থাকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকে শাসকের দক্ষতা। আবেদন হারায় বয়সের কারণে। একটা সময় স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর কাছেও বন্দি হয়ে যান স্বৈরশাসক, নিজের অনুসারীদের যোগান দিতে হয় সীমাহীন সম্পদের যোগান। ফলে জনগণের বিশাল অংশ বঞ্চিত হয় সামাজিক ন্যায্যতা থেকে, বাধাগ্রস্ত হয় তাদের অর্থনৈতিক অধিকার। তৈরি হয় পতনের স্ফুলিঙ্গ।


দীর্ঘ শাসনের ফলে একটা সময় স্বৈরশাসকের কবল থেকে জনগণ মুক্তি খুঁজে, শাসকের দক্ষতার হ্রাস একটা সময় পতন ঘটায় স্বৈরশাসকের। কিন্তু যে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণ স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়, অধিকাংশ সময়ই তা থেকে যায় অপূর্ণ। অন্তহীন শোষণের চক্রে ঘুরপাক খায় শোষিতের জীবন।

বাংলাদেশ ছিল স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত ছিল না বলে মন্তব্য করেছে একটি জার্মান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের ১২৯টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে।

রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৬ সালে তাদের আগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিশ্বের ৭৪টি দেশে গণতান্ত্রিক এবং ৫৫টি দেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চলছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘ ষোল বছরের দু:শাসনের অবসান হয়েছে গত ৫ অগাষ্ট। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। সাথে ছিলেন ছোটবোন শেখ রেহানা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে রাজধানী ঢাকা ত্যাগ করেছেন তারা। এদিন বেলা আড়াইটায় বঙ্গভবন থেকে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনা ভাতর চলে যান। যাওয়ার আগে একটি ভাষণ রেকর্ড করে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি সে সুযোগ পাননি।

আরো পড়ুন : যেভাবে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন ও পরিবর্তন হয়