পাবনার কাজীরহাট ও মানিকগঞ্জের আরিচা নৌপথ সচল রাখতে ১৭ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পলি অপসারণ করার পরও পদ্মা-যমুনায় নাব্য সঙ্কট কাটছে না। ছয়টি ড্রেজার দিয়ে রাত-দিন ড্রেজিং চালানোর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিআইডব্লিউটিএর ‘অপরিকল্পিত’ ড্রেজিং ব্যবস্থার কারণে পরিবহন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, অন্যদিকে কার্গো জাহাজ ও ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। পারাপারেও সময় বেশি লাগছে; ঘাটেই নষ্ট হচ্ছে কাঁচামালসহ কোটি কোটি টাকার পণ্য।
আরিচা-কাজীরহাট নৌপথ ব্যবহারকারীরা বলছে, খনন করা বালু, পলিমাটি আবার নদীতেই ফেলার কারণে ড্রেজিংয়ের সুফল মিলছে না।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলছেন, “আমাদের ড্রেজিং সঠিকভাবেই হচ্ছে। গত বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত পদ্মা-যমুনায় প্রায় ১৭ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পলিমাটি খনন করা হয়েছে।
“নদীতে প্রচণ্ড স্রোতের কারণে মাটি কাটার পর উজান থেকে বালু এসে আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক মাত্রায় বালুর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় কারণেই নৌপথের নব্যতা ঠিক রাখা যাচ্ছে না।”
পাবনার কাজীরহাট থেকে মানিকগঞ্জের আরিচা পর্যন্ত এই নৌপথটি বেশ জনপ্রিয় কিছু জেলার মানুষের কাছে। বিশেষ করে নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জের মানুষ ও পণ্যবাহী ট্রাক এই পথ দিয়ে বেশি চলাচল করে থাকে।
রাজশাহী, কুষ্টিয়া অঞ্চলের কিছু মানুষও সময় বাঁচাতে এই পথে যাতায়াত করেন।
নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, কাজীরহাট থেকে আরিচা পর্যন্ত নৌপথের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার।
পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরিচা ঘাট থেকে কাজিরহাট পর্যন্ত যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মত। আর ভাটিতে ফেরার সময় সময় আধা ঘণ্টা কম লাগে।
এ পথে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল করে। স্পিডবোটে এতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট।
পণ্যবাহী পরিবহনের কয়েকজন শ্রমিক জানান, অনেকে যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়েও যাতায়াত করেন। কিন্তু অনেকে বেশি টোলের কারণে নৌপথেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে গেলে ওজন মেপে পরে গাড়িকে টোল দিয়ে সেতুতে উঠতে হয়। কিন্তু ফেরিতে সেটা ‘ম্যানেজ’ করা হয়। এ কারণেও অনেক ট্রাক সেতু না দিয়ে ফেরিতে চলাচল করেন।
আরিচা-কাজীরহাট নৌপথ দেড় দশকের বেশি সময় বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালে আবার চালু হয়।
তখন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা এবং পদ্মা নদী দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। সেই সময় ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফেরিঘাট আরিচা-দৌলতদিয়া এবং আরিচা-নগরবাড়ী যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন পারাপারে আরিচা নদী বন্দরের আওতায় পরিচালিত হতো।
ফেরি পারাপারের অন্যতম প্রধান ঘাট হিসেবে তখন থেকেই নগরবাড়ী উত্তরাঞ্চলে পরিবহন সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। পরবর্তী সময়ে নৌপথের দূরত্ব কমানোসহ উন্নত যাত্রী সেবা নিশ্চিতে ২০০২ সালে ফেরিঘাট আরিচা থেকে পাটুরিয়াতে স্থানান্তর করা হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ায় নগরবাড়ী পথে ফেরি সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় এবং ফেরিঘাট আট কিলোমিটার ভাটিতে কাজিরহাটে স্থানান্তর করা হয়।
তবে ঘাট স্থানান্তর করা হলেও ব্যবহারকারীদের কাছে এর গুরুত্ব কোনো অংশেই কমে যায়নি। আরিচা থেকে কাজিরহাটে লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচল অব্যাহত রয়েছে এবং এর হার আনুপাতিক হারে বাড়ছে।
সম্প্রতি কাজিরহাট ঘাটে গিয়ে নদীতে পানি কমে যাওয়ায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি পাারাপারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেছে।
ঘাটে কথা হয় ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং ইউনিট, ড্রেজিংয়ের নামে সরকারি টাকা নয়-ছয় করে। তারা নদী থেকে বালু তুলে আবার নদীতে ফেলে। ওই বালু আবার নদীতে গিয়ে ভরাট হয়ে যায়। এই বালু টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করলে সরকার রাজস্বও পাইত। একই বালু বার বার কাটাও লাগত না।”
তিনি বলেন, “আরিচা-কাজীরহাট-নগরবাড়ী নৌপথ সচল রাখতে গত ২৮ জুলাই থেকে চার মাসের বেশি সময় ধরে পদ্মা ও যমুনা নদীতে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং ইউনিটের নিজস্ব ছয়টি ড্রেজার দিয়ে দিন-রাত পলি অপসারণের কাজ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।”
পাবনার রূপপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, “বিআইডব্লিউটিএর যে ছয়টি ড্রেজার রয়েছে তা ঠিকমতো কাজ করছে না। যেগুলো করছে তাও আবার অপরিকল্পিত। ড্রেজিং পলি পাইপের সাহায্যে উজানে ফেলছে সেই পলি স্রোতের টানে আবারও ভাটিতে এসে জমা হচ্ছে। এভাবে অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণেই নাব্য সঙ্কট নিরসন হচ্ছে না। এখানে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।”
এলাকাবাসী ও নৌপথ ব্যবহারকারীরা জানান, চলতি বছর শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নদীতে পানি কমে ডুবোচর সৃষ্টি হয়ে নৌ-চ্যানেল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নাব্যতার অভাবে ফেরি কর্তৃপক্ষ গত নভেম্বর মাসে বাধ্য হয়ে তিনবার সাময়িকভাবে ফেরি সার্ভিস বন্ধ রাখে।
এখন কোনোরকমে ফেরি চললেও দ্রুতগতিতে পানি কমায় নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বালুর প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় চ্যানেলটি ক্রমেই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যে কোনো সময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে কার্গো জাহাজ ও ফেরি চলাচল।
চলতি মৌসুমে পাবনার কাজিরহাট-আরিচা নৌপথে নাব্য সংকটের কারণে দুই-তিন বার নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন এ পথে চলাচলকারীরা।
তাদেরই একজন পাবনার বাসিন্দা ঢাকার মিরপুরে বসবাসরত আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, “কয়েকদিন আগে আমি বাড়ি আসার জন্য ঢাকা থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়ে আরিচা এসে শুনি ফেরি চলাচল বন্ধ। তখন সেখান থেকে ফিরে আবার যমুনা সেতু হয়ে বাড়ি যাই। ওই দিন পরিবার- পরিজন নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।”
পাবনা শহরের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, “আমি প্রতি সাপ্তাহে ঢাকা যাই, মাঝেই মধ্যেই শুনি যে ফেরি চলছে না। গত কয়েকদিন আগে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। এরপর শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বেশি ভাড়া দিয়ে আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়।”
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মিলিত প্রবাহ একসঙ্গে ধারণ করে যমুনা নদী প্রবাহমান। উজানে পানি নিয়ন্ত্রণ করায় তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রবাহ কমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে পদ্মায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এর ফলে পদ্মা ও যমুনায় নাব্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন-বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ঘাটের ম্যানেজার আবু আব্দুল্লাহ বলেন, “প্রায় এক মাস ধরে আরিচা ঘাটের অদূরে যমুনা নদীর ডুবোচরে ফেরি আটকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায়ও ঝুঁকি নিয়ে ফেরি সচল রাখা হচ্ছে। গত চার মাসের বেশি সময় ধরে ছয়টি খনন যন্ত্র দিয়ে একযোগে খনন করেও নাব্যতা ঠিক রাখা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।”
বর্তমানে এই নৌপথে পাঁচটি ফেরি দিয়ে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৪০০টি যানবাহন পারাপার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “যানবাহনের অধিকাংশই পণ্যবাহী। এ ছাড়া অল্প কিছু যাত্রীবাহী যানবাহনও পারাপার হয়। বার বার নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়া ও সময় বেশি লাগায় পণ্য পরিবহনে স্থবিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে ও পরিবহনেও ব্যয় বাড়ছে।”
এ সমস্যার সমাধান কোথায় জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ বলেন, “আরিচা-কাজীরহাট পথের পুরাতন চ্যানেলের পাশে আরেকটি নতুন চ্যানেল খননের কাজ প্রায় শেষের পথে। কাজটি শেষ হলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি।”