২০২৩ সালের ৭ রমজানে রংপুর যাবার জন্য টিকিট কেটেছি। সকাল বেলাই চলে যাবো অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে! রাতে ভালো লাগছিল না। ছটফট করতে করতে ঘুমিয়েছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। বালিশের পাশে থাকা মোবাইল খুঁজছিলাম। কয়টা বাজে দেখার জন্য। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না। বাধ্য হয়েই ছোট ছেলেকে ডাকাডাকি করছি। আসতেই বললাম। দুই মোবাইলের একটির ও খুঁজে পাচ্ছি না! ছেলে নিচু স্বরে বলল। পাওয়া যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন! বুঝতে পারছি না। কেন এমন কথা বলছে ছেলে।
রাগারাগী শুরু করা মাত্রই ছেলে ওর ঘর থেকে মোবাইল এনে হাতে দিল। খুলেই দেখি ” বড় ছেলের পোস্ট আমার মমতাময়ী মা আর নেই!” কান্নার রোল পড়ে গেল গোটা বাসায়। আশ পাশের বাসার লোকজন ও ছুটে এলো। কথা বলতে পারছিলাম না। খবরটি দেখেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভেসে যায়। কারো কোন কথাই শুনতে ভাল লাগছিল না!
বড় ছেলে উমর ফারুক মেয়ে সারা ও জামাতা সুজন লাশ সহ এ্যমবোল্যানসে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে! ছোট ছেলে উমর শরীফকে জানানো হয়েছে। আমাকেও তাই জানানো হলো পরে। আমার কল্পনা করতে ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। এটাই কি মানুষের জীবন?? এতোই ছোট্ট জীবন? এসব যখন ভাবছিলাম।
তখন শুধুই মানুষের জীবন নিয়ে তুলনামূলক চিন্তা আমাকে আতংকিত করছিল। অত্যন্ত এ্যলোম্যালো হয়ে যাই আমি। কল্পনা করাও আমার জন্য বড়ই কঠিন হয়ে পড়ে! মাথায় কাজ করছিল না আমার! দুঃখ আর হতাশার জায়গাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভেষে উঠে দাম্পত্য জীবনের অনেক স্মৃতির পাতা! আর ভাবনার যায়গা গুলোতে প্রচন্ডভাবে আঘাত লাগছিল আমার কলিজার ভিতর- বাহিরে!
রাতেই দলে দলে আত্মীয় স্বজন আসছিল বাসায়। সবার চোখে মুখে হতাশার স্পষ্ট ছাপ! কেউ কাঁদছে। কেউ আফসোস করছে। কেউ কেউ দিচ্ছে সান্ত্বনা। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখছি। সকালেই এসে পৌঁছায় লাশ! কি যে হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। তা লিখে শেষ করা যাবে না!
কোথায় ছেলে মেয়েকে আমি শান্তনা দেবো। উল্টো ছেলে মেয়েই আমাকে শান্তনা আর ধৈর্য্য ধারণ করার জন্য বলতে থাকে। সবার চোখেই টল টল করছে পানি! কেউ আটকে রাখতে পারছে। কেউ পারছে না! এমন দৃশ্য ছোটকালে ও একবার দেখেছিলাম আমার মায়ের মৃত্যুর পর। সেই ক্ষত বিক্ষত মনের যন্ত্রনা শেষ হয়নি আজও!! তার পর এই মৃত্যুকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না! কিন্তু মানতে হচ্ছে এই কঠিন বজ্রপাতের তীব্র যন্ত্রণাকে কারণ এটাই স্বাভাবিক ও চিরন্তন তাই!?
অসম্ভব কঠিন যন্ত্রনা আর অস্বাভাবিক চিন্তায় কঠিন পাথরে মুর্তি হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে দেখেছি সবাইকে। আর ভেবেছিলাম। এটি কি হয়ে গেল!? মানুষের জীবন এতোই ছোট্ট? মাত্র ক’দিনের এই দুনিয়া? সবাইকে না খেয়েই রোজা রাখতে হলো। মহিলা মারা গেলে মাইকিং করা হয় না! কিন্তু ফেসবুকে অনেকই জেনে যায়। তাই আত্মীয় স্বজনসহ অনেক লোক জানাযায় শরীক হন। অনেক সাংবাদিক আসেন শেরপুর থেকে। ঝিনাইগাতী থেকে ও আসেন। সান্তনা দেন। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
জানিনা, জানাযার ইমামতি করার জন্য মৃত্যুর আগেই তার বড় বোনের ছেলে মুফতি সোয়ায়েবকে বলে ছিলেন কি না। এবং গোসল করাতে তার স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন কি না। তবে সকালে উনারা স্বামী-স্ত্রী একত্রে এসে বললেন। খালু, আমার স্ত্রী গোসল করাবে আর আমি জানাযায় ইমামতি করবো। আপত্তি করিনি এ কারণে যে, কিছু দিন আগে সে তাদের জামালপুর বাসায় গিয়েছিলেন। হয়তোবা তাঁদেরকেই গোসল এবং জানাযায় ইমামতি করতে বলে গিয়েছিলেন তাই।
মহিলাদের জানাযায় এতো লোক সাধারণত হয় না বলতে শুনেছি অনেককেই। যাহোক রমজানের দিনে বিকেলে জানাযা শেষে গ্রামের বাড়ি পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার আগে গ্রামবাসী বলেছিলেন। আরো একটি জানাজার কথা। কথাটি রক্ষা করা যায়নি সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায়! তাড়াতাড়ি দাফন শেষ করে ইফতার করতে হয়। এভাবেই কেটে যায় আমার স্ত্রীর জীবনের শেষ অধ্যায়!!
কিছু স্মৃতি:
ব্যক্তিগত ভাবে আমি খুবই রাগি মানুষ ছিলাম। আমার স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার এক জন মানুষ। তাকে সচরাচর কেউ রাগ করতে দেখেছেন কি না। তা আমার জানা নেই! তবে আমি রাগান্বিত হলে সে আমাকে মাথা গরম না করার জন্য বলতেন। কোন কথা থাকলেও মেজাজ মর্জি বিবেচনায় কথা বলতেন। কখনো বলতে শুনেছি, রাগ করোনা। একটা কথা বলি- । বলবো ? যদি বলতাম বলো। তখন সে কথা বলতো। তাঁর কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। আমার স্ত্রী হিসেবে নয়। বাসার আসপাশের মানুষের সাথে কোন দিন কোন ঝগড়া ঝাটি বা কথা কাটাকাটি করতে ও দেখিনি কোনদিন।
তাকে কোন দিন কাজা নামাজ আদায় করতে ও দেখিনি। অপারেশনের পর। জ্ঞান ফিরে আসলে। জিজ্ঞেস করেন। কয় ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে। জানার পর শুয়ে শুয়ে ঐ নামাজ গুলো ইশারায় কাজা নামাজ আদায় করতে দেখেছি। আর আমি সেই অভাগা স্বামী যার ভুল ভ্রান্তির কোন শেষ নেই! তবু ও স্বামী হিসেবে মহান আল্লাহর দরবারে লাখো লাখো কোটি কোটি বার ফরিয়াদ জানাই। হে মহান আল্লাহ তুমি আমার স্ত্রীকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করো। তাঁর জীবনের জানা অজানা সকল ভুল ভ্রান্তি পাপ অন্যায় অবিচার অত্যাচার ক্ষমা করে দিও। আমীন। সুম্মা আমীন।