ঢাকা ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রমথ চৌধুরী; গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক

প্রমথ চৌধুরী
গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক
(৭ আগস্ট ১৮৬৮-২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

প্রমথ চৌধুরী। আরেক নাম প্রমথনাথ চৌধুরী। তিনি বীরবল নামেও পরিচিত। প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার।
তিনি বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসাবে প্রসিদ্ধ।
জন্ম:
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ছিলেন জমিদার।

শিক্ষাজীবন:
প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে বিএ (অনার্স) দর্শন, ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৮৯৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী পদক’ লাভ করেন ।

পারিবারিক জীবন:
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী (১৮৬০-১৯৪২) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আরেক বড় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা প্রতিভা দেবীর সাথে আশুতোষ চৌধুরীর বিবাহ হয়।

কর্মজীবন:
প্রমথ চৌধুরী বিলাত থেকে ফিরে কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। পরে তিনি সাহিত্যচর্চায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন। প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বেশি বিখ্যাত। তার প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে।

১৯১৪ সালে মাসিক সবুজপত্র প্রকাশনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একে কেন্দ্র করে তখন একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরী ‘বীরবল’ ছদ্মনামে এ পত্রিকায় ব্যঙ্গরসাত্মক প্রবন্ধ ও নানা গল্প প্রকাশ করেন। তাঁর এ ছদ্মনাম থেকে তখন বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ধারা প্রবর্তিত হয়। তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য পত্রিকা হলো বিশ্বভারতী (১৩৪৯-৫০), রূপ ও রীতি (১৩৪৭-৪৯) এবং অলকা।

সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর প্রধান খ্যাতি মননশীল প্রবন্ধলেখক হিসেবে। তবে তিনি উচ্চমানের গল্প ও কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। বুদ্ধিদীপ্ত তির্যকভঙ্গি তাঁর গদ্য-পদ্য সব রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। শাণিত যুক্তি ও আলঙ্কারিক ভাষা প্রয়োগেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তিনি ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। ফরাসি সনেটরীতি ট্রিয়লেট, তের্জারিমা ইত্যাদি বিদেশি কাব্যবন্ধ বাংলা কাব্যে তিনিই প্রবর্তন করেন।

প্রথম চৌধুরীর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
কাব্যগ্রন্থ: সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯) ও পদচারণ (১৯২০); গল্পগ্রন্থ: চার ইয়ারি কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯), ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭), নীল লোহিত (১৯৩৯), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯), সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪), দুই বা এক (১৯৪০); প্রবন্ধগ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), নানাকথা (১৯১১), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), দুই ইয়ারির কথা (১৯২১), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০) এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৫২-১৯৫৩)।

প্রমথ চৌধুরীর গল্পসংগ্রহের ভূমিকা লিখেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখেছিলেন-
ভূমিকা
আমার এই নিভৃত কক্ষের মধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে প্রমথর জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ চলেছে- দেশের যশস্বীরা তাতে যোগ দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের কর্তৃত্বপদ নেবার অধিকার স্বভাবতই আমারই ছিল। যখন তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিলেন তাঁর পরিচয় আমার কাছে ছিল সমুজ্জ্বল। যখন থেকে তিনি সাহিত্যপথে যাত্রা আরম্ভ করেছেন আমি পেয়েছি তাঁর সাহচর্য এবং উপলব্ধি করেছি তাঁর বুদ্ধিপ্রদীপ্ত প্রতিভা। আমি যখন সাময়িকপত্র চালনায় ক্লান্ত এবং বীতরাগ, তখন প্রমথর আহ্বানমাত্রে ‘সবুজপত্র’ বাহকতায় আমি তাঁর পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। প্রমথনাথ এই পত্রকে যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হই নি।

প্রমথর গল্পগুলিকে একত্র বার করা হচ্ছে এতে আমি বিশেষ আনন্দিত, কেননা গল্পসাহিত্যে তিনি ঐশ্বর্য দান করেছেন। অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যে মিলেছে তাঁর অভিজাত মনের অনন্যতা, গাঁথা হয়েছে উজ্জ্বল ভাষার শিল্পে। বাংলাদেশে তাঁর গল্প সমাদর পেয়েছে, এই সংগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করবে।

অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে যথোচিত গৌরব দেয় নি সেজন্য আমি বিস্ময় বোধ করেছি।

আজ ক্রমশ যখন দেশের দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর কীর্তির অবরোধ উন্মোচিত হল তখন আমি নিস্তেজ এবং জরার অন্তরালে তাঁর সঙ্গ থেকে দূরে পড়ে গেছি। তাই তাঁর সম্মাননা-সভায় দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য যথাযোগ্য আসন গ্রহণ করতে পারলেম না। বাহির থেকে তার কোনো প্রয়োজন নেই অন্তরেই অভিনন্দনের আসন প্রসারিত করে রাখলুম দলপুষ্টির জন্য নয় আমার মালা এতকাল একাকী তাঁর কাছে সর্বলোকের অগোচরে অর্পিত হয়েছে আজও একাকীই হবে। আজ বিরলেই না হয় তাঁকে আশীর্বাদ করে বন্ধুকৃত্য সমাপন করে যাব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মৃত্যু : প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রমথ চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ:
শিব

রজতগিরিতে হেরি তব শুভ্রকায়া,
চন্দ্র তব ললাটের চারু আভরণ,
তব কণ্ঠে ঘনীভূত সিন্ধুর বরণ,
বিশ্বরূপ জানি আমি তব দৃশ্য মায়া।

যার স্ফূর্ত্তি চরাচর, সে ত তব জায়া।
নিজদেহে করিয়াছ বিশ্ব আহরণ,
তাই হেরি কৃত্তি তব চিত্র-আবরণ,
জীবনের আলোশ্লিষ্ট মরণের ছায়া!

তোমার দর্শন পাই মূর্ত্তিমান মন্ত্রে,
যজ্ঞসূত্রে বাঁধা যাহা হৃদয়ের তন্ত্রে।

সেই রূপ রেখে দেব ভরিয়া নয়নে,
শিবমূর্ত্তি হেরি বিশ্বে, দেহ এ ক্ষমতা।
ধরিতে পারি না আমি নেত্রে কিম্বা মনে,
আকারবিহীন কোন বিশ্বের দেবতা।

ফুলের ঘুম

বরফ ঢাকিয়াছিল ধরণীর বুক
অখণ্ড শীতল শুভ্র চাদর পরিয়ে।
রাশি রাশি চন্দ্রালোক নিঃশব্দে ঝরিয়ে,
আপাণ্ডুর করে’ ছিল নীলিমার মুখ।

সেদিন ছিল না ফুটে শিরীষ কিংশুক,
গিয়েছিল বর্ণ গন্ধ সকলি মরিয়ে।
তুষারের জটাভার শিরেতে ধরিয়ে
বৃক্ষলতা সমাধিস্থ ছিল হয়ে মূক।

পাতার মর্ম্মর আর জল-কলরব,
হিমের শাসনে ছিল নিস্তব্ধ নীরব।

পৃথিবীর বুক হতে তুষার সরিয়ে
সেদিন দেখিনি আমি, কোথায় গোপনে,
সুযুপ্ত ফুলেরা সবে নয়ন ভরিয়ে
রেখেছিল বসন্তের রক্তিম স্বপনে!

আত্মকথা

কবিতা আমার জানি, যেমন শঙ্কুর,
দু’দিনে সবাই যাবে বেবাক্ ভুলিয়ে!
কল্পনা রাখিনে আমি আকাশে তুলিয়ে,-
নহি কবি ধূমপায়ী, নলে ত্রিবঙ্কুর।

হৃদয়ে জন্মিলে মোর ভাবের অঙ্কুর,
ওঠে না তাহার ফুল শূন্যেতে দুলিয়ে।
প্রিয়া মোর নারী শুধু, থাকেনা ঝুলিয়ে,
স্বর্গ-মর্ত্ত্য-মাঝখানে, মত ত্রিশঙ্কুর!

নাহি জানি অশরীরী মনের স্পন্দন,-
আমার হৃদয় যাচে বাহুর বন্ধন॥

কবিতার যত সব লাল-নীল ফুল,
মনের আকাশে আমি সযত্নে ফোটাই,
তাদের সবারি বদ্ধ পৃথিবীতে মূল,-
মনোঘুড়ি বুঁদ হ’লে ছাড়িনে লাটাই!

 

আরো পড়ুন : কায়কোবাদ, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

সম্পাদক ও প্রকাশক

মোঃ মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

অফিসঃ ২/২ আরকে মিশন রোড , ঢাকা।

ইমেলঃ chalomanbarta@yahoo.com, chalomanbarta@gmail.com

মোবাইলঃ ০১৭১১০৫৬৮৬৬, ০১৬৮১৯২৪০০০

প্রমথ চৌধুরী; গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক

আপডেট সময় ১১:৩৫:০৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩ অগাস্ট ২০২৪

প্রমথ চৌধুরী
গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক
(৭ আগস্ট ১৮৬৮-২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)
মাহমুদুন্নবী জ্যোতি

প্রমথ চৌধুরী। আরেক নাম প্রমথনাথ চৌধুরী। তিনি বীরবল নামেও পরিচিত। প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার।
তিনি বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসাবে প্রসিদ্ধ।
জন্ম:
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ছিলেন জমিদার।

শিক্ষাজীবন:
প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯ সালে বিএ (অনার্স) দর্শন, ১৮৯০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৮৯৩ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জগত্তারিণী পদক’ লাভ করেন ।

পারিবারিক জীবন:
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী (১৮৬০-১৯৪২) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আরেক বড় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা প্রতিভা দেবীর সাথে আশুতোষ চৌধুরীর বিবাহ হয়।

কর্মজীবন:
প্রমথ চৌধুরী বিলাত থেকে ফিরে কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। পরে তিনি সাহিত্যচর্চায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন। প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বেশি বিখ্যাত। তার প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে।

১৯১৪ সালে মাসিক সবুজপত্র প্রকাশনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একে কেন্দ্র করে তখন একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরী ‘বীরবল’ ছদ্মনামে এ পত্রিকায় ব্যঙ্গরসাত্মক প্রবন্ধ ও নানা গল্প প্রকাশ করেন। তাঁর এ ছদ্মনাম থেকে তখন বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ধারা প্রবর্তিত হয়। তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য পত্রিকা হলো বিশ্বভারতী (১৩৪৯-৫০), রূপ ও রীতি (১৩৪৭-৪৯) এবং অলকা।

সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর প্রধান খ্যাতি মননশীল প্রবন্ধলেখক হিসেবে। তবে তিনি উচ্চমানের গল্প ও কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। বুদ্ধিদীপ্ত তির্যকভঙ্গি তাঁর গদ্য-পদ্য সব রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। শাণিত যুক্তি ও আলঙ্কারিক ভাষা প্রয়োগেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তিনি ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। ফরাসি সনেটরীতি ট্রিয়লেট, তের্জারিমা ইত্যাদি বিদেশি কাব্যবন্ধ বাংলা কাব্যে তিনিই প্রবর্তন করেন।

প্রথম চৌধুরীর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
কাব্যগ্রন্থ: সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯) ও পদচারণ (১৯২০); গল্পগ্রন্থ: চার ইয়ারি কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯), ঘোষালের ত্রিকথা (১৯৩৭), নীল লোহিত (১৯৩৯), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯), সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্র্যাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪), দুই বা এক (১৯৪০); প্রবন্ধগ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), নানাকথা (১৯১১), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), দুই ইয়ারির কথা (১৯২১), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০) এবং প্রবন্ধ সংগ্রহ ১ম ও ২য় খণ্ড (১৯৫২-১৯৫৩)।

প্রমথ চৌধুরীর গল্পসংগ্রহের ভূমিকা লিখেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি লিখেছিলেন-
ভূমিকা
আমার এই নিভৃত কক্ষের মধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে প্রমথর জয়ন্তী উৎসবের উদ্যোগ চলেছে- দেশের যশস্বীরা তাতে যোগ দিয়েছেন। প্রমথ চৌধুরীর এই জয়ন্তী অনুষ্ঠানের কর্তৃত্বপদ নেবার অধিকার স্বভাবতই আমারই ছিল। যখন তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিলেন তাঁর পরিচয় আমার কাছে ছিল সমুজ্জ্বল। যখন থেকে তিনি সাহিত্যপথে যাত্রা আরম্ভ করেছেন আমি পেয়েছি তাঁর সাহচর্য এবং উপলব্ধি করেছি তাঁর বুদ্ধিপ্রদীপ্ত প্রতিভা। আমি যখন সাময়িকপত্র চালনায় ক্লান্ত এবং বীতরাগ, তখন প্রমথর আহ্বানমাত্রে ‘সবুজপত্র’ বাহকতায় আমি তাঁর পার্শ্বে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। প্রমথনাথ এই পত্রকে যে একটি বিশিষ্টতা দিয়েছিলেন তাতে আমার তখনকার রচনাগুলি সাহিত্য-সাধনায় একটি নূতন পথে প্রবেশ করতে পেরেছিল। প্রচলিত অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষণীর মধ্যে তা সম্ভবপর হতে পারত না। সবুজপত্রে সাহিত্যের এই একটি নূতন ভূমিকা রচনা প্রমথর প্রধান কৃতিত্ব। আমি তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করতে কখনও কুণ্ঠিত হই নি।

প্রমথর গল্পগুলিকে একত্র বার করা হচ্ছে এতে আমি বিশেষ আনন্দিত, কেননা গল্পসাহিত্যে তিনি ঐশ্বর্য দান করেছেন। অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যে মিলেছে তাঁর অভিজাত মনের অনন্যতা, গাঁথা হয়েছে উজ্জ্বল ভাষার শিল্পে। বাংলাদেশে তাঁর গল্প সমাদর পেয়েছে, এই সংগ্রহ প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করবে।

অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ তাঁর সৃষ্টিশক্তিকে যথোচিত গৌরব দেয় নি সেজন্য আমি বিস্ময় বোধ করেছি।

আজ ক্রমশ যখন দেশের দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর কীর্তির অবরোধ উন্মোচিত হল তখন আমি নিস্তেজ এবং জরার অন্তরালে তাঁর সঙ্গ থেকে দূরে পড়ে গেছি। তাই তাঁর সম্মাননা-সভায় দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য যথাযোগ্য আসন গ্রহণ করতে পারলেম না। বাহির থেকে তার কোনো প্রয়োজন নেই অন্তরেই অভিনন্দনের আসন প্রসারিত করে রাখলুম দলপুষ্টির জন্য নয় আমার মালা এতকাল একাকী তাঁর কাছে সর্বলোকের অগোচরে অর্পিত হয়েছে আজও একাকীই হবে। আজ বিরলেই না হয় তাঁকে আশীর্বাদ করে বন্ধুকৃত্য সমাপন করে যাব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মৃত্যু : প্রমথ চৌধুরী ১৯৪৬ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রমথ চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ:
শিব

রজতগিরিতে হেরি তব শুভ্রকায়া,
চন্দ্র তব ললাটের চারু আভরণ,
তব কণ্ঠে ঘনীভূত সিন্ধুর বরণ,
বিশ্বরূপ জানি আমি তব দৃশ্য মায়া।

যার স্ফূর্ত্তি চরাচর, সে ত তব জায়া।
নিজদেহে করিয়াছ বিশ্ব আহরণ,
তাই হেরি কৃত্তি তব চিত্র-আবরণ,
জীবনের আলোশ্লিষ্ট মরণের ছায়া!

তোমার দর্শন পাই মূর্ত্তিমান মন্ত্রে,
যজ্ঞসূত্রে বাঁধা যাহা হৃদয়ের তন্ত্রে।

সেই রূপ রেখে দেব ভরিয়া নয়নে,
শিবমূর্ত্তি হেরি বিশ্বে, দেহ এ ক্ষমতা।
ধরিতে পারি না আমি নেত্রে কিম্বা মনে,
আকারবিহীন কোন বিশ্বের দেবতা।

ফুলের ঘুম

বরফ ঢাকিয়াছিল ধরণীর বুক
অখণ্ড শীতল শুভ্র চাদর পরিয়ে।
রাশি রাশি চন্দ্রালোক নিঃশব্দে ঝরিয়ে,
আপাণ্ডুর করে’ ছিল নীলিমার মুখ।

সেদিন ছিল না ফুটে শিরীষ কিংশুক,
গিয়েছিল বর্ণ গন্ধ সকলি মরিয়ে।
তুষারের জটাভার শিরেতে ধরিয়ে
বৃক্ষলতা সমাধিস্থ ছিল হয়ে মূক।

পাতার মর্ম্মর আর জল-কলরব,
হিমের শাসনে ছিল নিস্তব্ধ নীরব।

পৃথিবীর বুক হতে তুষার সরিয়ে
সেদিন দেখিনি আমি, কোথায় গোপনে,
সুযুপ্ত ফুলেরা সবে নয়ন ভরিয়ে
রেখেছিল বসন্তের রক্তিম স্বপনে!

আত্মকথা

কবিতা আমার জানি, যেমন শঙ্কুর,
দু’দিনে সবাই যাবে বেবাক্ ভুলিয়ে!
কল্পনা রাখিনে আমি আকাশে তুলিয়ে,-
নহি কবি ধূমপায়ী, নলে ত্রিবঙ্কুর।

হৃদয়ে জন্মিলে মোর ভাবের অঙ্কুর,
ওঠে না তাহার ফুল শূন্যেতে দুলিয়ে।
প্রিয়া মোর নারী শুধু, থাকেনা ঝুলিয়ে,
স্বর্গ-মর্ত্ত্য-মাঝখানে, মত ত্রিশঙ্কুর!

নাহি জানি অশরীরী মনের স্পন্দন,-
আমার হৃদয় যাচে বাহুর বন্ধন॥

কবিতার যত সব লাল-নীল ফুল,
মনের আকাশে আমি সযত্নে ফোটাই,
তাদের সবারি বদ্ধ পৃথিবীতে মূল,-
মনোঘুড়ি বুঁদ হ’লে ছাড়িনে লাটাই!

 

আরো পড়ুন : কায়কোবাদ, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি