অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) থেকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার পরিবার। ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়ার পাশাপাশি উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনেও ক্ষতির মুখে ফেলেছে ইউসিবি’কে। এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ তদন্তে। সাইফুজ্জামানের দুর্নীতি তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে আগের পর্ষদকে সরিয়ে ইউসিবিএলকে দখলে নেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। নিজ পরিবারের সদস্যদেরকে অন্তর্ভূক্ত করেন পর্ষদে। স্ত্রী রুখমিলা জামানকে চেয়ারম্যান এবং ভাই আনিসুজ্জামানকে করেন নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। চাচাতো ভাই আলমগীর কবীর অপুকে নিয়ম লঙ্ঘন করে করা হয় ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এরপরই ব্যাংক লুটের ছক আঁকেন জাভেদ।
জাভেদের দখল নেয়ার পর থেকে ২০২৪ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংকের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং লুটপাটের কথা জানিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে চিঠি দিয়েছে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। এতে বলা হয়েছে, নানা অসঙ্গতি থাকার পরও আদনান ইমামের কোম্পানি জেনেক্স এবং এর সহযোগী কোম্পানিকে দুই হাজার কোটি ঋণ দেয়া হয়। যদিও এ ঋণে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে কোনো সুপারিশ ছিল না। শুধু জাভেদের প্রভাবেই এ ঋণ অনুমোদন করা হয়। নীতমালা ভঙ্গ করে দেয়া ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানতও নেয়া হয়নি। এ ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলেও অভিযোগ আছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংক লুটপাটে জড়ায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ঋণ অনুমোদনের সভায় তিনি (জাভেদ) বসে থাকবেন, তার স্ত্রী চেয়ারম্যান সে-ও থাকবে, তার আত্মীয় থাকবে, তারাই সবকিছুই করবে এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি আরও বলেন, জাভেদের একাধারে রাজনৈতিক প্রভাব পাশাপাশি রয়েছে ব্যাংকের মালিকানা, দুই মিলিয়ে তিনি তো বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক। সেই জন্যই ব্যাংকটির পরিচালনায় এই সমস্যাগুলো হয়েছে। ইচ্ছেমতো ঋণের নামে লুট করতে পেরেছেন।
আনিসুজ্জামান ও বশির আহমেদসহ বোর্ড সদস্যদের অনুমোদনে লকড-ইনে থাকা জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬টি শেয়ারও কেনে ইউসিবি। প্রতিটি শেয়ার ১৭২ টাকা ৫০ পয়সা দরে মোট ১০৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। ১৭২ টাকার শেয়ার গত সেপ্টেম্বরে লেনদেন হয় মাত্র ৩৭ টাকায়। বর্তমানে এর বাজারমূল্য আরও কমে ২৯ টাকা। ফলে শেয়ারে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি টাকা। শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে কোনো গবেষণা এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছিল না বলেও উঠে এসেছে তদন্তে।
বিষয়টি নিয়ে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংক ডিপোজিট দেবে, ল্যান্ডিং করবে। যদি ব্যাংক বিনিয়োগ করতে যায়, তাহলে অবশ্যই ইনভেস্টমেন্ট অ্যানালাইসিস করতে হবে। কোন শেয়ারটা কিনছে, সেটি ক্রয় করার যোগ্য কিনা, এটার দাম বাড়বে কিংবা কমবে কিনা; কিংবা এটার পেছনে কারা রয়েছে-এগুলো তো অবশ্যই দেখতে হবে। তাদের মধ্যে একটি নেতিবাচক চিন্তাধারা কাজ করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার পরিবারের ব্যাংক লুটপাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দিয়েছে বর্তমান পর্ষদ। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে দুদক। ইউসিবির অনিয়ম খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকও।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, এই অনিয়মের বিষয়ে যাদের কাজ করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের সেইসব বিভাগ কাজ শুরু করবে। একইসঙ্গে কার্যকরী ব্যবস্থাও গ্রহণ করবে।