দেশের মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করলো আরও একটি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি বা এনসিপি)। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তারুণ্য নির্ভর এই নতুন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। তাদের বক্তব্যে উঠে আসা সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ ও ইনকিলাব জিন্দাবাদ, কীসের বার্তা দেয় এসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন বিভিন্ন দল ও মতের মানুষ।
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বারবার ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এসময় তার বক্তব্যে উঠে আসে সেকেন্ড রিপাবলিক বা দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও। উঠে আসে গণপরিষদের কথা।
তবে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের ভবিষ্যৎ, নির্দিষ্ট কর্মসূচি বা রাজনৈতিক দর্শন ও বিস্তারিত কর্মপন্থা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে অনেকটা ধোঁয়াশাই থেকে গেছে।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি শনিবার (১ মার্চ) এক অনুষ্ঠানে বলেন, অনেক ভালো ভালো কথা বললেও রাষ্ট্র সম্পর্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কোনো পলিটিক্যাল ফিলোসফি (রাজনৈতিক দর্শন) পাননি তিনি।
অন্যদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ এক অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে ছাত্রদের নতুন দলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, গণপরিষদ ও স্থানীয় নির্বাচন এবং দ্বিতীয় স্বাধীনতার বিষয়টি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার ষড়যন্ত্র।
গণপরিষদ নির্বাচনের দাবির বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, সংবিধান থাকার পরও গণপরিষদ প্রয়োজন কেন? যারা এসব প্রশ্ন সামনে আনছেন, হয় তারা বোঝে না অথবা তারা গভীর ষড়যন্ত্রে যুক্ত আছে।
সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, নতুন সংবিধানের কথা বলছেন আপনারা (এনসিপি)। নতুন সংবিধান যেটা হবে, সেটার ব্যাপক সংশোধনী প্রস্তাব আপনারা সংস্কার কমিশনে দিয়েছেন, আমরাও দিয়েছি। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা ও গণ-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমাদের সন্তানরা রক্ত দিয়েছে, সেই আকাঙ্ক্ষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সেই সংশোধনীগুলো আমরা সাজিয়েছি। সেই সংবিধানের নাম যদি আপনারা নতুন সংবিধান দেন ঠিক আছে। কিন্তু গণপরিষদ কেন, আমরা বুঝলাম না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। গণপরিষদের সদস্যরা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যে সংবিধানের ভিত্তিতে পরে সংসদ নির্বাচন হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে গণপরিষদ নির্বাচনের জন্য আমরা কী নতুনভাবে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি? রাষ্ট্র তো স্বাধীন আছে। আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
এদিকে, নব্যগঠিত এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলেন, তারা যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টে দেওয়ার বার্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোতেই স্বৈরাচার তৈরির সুযোগ আছে। রাষ্ট্রের মতো অনেক দলেও তাই সর্বময় ক্ষমতা একজনের হাতে চলে যাচ্ছে। আবার গত ১৫ বছরে যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা কিন্তু তরুণরা করেছে। ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক সিস্টেম ভাঙা এবং তরুণদের প্রত্যাশা পূরণের বার্তাই আমরা দিয়েছি।
২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থসুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা মনে করি জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে। একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য। আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় গড়ে তোলা ও তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র রক্ষা করা হবে আমাদের রাজনীতির অগ্রাধিকার। এর মধ্য দিয়েই কেবল আমরা একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবো।
কীভাবে সেকেন্ড রিপাবলিক, গণপরিষদ ও ইনকিলাব জিন্দাবাদ এলো
সেকেন্ড রিপাবলিক ধারণাটি তৈরি হয়েছে ফরাসি বিপ্লব থেকে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, কোনো দেশে আগের শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে নতুন শাসনকাঠামো বা ব্যবস্থাপনা। আর বিপ্লব বা অভ্যুত্থানসহ নানাভাবে এরকম পরিবর্তন আসতেই পারে।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নাহিদ ইসলামের দেওয়া ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটিও সবার নজরে আসে। যদিও তাদের দলীয় স্লোগান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির স্লোগান ছিল। এটি বিপ্লব বা পরিবর্তনের স্লোগান। অন্যদিকে, গণপরিষদ হলো নতুন সংবিধান করা। অর্থাৎ সামনে যে নির্বাচন হবে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদ সদস্য হিসেবে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। ওই গণপরিষদই আবার পার্লামেন্ট হিসেবে কাজ করবে।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ আরও বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেকেন্ড রিপাবলিক ও গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের কথা এসেছে। সেকেন্ড রিপাবলিকের চিন্তা থেকেই বিদ্যমান সংবিধান বাতিলের বিষয়টি আসে।
কেউ কেউ মনে করছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের জায়গায় ২০২৪-কে প্রতিস্থাপনের একটি চেষ্টাও নতুন দলটির কোনো কোনো অংশের থাকতে পারে। যদিও দলটির নেতারা আগেও বলেছেন, একাত্তরকে মূল ভিত্তি করেই তারা ২৪-এর চেতনায় নতুন বাংলাদেশ করতে চান।