ঢাকা ১২:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মূল্য

পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো কর্মে আত্মনিয়োগ করতে হয়। আর এসবের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জনের বিষয়টি নির্ভর করে। যুগে যুগে কল্যাণের বার্তা দিতে নবী ও রাসূলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ও গোটা মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়াতে পাঠানো প্রত্যেক নবী রাসূলও কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রতিটি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে মর্যাদা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ প্রত্যেক নবী ও রাসূল (সা.) জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে শ্রম দিতেন। তারা এসব করতে কোনো প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেননি— যা অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

নবী ও রাসূলগণের জীবনী থেকে এরকম তথ্যই পাওয়া যায়। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা সুতারের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করতেন। হজরত শুআইব (আ.)-এর খামারে হজরত মূসা (আ.) ৮-১০ বছর চাকরি করেছেন। এমনকি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও মা খাদিজা (রা.)-এর ব্যাবসা দেখাশুনা করেছেন দীর্ঘকাল। তিনি বলেছেন, ‘নিজ হাতে কাজ করার মাধ্যমে উপার্জিত খাদ্যের থেকে পবিত্র কোনো খাদ্য নেই।’ (বুখারি)

হালাল উপার্জন করার তাগিদ সর্বদা দিয়েছেন রাসূল (সা.)। ইবাদত কবুলের শর্তই হলো হালাল আয় বা রুজি। সুতরাং হালাল আয়ের একমাত্র পন্থাই হলো কায়িক বা দৈহিক শ্রম। উপার্জন করার নির্দেশনা দিয়ে মূলত রাসূল (সা.) শ্রমের মর্যাদাকেই অতি উচ্চে তুলে ধরেছেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমা’র ১০ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর। রাসূল (সা.) ও কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রতিই উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব (তিরমিজি)। আরেক হাদীসে এসেছে হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে সেটিই সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দিয়ে অর্জন করা হয় (মুসলিম)। আর ভিক্ষাবৃত্তিকে নিকৃষ্ট হালাল বলা হয়েছে।

সূরা কাসাসের ২৬ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে আল্লাহ বলেছেন, ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সেই, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সামর্থ্যবান ও আমানতদার।’ এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে মানুষ যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাই সে আমানতদার। তাই কোনো শ্রমিক যখন হালাল কর্মে চুক্তিবদ্ধ হবে, তা করে দেওয়া তার কাছে আমানত রক্ষার স্বরূপ—এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

হাদিসে এসেছে, আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো, তার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি হলো- যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলো, যিনি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণরূপে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পূর্ণ মজুরি দেয় না (বুখারি- ২২২৭)। শ্রমের গুরুত্ব দিয়ে নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে লাগাবে, সে যেন তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায়। (বুলুগুল মারাম- ৯১৪)

এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হলো মালিকপক্ষও শ্রমিকের অধিকার হরণ করতে পারবে না। তা করলে স্বয়ং আল্লাহ শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াবেন। বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার। ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও (ইবনে মাজাহ-২৪৪৩০)। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা সর্বাধিক। কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শ্রমের মর্যাদাই সর্বোচ্চ।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা সুরা মুমিনুনের ৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আর তারাই প্রকৃত মুমিন; যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন- ‘অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাজাহ)

ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয়েছে হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) এর মাধ্যমে। এর পর বংশ বিস্তার করে জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে; তাকে এমন কষ্টের কাজ দেবে না—যা তার সাধ্যের বাইরে। কোনো কাজ কঠিন হলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে’ (মুসলিম, মিশকাত)।

মুমিন মুসলমান হিসেবে আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, শ্রমিক এবং মালিক দুজনই মানুষ। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে সতর্ক করে বলেছেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। এখানেই স্পষ্ট, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই।

সূরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াতে মহান রব মানুষের বিবেককে কাজে লাগাতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দিতে পারবেন না। আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।

শৃঙ্খলিত জীবনের জন্য হালাল উপার্জনের বিকল্প নেই। অবৈধপন্থায় যেকোনো আয় সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে, অশান্তির কারণ হয় এবং বিপর্যয় ঘটায়। রাসূল সা. এর হাদীস থেকেও তা প্রমাণিত।

আবু মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) কুকুরের বিক্রয়মূল্য, যেনাকারিনীর আয় ও গণকের পরামর্শ বা মতামত নিতে নিষেধ করেছেন (সহিহ ইবনু মাজাহ (২১৫৯)। সমাজের বাস্তব চিত্র দেখলে এসবের নেতিবাচক প্রভাবই আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে। হাদীসে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ই বর্তমান সমাজকে কলুষিত করছে।

সমাজে শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত করতে সাড়ে ১৪০০ বছর আগেই রাসূল সা. গোটা উম্মাহকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যার মাধ্যমে তিনি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সামাজিক ন্যায়বিচার জারি করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিটি মানুষ পেয়েছিল তার আত্মমর্যাদা।

আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। পৃথিবীর দেশগুলোর সরকার, শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন দিবসটি পালন করছে। আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য নানা কর্মসূচির। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়—অনেক রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে দিবসটি পালন করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, কিন্তু আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। প্রতিটি মানুষ যদি বিবেক জাগ্রত করে নিজ বলয় ও দায়িত্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে সকলের মর্যাদা ও মূল্য নিশ্চিত করে তাহলেই শ্রমিক দিবসের সার্থকতা ফুটে উঠবে।

ট্যাগস

© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমের মূল্য

আপডেট সময় ১১:২২:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ মে ২০২৫

পৃথিবীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো কর্মে আত্মনিয়োগ করতে হয়। আর এসবের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিও অর্জনের বিষয়টি নির্ভর করে। যুগে যুগে কল্যাণের বার্তা দিতে নবী ও রাসূলদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ও গোটা মানবজাতির কাছে পাঠানো হয়েছে। দুনিয়াতে পাঠানো প্রত্যেক নবী রাসূলও কর্মে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, প্রতিটি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে মর্যাদা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বালাদের ৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেছি।’ প্রত্যেক নবী ও রাসূল (সা.) জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে শ্রম দিতেন। তারা এসব করতে কোনো প্রকার কুণ্ঠাবোধ করেননি— যা অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

নবী ও রাসূলগণের জীবনী থেকে এরকম তথ্যই পাওয়া যায়। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন। হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রি বা সুতারের কাজ করেছেন। হজরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন। হজরত সুলাইমান (আ.)-এর পিতা নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ (আ.) লৌহশিল্প বা কামারের কাজ করতেন। হজরত শুআইব (আ.)-এর খামারে হজরত মূসা (আ.) ৮-১০ বছর চাকরি করেছেন। এমনকি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও মা খাদিজা (রা.)-এর ব্যাবসা দেখাশুনা করেছেন দীর্ঘকাল। তিনি বলেছেন, ‘নিজ হাতে কাজ করার মাধ্যমে উপার্জিত খাদ্যের থেকে পবিত্র কোনো খাদ্য নেই।’ (বুখারি)

হালাল উপার্জন করার তাগিদ সর্বদা দিয়েছেন রাসূল (সা.)। ইবাদত কবুলের শর্তই হলো হালাল আয় বা রুজি। সুতরাং হালাল আয়ের একমাত্র পন্থাই হলো কায়িক বা দৈহিক শ্রম। উপার্জন করার নির্দেশনা দিয়ে মূলত রাসূল (সা.) শ্রমের মর্যাদাকেই অতি উচ্চে তুলে ধরেছেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা জুমা’র ১০ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হবে, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং রিযিক অন্বেষণ কর। রাসূল (সা.) ও কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রতিই উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফরজ ইবাদতগুলোর পরই হালাল উপার্জন ফরজ দায়িত্ব (তিরমিজি)। আরেক হাদীসে এসেছে হালাল উপার্জনগুলোর মধ্যে সেটিই সর্বোত্তম, যা কায়িক শ্রম দিয়ে অর্জন করা হয় (মুসলিম)। আর ভিক্ষাবৃত্তিকে নিকৃষ্ট হালাল বলা হয়েছে।

সূরা কাসাসের ২৬ নম্বর আয়াতে স্পষ্ট করে আল্লাহ বলেছেন, ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সেই, যে দৈহিক দিক দিয়ে শক্ত-সামর্থ্যবান ও আমানতদার।’ এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, পৃথিবীতে মানুষ যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাই সে আমানতদার। তাই কোনো শ্রমিক যখন হালাল কর্মে চুক্তিবদ্ধ হবে, তা করে দেওয়া তার কাছে আমানত রক্ষার স্বরূপ—এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

হাদিসে এসেছে, আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদী হবো, তার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি হলো- যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। আর তৃতীয় ব্যক্তি হলো, যিনি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণরূপে কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তার পূর্ণ মজুরি দেয় না (বুখারি- ২২২৭)। শ্রমের গুরুত্ব দিয়ে নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে লাগাবে, সে যেন তার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে কাজে লাগায়। (বুলুগুল মারাম- ৯১৪)

এখানে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হলো মালিকপক্ষও শ্রমিকের অধিকার হরণ করতে পারবে না। তা করলে স্বয়ং আল্লাহ শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াবেন। বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবীর ন্যায্য অধিকার। ইসলাম দ্রুততম সময়ে তা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও (ইবনে মাজাহ-২৪৪৩০)। অন্য হাদিসে পারিশ্রমিক ও প্রাপ্য অধিকার নিয়ে টালবাহানাকে অবিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা সর্বাধিক। কোনো অবস্থাতেই শ্রমিকদের খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শ্রমের মর্যাদাই সর্বোচ্চ।

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা সুরা মুমিনুনের ৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আর তারাই প্রকৃত মুমিন; যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।’ হজরত আবু বকর (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন- ‘অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (ইবনে মাজাহ)

ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন হয়েছে হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) এর মাধ্যমে। এর পর বংশ বিস্তার করে জাতিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।

রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিকরা তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তাদের তোমাদের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা যার ভাইকে তার দায়িত্বে রেখেছেন, সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরিধান করবে তাকেও তা পরিধান করাবে; তাকে এমন কষ্টের কাজ দেবে না—যা তার সাধ্যের বাইরে। কোনো কাজ কঠিন হলে সে কাজে তাকে সাহায্য করবে’ (মুসলিম, মিশকাত)।

মুমিন মুসলমান হিসেবে আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, শ্রমিক এবং মালিক দুজনই মানুষ। আল্লাহ তায়ালা সূরা নিসার ১ নম্বর আয়াতে সতর্ক করে বলেছেন, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। এখানেই স্পষ্ট, সূচনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান। সেই দিক দিয়ে সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই।

সূরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াতে মহান রব মানুষের বিবেককে কাজে লাগাতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রমিকদেরও ভালোভাবে নিজের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মালিকরাও শ্রমিকদের সামর্থ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দিতে পারবেন না। আল্লাহ তায়ালা নিজেই কোনো ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না।

শৃঙ্খলিত জীবনের জন্য হালাল উপার্জনের বিকল্প নেই। অবৈধপন্থায় যেকোনো আয় সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে, অশান্তির কারণ হয় এবং বিপর্যয় ঘটায়। রাসূল সা. এর হাদীস থেকেও তা প্রমাণিত।

আবু মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী (সা.) কুকুরের বিক্রয়মূল্য, যেনাকারিনীর আয় ও গণকের পরামর্শ বা মতামত নিতে নিষেধ করেছেন (সহিহ ইবনু মাজাহ (২১৫৯)। সমাজের বাস্তব চিত্র দেখলে এসবের নেতিবাচক প্রভাবই আমাদের চোখের সামনে উঠে আসে। হাদীসে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয়ই বর্তমান সমাজকে কলুষিত করছে।

সমাজে শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠিত করতে সাড়ে ১৪০০ বছর আগেই রাসূল সা. গোটা উম্মাহকে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যার মাধ্যমে তিনি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সামাজিক ন্যায়বিচার জারি করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিটি মানুষ পেয়েছিল তার আত্মমর্যাদা।

আজ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। পৃথিবীর দেশগুলোর সরকার, শ্রমিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন দিবসটি পালন করছে। আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য নানা কর্মসূচির। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব আয়োজনেই সীমাবদ্ধ থাকে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়—অনেক রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে শ্রমিকরা যে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে দিবসটি পালন করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, কিন্তু আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। প্রতিটি মানুষ যদি বিবেক জাগ্রত করে নিজ বলয় ও দায়িত্বাধীন প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে সকলের মর্যাদা ও মূল্য নিশ্চিত করে তাহলেই শ্রমিক দিবসের সার্থকতা ফুটে উঠবে।